মহাত্মা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিরচিত পিতার হুকুম বইটি আগাগোড়া খুব দ্রুত শেষ করা গেছে। অনেকটা ডায়লেক্টিক ভঙ্গিতে গদ্য লিখেন তিনি। গদ্যে ফিকশন থাকলে তা গদ্যকে আকর্ষণীয় করে।
প্লাতনের লেখাগুলো এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কী? আমার মনে হয় গদ্যকে ফিকশনাইজড করার কারণে প্লাতনের বইগুলো এত আকর্ষণীয়। প্লাতনের বইগুলো শুধু গল্প বা কাহিনী হিসেবে পড়লেও চমৎকার লাগে। সেই ফিকশনের পরতে পরতে তিনি তর্ক করেছেন জগতের প্রায় সব বিষয়ে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যের মধ্যেও সেই মজা আছে, ফলে এ গতিশীল গদ্য পাঠককে ধরে রাখে।
নিঃসন্দেহে এটা একজন লেখকের অনেক বড় গুণ। সমাজকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তিনি মার্কসবাদী কিনা না জানলেও এই বইয়ে তিনি মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষমতা ও তার হুকুমকে তলব করেছেন।
অবশ্যই সমাজ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ অনেক বড় ও এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টুলস। এ বইটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের চিন্তার লেজেই আগুন লেগে যায় যেন। চিন্তার লেজে আগুন জ্বালানোইতো বিদ্বজ্জনের কাজ।
ইতিহাসের ধারাবাহিক পিতৃতান্ত্রিকতা কীভাবে পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে ও তা কীভাবে দুর্বলদের ওপরে কষাঘাত করেছে সেটা তিনি অজস্র উদাহরণ দিয়েছেন বইতে। এই পিতৃতান্ত্রিক হুকুম দুর্বল চক্র থেকে নানান চক্রে বিদ্যমান।
মানবজাতি বুদ্ধিমান প্রজাতি হিসেবে এ দুনিয়ায় এখনও পর্যন্ত টিকে আছে; কিন্তু অন্যসব প্রাণিজগতকে সে পদানত করেছে। তার প্রয়োজনে লাগে এমন প্রাণী ছাড়া বাকি সব প্রাণীকে সে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, এখনও করে চলেছে নিরন্তর। মানবপ্রজাতির দিকে তাকালেও আমরা দেখব মানুষের ভেতর আবার যারা দুর্বল তারা সবলের ভোগ্য।
আবার সমগ্র মানবজাতির ভেতর মেয়েদের পুরুষ মানুষ বলতেই রাজি নয়। কারণ তারা দুর্বল, পিতৃতান্ত্রিকতার শুরু থেকেই তারা গৃহবন্দি। মাতৃতান্ত্রিকতা থেকে পিতৃতান্ত্রিকতায় প্রবেশকে তিনি বলেছেন ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষ বুদ্ধিজীবীরা বলে মানবজাতি, তারা কিন্তু মানবীজাতি বলে না। কিন্তু মানবী বলে। মানবজাতি মানে কি তবে শুধু পুরুষজাতি?
