Author Picture

শহীদ সাবেরের ‘আরেক দুনিয়া’ (পর্ব-৫)

মযহারুল ইসলাম বাবলা

সব চিঠিতেই শুভেচ্ছা থাকে না। থাকে এক করুণ চিত্র। ছাত্রটির বাবার চিঠি এসেছে।

তিনি লিখেছেন :
‘… পরিবার ভেঙে গেল। তোমার জন্য তোমার আম্মা পাগল হয়ে গেছে। তোমার ছোট ভাই-বোনদের যন্ত্রণাদায়ক প্রাণান্ত জিজ্ঞাসা আমারও জীবনীশক্তির মূলে আঘাত করছে। তুমি যদি ইচ্ছে কর তবে মুক্তিলাভ করতে পার অনায়াসে। সরকারের কাছে জানাও যে তুমি আর রাজনীতি করবে না। এটা আমাদেরই জাতীয় সরকার। আশা করি তুমি তাই করবে। নচেৎ-বাবা ভয় দেখিয়ে লিখেছেন, ‘কবরের এপারে আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না বোধ হয়…’। মর্মান্তিক চিঠি।

চিঠি পেয়ে কয়েকদিন গুম মেরে যায় ছাত্রটি। ভেবেচিন্তে শেষে লেখে :
‘… আপনার চিঠি পেলাম। আমাদের পরিবারের যে ধ্বংসের চিত্র আপনি এঁকেছেন, তা আমাকে তীব্র বেদনা দিয়েছে!… কিন্তু আচ্ছা, আমি তো শুধু আপনাদের ছেলেই নই, সমাজের ছেলেও। সমাজের প্রতি রয়েছে আমার আরও বড় কর্তব্য।…

‘আমি বাইরে এসে সমস্যার সমাধান করতে পারব না। বাইরে হাজার হাজার বেকার যুবক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তারা সম্পূর্ণ ভবিষ্যতহীন। এই সমাজকে ভেঙে নতুন করে দুনিয়া গড়তে হবে। আপনি অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বেতন পাননি চার মাসের। ভেবে দেখুন কতটা অমানুষিক এ ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থা এর জন্য দায়ী- তার কাছে আমাকে  আত্মসমর্পণ করতে আশা করি আপনি আর বলবেন না।’

শেষের দিকে লিখেছিল, ‘এটা আমাদের জাতীয় সরকার নয়, এ সরকার ইস্পাহানি-হারুনদের, পীরদের-মীরদের, বড় বড় ধনীদের। তারা জাতি নয়, তার বাইরে রয়েছে মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি শোষিত শ্রেণী। বর্তমান সরকার তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না’।

লিখে শেষে ভাবলেন চিঠিতে রাজনীতি করা চলবে না; তাই কেটে দিয়েছে শেষের লাইন কটি।

কিন্তু এবার মানুষ। দোষে গুণেই মানুষ। তাই এমন সংগঠিত জীবন আর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও বিচ্যুতি দেখা যায়। দীর্ঘ দিনের জেল বাসের ফলে তিরিক্ষি হয়ে ওঠে মন। হঠাৎ দেখা যায় ঝগড়া হয়েছে। কথাবার্তা বন্ধ হয়েছে। অনেক দূর গড়িয়েছে ব্যাপার।

‘… পরিবার ভেঙে গেল। তোমার জন্য তোমার আম্মা পাগল হয়ে গেছে। তোমার ছোট ভাই-বোনদের যন্ত্রণাদায়ক প্রাণান্ত জিজ্ঞাসা আমারও জীবনীশক্তির মূলে আঘাত করছে। তুমি যদি ইচ্ছে কর তবে মুক্তিলাভ করতে পার অনায়াসে। সরকারের কাছে জানাও যে তুমি আর রাজনীতি করবে না। এটা আমাদেরই জাতীয় সরকার। আশা করি তুমি তাই করবে। নচেৎ-বাবা ভয় দেখিয়ে লিখেছেন, ‘কবরের এপারে আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না বোধ হয়…’।

টনক নড়ে তখন। বসে যায় আত্মসমালোচনার বৈঠক। কারণ অনুসন্ধান হয় কেন এমন হল? বহু আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয়- ‘অমুক রাজবন্দি-আমাদের যৌথ জীবনে সমানভাবে অংশ নিতে পারছে না। এর কারণ হচ্ছে রাজনীতিতে সবচেয়ে ওপরে স্থান না দেয়া। অমুক তার অন্যায় উক্তির দ্বারা অমুকের এই মনোভাবকে বাড়তে দিয়েছে। সম্পাদক কেন এর সভা ডাকেননি, সবার সামনে অবস্থা ব্যক্ত করেননি, তাহলে তো এ ঘটতে পারত না।

রাজবন্দি অমুক আত্মসমালোচনা করেন,- ‘আমি দেখতে পাচ্ছি কিছু দিন ধরে আমার মেজাজ খারাপ হতে চলেছে। আমি ভুলে যাচ্ছিলাম যে আমরা সবাই কমরেড। এ হচ্ছে দীর্ঘ দিনের জেল-বাসের ফল। আমি এ দোষ কাটিয়ে উঠব। সহকর্মীরা আমাকে সাহায্য করুন।’

