Author Picture

জীবন দেখব, জীবনের ভণ্ডামি দেখব না, এটা তো হতে পারে না: হাসান আজিজুল হক

মনি হায়দার

ছোটগল্পের পাশাপাশি উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রেও নিজস্বতার পরিচয় দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের জীবন প্রণালি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তার গল্প-উপন্যাসের পটভূমি হয়েছে। হাসান আজিজুল হকের চরিত্রগুলোতে যেমন আছে ক্ষরণ ও ব্যর্থতা, তেমনি রয়েছে সাফল্য ও বিজয়গাথাও। আমাদের সামাজিক ভয়ানক অবক্ষয়ের ইতিহাসও তার লেখায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘বৃত্তায়ন’, ‘শিউলি’, ‘আগুনপাখি’; ছোটগল্পের মধ্যে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘আমরা অপেক্ষায় আছি’ উল্লেখযোগ্য।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ বহু পুরস্কার।

 

সাক্ষাকার নিয়েছেন : কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার

 

বেশ কয়েক বছর আগে আপনার দুটো গল্পগ্রন্থ বের হয়েছে, গল্পসমগ্র এক এবং দুই, মওলা ব্রাদার্স থেকে। সেই গল্পগুলো পড়ে দেখলাম, আপনি অনেক বছর হয় আর গল্প লেখেন না। বইটা বের হয়েছে অনেকদিন আগে। আপনার কাছে এভাবে জানতে চাই যে, আর কেন গল্প লিখছেন না? গল্পের আখ্যান কি আপনার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে ?

: না, ব্যাপার ঠিক তা নয়। নানান জিনিস এসে লেখকের মনে জোটে। আগাগোড়া প্রবন্ধ লিখেই গিয়েছি। একটা সময় মনে হল একটু বড় করে কিছু লিখি। তখন বিধবাদের কথা গল্প হিসেবেই শুরু করেছিলেম। পরে দেখা গেল ‘বিধবাদের কথা’ গল্প ঠিক নয়, এটা একটা ছোট উপন্যাস হয়ে গেছে। তারপর আমি ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটা একটা ছোট্টগল্প থেকে শুরু করি। গল্পটাকে অবলম্বন করে আমি ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটা লিখে ফেললাম। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটা লেখার পর মনে হল, দীর্ঘ লেখা তো আমি লিখতে পারি। এখন এটাও স্বীকার করি, যখন লেখক হব মনে করছি আমি, ১৯৬০ সালে, তখন ঔপন্যাসিক হব, এটা তো নিশ্চিত ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু কপালের ফেরে ছোটগল্পকার নামটা যে হল, তার সঙ্গে নানা উপাধি জুটে গেল আর কী। তার ঔপন্যাসিক এ অভিধা আর হল না বুঝি। আসবে না আর। একসময় একটা অপ্রতিরোধ্য তাড়না ভেতর থেকে মনে হল, এই কাহিনীটা আমি লিখব। কারণ আমার মনের মধ্যে যেসব জিনিস আছে, সেগুলো তো যেভাবেই হোক অন্যদের ভাগ দিতে হবে। আমার যে তিক্ততা আছে, আমার যে প্রেম আছে, আমার যে মানুষের প্রতি ভালোবাসা আছে, আমার যে মানসিক প্রবৃত্তিগুলো আছে, সেগুলো সম্বন্ধে তো আমি জানি। মানুষের কুপ্রবৃত্তি, মহৎ প্রবৃত্তিও আছে, কোনোরকম প্রবৃত্তির বাইরে যে মানুষের বিশুদ্ধ যুক্তি সেটাও আছে। এটা আমি মানি, সে জন্য আমার মনে হল, গোটা মানুষকে আঁকা দরকার। যেমন গাছ লাগালে বীজটা যদি ভালো হয়, জায়গাটা ভালো হয়, তাতে যেটুকু সার দেয়া দরকার, যদি দেয়া হয় তাহলে গাছটা অনেক ভালো হয়। লেখাও অনেকটা তাই। আমি মানুষকে নিয়ে লিখব মানে আমার খুব ভালো করে জানতে হবে, সমাজের গতি কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, সমাজ খারাপ হলে ভাবতে হবে, সমাজ এদিকে যাচ্ছে কেন? আমাকে তখন বলতে হবে, শাসক এক জিনিস, দেশ এক জিনিস, রাষ্ট্র এক জিনিস, সরকার আরেক জিনিস।

মানুষ এক জিনিস-

: তখন আমি একের পর এক গল্প লিখতে শুরু করি। সেই সঙ্গে সঙ্গে বাল্যস্মৃতি আছে, বাল্যাভিজ্ঞতা আছে। এ কথাটায় তোমাকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে, অভিজ্ঞতার বাইরে আমি কিছুই লিখিনি।

মা-মেয়ের সংসারনিয়ে আপনি লিখলেন, মা এবং মেয়ে একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা, কী বেদনার সঙ্গে মেয়েটি খুঁজতে যায় শেয়ালটাকে বা বাঘটাকে, পায়নি, এ বাঘটা আসলে কী? কিসের প্রতীক এঁকেছেন ?

