Author Picture

গোলাপের রাজতোরণ (পর্ব-২)

বুলবুল সরওয়ার

কাজলকে দেখে প্রথম নাক সিঁটকালেন দুলাভাই। মা-তনুজা বা খালা-নূতন এখনও দুর্দান্ত রূপসীআর মেয়েটা এমন নিগ্রো-নিগ্রো কেন?
আপা ঝামটা মারলেন: অভিনয় দেখ, মেয়েদের রূপটাই বড় হলো? তোমার প্রিয়-ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র সুপ্রিয়া তো এরচেয়ে কালো; তার বেলা?
আরে সেটা বুঝাইনি আমি—আমার বউয়ের পাশে তো আমাকে রাজ্জাক না-হলেও চলে; কিন্তু কাজলকে তো শাহরুখের সাথে মানাচ্ছে না—তাই বলছি!
আপা তার স্বভাববিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় হেসে উঠলেন: ও—তাহলে জনাব এদ্দিনে বুঝেছেন যে তিনি নায়করাজ রাজ্জাক নন?
আশে পাশের দর্শকরা বিরক্ত হচ্ছে দেখে আমি দুলাভাইর হাতে মৃদু চাপ দেই। লজ্জা পেয়ে বুড়ো দম্পতি শেষ পর্যন্ত থামে।
ততক্ষণে পর্দায় সীমাহীন ফুলের বাগানে বসন্ত এসে দোল খাচ্ছে। পুরো হল মন্ত্রমুগ্ধ। ললিত-জতিনের সুর আর আনন্দ বকশীর কথায় যাদু ঢেলেছেন লতাজী-আশা অভিজিত-উদিত-শানু। ডোলি সাজাকে রাখ-না—গানের সাথে যেন পুরো হল দুলে উঠলো। প্রেমের চিরায়ত এই-রূপ আজকালকার সিনেমা থেকে সরে গেছে দেখে দর্শকও চলে গেছে হল ছেড়ে—বেশিরভাগ পরিচালকই এই সত্যটা ধরতে পারে না বলেই শত শত ছবি মুখ থুবড়ে পড়ছে।

ছবিটা সবারই মন ভালো করে দিলো। শুধু ‘মেরে, খাবও সে যো আয়ে—’ গানটির চিত্রায়নে আপা একটু আপত্তি কবলেন: কাজলের মত অভিনেত্রীর খোলা- মেলা হবার কি দরকার ছিলো? মোটেও মানায় নি।
আরে, দর্শক কি সব তোমার-আমার মত বুড়োবুড়ি নাকি? শালা বাবুদের কথাও তো চিন্তা করতে হবে, নাকি?
আচ্ছা—ঠিক আছে ঠিক আছে—মেনে নিলাম!
আপার এত ভালো মেজাজ সচরাচর দেখা যায় না। দুলাভাই সুযোগটা কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দেরী করলেন না। বললেন: টেক্সি নিয়ে শহরটা একটা চক্কর দেই?
সবুজ-সাথী লাফিয়ে উঠলো: চলো আম্মু, চলো-চলো।
টেক্সি নিলাম বড় দেখে। সাথী সামনের সিটে আমার কোলে এসে বসলো। সবুজের তাতে গোস্যা। দুলাভাই তাকে সামলালেন—বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখিয়ে-দেখিয়ে।

জয়পুর শহর পুরোটাই অন্যরকম। পুরানো শহরটিমধ্যযুগীয় নগরীর মত দেয়াল-ঘেরা—পুরোটাই পরিকল্পিত—বাইরের অংশ: এক্সটেন্ডেড জয়পুর আধুনিক—অন্যান্য মেগা-সিটির মতই। প্রতিতুলনা করলে মানতেই হয়—পুরানো শহর একটু চাপা হলেও সেটাই বেশি রূপসী, কিন্তু বাইরের অংশ পশ্চিমা-নর্তকীর মত: খোলামেলা!
দুলাভাই ফোঁড়ন কাটলেন, সেই বংকিমের রোহিনী-ভ্রমরের মত ব্যাপার—জোয়ার জাগে ঠিকই, কিন্তু প্রেম জাগে না—তাই না, শালা বাবু।
এান-সাগরের পানির মধ্যে ঝলমলানো জলমহলের সামনে গাড়ি থামালো ড্রাইভার। স্যার, একটু নামুন। রাজা জয় সিংয়ের এই অমর কীর্তি বিশ্বে বিরল। দেখে নিন। ছবি নিন।