মরচে ধরা যন্ত্রে তেল দেয়া যেন এটা। এ হচ্ছে সংগঠনের মধ্যে জীবনীশক্তির সঞ্চার। আবার পুরোদমে কাজ চলতে থাকে। নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় জেল জীবন কাটানোর জন্য। প্রস্তাব নেয়া হয় ‘সমাজের ক্রমবিকাশ’, ‘ডলার সংকট’, ‘নয়া গণতন্ত্র’- এগুলোর ওপর ক্লাস হবে তিনটি, এ মাসে। বিতর্ক সভা হবে একটি। বিষয়- ‘জাতিসংঘে কোরিয়া প্রসঙ্গ’ আলোচনা। তার প্রস্তুতি চলতে থাকে। একঘেঁয়েমি কাটে।

কারাগারের উচ্চ প্রাচীর ভেদ করেও এখানে খবর আসে। ‘সৈন্য এসে ভরে গেছে শহর’, ‘ছাত্ররা আমাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।’ আসে এসব খবর।

সিরাজ সান্ত্রী বলে মিটিংয়ের খবর। বলে, উজীরে আজম তো আমাদের কথা কইল না। আলাপ হয় এ নিয়ে- ‘বুঝলেন সেপাই সাহেব’, ওসমান বলে ‘এবার আমাদের এক হয়ে দাঁড়াতে হবে।’

সান্ত্রী বন্ধুটি বলে, আমাদের মধ্যে একতা নেই।

নেই? না থেকে পারে? গড়তে হবে একতা, সেপাইও তা জানে।

সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শ নিয়ে সান্ত্রীরাও ভাবতে শুরু করছে। পুরোপুরি ধারণা নেই কারও। পেয়েছে কেবল আবছা আবছা একটা ধারণা। তার মধ্যে দিয়ে তারা বুঝতে পারে সমাজতন্ত্র হচ্ছে ধনীদের বিরুদ্ধে গরিবের, যুক্তি তর্ক করার ভাষা।

সবাই আবার তারও বুঝতে পারে না। এ অঞ্চলে বেশিরভাগ কমিউনিস্টই এসেছে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে, সংকটের ধাক্কা এসেছে তাদের ওপরে আগে। তাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশও নিয়েছেন তারা সবার আগে। সুস্পষ্ট ধারণাহীন কোনো কোনে সান্ত্রীর মনে এ নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কোনো মুসলমান কমিউনিস্ট পেলেই তাকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করে।

তাকে জবাব দেয়া খুবই সোজা। দাঙ্গার প্রশ্নে দৃষ্টান্ত টানতে হয় পাঞ্জাবের দাঙ্গার। সেখানে শতশত লোক কমিউনিস্ট বংশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও নিজেরা জান দিয়ে বাঁচিয়েছে মুসলমানের প্রাণ। মুসলমানও বাঁচিয়েছেন হিন্দুর। তুলে ধরতে হয় তার সামনে বর্তমান শাসনব্যবস্থার চেহারা। ঢাকার ছাত্রী নাদেরা বেগমের কথা। বর্তমান শাসকদের ধর্মীয় জিগিরের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় যুক্তি আর কি হতে পারে সান্ত্রীদের কাছে।

সান্ত্রীরা জানে এরা হচ্ছে সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই তারা বন্দিদের চমৎকার সব খবর এনে দেয়। কি করে জেল থেকে ৫শ’ খানা দামি কম্বল চুরি গেলে- কোথায় গেল তা। ১শ’ বস্তা ডালের কি হল, এসব খবর। লেখা আছে দেড় হাজার টাকার কাঠ কেনা হয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে একখানা ভক্তপোষ ছাড়া আর কিছুই তৈরি হয়নি। বাকি কাঠ কোথায়? এসব খবর নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। চাচা যদি উপস্থিত থাকেন, তবে হয়তো বলেন- বড় চোর ধরা পড়ে না। তাদের হাতেই তো আইন।

চোর ডাকাতের শাস্তির জায়গা তো এ নয়। এটাও একটা চুরির জায়গা। চক্রবর্তী বলেন- বুড়ো মার্কস ঠিকই বলেছিল যে জেলাটা হচ্ছে শাসকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার যন্ত্র। কেতাবের হরফের ছাদে চোখ বুলিয়ে সেটা যদি কেউ না বুঝে থাকেন, তবে বুঝবেন এখানে এসে।

জেলের মধ্যে ফন্দিবাজি এর এটা-ওটা পকেটস্থ করার নাম দিয়েছে, লটর পটর করা-আঞ্চলিক ভাষায়-চুদুর-ভুদুর করা। চুদুর-ভুদুরকারীদের বলা হয় বি কেলাশ। কিরে বেটা বি কেলাশ, কেমন আছস? একজন আর একজনকে শুধোয়।