: তার যে সর্বনাশ হয়েছে, তাদের আমি চারটা শেয়াল বলেছি। যে সর্বনাশ তার এবং তার মায়ের হয়েছে, তারপর যে গ্লানি তার হয়েছে, তার থেকে আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে যেতে চেয়েছে, বাঘের পেটে যেতে চেয়েছে। তার আর কিছুর দরকার নেই এ জীবনে। এ জন্য সে বাঘ খুঁজে বেড়াচ্ছে আর কী। এত সব শুধু ওই মেয়েটির মধ্যে প্রচণ্ড যন্ত্রণা এবং কষ্ট, এগুলো তো অনুভব করার ব্যাপার, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, সে জন্য কোনো রকমে সামনে একটা চিত্র তৈরি করে সেটা বানানোর চেষ্টা করে। আমাকেও তাই করতে হয়েছে। তাহলে খালের ওপারেই যখন সুন্দরবন শুরু হয়েছে, তাহলে ওপারেই চলে যাক সে। আমি এরকম জায়গা দেখেছি, জায়গাটা কিন্তু আমার দেখা। যে জায়গায় মা-মেয়ের সংসার, সে জায়গা তাফাইল বাড়িঘাট বলে যে জায়গাটা আছে, সুন্দরবন সংলগ্ন। একেবারে শেষ প্রান্ত। এ পর্যন্ত আমার যাওয়া আছে।

আপনি তো দীর্ঘদিন খুলনায় বসবাস করেছেন ?

: হ্যাঁ, করেছি। সে জন্য মনে করলাম, আমাদের দেশে সাধারণত মেয়েদের যেভাবে দেখা হয় তার একটা প্রচণ্ড প্রতিবাদ করা দরকার। এ প্রতিবাদ থেকে মা-মেয়ের সংসার লেখা, শেষটুকু পড়লে বুঝতে পারা যায়।

আপনার যে আরেকটি গল্প, এর উল্টোপিঠে মন তার শঙ্খিনীএখানে হামিদা বা হামি যে কাজটা করে নারীর ভেতরে যে কত রকম নারীত্ব এবং তার প্রতিশোধের স্পৃহা আছে, থাকতে পারে, অসাধারণ ব্যঞ্জনায়, শেষে বলে, ‘আমি স্বামীর বাড়ি যাচ্ছি কিন্তু পেটে আমার ছাওয়ালবিস্ময়কর ব্যঞ্জনা! কীভাবে তৈরি করলেন ?

: কেমন করে তৈরি করেছি আমি জানি না, আমার চোখের সামনে একটা মেয়ে আছে, খুব গরিব ঘরের মেয়ে, পিতৃমাতৃহীন, শুধু তার দাদি আছে। সে যেভাবে মানুষ হয়েছে, তাতে সত্যিকারের অর্থে মানুষের মর্যাদা তার কখনোই পাওয়ার কথা নয়। ওই মেয়েটাকে সামনে রেখে আমি ভাবলাম একটা প্রেমকাহিনীই লিখি।

সাধারণত আপনি প্রেমের গল্প খুব কম লেখেন

: লিখিই না বলতে গেলে। সেই মেয়েটিকে সামনে রেখে আমি এ গল্পটা লিখতে শুরু করি।

প্রেমের গল্প লেখেননি, কেন লেখেননি ?

: সত্যি কথা বলতে কী, প্রেমের ব্যাপারটা আমার গল্পে জীবনের চাপে আসেনি।

প্রেম কি জীবনের বাইরে ?

: বাইরে নয়, কিন্তু তার ধরনটা কেমন হতে পারে? আমি যে গ্রামে ছিলাম, গ্রামেও তো ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেম হবে, আমার অভিজ্ঞতার মধ্যেই তো হবে। আমি অল্পবিস্তর দেখেছি। সেটা অবর্ণনীয় ব্যাপার।

সেটা আপনার দুটো উপন্যাস, ‘আগুনপাখিসাবিত্রী উপাখ্যানপড়ি, তাহলে দেখতে পাই, আপনার ফেলে আসা জীবন, আপনার শৈশব, যৌবন, সেসব জায়গা খুবই ভয়ংকর, নিপীড়িত, দুঃখ, মর্মান্তিক, বেদনার্ত

: বাসেত বলে একটা ছেলে ক্রমাগত লম্বা হয়ে যাচ্ছে, ‘তৃষ্ণা’ গল্পে। সে শুনতে পাচ্ছে গ্রামেরই একটি মেয়েকে, প্রেম জিনিসটা তো প্রশ্নই ওঠে না, ‘চার আনা দে, তিন আনা দে, দু আনা দে, নইলে আমি রাজি নই’। এ থেকেই আমি বাস্তব চেহারাটা দেখতে পেয়েছি। আমি একটি কুয়োর মধ্যে একটি শিশুর মৃতদেহ দেখেছি, পরে আমি শুনেছি যে, সেটি কোনো এক বিধবার বাচ্চা, হয় সে মৃত জন্মেছিল অথবা তাকে মেরে ফেলে ওখানে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আমার ছোটবেলায় আমরা সবাই কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে মৃতদেহটা দেখেছিলাম। গ্রাম দেখব কিন্তু তার গ্লানি দেখব না। জীবন দেখব, জীবনের কষ্ট দেখব না, জীবনের ভণ্ডামি দেখব না, এটা তো হতে পারে না।

