Author Picture

গোলাপের রাজতোরণ (পর্ব-৩)

বুলবুল সরওয়ার

এরপর গেলাম আয়না-ঘরে। এটিও আসলে পুরানো তেতলাহাভেলীর আয়না-ছাওয়া দেয়ালের যাদু!সবগুলো দরোজা-জানালায় বহির্মুখী আয়না লাগানো। বেশ মজা লাগলো আয়না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পুরো জয়পুরের প্রতিবিম্ব দেখতে। দূরের আমের ফোর্ট এবং নাহারগড় ফোর্ট দেখা গেল কবুতরের বাসার মত। সবুজ হেসে উঠে বললো—ঐটুকুন বাড়ি, ওর আবার এত নাম?
আমি তার চুল ধরে টান দেই: শয়তান ছেলে, তুই জানিস, আম্বর প্যালেস পৃথিবীর সুন্দরতম প্রাসাদের একটা? ওখানেই শুটিং হয়েছে পৃথিবী-বিখ্যাত ‘মুঘল ই আজম’ ছবি?
ও—সেটা। বলবে তো আগে। আব্বু বলেছিল, ওখানে হাতিতে উঠতে হয়। আমরা , অবশ্যই হাতিতে উঠতে চাই, মামা।

*
রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহ’র গড়া বিস্ময়কর মানমন্দির “যন্ত্রর মন্ত্রর” এ ঢুকলাম এরপর। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে সমাপ্ত এই মান মন্দিরে উনিশটি পরিমাপক যন্ত্র আছে। সবুজ সাথী দৌড়ে উঠতে চাইলো প্লেনের সিঁড়ির মত দেখতে ত্রিভুজের উলম্ব-বাহুর উপর। আটকে দিলো গার্ড।
কি জন্য এত কড়াকড়ি মামা?
এটি একটি ‘বিশ্ব-ঐতিহ্য’, সবুজ।
সেটা আবার কি?
ইউনেস্কো নামের একটি জাতি সংঘের সংস্থা—বিশ্বের সকল শ্রেষ্ঠ ও দরকারী প্রাচীন (ঐতিহ্যিক) নির্মানকে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের অধীনস্ত করে নেয়। এর ফলে অমর কীর্তিগুলো সংরক্ষিত হয় এবং মানুষ তার গুরুত্ব ও সম্মান বুঝতে পারে।
যেমন?
যেমন তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, দিল্লীর লাল কেল্লা, হায়দ্রাবাদের চারমিনার, আমাদের সুন্দরবন—এমন কত কি?
সুন্দরবন তো মানুষের বানায়নি, মামা—তা কেন নিলো?
বাঁচাবার জন্য। মানুষ না বানালেও, ধ্বংস তো করছে? সেটাওতো ঠেকাতে হবে।
হুহ্! তাচ্ছিলের শব্দ করল সবুজ—যে আমাদের মানুষ—জানোয়ারের অধম—তার হাত থেকে বাঁচাবে সুন্দর বন। আমি এসব কিচ্ছু বিশ্বাস করি না, মামা। তার চেয়ে সত্যি করে বলো—ঐসব সংস্থার নামে বিদেশীরা এসবের দখলে নিচ্ছে কিনা?
আমি হতভম্ব। ক্লাশে সিক্সে-পড়া ছেলের মুখে এসব কি শুনছি? কিভাবে যে ধ্বংস হচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম—কেউ জানে না।
কেউ জানতে চায়ও না, শালা বাবু। শালার মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম কেন—ভেবে এখন নিজেই অবাক হই। পুরো দেশের কোথাও একবিন্দু দেশপ্রেম নেই।
কিন্তু আপনি অন্তত দুটো ডিপ-সী শিপিং ট্রলারের মালিক হয়েছেন—দুলাভাই। নাহয়, সেটাই লাভ ধরুন।
দুলাভাই কোন কথা না বলে সরে গেলেন।