জয়পুর শহর পুরোটাই অন্যরকম। পুরানো শহরটিমধ্যযুগীয় নগরীর মত দেয়াল-ঘেরা—পুরোটাই পরিকল্পিত—বাইরের অংশ: এক্সটেন্ডেড জয়পুর আধুনিক—অন্যান্য মেগা-সিটির মতই। প্রতিতুলনা করলে মানতেই হয়—পুরানো শহর একটু চাপা হলেও সেটাই বেশি রূপসী, কিন্তু বাইরের অংশ পশ্চিমা-নর্তকীর মত: খোলামেলা!

শুনে খুবই বিস্মিত হলাম যে প্রাসাদটি পাঁচ তলা। আমাদের চোখে পড়ছে মাত্র দু-তলা। বাকী অর্ধেক নাকি পানির নিচে। চার কোনায় চারটি ডোম-মিনার। মাঝে কুঁড়েঘর টাইপের মেইন ডোম। ড্রাইভার জানালো: ওটি বেঙ্গল-ডোম, স্যার?
বেঙ্গল-ডোম মানে?
মানে বেঙ্গলে নাকি ঐ রকম ঘর আর ছাদ আছে, তাই।
বুঝলাম—রাজা মানসিংহের কারণে আমাদের এই খড়ের কুঁড়েঘর ঠাঁই পেয়েছে পশ্চিম ভারতের বিজন প্রান্তরে।
এই লেকটা কত বড়, ড্রাইভার সাহেব?
লম্বায় আট কিলো আর চওড়ায় সাড়ে তিন।
এই রাজা মান সিংহই তো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার গভর্নর ছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ, তাই। তার মেয়ে ছিলো যুবরাজ দারা শিকোহ’র স্ত্রী। তিনিই বেঙ্গলের মহারাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে ‘শিলাদেবী’ মূর্তি নিয়ে আসেন জয়পুরে। আম্বর ফোর্টে এখনো সেই দেবী-মূর্তি বিদ্যমান।
আধা-চাঁদকে সঙ্গে করে আমরা হোটেলে ফিরি। ড্রাইভার ভালো-মানুষী দেখিয়ে শহরের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলিও ঘুরিয়ে নেয়—হাওয়া মহল, যন্তর-মন্তর, বিরলা মন্দির, সেন্ট্রাল মিউজিয়াম; এবং দূর থেকে সিটি প্যালেস এবং চন্দর মহলসহ ‘মেইন বাজার’। আমরা তাকে নির্ধারিত মূল্যের উপর দুশো টাকা বখশিশ দিলে,সে কালকেও আমাদের ‘গাইড-কাম-ড্রাইভার’ হবারপ্রস্তাব দেয়। দুলাভাই সানন্দে সম্মতি দেন।
‘সকাল সাড়ে আটটায় আসবো আমি’—গুরুদেব চৌহান বিদায় নেয়, স্তম্ভিত আপার পায়ের ধূলা মাথায় নিয়ে—‘মাঈজী, আপনি লক্ষ্মী আছেন—দোয়া কিজিয়ে।’
পাথুরে দেবীও টলে গেল গুরু চৌহানের অর্ন্তদৃষ্টিতে। চোখে জল বেরিয়ে এলো তার।

হোটেলটার বাঙালীয়ানা যথেষ্ট। দুলাভাই মজা করে বললেন সবুজকে: জানিস বেটা, সত্যজিত তার ‘সোনার কেল্লা’ ছবি করার সময় যাত্রাবিরতীতে এখানেই খেয়েছিলেন?
হুম্ম—তোমাকে বলেছে।
সাথী মুখ টিপে হাসছে দেখে দুলাভাই তার মাথার ঝুটি নাড়িয়ে বললেন: বুড়িটাকে তো আজ দারুণ দেখাচ্ছে—একেবারে কংকাবতী।
কংকাবতী কে, আব্বু?
মামাকে জিজ্ঞাসা করো—সে তো ঐসব দুষ্টুদের নিয়েই থাকে সারা দিন।
বল মামা, কংকাবতীর গল্প বলো।
আওে গল্প না, সে হচ্ছে রবিঠাকুরের কবিতা—যেখানে রাজকন্যার চেয়ে তার সতালু বোন বেশি সুন্দরী ছিল। সেই সুন্দরী বোনের নাম ছিল কংকাবতী। কবিগুরুর লাইনগুলো ঠাকুরমার ঝুলির চেয়েও মজার—
রাজকন্যা কংকাবতী সতীনের মেয়ে
এ ধরায় রূপসী সে সকলের চেয়ে।
দারুণ! তারপর?
তারপর, আলু-পরোটা আর চানা-গোবী এসে গেল…গল্প বলার ঝক্কি ফুরোলো।