আমার মনে হয়, আপনি ভণ্ডামির কষ্টটা একটু বেশি অনুভব করেন

: কিন্তু আমার ভেতরে মানুষের প্রতি গভীর আস্থা এবং ভালোবাসা আছে। এটাই কিন্তু আমার মূল অনুপ্রেরণা। সে জন্যই বোধহয় মানুষকে আমি দেখাতে চাই। ভালো মানুষ কি নেই আমার গল্পে? আছে। কিন্তু আমি তাদের নিয়ে মাথা ঘামাইনি। বরং দেখ, ‘আমৃত্যু আজীবন’-এ ওই চাষী আর তার ছেলে আর তার স্ত্রী, যে বলছে, তোমার একটা বলদ মারা গেছে, তাতে কি, আমি টানতে পারি না লাঙ্গলটা আরেকদিকে?’ গ্রামের জীবনে তো এই-ই চিত্র, সেটাও তো আমারই লেখা, তাই না?

অনিবার্যভাবে আপনারই লেখা, কিন্তু কথাটা হচ্ছে যে, হাসান আজিজুল হকের গল্প যখন পড়ি তখন জীবনের এত গভীর বেদনার নির্যাস থাকে, এত কষ্ট থাকে এবং এত রুক্ষ জীবনের চালচিত্র থাকে, সেখানে রাশি রাশি বেদনার রোদন থাকে, একটা ভয়াবহচিত্র থাকেলড়াই ঠিক আছে, কিন্তু তার মধ্যে যে সৌন্দর্যের দিকটা, সেটা একটু কম থাকেকী মনে হয় আপনার ?

: আমি এটা নিয়ে ভাবি না। আমি মূলত মনে করি যে, মানুষ যেমন, তেমন করেই তাকে আঁকা দরকার। সৌন্দর্যস্পৃহা মানুষের মধ্যে নেই, তা নয়, তা-ও আমি এঁকেছি, একটু পড়লে বোঝা যাবে।

তা এঁকেছেনআমরা অন্যান্য লেখকের লেখায় যা তীব্রভাবে সরাসরি পাই, আপনারটায় মন্থন করতে হয়প্রতিলাইন, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ খুব গভীরভাবে পাঠ করার পরই ওই সৌন্দর্যটা আবিষ্কার করা যায়

: সেটার জন্য তো আমি লেখক হিসেবে কিছু বলতে পারব না, তাই না? আমি তো লিখি পাঠকদের জন্যে। পাঠকরা যা পড়েন, পাঠকরা যা বলেন, সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন, আমাকে বলতে হবে যে, এটা আমি লিখেছি, আমার কিছুই করার নেই।

আপনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে কবে এসেছেন ঢাকায় ?

: ১৯৫৪ সালে।

একটু পরে এসেছেন ?

: একটু পরে মানে আমি ওখান থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করে এসেছি।

পরিকল্পিতভাবে ?

: আমি বরাবর বলি, আমি কোনো ধাক্কায়-টাক্কায় আসিনি। আমার বড় বোন, আমার একটাই বোন, জানু আপা, যার স্বামী অধ্যাপক ছিলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব, নামকরা অধ্যাপক ছিলেন। উনি তখন দৌলতপুর কলেজে ছিলেন। আমার বোন বিশেষ করে আমার ভগ্নিপতি বলেছিলেন, ‘আমাদের এখানে এসে তুমি দৌলতপুর কলেজে ভর্তি হয়ে যাওনা কেন?’ আমার বাবা কিন্তু আমার মতো ঝুঁকি নিতে পছন্দ করতেন, আমার মতো। মা বললেন, ‘কেন বর্ধমানে পড়া যাবে না?’ বাবা বললেন, ‘চিঠিটা এলো যখন তখন যাক না কেন ও।’ পাসপোর্ট হল, ভিসা হল, চলেই এলাম। কাজেই আমি স্বেচ্ছায় এসেছি, ওই অর্থেই বলি আর কী।

খুলনায় তখন পরিবেশটা ভালো ছিল ?