এই দুষ্কর শ্বাসরোধী ‘ইসলামী-সাহিত্য’ নিয়ে কত ব্যক্তি, কত মিটিঙে-মজলিসে দৌড়েছি—সেকথা হঠাৎ মনে করিয়ে দেন আমায় অন্নদাশংকর রায়—যিনি রেনেসাঁসের অন্যতম বাঙালী-ব্যাখ্যাকারী এবং গ্রন্থপ্রণেতারা।
তিনি আমায় বলেছিলেন, ইসলামী-সাহিত্য বলে কোনো কিছু হয় না; মুসলমানী হলেও হতে পারে।
কেন? আমি ফুঁসে উঠি।
তিনি হেসে বলেন, আমি কলকাতার চেয়ে পূর্ববঙ্গ বেশি চিনি বলেই বলছি: তোমরা অসহিঞ্চু ও রগচটা-মানুষ। সত্য এবং যুক্তির উপর সবসময়ই চাপাতে চাও আবেগ।

সবুজ আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলো—তাই কি মাদ্রাজ পড়তে এসেই বড়দের মত কথাবার্তা শিখেছিস?
কেন, এগুলো কি তোমার মনে জাগে না? যারা সারা পৃথিবী লুটে নেয়—তারা বুঝি নতুন কোনো ষড়যন্ত্র¿ করতে পারে না, না?
কৈ, না-তো—আমার তো তা মনে হয়নি।
মিথ্যা বলছ কেন, মামা? সাহিত্যিকদের মিথ্যা বলতে নেই—জানো না? তারা হচ্ছে জাতীর বিবেক।
আর বুদ্ধিজীবিরা?
জাতীর মগজ।
আর ডাক্তাররা?
হাতের পাঁচটা আঙুল।
আরেক হাত—?
পুলিশ।
আমি হো-হো করে হেসে উঠি। পিচ্চি দু-বছরেই এত কিছু শিখলো ক্যামনে?

‘দ্য হিন্দু’ পড়ি—বুঝলে মামা, ইন্ডিয়ার সবচেয়ে অভিজাত পত্রিকা। আঠারো শো আটাত্তরের পত্রিকা— তোমার ইত্তেফাক-ইনকিলাব না। প্রতি সপ্তাহে ওদের যে এক্সক্লুসিভ-উইকএন্ড স্পেশালস থাকে না, মামা—তা পড়লে সক্রেটিসের বউও এরিস্টোটল হয়ে যেত। দ্য-হিন্দু যে কারো জি-কে’র জন্য যথেষ্ট। আচ্ছা, মামা—অরুন্ধতী রায়কে চেন?
ঔপন্যাসিক তো? নামে চিনি। কেন?
দারুণ সত্যি লেখেন, মামা। সাহসীও খুব। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকার কোনো সাংবাদিক তার মত লিখতে পারবে না। চ্যালেঞ্জ , মামা! আচ্ছা, আমায় বলো তো—ইসলামী সাহিত্য কি? ভারত-জুড়ে এর বিপক্ষে কাঁদা ছোড়াছুরি চলছে গত কয়েক মাস।

আমি বোবা হয়ে যাই সবুজের প্রশ্নে। এই একটিমাত্র ‘শব্দ-বন্ধ’ আমার জীবনকে প্রায়-নষ্ট করে দিয়েছে। যে বেদনার-ভারে আমি বিশ্বময় ঘুরে বেড়াই, আর দেখি—দুনিয়ার কোন অংশটি খোদার নয়? সেভাবেই ইসলামী সাহিত্য খুঁজি আর ভাবি—পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে এভাবে ছোট করার আসলে উদ্দেশ্য কি? বাংলাদেশের বড় এক জনগোষ্টী ইসলামী-সাহিত্যের ‘মজমা’য় রমরমা-ব্যবসা ফেঁদে উদ্ভট-অলৌকিক কিচ্ছা-কাহিনী লিখে চলছে আর মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্ররা তারই তাল্বে-আলেম হয়ে সেই জিনিস টেনে জুমার-খুৎবা থেকে সুরেলা-ওয়াজ পর্যন্ত টেনে নিয়ে চলছে শ’-শ’ বছর ধরে। না তাতে আছে আধুনিক-ইকবাল, না বিদ্রোহী-নজরুল। ফররুখের মত রোমান্টিক-ঐতিহ্যিক-আধুনিক-কবিকে তারা রেনেসাঁর-কবি বলে—আদৌ রেনেসাঁসের কোন সংজ্ঞা না-বুঝেই। বাঙালী মুসলমানদের রেনেসাঁস একমাত্র নজরুল আর মুজতবা ছাড়া কারো হাতেই ঘটে-নি; একবিন্দুও না—অথচ এদের হাতেই নাকানী-চোবানী খাচ্ছেন কাজী-দা’রা জীবনভর। সাধে তো আর তিনি বলেন নি যে—
‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’