সিমন দ্য বেভোয়ার তার দ্বিতীয় লিঙ্গ বইয়ে বলেছিলেন ‘মাছ বা পাখি যারা ভ্রূণে বিকশিত হওয়ার আগেই ডিমকে শরীর থেকে বের করে দেয়, তারা তাদের শাবকদের সঙ্গে স্তন্যপায়ীদের থেকে কম দাসত্বে আবদ্ধ থাকে।
সেই সময় তারা মুক্ত থাকে মাতৃত্বের দাসত্ব থেকে। তখন স্ত্রীলিঙ্গটি মাঝে মধ্যেই সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে পুলিঙ্গ জীবটির। অশ্বী অশ্বের মতোই দ্রুতগামী। শিকারি কুকুরীর ঘ্রাণ পুরুষ কুকুরের মতোই তীব্র, বানরীও বুদ্ধিমত্তায় বানরের চেয়ে কম নয়। কিন্তু নারী এ স্বাতন্ত্র্যকে নিজের বলে দাবি করে না। প্রজাতির কল্যাণের জন্য সে ত্যাগ করে এ দাবি’।
নারী ও পুরুষ একই প্রজাতির ধারক। তাদের উভয়ের দায়িত্ব মানুষ প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখা। মানুষ প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি নিজেকে উৎসর্গ করে নারী, বিসর্জন দেয় নারী। অথচ তবুও সেই নারীকেই সব লাঞ্ছনা সইতে হয় পুরুষের হাতে। মানুষের প্রজাতি টিকিয়ে রাখার বেশি ভূমিকা রাখা নারীকে মানুষ হিসেবেও মর্যাদা দেয়া হয় না।
এ বইতে হোমারের ইলিয়াড ওডিসি থেকে শুরু করে মহাভারত, রামায়ণ, মাইকেল মধুসূধন, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, তলস্তয়, শেকসপিয়র, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, ডিএইচ লরেন্স ঘেঁটে তিনি দেখাচ্ছেন এসব মহাগ্রন্থগুলোতে নারীদের কী নগণ্য চরিত্র হিসেবে চরিত্রায়ণ করা হয়েছে। যদিও কোনো কোনো বই শুধু একটা নারীকে অপহরণ নিয়েই তবুও সেখানে নারী অনুপস্থিত।
যেমন হেলেনকে নিয়ে গ্রিক আর ট্রোজান যুদ্ধ অথচ টোটাল ইলিয়াডে দেখা যাবে আগামেমনন, একিলিস, হেক্টরের যুদ্ধ। হেলেন অন্তপুরে, তাকে আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
অবশ্য এর মধ্যে হেনরিক ইবসেনের নোরা চরিত্রটা ব্যতিক্রম। যিনি পুরুষতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতার শেখল ভেঙে বেরিয়ে আসেন। ‘আমার মাছুমা খালাম্মা’ নামের প্রবন্ধের মাছুমা খালাম্মাও আসলে বাঙালি নোরা। তিনি অর্গল ভাঙা নারী।
যদিও তিনি সংসারের ভেতর থেকেই জয় করেছেন বিশ্বটাকে। বাংলাসাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম ও বেগম রোকেয়ার লেখাপত্রই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম; যা আসলে নারীকে সচেতন করে তোলে বলে মনে করেন চৌধুরী।
সম্পত্তির উৎপত্তি ও ব্যক্তিমালিকানার ধারণা গড়ে উঠার সময় গৃহ সামলানো নারীও আসলে পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে উঠেছে। আর এর পরের যুগপর্বে সেই ধারণাটা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।
আর পুরুষ সাহিত্যিকরা প্রায় কেউই এ ধারণা থেকে বেরোতে পারেননি। তারা নারীর জন্য রোমাঞ্চ অনুভব করেছে; কিন্তু তাকে ঠিকই তারা ভেবেছেন পুরুষতন্ত্রের দাসি। এটাই তাদের নৈতিকতার সীমারেখা, যেটা দিয়ে তারা নারীকে বিচার করেছেন।
তলস্তয়ের মতো মহান উপন্যাসিকও এই ভুল করেছেন। চৌধুরী বলেন ‘পিতৃতান্ত্রিকতার ব্যাপারটা যে কতখানি নৃশংস হতে পারে, তার নজির আছে তলস্তয়ের উপন্যাস আন্না কারেনিনায়।
উপন্যাসের নায়িকা আন্না সমাজের সর্বোচ্চ স্তরের নারী। বিবাহিত, পুত্রসন্তানের জননী। রূপে ও গুণে তার সঙ্গে পাল্লা দেয় এমন মেয়ে ওই সমাজ বিরল। পুরুষরা তাকে সমীহ করে, মেয়েরা ঈর্ষা। কিন্তু সমাজ তাকে চরিতার্থতা দিতে অসমর্থ। স্বামী উঁচু দরের আমলা, স্ত্রীর সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান বিশ বছরের। আন্নার জন্য পরে একজন আগ্রহী প্রেমিক এলো, সে-ও আমলা, সেনাবাহিনীর অফিসার। এরা উভয়েই আন্নাকে দেখে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে। শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মহত্যা করতে হয়’।