: খুলনায় তখন পরিবেশ ভালো ছিল; কিন্তু তখন দেশ বিভাজনের বীভৎস চিত্রটা প্রকাশ করতে গিয়ে, নানাভাবে মানুষ যে চলে আসছে, সেটাকে কি বলে মহাযাত্রা? শেয়ালদা স্টেশন ভর্তি, কিছু মানুষ আসছে আর কিছু মানুষ যাচ্ছে। পা রাখার জায়গা নেই। কোথাও পা দিলে কোনো বাচ্চার পিঠে পড়বে। এই কথাটা আমি বারবার বলেছি, আমি একজোড়া নতুন জুতা কিনেছিলাম, তাই পুরনো জুতা ফেলে দিয়েছিলাম। ওই জুতার ওপর পাঁচ থেকে ছয়জন মানুষ যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল, একজন এক পাটি পেয়েছে, আরেক পাটি পায়নি, সে পাটির ওপর তিন-চারজন লোক। ব্যাপারটা আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে, আমি ওই দৃশ্যটা ভুলতে পারি না। এই যে দুর্গতি মানুষের হয়েছে, তখন থেকে আমি তীব্রভাবে এ বিভাজনের সমালোচনা করেছি, এখনও আমি মনে করি না, এ বিভাজন এভাবে মেনে নেয়ার কোনো কারণ ছিল না। ঠিক আছে, অন্যভাবে হতে পারত।

পারত, নানাভাবেই হতে পারতআপনার একটা গল্প আছে স্বপ্নরা দারুণ হিংস্র’, স্বপ্নকে সাধারণত মানুষ খুব পজিটিভলি দেখে, স্বপ্নের ভেতরে তার নিজের স্বপ্ন রূপায়ণ করে, অন্যকে জাড়িত করে, উদ্ভাষিত করেকিন্তু একটা গল্পের নাম স্বপ্নরা দারুণ হিংস্র’, গল্পটা কেন লিখলেন ?

: আমার কিছু গল্প আছে, যেগুলো এখন আমি নিজেও অনুমোদন করি না।

এটা হতেই পারেএকজন লেখককে জীবন, মনন, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বয়স, মেধা-

: আমার কখনও মনে হয়েছিল যে একদম নতুন কিছু একটা লিখি।

এটা কিন্তু একটু অন্যরকম গল্প

: একটু অন্যরকম গল্প। এর অনুপ্রেরণার উৎসটা আমি বলতে পারি। একদিন গাব্রিয়া গার্সিয়া মার্কেস, তিনি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন, একটা উপত্যকা দিয়ে, উপত্যকা রোদে ভাসছে, হঠাৎ ‘শতবর্ষের নির্জনতা’, এরকম একটা কথা মনে হল। তখন উনি আর গেলেন না। তিনি গাড়িটা ঘুরিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকে স্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন, ‘আমি উপরে যাচ্ছি, আমি বসব, খাবার-দাবার পাঠিয়ে দেবে উপরে, আমাকে বিরক্ত করবে না, আমাকে ডাকবে না।’ এরকম করে ‘শতবর্ষের নির্জনতা’ লেখা হয়ে গেল। এটা একটা অনুপ্রেরণার ব্যাপার। এই গল্পটায় মনে হয় যে এর মধ্যে একটা অলীকতা কাজ করছে।

আপনার অধিকাংশ গল্প একটু বড়; কিন্তু আপনার এ গল্পটা বেশ ছোট

: এ গল্পটা বেশ ছোট। আড়াই পৃষ্ঠা সম্ভবত। তখন আমি এ গল্পটা লিখে ফেলি, একটা কিছু হবে, এই মনে করে আমি লিখিনি। ‘শত্রু’ বলে আমার একটা গল্প ছিল, লোকেরা জানে না। এ গল্পগুলো পরবর্তীকালে আমি কোথাও দিইনি। ‘স্বপ্নরা দারুণ হিংস্র’ আমার কোনো সংকলনে নেই। আমার অননুমোদিত গল্প আমি কোথাও দিইনি। যদি কেউ বলে কিচ্ছু হয়নি, আচ্ছা ঠিক আছে হয়নি।

আপনার একটা গল্প আছে, ‘মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছেমানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে নাকি মনুষ্যত্ব খুন হয়ে যাচ্ছে?

: একটা সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলেন, তখন এরকম আশঙ্কা যত্রতত্র দেখা দিচ্ছিল। এ আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন। আমার সামনে যে চরিত্রটা ছিল, আমার জানা, সে আমাকে একদিন বলল যে, ‘আপনার বাড়ি খুলনা?’ ‘হ্যাঁ, আমার বাড়ি খুলনা,’ ‘আমি একটা দিন আপনার সঙ্গে থাকব’, ‘আচ্ছা থাকেন’ পরদিন লোকটা চলে গেল, যাওয়ার সময় ধরন-ধারণ ভালো লাগল না, লোকটা খুন হয়ে গেল।

আপনার যে আরেকটি গল্প, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, একজন বন্ধু আরেকজন বন্ধুকে কীভাবে সেক্রিফাইস করে, রাজনীতিবিদকে ধরে ফেলতে চায়, মেরে ফেলতে চায়, এই যে অপেক্ষা করতে করতে পুলিশ এসে ধরে ফেলল, এক ধরনের পরাজয়

: পুলিশ তাকে গুলি করেই মেরে ফেলল।

এটা আপনি নির্দিষ্ট করেননিঅথচ ওরা দিনের পর দিন, ওরা অপেক্ষা করেছে, একটি সুন্দর স্বপ্নের জন্য, একটি বিপ্লবের জন্য, একটি সুন্দর সময়ের জন্য