আমি বোবা হয়ে যাই সবুজের প্রশ্নে। এই একটিমাত্র ‘শব্দ-বন্ধ’ আমার জীবনকে প্রায়-নষ্ট করে দিয়েছে। যে বেদনার-ভারে আমি বিশ্বময় ঘুরে বেড়াই, আর দেখি—দুনিয়ার কোন অংশটি খোদার নয়? সেভাবেই ইসলামী সাহিত্য খুঁজি আর ভাবি—পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে এভাবে ছোট করার আসলে উদ্দেশ্য কি? বাংলাদেশের বড় এক জনগোষ্টী ইসলামী-সাহিত্যের ‘মজমা’য় রমরমা-ব্যবসা ফেঁদে উদ্ভট-অলৌকিক কিচ্ছা-কাহিনী লিখে চলছে আর মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্ররা তারই তাল্বে-আলেম হয়ে সেই জিনিস টেনে জুমার-খুৎবা থেকে সুরেলা-ওয়াজ পর্যন্ত টেনে নিয়ে চলছে শ’-শ’ বছর ধরে। না তাতে আছে আধুনিক-ইকবাল, না বিদ্রোহী-নজরুল।

এই দুষ্কর শ্বাসরোধী ‘ইসলামী-সাহিত্য’ নিয়ে কত ব্যক্তি, কত মিটিঙে-মজলিসে দৌড়েছি—সেকথা হঠাৎ মনে করিয়ে দেন আমায় অন্নদাশংকর রায়—যিনি রেনেসাঁসের অন্যতম বাঙালী-ব্যাখ্যাকারী এবং গ্রন্থপ্রণেতারা।
তিনি আমায় বলেছিলেন, ইসলামী-সাহিত্য বলে কোনো কিছু হয় না; মুসলমানী হলেও হতে পারে।
কেন? আমি ফুঁসে উঠি।
তিনি হেসে বলেন, আমি কলকাতার চেয়ে পূর্ববঙ্গ বেশি চিনি বলেই বলছি: তোমরা অসহিঞ্চু ও রগচটা-মানুষ। সত্য এবং যুক্তির উপর সবসময়ই চাপাতে চাও আবেগ।
আমি বলি, ওসব ধানাই-পানাই ছেড়ে ব্যাখ্যা দিন।
তিনি বললেন, আচ্ছা উল্টোভাবে ভেবে দেখ তো। বলো, হিন্দু-সাহিত্য কোনটা?
কেন—গীতা রামায়ন—এসব?
না-না, ভুল করছো তুমি—ডাক্তার। ওসব হলো ধর্মের বই। সাহিত্য হলো সৃজনশীল বেদনা বা জীবন-নদীর উপাখ্যান। নীতিকথা সেখানে থাকতে পারে, কিন্তু তা শিল্পকে ক্ষুন্ন করে নয়।
যেমন?