জেলের মধ্যে ফন্দিবাজি এর এটা-ওটা পকেটস্থ করার নাম দিয়েছে, লটর পটর করা-আঞ্চলিক ভাষায়-চুদুর-ভুদুর করা। চুদুর-ভুদুরকারীদের বলা হয় বি কেলাশ। কিরে বেটা বি কেলাশ, কেমন আছস? একজন আর একজনকে শুধোয়।

রাজবন্দি ওয়ার্ডে এর বালাই নেই। জেলশুদ্ধ লোক দেখতে পাচ্ছে তাদের। প্রভাবান্বিত হচ্ছে তারা। রাজবন্দিদের লড়াই-পদ্ধতি মনে হয় তারও আয়ত্ত করেছে। সম্প্রতি কয়েকজন খাওয়া ছেড়েছে। হাঙ্গার স্ট্রাইক উচ্চারণ করতে পারে না তারা।

বলে থান্ডার স্ট্রাইক। তার ফল ফলেছে ইতিমধ্যে। আগে কয়েদিদের জেলে বিড়ি খাওয়ার নিয়ম ছিল না। সম্প্রতি অনুমতি এসেছে নিজের খরচায় বিড়ি খাওয়ার।

তাস, দাবা, ক্যারম, খবরের কাগজ, শরীরচর্চা, গালগল্প রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা- এই হচ্ছে এখানকার দৈনন্দিন পরিক্রমণের কক্ষ। সূর্য উঠবে। লকআপ খুলবে। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ একই ধারায় রুটিন বাঁধা জীবন। আবার রাত্রি আসবে। আবার পত্রিকা পাঠ। তারপর খাওয়া ঘুমানো। কারাগারের অন্ধকার তীব্র হয়ে আসে। শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়ে আসে। লকআপ হয়ে গেছে বহুক্ষণ আগে। স্টেটসম্যান পত্রিকার পশ্চিমী গণতন্ত্রের প্রশস্তিতে ইতি পড়েছে অনেকক্ষণ। সবাই শুয়েছে খাওয়ার পর। ঘুম আসছে না। ছাত্রটি কবিতা লেখা শেষ করে-

‘…বিরাট সম্ভাবনা মেনে নিই
আজ কঠিন বিশ্বাসে
এই দৃঢ় আশ্বাসে
আগামী দিনকে জানাই অভিনন্দন
যখন,
আমার মত বিশ বছরের তরুণ প্রাণ
উদ্ধত যৌবন নিয়ে
গাইবে জীবনের জয়গান
তাদের শক্ত বাহুর শক্তিতে
খামারে ও ক্ষেতে
ট্রাক্টর পাবে গতি
(লুপ্ত নিয়তি)
পাহাড় ওড়াবে নদীকে ফেরাবে
সাগরকে মানাবে হার
আর
বন্য জীবনের দুয়ারে লাগাবে খিল
মুক্ত স্বাধীন সোভিয়েত দিল।…

রাত্রির কামনা পূর্ণ হবে। আবার প্রভাত আসবে। সৌর তালিকা থেকে খসে খসে পড়বে এক একটি দিন।
প্রস্তুরীভূত গ্রানাইটের মতো বন্দি জীবন কঠিন কিন্তু গতিশীল জীবন এগিয়ে চলেছে।

ভেতর বাইরে সারা দুনিয়ায় আজ দ্বন্দ্ব। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার পালা ‘এসেছে। একদিন এ তিমির-তপস্যার অবসান হবে- এ আশাটি ধুঁক ধুঁক করে জ্বলছে সবার হৃদয়ে। বন্দিরা বেঁচে আছে।

সমাপ্ত 

আরো পড়তে পারেন

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি (সব পর্ব)

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ভাষা আন্দোলনের পর্যায় বিশ্লেষণ সূচনা ও বিকাশ পর্ব (১৯৪৭-১৯৪৮) বায়ান্নর প্রস্তুতি পর্ব (১৯৪৯-১৯৫১) বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

হারুন আল রশিদের সৃষ্টির ভুবনে ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’

হারুন আল রশিদ দুই দশকের বেশি সময় ধরে গদ্য সাহিত্য রচনার আধুনিক কলা-কৌশল রপ্ত করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যে স্থায়ী অবদান রাখা শতাধিক লেখকের উপন্যাস তিনি নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেছেন। ইংরেজিতে লেখা তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ উপন্যাস, The Memoirs of An Unrequited Love ও The River Flows Upstream, নতুন আঙ্গিকে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। ইংরেজি ভাষায় এ যাবৎ….

রাজীব সরকারের সৃষ্টির ভুবন

রাজীব সরকার এই সময়ের শক্তিমান লেখক। প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার কাজগুলোও সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। বিতর্ক বিষয়ে রাজীব সরকারের একাধিক বই মেধাবী তরুণদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার রম্যরচনার আলাদা পাঠকশ্রেণি গড়ে উঠেছে। গল্প ভ্রমণকাহিনি ও লিখেছেন। চলমান বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় মতামতধর্মী কলামও লিখে থাকেন বিভিন্ন সময়ে। জন্ম কিশোরগঞ্জ….

error: Content is protected !!