পাঁচ তলার উপরে উঠতেই দুটো জিনিস চোখে পড়লো—দূরের আম্বর প্যালেস, আর চোখের সামনেইজয়সিংমানমন্দির।

রাজস্থান-পাঞ্জাবে আলু-পরোটা প্রধান নাশতা। দুই লেয়ার ময়দার মাঝে আলুর পুর দিয়ে ঘিয়ে ভাজা হয়এই পরোটা। খেতে বেশ সুস্বাদু। চাটনী বা সালাদ দিয়েই স্থানীয়রা বেশি খায়। বাইরের লোকেরা খায় মাংস, নিরামিষ বা মিষ্টি সহযোগে। সবুজ-সাথী বেশ আগ্রহ সহকারে খেল। আপাও নিন্দামন্দ করলেন না।
ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাইরে এসে দেখি চৌহান তার গাড়ি নিয়ে হাজির। সিক্স সিটার গাড়িটা বেশ ঝকঝকে। দুলাভাইর মন শরীফ হয়ে গেল।
প্রথমেই আমরা গেলাম চান্দপোল-গেটে। শহরের প্রধান প্রবেশ পথ এটি। সেই ১৭২৭এ রাজা জয়সিংহের হাতে গড়া এই বুলন্দ-গেট। বাকী দরোজাগুলোও চমৎকার। চৌহান জানালো: মোট সাতটি গেট এই পুরানা শহরে—সূর্যপোল, আজমের, নিউ গেট, সাঙ্গানেরী, ঘাট, সম্রাট ও জোরবার সিং গেট।

এই রাজা জয় সিংহেরই তো আরেক নাম সোয়া-জয় সিং—তাই না, চৌহান?জ্বী-হ্যাঁ।তখন তিনি আম্বরের রাজা। সেটাই বর্তমান জয়পুর। মাত্র এগারো বছর বয়সে জয়সিং সিংহাসনে বসেন। পরিণত বয়সে তার বুদ্ধিমত্তা ও বিজ্ঞানমনষ্কতায় সম্রাট আওরঙ্গজেব এত খুশি হন যে তাকে সোয়া (মানে এক-পূর্ণ চারের-এক) উপাধী দেন—গণিত, স্থাপত্য বিদ্যা এবং জ্যোতিবির্দ্যায় জয়সিংয়ের বুৎপত্তি ও প্রজ্ঞা দেখে। বলা হয়, তিনি ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর সেরা পন্ডিত আর তাকে তুলনা করা হয় পারস্যের কবি ওমর খাইয়ামের সাথে। কারণ, জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনিই ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ।
কি ভাবে বুঝলে?
আরে, খৈয়ামই তো প্রথম গ্রেগরী-সনের খুঁত সারান, স্যার।
খুলে বলো দেখি, ভাই। আমি কৌতূহলে ঘন হয়ে বসি।