যেমন তোমাদের ‘কিমিয়ায়ে সা’দাত’ বা রুমির ‘মসনবি’। বা ওরকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে—মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ বা গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’। এসব আবেগে-থলেথলে হলেও কিন্তু সাহিত্য। হিন্দুয়ানী বলে যদি মহাভারতকে বাদ দাও, তাহলে তো সাহিত্য বলে কিছুই থাকবে না।
আমি কিছু বলতে যেয়েও থেমে যাই—কারণ, প্রখ্যাত দার্শনিক দেওয়ান মেহাম্মদ আজরফ একবার আমায় বলেছিলেন: কয়েকটা মাত্র “হারাম” বাদ দিয়ে বাকী বিশ্বের সবই ইসলাম। সৈয়দ আলী আহসান বলেছিলেন: পৃথিবীর কোথাও এমন একটি মসজিদ দেখাতে পারবে না—যেখানে টয়লেট নেই। ফটোগ্রাফাররা কি তার কোনো ছবি তোলেন? পুলিশ তুললে তুলতেও পারে; কারণ—গোয়েন্দাগিরিতে অনেক নোংরা প্রমাণও দেখা লাগে। সুতরাং তোমাকে বলছি—সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল, ইসলামী-অনৈসলামিক ভেদ টেনো না। আর পুলিশ হওয়াটাও শিল্পীর কাজ নয়।

হিন্দু-সাহিত্য বা ইসলামী-সাহিত্য সত্যিই আমাকে বিভ্রান্ত করে। কারজাভীর যে-সব বই সারা বিশ্বে আদৃত—তাতো আসলে তাফসির বা ইজমা-কিয়াস। কোরান হাদিস তো আকর গ্রন্থ। আরব্য উপন্যাসের পাশে মোকসেদুল মোমেনিন রেখে আমি বহুদিন চুপচাপ বসে ভেবেছি—এ আসলে কী? আজও সে-রকম সবুজের সামনে নি:শ্চুপ হয়ে গেলাম। ছোটেদের ভূতের গল্প শেখাতে নেই!
পাঁচটি বড় শহরে রাজা জয়সিং তার এই যন্ত্রর মন্ত্রর তৈরি করেন- জয়পুর, দিল্লী, উজ্জয়ীনি, মথুরা এং বেনারসে। এর মধ্যে জয়পুরের এই যন্তরমন্তরের খ্যাতি সর্বাধিক। কারণ, এখানে রয়েছে চৌদ্দটি ‘যন্ত্রর’, যা সেই ‘মন্তর’ জানে—যার দ্বারা অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, ধ্রুবতারার অবস্থান, সূর্যের উচ্চতা, দিন-ক্ষণ-সময় এবং কাল ে মহাকাল নিরুপন করা সম্ভব। এখানকার সান-ডায়ালটি (সূর্যঘড়ি) পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম। আষ্টআশি মিটার উচ্চতার ‘বিরাট সম্রাট-যš’ও বিস্ময়কর। চক্র, যন্ত্র, দক্ষিণ-ভিত্তি যন্ত্র, দিশা যন্ত্র, ধ্রুবতারা নির্ণায়ক এবং রাশি-বলয় যন্ত্র সাথী—সবুজের বেশি ভালো লাগলো।
আমি শুধু অবাকই হলাম একজন রাজার এই অত্যাশ্চার্য বিজ্ঞান-চর্চা দেখে। আওরঙ্গজেব ঠিকই মানুষ চিনেছিলেন!
সানডায়ালের নিচের গোলক তামায় দাগাংকিত। খালি চোখেই পরিষ্কার দেখা গেল, প্রতি মিনিটে ছায়া ৬ সেমি করে সরছে। সবুজ তিনবার তার ঘড়ি মিলিয়ে সানডায়ালের চূড়া থেকে চিৎকার করে উঠলো- আব্বু, ডিসিশান ফাইনাল—ইঞ্জিনিয়ারিং। দুলাভাইর মুখে তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়লো ।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সিটি প্যালেস—রাজবাড়ি। বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের গড়া এই প্রাসাদ এককথায় বিশাল।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সিটি প্যালেস—রাজবাড়ি। বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের গড়া এই প্রাসাদ এককথায় বিশাল। মূলত দুটি প্রাসাদ এখানে—‘চন্দ্রমহল’ এবং ‘মুবারক মহল’। চন্দ্রমহলের বড় অংশ এখনও আবাসিক—জয়পুরের রাজপরিবার বাস করেন। বাকী অংশ যাদুঘর—মানে দর্শনালয়।
নৈহাটির যাদুকর-নির্মাতা বিদ্যাধর জয়পুর শহরের প্রধান-স্থপতি ছিলেন। বাস্তু-শাস্ত্র, পশ্চিমী-নির্মান এবং মোঘল-শিল্পকলা এবং পারসিকদের রাজসিক নির্মাণের সমন্বয় করেন তিনি এই প্রাসাদ ও শহরে। প্রাসাদের কোন কোন তোরণ—লাল-কেল্লাকে স্মরণ করিয়ে দেয়; যার দেয়ালে রয়েছে ভারতীয় ঐতিহ্যের অসংখ্য ‘খিড়কী’।

