দ্বন্দ্ব
কে বলে সমস্ত গেছে? ঘোরে বা বেঘোরে,
মানুষের সব খোয়া যায়!
একার ভিতরে এক নিঃস্বতম, তারও ভেতরে
বসা, মানুষ কি একা হতে পারে—
সত্যি, বলো তো:
কেউ একা হতে চায়?
সন্ন্যাসে যাবার পরও, লক্ষ করো, তারে
ট্যাঁকে যে গৃহের চাবি— অভ্যাসবশত?
মুগ্ধরঙ, মায়াঘ্রাণ, জীবনের অনর্থক দাবী,
মানুষের কলিজার তন্তু নাড়ায়—
কলকাতা: ভ্রম ও ভ্রমণ
যখন, চন্দ্রকেতু গড়ে গেলাম— তখন, জোব চার্নকের
সুতানুটি গ্রামটি, কৃষ্ণদাসের সদ্য লেখা নারদপুরাণ হাতে,
কলকাতা হাইকোর্টের বারান্দায় পায়চারি করছে…
যখন, কলকাতায় পৌঁছালাম;
নগরটি তখন আসামের বরাক উপত্যকায়
বেড়াতে গিয়েছে; এবং ওটা যেখানে ছিলো,
সেখানে, প্রাগৈতিহাসিকের একটা গুহা—
কয়েক শতাব্দী ধরে জমতে থাকা মাকড়সার ঘন জাল
স্তরে স্তরে প্রতিবন্ধী করে তুলেছে গুহার প্রবেশমুখ; তাতে
মেখে আছে: বহু প্রাচীন, মধ্যম পুরাতন ও টাটকা রক্তের দাগ!
অন্ধকার বলা যাবে না— ঠাণ্ডা ও জটিল। কলকাতার নেশা
আর নয়। শেষটায়, একটা ছায়ার ভেতর থেকে
রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে, বেরিয়ে এলাম:
রৌদ্রের দিকে, জীবনের দিকে দিকে…
বিকল্প
ছোট-বড় অনেক গোপনতা
চাপা পড়লো: ময়লার ভাগাড়ে;
বাদ দিন! খুঁড়ে তুললে, কথা—
কেউ আবার মর্মাহত হতে পারে।
ওরা থাক, নিরাপদেই থাক,
পচে মরুক: দুর্গন্ধের স্তুপে—
বরং ভাবা যাক;
সত্যই জন্ম নেবে: অনাগত গ্রীষ্মের কিশলয়রূপে!
সিস্টার
রুটিন মাফিক প্রহার সয়ে বেড়ানো গবাদীর চোখের মতো চোখ ছিলো তার— বিশ্বাস করতো না কাউকে; এবং সন্দেহপ্রবণ শব্দটা, সম্ভবত, তার জন্যই সংযোজিত হয়েছিলো, বিদ্যার্থী বাঙলা অভিধানে।
তার ধারণা: যীশুখ্রিষ্ট ছাড়া অন্য কোনও বিষয়েই কবিতা লেখার দরকার নেই। কখনও বিয়ে করবে না বলে— নান হয়ে গিয়েছিলো, আগাথা দি’। ওর মুখমণ্ডল, আজ আর স্মৃতিতে নেই; দৃষ্টিজুড়ে, মেখে আছে, শুধুই ক্রমস্ফীত তার স্তন দু’টি।
গীর্জা চত্বরের মহুয়াতলায়, এক বিকেলে, কাকে যেন বলতে শুনেছিলাম: ‘‘ওর মতো আরও কিছু নান থাকলে, চিরকুমার পাদ্রিগুলো বেঁচে যেতো এবং আরও মনোযোগী হতো ধর্মোপদেশে—
ধর্ম ও যৌনতা— ব্যক্তির একান্ত বিষয়। ওসব নিয়ে ঘনীভূত পোয়াতি মেঘের আস্ফালন, কুৎসা, গুড়ুম গাড়ুম আওয়াজ— একদমই পছন্দ নয় আমার…
মানবাশ্ব
ও দানবীয়, শুয়ে পড়ো— এই পদতলে;
তোমার দেহকাঠামোর কোমল-কাঠিন্য
অনুভব করতে চাই: খুরে।
বহু বছর, কথা না-বলতে বলতে, ঠুলিপরা
চোখ দু’টো— ধারণ করলো উলের রং,
কোচোয়ান আমাকে জুড়ে দিয়েছে টমটমের সাথে;
নালপরা পায়ে খটাশ খট আওয়াজ তুলে
দৌড়াচ্ছি ধীর গতিতে। পালানোর মতো
চারণভূমি নেই। ক্রমশ গরম হচ্ছে বাতাস—
কঠিন খরা আর অজন্মায় পড়বে দেশ…
লু হাওয়া শুরুর আগেই, আমাকে ছুটতে হবে:
ঘাসের সন্ধানে— ও দানবীয়, দ্রুত শুয়ে পড়ো!