: তোমার মনে আছে ওইসব কথা, আমি আর মনে করিয়ে দিতে চাই না। স্বাধীনতার পর কিভাবে দেশটা রক্তাক্ত হয়েছিল। মানুষ কিভাবে খুন হচ্ছিল। নামধাম এখন আর বলতে চাই না। দৌলতপুর কলেজে থাকি, কোয়ার্টারে থাকি, বাইরে বারান্দায় বসে আছি, দেখছি যে আমার দেয়ালের ওপর দিয়ে একটা লোক উঠে আসছে। কে কে বলতে বলতে অন্যদিকের দেয়াল পেরিয়ে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পরই আমি দেখলাম হাতে বন্দুক নিয়ে আরেকজন প্রাচীর দিয়ে উঠছে। বোঝা যাচ্ছে, সে ওকে পেলেই গুলি করত। এরা যে কোনো বাহিনী-টাহিনী নয়, সেও আমার বাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। তখন আমার মনে হয়েছে, একি বীভৎস কান্ড শুরু হয়েছে। এসময় আমি একবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া গিয়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথ যেখানে থাকতেন, তখন শুনছিলাম, নৌকা করে এক বুড়ো দুধ নিয়ে যাচ্ছে, ঝট করে তিন-চারজন উঠে এসে বলল, ‘তোর ছেলেটা কই? কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল? নাহলে এক্ষুনি তোকেই মেরে ফেলব।’ সে বলছে, ‘আমি জানি না বাবা, আমি জানি না।’ বলতে বলতে ঘাড়টা কাত করে এক কোপ দিয়ে লোকটার ঘাড়টা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। এ ঘটনা আমাকে বলল। তখন আমি বুঝলাম কী রকম অরাজকতা শুরু হয়েছে। তখন আমি তীব্র সমালোচনা করেছি, যেগুলো এখন আর আমি করব না।

একুশে পদক নিয়ে একটা ঘটনা আছে, কোনো এক সরকার আপনাকে পদক দিতে চেয়েছিল, নিতে চাননি, ফোন করে আপনার অনুমতি চেয়েছিলঘটনাটা কী রকম  ?

: একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি আমাকে ফোন করেছিল, ‘আপনাকে এবার একুশে পদক দেয়া স্থির হয়েছে, আপনি একটু সম্মতি জানান।’ আমি বললাম, ‘কেন, সম্মতি জানাতে হবে কেন? যে পুরস্কার জিজ্ঞেস করে দেয়া হয়, সে পুরস্কার তো পুরস্কার থাকে না, চেয়ে নেয়া হয়, নোবেল পুরস্কার যাকে দেয়া হয়, তাকে তো জিজ্ঞেস করা হয় না।’ তলস্তয় বলেছিল, ‘আমাকে যেন পুরস্কার আদৌ দেয়া না হয়,’ উনি ১৯১০ নাগাদ মারা গেছেন, পুরস্কার চালু হয়েছিল ১৯০০ সালে। যেমন, জ্যাঁ পল সার্ত, বলেছিলেন, ‘আমার স্বাধীন লেখা কেন একটা পুরস্কারের অধীনে চলে গেল, এমন পুরস্কার আমি নেব না।’ এরকম কেউ কেউ নেননি। কেউ কেউ আবার নিতে গিয়েছেন, তাকে নিতে দেয়া হয়নি। রাশিয়ান একজন লেখককে নিতে দেয়া হয়নি। একজন লুকিয়ে চলে গেছেন। তখন আমার মনে হল, যে পুরস্কার আমাকে জিজ্ঞাসা করে দেয়া হচ্ছে, তা কখনোই আমার উপযুক্ত হতে পারে না। আমি আমার কলমের অধীন, আমি কোনো কর্তৃপক্ষের অধীন নই।

আপনার অধিকাংশ গল্প অত্যন্ত সাহসী গল্প এবং এ দেশের মানুষের জীবন থেকে উত্থিত আখ্যানএকটি গল্প পাবলিক সার্ভেন্টসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমি মনে করি একটি শক্তিশালী গল্পএখানে মামুন এবং শায়লা স্বামী-স্ত্রী, কীভাবে আপনি ব্যবহার করেছেন, সাহস এবং দ্রোহ, আপনি কীভাবে পেলেন? কোন সাহসে লিখলেন? সে সময় নাকি আরও পরের দিকে ?