মহারাজা দ্বিতীয় জয় সিং ১৬৯৯ থেকে ১৭৪৩ পর্যন্ত জয়পুর, আমের, বিকানের ও উদয়গড়ের রাজা ছিলেন। তৎকালীন রাজধানী আমের থেকে মাত্র ১১ কিমি দূরে তিনি এই শহর নির্মাণ করেন মূলত নাগরিক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ফলে পানির অভাব দেখা দেয়ায়। বিদ্যাধর তার নির্মানজ্ঞান কাজে লাগিয়ে পুরো শহরকে ৯টি ব্লকে ভাগ করেন—যার মধ্যে দুটি হবে সরকারের প্রশাসন ও বাসস্থান। বিশাল রাস্তা ও প্যাভেলিয়ন গড়ে তোলা হয়—যার সব প্রান্তমুখে রয়েছে একেকটি বড় তোরণ। তার নাতী মহারাজা রাম সিং ১৮৭৬ এ ভারত ভ্রমণে আসা প্রিন্স অফ ওয়েলসকে স্বাগত জানাতে পুরো শহর এবং রাজ প্রাসাদকে গোলাপী রঙে রাঙিয়ে দেন। হিন্দু বাস্তুশাস্ত্রে যার অর্থ: স্বাগতম!

দ্রব্যভতী নদীর পানি টেনে এনে গড়া হয় রামগড় লেক—যার ঠিক মধ্যখানে রাজহংসীর মত দাঁড়িয়ে আছে জলমহল। আমরা গত রাতে যেখানে থেমেছিলাম। সেই একই রাস্তা—ডানে জলমহল এবং বামে তারকা হোটেলের সারি রেখে গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে চললো আম্বর ফোর্টের গোড়ায়।
নেমেই বিচিত্র সুরের পাখির ডাকে সবুজ-সাথী চমকে ওঠে—মা, দেখ-দেখ, ময়ূর। এক-দুই-তিন—না, গুনে শেষ করা যাবে না—এত শত। পেখম-মেলা এই-পাখি বর্ষায় যত সুন্দর; অন্য সময়ে তেমনি কুৎসিত। পালকবিহীন অবস্থায় দেখছি বলে—নাকি, গলার স্বর বিশ্রি কর্কশ বলেই এ-রকম বৈসাদৃষ্য লাগছে কিনা, কে জানে!
রাজস্থানের রাষ্ট্রিয় প্রতীক—ময়ূর।