প্রাগমুহূর্তের গান
সোনার ইমিটেশন করা পরকীয়া রোদে, ঝলমলিয়ে উঠলো: সবুজ বিকেল। পূবের দিগন্তরেখা বরাবর— তিন কী চারটে শাদা খরগোশ লাফিয়ে উঠছে মেঘে এবং ভাড়ি পাথরখণ্ডের মতো দুমদাম পতনমাত্রই লুটোপুটি খাচ্ছে— কচি ভাদাল ঘাসের রাজকীয় গালিচায়; যা কিনা, এতটাই বিশাল ও বিস্তারিত যে, রাজ্যসীমা চিহ্নিত করতে চায় যেন-বা বাদশাহ আকবরের।
তখনই আসে সেই নারী; যার বর্তুলাকৃতি কাষ্ঠল স্তনে, কাঠঠোকরা হবার উন্মত্ত মুহূর্তে, মাত্র এক যুগ পরেই, কবিতার গোপন-সূত্রাবলি আবিস্কার করবো আমি—
কিন্তু সেটা তো সেই শৈশবের গল্প; যা যত্নে লুকানো থাকে— মানুষের ব্যক্তিগত কাঠের সিন্দুকে! সব সিন্দুকই চিত্রিত আর দুর্বোধ্য লতার আল্পনাঋদ্ধ নয়— যেমনটি ছিলো আমার। কে জানতো যে, বটগাছের মতো আকাশচুম্বী, সংহত আর জমাট সেই কালখণ্ড থেকেই এত বিচিত্র সময়ঝুড়ি নেমে আসবে— পৃথিবী, মাটি, মানুষ আর ক্ষতবিক্ষত হবার মতো এতসব চিন্তারাশির দিকে!
সময়ের অবগুণ্ঠণে মোড়া সেই নারী— আর নেই।
কিংবা দূর অরণ্যছায়ার সবুজে, প্রতিবিম্বিত তার অধরা আঁচল— পাখির ফাঁদের মতো প্রলোভনে ডাকে; স্বেদের ঐশ্বর্য তার, কোনও কোনও বিমল বাতাসে টুপটাপ ঝরে পড়ে উজ্জ্বল মেঘেদের তনুমন থেকে। তার ত্বকঘ্রাণ, চুলের দুর্বোধ্যতা, চোখ থেকে ঠিকরে পড়া প্রতারক ও মায়াবী আলো— আর অসমদৈহিক পুলক থেকে উৎসারিত সুরেলা শীৎকার, সংগীতের মতো ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে হতে, ছড়িয়ে পড়ছে দিগন্তের পর দিগন্তে—
অধরা, অনাস্বাদিত পংক্তির হাহাকারময়তায়, তীব্র কামনামদির সব কবিতা উছলে উঠে, ছলকে, ছিটকে পড়ছে: মাঠে মাঠে, দূর বনে, অচেনা যত নদীর তীরভূমিতে…
সম্ভোগদক্ষ কলমবাজেরা, আজ, নিখোঁজ হলে হে, কোথায়?