: তার আগে কি ‘খনন’ লিখিনি? এটা তো খালকাটা প্রোগ্রামের কর্মসূচি ছিল, কার ছিল তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, তখন তো লিখেছি। তখন ভয় করিনি, পরবর্তীকালেই বা কেন ভয় করতে যাব? তখন আমি কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে এ আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করতে চেয়েছিলাম। রাষ্ট্রের যারা নিয়ন্ত্রক তাদের অনেকটা নির্ভর করতে হয় বাস্তব প্রশাসনের জন্য। তার মনের মধ্যে অনেক কিছুই জন্ময় সেটা গুঁড়িয়ে দেয়া দরকার, আমার মনে হয়েছিল। আমি সে জন্য ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ গল্পটা লিখেছিলাম।

যখন শায়লা ধর্ষিত হয়ে ফিরে আসে, যে সংলাপটা, যে বোঝাপড়াটা, তীক্ষ্ণতা, শায়লায় যে এক ধরনের ভয়ানক হয়ে ওঠার ব্যাপারটা, একজন সম্মানিত নারী, হতে পারে নারী, তার সম্মানবোধ আছেসে জায়গা থেকে সে যেভাবে উঠে এসেছে, স্বামীকে প্রশ্ন করেছে এটা মর্মান্তিক ব্যাপার

: এর কোনো জবাব দিতে পারেনি। এবং আমি গল্পটা সেভাবে শেষ করেছিলাম, জবাব দিতে পারবে না বলেই। একবার তো আলো জ্বলে উঠল, দেখাল যে স্ত্রীকে টানতে টানতে নিয়ে গেছে। বলে যে ‘সে কী দেখেছিল, একবার যে আলো জ্বলে উঠল?’ অর্থাৎ ধর্ষণরত এবং ধর্ষিতা, সে কী করেছিল, সে কি দৌড়ে গিয়েছিল? নাকি বাড়ি চলে গিয়েছিল? নাকি দাঁড়িয়েছিল?’ এ ক্ষোভ নারীর মনে হবে না, নারীদের আমরা কোনো অগ্রাধিকারই দিই না, কেন দিই না, জানি না। এটা একটা নারীর স্বাতন্ত্র্যই বটে আর যারা রাষ্ট্র চালায় বলে রাষ্ট্রের প্রভু মনে করে নিজেদের, তাদের ভেতরটা কেমন? তাদের নাম ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’, কিন্তু তারা নিজেদের প্রভু মনে করে। আমার এ গল্পটা অনেকেই পড়েছেন কিন্তু আমার কাছে কেউ আপত্তি করেননি।

আপনি যেটা করেছেন তীব্র সত্য তো, তীব্র সত্য বলা কঠিনগ্রহণ করা তো আরও কঠিনহয়তো এ জন্যই আপনার কাছে কেউ কিছু বলেনিখননগল্পটা নিয়ে কথা উঠেছিল, আমি যতদূর জানি

: প্রশ্ন উঠেছিল, কেউ কেউ বলেছিল, ‘আপনাকে বোধহয় অ্যারেস্ট-ট্যারেস্ট করতে পারে।’ এটা সরাসরি আক্রমণ, আর ওই রকম প্রশ্ন, ‘তোমরা যে কাটছ বিনা পয়সায়…?‘ ‘হ্যাঁ, পানি আসবে, এই আসবে, আমাদের সেচের পানি থাকবে, কোনো অসুবিধা হবে না।’ ‘তাহলে খালের দুই পাড়ের জমিগুলো কার? তোমরা মালিক?’ ‘না, আমরা মালিক না?’ ‘তাহলে এখানে যে ধান হবে, জমির মালিক ধানগুলো মাথায় করে তোমাদের বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসবে? তাহলে খালটা কার জন্য কাটছ?’ এ জন্য আমি ‘খনন’ গল্পটা লিখেছিলাম। একজন সাংবাদিককে দিয়ে খুব কঠিন কথা আমি বলিয়েছিলাম।

কী বলিয়েছিলেন ?

: আমি বলিয়েছিলাম যে, ‘দেশ থেকে মানুষের বুকের ওপরে বাঁশচাপা হয়ে থাকে।’ আর বলেছিল, ‘এই যে মেয়েটি, যে তার দুটি স্তন খোলা রেখে একটি বাচ্চা কোলে করে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে, সে যে বাংলোয় আছে, সে বাংলোয় বলছে, ‘শালা কী দেশ হয়ে গেল, আমি এখন মদ খাব,’ প্রচুর মদ খেল, তারপর ‘নিয়ে আয় যা, কোনো একটা মহিলা-টহিলা আমার জন্য নিয়ে আয়, কোনো অসুবিধা নেই।’ ঠিক সেসময় হাজির হল, এই মহিলাটি, তার সে খোলা বুক এবং সেই সন্তান নিয়ে। সে সময় সে তীব্র চিৎকার করছে, ‘তাড়িয়ে দে ওকে, তাড়িয়ে দে।’

আপনার একটা যে গল্প আছে, ‘বিধবাদের কথা’, এটা একটা উপন্যাসের কথা এর আগেও বলেছি, এ চরিত্রগুলো, রাহেলা, তার বোন, একই বাড়িতে থাকা- এই গল্পের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধকে এত তীব্রভাবে এনেছেন, এটার মধ্যে যে কাজটি হয়েছে, নিশ্চয় আপনি সচেতনভাবে করেছেন, সম্পর্ক, পিতার বিরুদ্ধে পুত্র, স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী, চাচার বিরুদ্ধে ভাতিজা, পৃথক করে ফেলে ধর্মভয়ংকর রকম, অথচ একই ধর্মে বাস করছে তারাতারা সবাই মুসলমান, ’৭১ সাল যেই হল একদল পাকিস্তান, একদল বাংলাদেশিএইটা কেন হয়? কীভাবে আবিষ্কার করলেন ?

