Author Picture

শেষ ক্রন্দনরত ব্যক্তির কারাবরণ

হাইকেল হাশমী

এই শহরে সবাই সব সময় হাসতে থাকে, সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে হাসতে হবে, এই আইন সম্পূর্ণ ভাবে বলবৎ করা হয়েছে। তাই এখানে কারো বিষণ্ণ বা কান্না করার কোন সুযোগ নেই।

পুলিশের কনস্টেবল শহরের অলিগলিতে টহল দেয় আর যেই লোকের মুখে হাসি নেই তাকে গ্রেপ্তার করে। আস্তে আস্তে সারা দেশে কোন বিষণ্ণ লোক আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু একটি অফুরন্ত বিষণ্ণতা দিয়ে পুরা শহরটা ঢেকে গেলো যার ভিতর অট্ট হাসির শোরগোল নিহিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একমাত্র কাজ হল শুধু বিষণ্ণ চেহারা খুঁজে বের করা আর জেলে পাঠানো।

রাস্তায়, হাটে, বাজারে সবাই মুখে হাসি সাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়। লোকজন পুলিশের কনস্টেবল দেখলে জোরে জোরে শব্দ করে হাসে, যেন ওদেরকে বিশ্বাস করাতে চায় যে তাঁরা মোটেও বিষণ্ণ নয়।

কিছু লোক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে তাদের চোয়ালের আকৃতি এমন বানিয়ে নিয়েছে যে তাদের আর হাসিমুখ বানিয়ে রাখার জন্য কোন কষ্টই করতে হয় না, জেগে থাকা অবস্থাই হোক অথবা ঘুমন্ত অবস্থা, হাসিমুখ তাদের চেহারার একটি অবিচ্ছিন্ন অংশে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কোন কারণে কান্না অতি জরুরী হয়ে পড়ে, তবে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নেয়া আবশ্যক। এই আইন আরোপ হবার পর থেকে যে কর্তৃপক্ষে এই অনুমতি প্রদান করেন তাদের দপ্তরের বাইরে লম্বা লাইন লেগে থাকে। এই লাইনটি শহরের এক মাথে থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেখানে লোকজন হাসতে হাসতে তাদের কান্নার অনুমতিপত্র নেয়ার জন্য ভিড় করে। কর্তৃপক্ষ গায়ের রঙ, বর্ণ, দুর্ঘটনা আর দুঃখ বিবেচনা করে অনুমতিপত্র অনুমোদন করেন।
শহরের লোকজন কোন দুর্ঘটনার সংবাদ পেলে প্রথমে তাদের পকেট থেকে অনুমতিপত্র বের করে দেখে যে এই দুর্ঘটনাতে দুঃখ পাবার অধিকার তাদের অনুমতিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে কি না আর যদি ওই কারণটি অনুপুস্থিত থাকে তাহলে তাঁরা দুঃখ প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। যদি ওই দুঃখ প্রকাশ করার অনুমতি তাদের পত্রে থাকে তখন অনুমতিপত্রটি নিজেদের গলায় ঝুলিয়ে আর্তনাদ করে।

ক্রমান্বয় এই শহরের বাসিন্দাদের চোখের আদ্রতা কমে গেলো আর এক হাসি খুশী বিষণ্ণতা সারা শহরকে গ্রাস করে নিলো।

সেই শহরে একজন যুবক, সে অনেক বিষণ্ণ, সে শত চেষ্টা করেও হাসতে অক্ষম। তাই সে নিজেকে নিজ ঘরে বন্দি করে রেখেছে। সে জানালা দিয়ে বাইরের গলিতে দেখে যেখানে লোকজন হাসতে হাসতে অথবা তাদের গলায় অনুমতিপত্র ঝুলিয়ে হেঁটে হেঁটে যায়। সে তাকদেরকে দেখে রীতিমত বিস্মিত আর দুঃখী।