আমরা হাতির হাওদায় বসে দোল খেতে-খেতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠতে লাগলাম। নিচে পানির ভেতর দুর্দান্ত ডিজাইনে গড়া এক বাগান। ছবি তুলতে যেয়ে উল্টে পড়ে প্রায় মরি আর কি! সবুজ সতর্ক ছিল। যথাসময়ে—উল্টে যাবার আগ মুহুর্তে—মামাকে টেনে না ধরলে নির্ঘাত মৃত্যু হতো আমার। সাথীর দুষ্ট-চোখ ভয়ে বিস্ফারিত—সবুজ তাকে ফিসফিসিয়ে বলে: আব্বু-আম্মাকে বলিস না। তারপর, ঠোঁটে আঙুল রেখে শিষ দেয়—শ-শ-শ।
আমরা হাসি।
হাতি হেলেদুলে উপরে উঠছে আর দূরের পিংক সিটি-জয়মহল বড় হয়ে উঠছে।
মামা-মামা, ঐ যে ট্রায়াংগলের মত দেখতে—ঐটাই তো যন্ত্রর মন্তর; আর পাশেই হাওয়া মহল—তাই না?
হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছিস। তোর চোখ তো খুবই শার্প। শূটার বা পাইলট হতে পারবি।

দ্রব্যভতী নদীর পানি টেনে এনে গড়া হয় রামগড় লেক—যার ঠিক মধ্যখানে রাজহংসীর মত দাঁড়িয়ে আছে জলমহল। আমরা গত রাতে যেখানে থেমেছিলাম। সেই একই রাস্তা—ডানে জলমহল এবং বামে তারকা হোটেলের সারি রেখে গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে চললো আম্বর ফোর্টের গোড়ায়।
নেমেই বিচিত্র সুরের পাখির ডাকে সবুজ-সাথী চমকে ওঠে—মা, দেখ-দেখ, ময়ূর। এক-দুই-তিন—না, গুনে শেষ করা যাবে না—এত শত। পেখম-মেলা এই-পাখি বর্ষায় যত সুন্দর; অন্য সময়ে তেমনি কুৎসিত। পালকবিহীন অবস্থায় দেখছি বলে—নাকি, গলার স্বর বিশ্রি কর্কশ বলেই এ-রকম বৈসাদৃষ্য লাগছে কিনা, কে জানে!

বিশাল গেট পেরিয়ে বিশালাকার হাতি-চত্বরে এসে থামলো। সামনেই আম্বর বা আমের প্যালেসের প্রকান্ড শাহী দরোজা। আমরা ঢুকেছি সূর্য তোরণ দিয়ে।
হাতি এক আশ্চর্য প্রাণী। আদি কাল থেকে তিনটি প্রাণী পৃথিবীর মানুষকে ভয়াবহ ভাবে সাহায্য করে আসছে—হাতি, ঘোড়া, উট। যুদ্ধ, নির্মাণ, পরিবহন—কোন্টায় এদের অবদান কম? তবে এদের মধ্যে হাতির উপকার বিস্ময়কর রকম বেশি। পিরামিড গড়া থেকে শুরু করে মোঘলদের বাঙলা জয়— সবটাতেই হাতিরই ছিল মূখ্য ভূমিকা।
আস্তে হাঁটু গেড়ে বসার পর আমরা টেনে-আনা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। মাহুতের নির্দেশে হাতি দুলাভাইকে স্যালুট জানালে—দুলাভাই পাঁচশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলেন—বকশিশ!
মাহত নিজেই প্রণাম করে বললো: খোদা, আপকো রাজা বানায়গা, হুজুর—।

মোঘলদের ঐতিহ্য মাফিক আমের ফোর্টও লাল বালু-পাথরের নির্মাণ। এর প্রধান আকর্ষণ দরবার-ই-আম, শিশ মহল (আয়নাঘর), জয় মন্দির এবং সুখ নিবাস।
এখানকার রাজাই ছিলেন মানসিং, মামা? ঐ-যে—যিনি বঙ্গবীর ইসা খাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন?
হুম্ম।
এটাতো আকবর দ্য গ্রেটের সময় তাই না, মামা?
হুম্ম।
কি হুম-হুম করছো হুতুম প্যাঁচার মত। বলো—এই পাহাড়ের নাম কি?
আরাবল্লী।
আম্বর কি কারো নাম, মামা?
না, তবে অম্বা হচ্ছে দেবী দুর্গার মা। এদের ভক্তি-মাতা হচ্ছেন আম্বা—স্থানীয় নাম শিলা-দেবী। কালিরই আরেক নাম এটি।
টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম সবাই। দুলাভাইর প্রধান আকর্ষণ শীশ মহল—সারা পথেই গেয়েছেন—পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া।