: আমি মনে করেছি, ’৭১-এ যে মূল্য আমরা দিয়েছি, একদিক থেকে বাংলাদেশে বহু বিধবা হয়েছে, এটা ঠিক। বাংলাদেশটাকেও যদি নারী হিসেবে কল্পনা করি তাহলে দেশটাই বিধবা। বিধবা এ দেশে যারা স্বামীহীনা তারা কিছুই করতে পারবে না। তাদের করার কোনো ক্ষমতা ছিল না। তাদের ছেলেরা উল্টো হয়েছে। সম্পর্কগুলো কোনাকুনি করা হয়েছে তো, আমি মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চেহারাটা দেখতে চেয়েছিলাম, সেখানে বলতে চেয়েছিলাম, এই দেশ এখন বিধবাদের দেশ, কেউ তাদের এখন দেখবে না, কাঁথা সেলাই করবে, এই কাঁথার মধ্যেই দুই বিধবার দুই রকম অভিজ্ঞতা ওরকম ভাবে এঁকে এঁকে যাবে। আমাদের সামনে টানিয়ে দেবে ওটা। দেখে নাও।

পাতালে হাসপাতালেগল্পের জমিরুদ্দি, চিকিসার এরকম অব্যবস্থাপনা, আমার মনে হয় যে, বাংলা সাহিত্যে এরকম আর কেউ লিখতে পারবে নাআপনি সামনে বলে বলছি না, আমার মনে হচ্ছে, চিকিসার অব্যবস্থাপনাটা, আর জমিরুদ্দি যে চিকিসা না পেয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে, তার অসম্ভব একটি বাস্তব চিত্র আপনি এঁকেছেনএ জমিরুদ্দি কি বাংলাদেশের প্রতীক? অথবা আমাদের চিকিসা ব্যবস্থার প্রতীক ?

: এ গল্পটা লেখার পর ওরকম বড় হাসপাতালের চিকিৎসক বলেছেন, আপনার অভিযোগ আমাদের খণ্ডন করার সাধ্য নেই, তবে সবাই ওরকম নয়। আমি বলেছি সেটা ঠিক, সব চিকিৎসক সেরকম নয়। যদি শতভাগ নিশ্চিত হতে চাও তাহলে অন্তত বিশ ভাগ প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু তুমি একটা দেখে একশ’ ভাগ নিশ্চিত হবে, তা তো হবে না। একজন ডাক্তারকে দেখে তুমি বলতে পার না, হাসপাতালের চিকিৎসা খুব ভালো আছে। দু-চারজন ভালো ডাক্তার তো আছেই। সে জন্যই ওটা হাসপাতাল নাকি ওটা পাতাল- বোঝা খুব কঠিন।

আগুনপাখিকে আঁকলেন, এই যে ভদ্র মহিলা থেকে গেলেন, স্বামীর সঙ্গে পর্যন্ত এলেন না, এই শক্তি কোথা থেকে তিনি অর্জন করলেন? তার একটু কষ্ট হয়নি তার নাতনি হয়েছে, এই বাংলায় রয়ে গেছে, মুখ দেখতে পাচ্ছেন, তিনি সাহসটা কোথায় পেলেন ?

: তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু হয়েছিল। তার কবরটা তো ওখানেই আছে। ‘ও তো আমার কাছেই আছে।’ আমার মনে হল, এটা আদর্শও বটে, এটা আদর্শায়িত কিন্তু এটা বাস্তবও বটে। আমি এরকম দেখেছি। তুমি যদি একবার পশ্চিম বাংলায় যাও, গ্রামে গ্রামে যদি ঘোরো, আর বিভাজনের পরে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস যদি নাও, তাহলে দেখবে, এ দেশের সংখ্যালঘুরা যেভাবে গিয়েছিল, গলাধাক্কা খেয়েই হোক আর লুণ্ঠন করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েই হোক, যে পরিমাণে গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমান ওই পরিমাণে আসেনি। পশ্চিম বাংলা থেকে প্রচুর মুসলমান এ দেশে চলে এসেছে, এরকম কোনো ইতিহাস আছে? এর কোনো পরিসংখ্যান কি কেউ করে দিতে পারবে, এরা কত আর ওরা কত? এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি। আমি আমাদের গ্রামের কথাই বলি, একঘরও কল্পনাও করেনি পাকিস্তানে কি আমি বাস করব। যখন বলছে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, তখন সেও বলছে, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। তর্কের খাতিরে বলছে, ‘ভালোই তো মুসলমানদের জন্য একটা আলাদা দেশ হবে।’ তারপর বলবে, ‘তুই যাবি?’ বলে, ‘আমি কি দেশ ছাড়ব?’ সাঁওতালদের মতো, ‘তুই খ্রিস্টান হয়েছিস পুজো করছিস কেন?’ ‘খ্রিস্টান হয়েছি, তাই বলে ধর্ম ছাড়ব নাকি?’ পশ্চিম বাংলার লোকজনও তাই, ‘পাকিস্তান সমর্থন করেছি, তাই কি আমার ভূমি ছেড়ে চলে যাব?’ সে জন্য পশ্চিম বাংলায় তুমি দেখবে, যারা উচ্চশিক্ষিত, বড় চাকরি করত, অপশন দিয়ে এখানে চলে এসেছিল। এখানে মোটামুটি শিক্ষিত লোকদের অভাব ছিল, বায়ান্ন সালের আগে এই তীব্র চেতনা জাগেনি, সে জন্য অনেকেই এসেছিল, ভাগ্য অন্বেষণেও এসেছিল।