আগে কখনো কখনো সে কিছু বিষণ্ণ চেহারা দেখতে পেতো কিন্তু যে দিন থেকে এই নতুন আইনটি বলবৎ হয়েছে, বিষণ্ণ চেহারাগুলো একেবারে উধাও হয়ে গেছে। সে এখন পুলিশ দেখলে জানালা থেকে সরে দাঁড়ায় যেন পুলিশ তার বিষণ্ণ চেহারাটি না দেখতে পায়।

একদিন সে জানালা থেকে দেখলো তার প্রতিবেশী নিজের অসুস্থ ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, তার চেহারা থেকে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পাচ্ছে, মনে হয় তার ছেলে বেশ অসুস্থ। এর মধ্যে পুলিশের কনস্টবল এসে হাজির, যেই না প্রতিবেশী পুলিশ দেখলো তখনই উচ্চ স্বরে হাসতে শুরু করলো।
“জনাব আমার বাচ্চা অসুস্থ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, হা হা হা”, লোকটি হাসতে হাসতে বলল।
“কিন্তু আমি যখন গলিতে ঢুকি তখন লক্ষ্য করেছি তুমি বেশ উদ্বিগ্ন আর চেহারাও মলিন মনে হয়েছে। তাহলে কি তোমাকে জেলে নিয়ে যাওয়া উচিৎ না আমার? হা হা হা” পুলিশ কনস্টবল বলল।
“না মোটেও না, আপনার ভুল হয়েছে আমি তখনও হাসি খুশী ছিলাম, এই দেখেন, হা হা হা। আমার ছেলেও খুব আইন মেনে চলে, সারাক্ষণ মুখের উপর হাসি সাজিয়ে রাখে, সোনা বাবা একটু হেসে দেখাও”।
“হি হি হি” বাচ্চাটা ভীষণ কষ্টের মধ্যেও হাসল আর অচেতন হয়ে গেলো।
প্রতিবেশী তার বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে ওখান থেকে হাসতে হাসতে পালিয়ে গেলো। এই দৃশ্য দেখে যুবকের চোখে পানি চলে এলো। পুলিশ কনস্টবল তার খাতায় কিছু লিখতে শুরু করলো হঠাৎ তার দৃষ্টি জানালার দিকে গেলো যেখানে সে দেখলো এক যুবক কাঁদছে। কনস্টবল নিজের চোখ আর কানের উপর বিশ্বাস করতে পারে নাই যে এই শহরে কেউ কাঁদতে পারে। এটি আইনের একদম পরিপন্থী। তাই সে দৌড়িয়ে জানালার কাছে এলো আর ওই যুবকটি ভয়ে ওখান থেকে সরে দাঁড়ালো। তারপর পুলিশ কনস্টবল জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
“বাইরে আসো, তোমার এতো বড় সাহস, তুমি আইন ভঙ্গ করেছো, তোমাকে শাস্তি পেতে হবে, হা হা হা”।
“ভুল হয়ে গেছে জনাব, ভুল হয়ে গেছে”, যুবকটি ভয়ে ভয়ে বলল।
“কোন ভুল হয় নাই, এবার তুমি বাইরে আসো, তোমাকে থানায় যেতে হবে তারপর তোমার উপর “কেস” হবে আর আইন অনুযায়ী তুমি সাজা পাবে, হা হা হা”।
“কিন্তু আমি যে সাজাকে ভয় পাই” যুবক বলল।
“সাজা তো পেতেই হবে, দরজা খুলো, হা হা হা”।
“না আমাকে মাফ করে দেন, দেখেন আমি হেসে দিচ্ছি আমাকে কোন খুশীর স্মৃতি মনে করতে দেন, আমি হাসছি”।
“তাড়াতাড়ি হাসো”, পুলিশ কনস্টবল রেগে বলল।
“আফসোস আমি কোন এমন খুশীর ঘটনা মনে করতে পারছি না, আমার জীবন অনেক দুঃখের মাঝে কেটেছে”।
“হাসির কোন সম্পর্ক খুশীর সাথে নেই, এটা আইনে লেখা আছে, হা হা হা”।
“আহ! আমি কিছুই মনে করতে পারছি না” যুবক কেঁদে দিলো।
“তুমি সাজা পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও, হা হা হা”, পুলিশ কনস্টবল বলল।
এর মধ্যে আরো পুলিশের লোক ওখানে এসে হাজির এবং আগে থেকে আসা পুলিশকে তাঁরা জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে, কিসের এতো গন্ডোগোল?”
“স্যার এই বাসায় একজন যুবক যে অনেক বিষণ্ণ, এমন কি সে কাঁদছে, আর অনেক চেষ্টা করেও হাসতে পারে নাই আর তার কাছে অনুমতিপত্রও নেই”।
“তাকে তো অবশ্যই সাজা পেতে হবে, আসো হাসতে হাসতে এই দরজা ভঙ্গে দেই”।
তারা ঘরের দরজা ভেঙ্গে যুবককে বের করে থানায় নিয়ে গেলো। হাজতের দরজা বন্ধ করার আগে পুলিশ কনস্টবল যুবককে বলল, “তোমার কাছে এখনো সময় আছে, শেষ বারের মতো জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি হাসতে পারো? যদি তুমি হেসে দেখাও তবে তোমার মোট সাজা থেকে কিছু সাজা কমে যাবে। কিন্তু তুমি এমনি করে কাঁদতে থাকলে এটা আইনের পুরোপুরি পরিপন্থী আর তোমাকে কারাবরণ করতে হবে। এই দরজা একবার বন্ধ হলে, খুব কঠিন এটা খোলা। তোমার এখানে আসার আগেও শহরের অনেক বিষণ্ণ আর দুঃখী লোকেরা এখানে বন্দি আছে, তুমি এই শহরের শেষ বিষণ্ণ মানুষ, এবার সারা শহর শুধুই হাসবে আর হাসবে, হা হা হা”।
“হাসো আমার সাথে হে পাগল যুবক, হাসো”।
“আমার জীবন অনেক দুঃখে ভরা, আমি কোন হাসির ঘটনা মনে করতে পারছি না”, যুবক কাঁদতে কাঁদতে জানালো।
“পাগল মানুষ, বর্তমানকালে হাসির সাথে খুশীর কোন সম্পর্ক নেই, এটা আইনের ব্যাখ্যা। ভিতরে ঢুকো হতভাগা মানুষ, হা হা হা”।
আর সে হাজতের লোহার ভারী দরজা বন্ধ করে দিলো।