গ্রেট সেলজুক সুলতান প্রথম মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নিযামুল মুলক (আল তুসী)। তিনি, থৈয়াম আর হাসান সাবাহ ছিলেন তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কৈশোরে এই তিন-বন্ধু এক অদ্ভুত অঙ্গীকার করে যে, তাদের মধ্যে যে আগে সৌভাগ্য লাভ করবে, সে তা অন্য দু-বন্ধুর মধ্যে ভাগ করে দেবে। হাসান তুসি (নিযামুল মুলক-প্রধানমন্ত্রী) পদে আসীন হবার পর ওয়াদা-পূরণার্থে দু-বন্ধুকে ডেকে নেন। হাসান নিলেন মন্ত্রীত্ব আর খৈয়াম চাইলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে গবেষণার সুুযোগ। পরে হাসান দরবারর থেকে অসততা, স্বেচ্ছাচার ও হিংস্রতার অভিযোগে বিতারিত হন এবং খুনীদেও সম্রাট নামে মধ্যপ্রাচ্যের মহা-আতংক হয়ে ওঠেন। এদিকে, দীর্ঘ আঠারো বছরের সাধনায় ওমর খৈয়াস সেন্ট-গ্রেগরীকে হারিয়ে জালালী-সন প্রবর্তন করেন।
জালাল কার নাম?
প্রথম মালিক শাহের উপাধী বা তখল্লুস ছিল জালাল।
ও—তাই বলো।
জালালী পঞ্জিকার শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়, বলব-স্যার?
নিশ্চয়ই বলবে।
গ্রেগরী পদ্ধতিতে কাল গণনায় প্রতি তিন-হাজার বছরেএক-দিনের গড়মিল ছিল। খৈয়াম ও তার দল সূর্যের পরিক্রমাকে আরো নিখুঁত বিশ্লেষণ করে এটিকে এমন যথাযথ করেন যে—ঐ এক-দিনের গড়মিল পাঁচ হাজার বছরে গিয়ে দাঁড়ায়! খুশি হয়ে সম্রাট কবিকে পুরস্কৃত করেন এবং নতুন গণনা-পদ্ধতীর নাম রাখা হয়: সম্রাটের তখল্লুসে—জালালী-সন।
দারুণ তো, চৌহান। কিন্তু তুমি এসব জানলে কিভাবে?
গাইড যে আমি জয়পুরের। ফরেনাররা এসব জানতেই বেশি আগ্রহী। অক্ষাংশ, দ্রাঘিমার হাজারো প্রশ্নে জান কাবাব কওে দেয়। এভাবেই রিপিট-অ্যান্ড-কারেক্ট পদ্ধতিতে শিখে নিয়েছি।
বাহ্।

১৭০৭এ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুতে মারাঠারা আবার জংলী হয়ে ওঠে। কিন্তু জয়সিংপেশোয়া বাজী-রাওকে একাধিকবার পরাজিত করায় পেশেয়া দক্ষিণ ভারতে সরে গিয়ে নিযামের হায়দ্রাবাদ দখল করে বসে। দিল্লীর মুঘল সুলতানদের প্রতাপশালী সম্রাটেরা সবাই তদ্দিনে মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। উপরে যারা ছিলেন—অর্থাৎ রাজপুত্ররা—ভোগবিলাস আর আত্মহননে মগ্ন। অনেকেরই মহল হয়ে দাঁড়ালো আনন্দকুঠি। পেশোয়া সে সুযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লো দিল্লী-আগ্রার উপর। জয়পুরও বাদ গেল না। রাজা জয়সিং তো আগে থেকেই জান-কা-যবন। কিন্তু ভঙ্গুর-মোঘলদের চেয়ে তখনো তিনি ঢের বেশি শক্তিধর। জয়পুরতো আছেই, সাথে তার রাজ্য বিস্তৃতও হয়েছে তদ্দিনে। বাঙ্গালী স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যকে তিনি বিপুল স্বাধীনতা দিয়েছেন নিজের নামে রাজধানী গড়তে। আম্বর প্যালেস আরো সুন্দরী হয়ে উঠলো দক্ষিণ পাশেই লেক ও গোলাপী ইমারত গড়ে ওঠার সুবারদ।

গ্রেগরী পদ্ধতিতে কাল গণনায় প্রতি তিন-হাজার বছরেএক-দিনের গড়মিল ছিল। খৈয়াম ও তার দল সূর্যের পরিক্রমাকে আরো নিখুঁত বিশ্লেষণ করে এটিকে এমন যথাযথ করেন যে—ঐ এক-দিনের গড়মিল পাঁচ হাজার বছরে গিয়ে দাঁড়ায়! খুশি হয়ে সম্রাট কবিকে পুরস্কৃত করেন এবং নতুন গণনা-পদ্ধতীর নাম রাখা হয়: সম্রাটের তখল্লুসে—জালালী-সন।