অবশ্য তলস্তয়ের প্রায় সব নারী চরিত্রই তিনি এঁকেছেন পিতৃতান্ত্রিকতার নৈতিকতায়। নারীদের তিনি পুতুল বানাতে চেয়েছেন। যেই নারীটি পিতৃতান্ত্রিকতার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন তখন হয় তাকে হত্যা করা হয়েছে না হয় তাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। আসলে যে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভবে নারী পরাজিত হয়ে পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত হল।
সেই ব্যক্তিমালিকানাই কিন্তু আজকের পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের বিকাশে নারীর অবস্থান আরও বেশি অধপতিত। পুঁজিবাদ নারীকে শুধু মর্যাদাহীন করেই ছাড়েনি। সে নিংড়ে নিয়েছে তার সবটুকু। সে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে তার নিজের প্রয়োজনে। ঘরের শ্রম দেয়ার পর তার বাকি শ্রমটুকু কেড়ে নেয়ার জন্য তাকে সে বাইরে নিয়ে এসেছে। পুঁজিবাদের কাছে নারী এক বিশাল পণ্য।
তাকে ঘরে খাটাও, বাইরে খাটাও, বিক্রি করো তার দেহ, তাকে সবসময় শাসনের ভেতর রাখো। পুঁজিবাদী দুনিয়া নারীর জন্য হাবিয়া দোজখ। এই বইতে চৌধুরী দেখাচ্ছেন কিছু কিছু নারী উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়; কিন্তু তারা তখন আর নারী থাকে না তারাও পিতৃতন্ত্রের পাহারাদারে পরিণত হয়। তখন তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় তারা কতটুকু পুরুষ হয়ে উঠতে পারে সেবা করতে পারে চিরপরাক্রান্ত পিতৃতন্ত্রের।
পিতৃতান্ত্রিকতা আসলে একরকম স্বৈরতন্ত্র। ক্ষমতা দীর্ঘদিন একই জায়গা থাকলে তা স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। পিতৃতান্ত্রিকতা ও পুরুষতান্ত্রিকতার মধ্যেও পার্থক্য আছে। চৌধুরী বলেন ‘পিতৃতান্ত্রিকতার সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিকতার মিল আছে বলে মনে হবে।
কিন্তু দুটি মোটেই এক বিষয় নয়, মৌলিক পার্থক্য আছে। পিতার ভাবমূর্তি একজন পুরুষেরই এবং পুরুষতান্ত্রিকতা হচ্ছে পুরুষের কর্তৃত্ব নারীর ওপর। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিকতা যে কেবল নারীর কর্তা, তা নয়। কর্তা সে পুরুষের ক্ষেত্রেও। পুরুষ ও নারী উভয়েই পিতৃতান্ত্রিকতার অধীনে থাকে, বাধ্য হয় থাকতে’।
এ বইয়ে হতবিহ্বল করে দেয়ার মতো মর্মস্পর্শী একটা অধ্যায় আছে ‘তাদের জোরটা কোথায়’। সমাজে ধর্ষণের যে মহামারি দেখা দিয়েছে সেটার শুলুক সন্ধান করা হয়েছে এ অধ্যায়ে। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরা যেমন নিয়মিত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে; তেমনি স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক থেকে শুরু করে বাসের ড্রাইভার-হেল্পার পর্যন্ত সবধরনের শ্রেণী-পেশার মানুষই ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে। আবার বস্তি থেকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত সবখানেই নারী ধর্ষিত হতে পারে।
এ অধ্যায়ে তিনি পত্রিকা থেকে পরিসংখ্যন করে দেখিয়েছেন, ধর্ষিত হওয়ার পর ধর্ষিতা যার কাছে বিচার দিতে যাবে তিনিও ধর্ষক। চৌধুরী নিজে দায়িত্ববান বিদ্বজ্জন বলে তার বইটি পাঠককে দায়িত্বমুখী করে, প্রতিরোধী করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয় আমাদের স্থবির চিন্তার লেজে।
পিতার হুকুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন মূল্য চারশ টাকা