 

উর্দু ভাষার গল্প
মূল: মোহাম্মাদ জামিল আক্তার ।। অনুবাদ: হাইকেল হাশমী

আরো পড়তে পারেন

শেষ বিকেলের অতিথি

আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে। খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে….

স্মৃতি এখন কী করবে

জেলখানা থেকে বেরিয়ে স্মৃতি বাসে চড়ে বসে। সঙ্গে ওর মেয়ে ফাতেমা। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি হায়দারের সঙ্গে। শুধুই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে। ফাতেমাও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর হয়তো দেখা হবে না বাবার সঙ্গে। হায়দারের চোখও ভেজা ছিল। আজই হয়তো ওদের শেষ দেখা। হায়দার বারবার স্মৃতির হাত ধরে অনুরোধ করেছে ওকে ক্ষমা করে দিতে।….

ইন্টারভিউ

কত দিন পর দেখা হলো রূপার সঙ্গে। তা মনে করতে পারছি না। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা থমকে গেলাম। চিন চিন করে উঠল বুকের ভেতর। ভেতর-বাইর শুরু হলো জ্বলন-পোড়ন। কথা বলব কি-না তা বুঝে ওঠার আগেই সে এলো এগিয়ে। আমাকে বলল, সায়েম তুমি এখানে? আমার ইন্টারভিউ আজ। তোমারও কি তাই? হ্যাঁ। আমারও তাই। কেমন আছ তুমি?….

error: Content is protected !!