ওদিকে আওরঙ্গজের জ্যৈষ্ঠ পুত্র হেরে গেছেন বৈমাত্রেয় ভাই বাহুদুর শাহ’র কাছে।
বাহাদুর শাহ আবার রাজা জয়সিংকে দেখতে পারেন না। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল পুরানো মিত্রদের সাথে। কিন্তু জয়সিং হারলেন না। বরং আওরঙ্গেজেবের দ্বিতীয় পুত্র বাহাদুর শাহ’র অযথা ঔদ্বত্ব্যের সমুচিত জবাব দিয়ে তিনি তার রাজ কেআরো সুসংহত ও নিরাপদ করলেন। তার সেই শক্ত অপরাজেয় হাতকে কেউ কখনো শিথিল করতে পারেনি—না মারাঠা-জাঠ, না আহমেদ শাহ আবদালী। ব্রিটিশরাও জয়পুরকে মর্যাদা দিয়েছিলো সেরা প্রিন্সলি-স্টেটের।

১৮৭৬এ রাজা রাম সিং প্রিন্স অভ ওয়েলসকে চমকে দিতে পরিকল্পিত এ-নগরীকে রাঙিয়ে তুললেন সোনালী-হলুদ রঙে। তখন থেকেই এর নাম হলো পিংক সিটি। গোলাপী শহর।
প্রথমেই ঢুকলাম ‘হাওয়া মহলে’। সাত তলা এই বিচিত্র ভবনটি আসলে অসংখ্য কুলুঙ্গি বা ঝরোকার সমষ্টি। এমন কৌশলে বানানো যে উপরের তিনটি তলার যেখানেই আপনি দাঁড়ান বা বসেন—ঝিরিঝিরি বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেবে। সামনের রাজপথ দিয়ে রাজা যখন যুদ্ধ জয় করে কিংবা রাজ্য পরিভ্রমণ শেষে ফিওে আসতেন—রানীরা এখানকার ঠান্ডা বাতাসে বসে উপভোগ করতেন স্বামীর বীর্যবত্তা ও শৌর্য। ড্রাইভার জানালো: ৯৫০টি জানালা বা ঘুলঘলি আছে মহলে। পৃথিবীর কোথাও এর কোন সতীন নেই।
পাঁচ তলার উপরে উঠতেই দুটো জিনিস চোখে পড়লো—দূরের আম্বর প্যালেস, আর চোখের সামনেইজয়সিংমানমন্দির।
মনিমন্দির কি, মামা?
দূর অবলোকন কেন্দ্র, মামা।
সহজ করে বলো।
যেখান থেকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়।
মানে টেলিস্কোপ-হাউস?
তুই তো সেই অদ্ভুত রিকশাওয়ালার ঢঙে কথা বললি—যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চেনে না, কিন্তু ইউনিভার্সিটি চেনে। বাহ্ বেশ।
তার মানে তুমি জানো না, তাই তো?
জানি রে বাবা, জানি। অবজাভেটরী মানে হলো সূর্যালোকের বিপরীত ছায়াকে নিরীক্ষণ করে সময়েরহিসাব করা আর রাতের নক্ষত্রপুঞ্জকে অনুসরণ করা। দূরবীণ, মা-দূরবীণ, আলো-ছায়া ইত্যাদি সেই লেন্স আবিষ্কারের পর থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, ওমর খৈয়াম, রাজা জয় সিং—এরা সবাই মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী। শুধু সূর্যকেই এরা পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করেন নি। বিভিন্ন গ্রহ এবং চাঁদকেও আমলে নিয়েছেন।
তো, অত বড় সিঁড়ি কিসের?

ওটাই ছায়া-মাপক যন্ত্র। গিয়ে দেখ, ওর গোড়ায় আছেপাথুরে অর্ধগোলক। নিপুন নিয়মে দাগ কাটা। ঐ মিসাইলের মত যে সিঁড়ি দেখছিস—ওর ছায়া যেখানে পড়ে—সেখানেই ‘টাইম’ লেখা আছে। ওরই আরেক নাম সুর্য-ঘড়ি। কাছে যেয়ে দেখিয়ে দেব, মামা। ঠিক আছে?
অবশ্যই—সবুজ স্মার্টলি জবাব দেয়—আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, না ডাক্তার—আজই তা ঠিক করে নেব।
কিভাবে?