বিশাল সিঁড়ি বেয়ে তিনি যেন দৌড় লাগালেন। আমি তার হাত টেনে ধরে বললাম: দুলাভাই, আস্তে। আপনি হার্টের রোগী। তিনি আমাকে কষে ধমক দিয়ে বললেন। জয়রাজ রিলিজের সময় বলে দিয়েছেন—‘দ্য মোর ইউ সেক্স অ্যান্ড দ্য মোর ইউ এক্সারসাইজ—দ্য মোর ইউ বি হেলদি।’ তোমার সামনেই তো বলেছে, শালাবাবু—ভুলে গেছ?
না, দুলাভাই—ভুলিনি। তবে তার মানে তো এই নয় যে যত্রতত্র তা করতে হবে।
আরে, শালা বাবু—আমি তো সেক্স করছি না, জগ করছি। তাও মানা?
বলতে বলতে আমরা মূল গেটে এসে পৌঁছলাম। প্রধান এই দরোজার নাম গনেশ-পোল। বিশাল কাঠের তিন-প্যানেলে অতুলনীয় সিলভার ও ব্রোঞ্জের কারুকাজ। আমার মনে পড়ে যায় হযরত সোলেমানের কিসসা…।

 

চলবে…

আরো পড়তে পারেন

আগ্নেয়গিরি থেকে পায়ে হেঁটে বেস-ক্যাম্পে ফেরা

ইথিওপিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে ‘অ্যারতে-আলে’ নামে লাভা উৎক্ষেপণে প্রজ্বলিত একটি আগ্নেয়গিরি। আমরা বেশ কয়েকজন পর্যটক আজ জোট বেঁধে, একটি ট্যুর কোম্পানির গাইডের তত্ত্বাবধানে ওই আগ্নেয়গিরির পাশের একটি লাভা-হ্রদের পাড়ে ক্যাম্পিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। ওখানে যেতে হলে প্রথমে একটি বেস-ক্যাম্পে এসে প্রস্তুতি নিয়ে ট্র্যাক করতে হয় ঘণ্টাকয়েক। বেস-ক্যাম্পে পৌঁছানোও ঝকমারি বিশেষ, আমরা ঘণ্টাকয়েক ল্যান্ডরাবারে প্রায়-দুর্গম এক….

মনে করি আসাম যাব

আফ্রিকার মাসাইমারা সাফারিতে যাওয়ার পর আর কোনো বড় সাফারিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অপর্না সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সিনেমাতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার চরিত্রে রাহুল বোসের মুখে কাজিরাঙার কথা শোনার পর এ রিজার্ভ ফরেস্টে সাফারি করার ইচ্ছা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির খুব কাছের এ জায়গাটাতে যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়, আমাদের উত্তর পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আর….

শিল্পের দেশে সৌন্দর্যের দেশে

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভেনিসে পা রেখেছিলাম এক রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দুপুরে। যাত্রীবোঝাই পাবলিক বাসে চেপে যাত্রা করলাম সেন্ট মার্কোসের উদ্দেশে। সেন্ট মার্কোসে অবস্থিত বিখ্যাত স্থাপত্য ক্যাথেড্রাল। ক্যাথেড্রালের চারদিকের দেয়াল সুসজ্জিত কারুকার্যে খচিত। চিত্রকর্ম ও অক্ষরে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন কাহিনি মুগ্ধতা তৈরি করে। এখানেই ভেনিসের প্রাণভোমরা, সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানেল যা যুক্ত করেছে শতাধিক জলরাশিকে। বিশাল খাল ভেনিসকে….

error: Content is protected !!