সেখানে আগুনপাখিএরকম একটা মোচড়, এই যে নারী তিনি খুব বেশি শিক্ষিত ছিলেন না

: এই যে বিভাজন সে অলীক, অপ্রয়োজনীয়, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন যারা এটা করেছে এগুলো তাদেরই চাল। তাদের কথা তো আমি ভুলতে পারছি না, সেটা এ মহিলা বলছে।

আপনি এক জায়গায় বলেছেন, পৃথিবী হচ্ছে নারী, সেই পৃথিবীর নাগরিক আপনি, সে জায়গা থেকে নারীর প্রতি আপনার একটা তীব্র পক্ষপাত আছে

: পক্ষপাত আছে।

কেন আছে ?

: সবকিছু ধারণ করে রেখেছে তারা। আমরা যে ধরিত্রী বলি, ধরিত্রী মানে যে সব ধারণ করে। এ জন্য পৃথিবীকে ধরিত্রী বলে। যদি তুমি নারীর দিকে তাকাও, তাহলে দেখবে একদিক থেকে সে ধরে রেখেছে। তোমাকে সন্তান দিচ্ছে, সন্তান দিয়ে তোমাকে মুক্তিই দিয়ে দিচ্ছে, সন্তান তার দায়িত্ব হয়ে যাচ্ছে। দুপুরবেলা তোমার খাওয়াটা হবে কিনা, সেটা শেষ পর্যন্ত দেখার দায়িত্ব তার, যথেষ্ট আধুনিক হওয়ার পর পুরুষরা কিন্তু ছাড়বে না দুপুরবেলার খাওয়াটা। কেন ঠিকমতো হবে না? সেদিনের একটা অভিজ্ঞতা পড়লাম, দু’জনে চাকরি করে। স্বামী ঘরে ঢুকে বসে আছে, তার পিপাসা পেয়েছে, বাড়িতে চাকরানিও আছে, তার স্ত্রী সবে ঘরে ঢুকেছে, তখন সে বলল, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই সময় দেয়ার জন্যযতদিন থাকবেন, ভালো থাকবেন, লেখার সঙ্গে থাকবেন

: তুমিও ভালো থেকো।

আরো পড়তে পারেন

বিস্তৃত পাঠ সবচেয়ে আনন্দের : ইমান মিরসাল

ইমান মিরসাল ১৯৬৫ সালে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। একজন আধুনিক আরব কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, সাহিত্য গবেষক এবং কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক। নব্বই দশকের উজ্জ্বল তরুণ লেখকদের একজন। সমসাময়িক আরবি কবিতার অন্যতম আকর্ষণীয় কণ্ঠ ইমান মিরসালের বহু কবিতাই এক ডজনেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত লিটারারি জার্নালগুলোয় নিয়মিত লেখাপত্র প্রকাশের পাশাপাশি পৃথিবীর….

‘পেশাদার খুনিরা, তোমরা সৈনিক নও।’ এটা ছিল কবিতাটির শেষ লাইন -আহমাদ ফারাজ

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি আহমাদ ফারাজ। ১৯৩১ সালের ১৪ জানুয়ারী পাকিস্তানের কোহাতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরোদস্তুর কবিতা লেখার সূচনা তাঁর কলেজে থাকতেই। যেগুলো পাঠ করলে দেখা যায়, তিনি তাঁর স্বতন্ত্র নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। আধুনিক উর্দু গযলেও রয়েছে তাঁর অসামান্য প্রভাব। শিক্ষা জীবনে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি ও উর্দু সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। পরে এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই….

আমি চেয়েছি কল্পনার ডানায় ভর করে বিজ্ঞানের আনন্দ সবার কাছে পৌঁছে দিতে

খন্দকার রেজাউল করিম শিক্ষক, গবেষক, লেখক। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৭৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যান। ১৯৮৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব অরিগন থেকে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে ৩০ বছর কাটিয়েছেন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা ও শিক্ষকতার কাজে। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরেটাস প্রফেসর। ড. করিম গবেষনার কাজে জড়িত….

error: Content is protected !!