যদি রাজা জয় সিংয়ের মানমন্দির আমাকে অ্যাট্রাক্ট করে—পড়বো ইঞ্জিনিয়ারিং; আর যদি না কওে, তাহলে তোমার লাইন—ডাক্তারী।
বাহ। ছেলে দেখছি লায়েক হয়ে উঠেছে। আরে গাধা—তুই বড় লোকের ছেলে—ঐ দুটোকেই শুধু থেমে থাকবি কেন? জানিস তো—শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েইছিয়াশীটা বিষয়ে অনার্স দেয়া হয়?
ছি-য়া-শি, মানে এইটি সিক্স?—সোবহানাল্লাহ! আমি ভাবতাম কি জানো, বুয়েট বা চুয়েটের মত ঢাবি’রও পাঁচ-ছয়টা ডিপার্টমেন্ট হবে। তাহলে তো চিন্তায় পড়ে গেলাম মামা—কি পড়বো?
চিন্তার দরকার নাই, চল্ নামি। আব্বু-আম্মু ঐ দেখ—নিচের ফোয়ারার পাশে পৌঁছে গেছেন। তাড়াতাড়ি কর।
দোতলায় ছোট্ট একটি স্যুভেনীর-শপ। সাথী সেখান থেকে একসেট চিরুনী কিনলো। বলা হলো: হাতির দাঁতের কাজ। কিন্তু সবুজ-সাথী ছাড়া সবাই বুঝলাম: এ হলো চুনাপাথর। দক্ষ কারিগর এত নিপুনভাবে এর পরিমার্জনা করে যে আয়নার মত মসৃন হয়ে ওঠে চিরুনীর গা। তখন এরা পর্যটককে ঠকায়।
বয়সের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় সবুজ ঈর্ষাটা লুকোতে পারলো না। বললো: আমাকে কি দেবে, আম্মু?
আপা হেসে বললেন: তোকে একটা আস্ত হাতি কিনে দেব, চল, বাইওে চল্।

 

চলবে… 

আরো পড়তে পারেন

আগ্নেয়গিরি থেকে পায়ে হেঁটে বেস-ক্যাম্পে ফেরা

ইথিওপিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে ‘অ্যারতে-আলে’ নামে লাভা উৎক্ষেপণে প্রজ্বলিত একটি আগ্নেয়গিরি। আমরা বেশ কয়েকজন পর্যটক আজ জোট বেঁধে, একটি ট্যুর কোম্পানির গাইডের তত্ত্বাবধানে ওই আগ্নেয়গিরির পাশের একটি লাভা-হ্রদের পাড়ে ক্যাম্পিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। ওখানে যেতে হলে প্রথমে একটি বেস-ক্যাম্পে এসে প্রস্তুতি নিয়ে ট্র্যাক করতে হয় ঘণ্টাকয়েক। বেস-ক্যাম্পে পৌঁছানোও ঝকমারি বিশেষ, আমরা ঘণ্টাকয়েক ল্যান্ডরাবারে প্রায়-দুর্গম এক….

মনে করি আসাম যাব

আফ্রিকার মাসাইমারা সাফারিতে যাওয়ার পর আর কোনো বড় সাফারিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অপর্না সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সিনেমাতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার চরিত্রে রাহুল বোসের মুখে কাজিরাঙার কথা শোনার পর এ রিজার্ভ ফরেস্টে সাফারি করার ইচ্ছা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির খুব কাছের এ জায়গাটাতে যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়, আমাদের উত্তর পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আর….

শিল্পের দেশে সৌন্দর্যের দেশে

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভেনিসে পা রেখেছিলাম এক রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দুপুরে। যাত্রীবোঝাই পাবলিক বাসে চেপে যাত্রা করলাম সেন্ট মার্কোসের উদ্দেশে। সেন্ট মার্কোসে অবস্থিত বিখ্যাত স্থাপত্য ক্যাথেড্রাল। ক্যাথেড্রালের চারদিকের দেয়াল সুসজ্জিত কারুকার্যে খচিত। চিত্রকর্ম ও অক্ষরে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন কাহিনি মুগ্ধতা তৈরি করে। এখানেই ভেনিসের প্রাণভোমরা, সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানেল যা যুক্ত করেছে শতাধিক জলরাশিকে। বিশাল খাল ভেনিসকে….

error: Content is protected !!