
-এক্সকিউজ মি, আমি আপনার পাশে বেঞ্চটাতে একটু বসতে চাচ্ছি?
-সারা পার্কে এত বেঞ্চ থাকতে এই বেঞ্চেই আপনাকে বসতে হবে!
-আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি, পার্কে অসংখ্য বেঞ্চ আছে ঠিকই। তবে আশেপাশের কোন বেঞ্চই খালি নেই। শুধু আশেপাশের না, সারা পার্কেও একটা বেঞ্চ খালি নেই। আমি পুরোটা পার্ক ঘুরেই এখানে এসেছি। দুপুরবেলাতো। দুপুরবেলা বেঞ্চ খালি পাওয়া যায় না। অন্য সময় খালি থাকলেও থাকতে পারে। দুপুরে ঢাকা শহরের সব ভবঘুরে মানুষ এসে শোয় পার্কে। অনেক ধান্ধাবাজ, মন্দ লোকও আসে।
-আপনি খামোখা এত কথা বলছেন কেন! বেঞ্চটা আমার একার নয়, আপনি ইচ্ছে হলে বসতে পারেন।
-ধন্যবাদ। ভয় পাবেন না, আমি খারাপ লোক নই। অনেকক্ষণ হেঁটেছিতো, টায়ার্ড লাগছে খুব। পার্কের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দুবার পাক খেলাম।
-আবারও খামোখা কথা বলছেন । সরকারি পার্ক, সরকারি বেঞ্চ। সবারই বসার অধিকার আছে।
-আসলে অনুমতি না নিয়ে হুট করে বসে পড়লে, আপনি যদি মনে করেন যে কোন বদ মতলব আছে। বললাম না, পার্কে মেলা মন্দ লোকও আছে।
-বদ মতলব থাকলেই কী! আপনি কি ভেবেছেন আমি অবলা নারী?
-না, নারীরা কি আর এখন অবলা আছে! ঘরে ঘরে এখন কত পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে! পত্রিকায় সব খবর ছাপা হয় না বলে সেসব কেউ জানতে পারে না।
-আপনিতো খুব খারাপ মানুষ। কোত্থেকে কোথায় চলে গেলেন। অন্য নারীদের কথা কথা বলছি না। বলছি আমার কথা। আমি নিজেকে রক্ষা করতে জানি।
-সেতো জানবেনই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা মেয়ের নিজেকে রক্ষা করতে জানাটাই স্বাভাবিক।
-আপনি কীভাবে জানলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি?
-আন্দাজ।
-তাই! তা আমাকে দেখে আর কী কী আন্দাজ আপনি করতে পারছেন?
সব সত্যি কি আসলে সত্যি! আমাদের বাসা ওই পুকুরটার কাছাকাছিই ছিল। এসএসসির পরীক্ষার পর পর আমরা কজন বান্ধবী মিলে এক রাতে অনেক্ষণ পর্যন্ত পরী দেখার আশায় পুকুর পাড়ে জেগে বসে ছিলাম। পরী দেখিনি। তবে জোছনার আলোয় দেখেছিলাম, কয়েকটা বাদুর নারিকেল বাগানের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমার এক বান্ধবী বলেছিল, ওগুলোই নাকি পরী। আমাদের দেখে জলে নামছে না
-মুসকিলে ফেললেন। … বয়সতো বোঝাই যায়। তেইশ হবে বড়জোর। ভাল ছাত্রী, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। বয়সের চেয়ে একটু গম্ভীর আর চুপচাপ। বই টই পড়তে পছন্দ করেন।…মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই একটু উদাস আর আনমনা হয়ে যান। যেমন এখন।
-আশ্চর্য কি জানেন, আমার সম্পর্কে আপনার সব আন্দাজই সত্যি।
-সিনেমা টিনেমাও দেখেন বোধহয়?
-দেখিতো। বন্ধুরা মিলে খুব সিনেমা দেখি।
-তাহলেতো ঘুরে বেড়াতেও পছন্দ করেন?
– হ্যাঁ, তাও পছন্দ।
-বই পড়তে পছন্দ করেন, মুভি দেখতে ভালোবাসেন, সময় পেলে ঘুরেও বেড়ান। তাহলেতো ঠিকই আছে।
-কী ঠিক আছে কে জানে! কিন্তু আপনি সবই কি আন্দাজে বললেন?
-অই রকমই কিছু ধরে নিন। মিলে গেছে না?
-মিলেছে!
– সব মিলে গেল! যাক বাবা, তাহলে ঠিকই আছে।… আচ্ছা, আমাকে দেখে আপনার কী মনে হয়?
-বুঝা যায়, আপনি খারাপ মানুষ।
– খারাপ! নাহ্, মনটাই খারাপ করে দিলেন। তবে কী জানেন, মানুষের চেহারা দেখে, সে কেমন মানুষ সেটা কিন্তু বোঝা যায় না সবসময়। চেহারা দেখে মানুষকে বিচার করা ভুলও হতে পারে।
-আমার ভুল হয় না। আমি চেহারা দেখেই মানুষ চিনি। আর চেহারা আপনার খারাপ, এ কথাতো বলিনি।
-না, তা অবশ্য বলেননি। মুখের উপর সে কথা কি আর কেউ বলে। কথাবার্তার ধরণ দেখেই তা বুঝে নিতে হয়। …আর খারাপ মানুষের চেহারাতো খারাপই হবে।
– তা-ই-বা কেন! এই যে পত্রিকা খুললে রোজ রোজ ডাকাত ছিনতাইকারী খুনি ধর্ষক আরও সব অপরাধীদের ছবি ছাপা হয়, তাদের সবার চেহারাই কি খারাপ নাকি! ওদের মধ্যে অনেকেই আছে চেহারা রাজপুত্রের মত। মায়া মাখানো নিস্পাপ চেহারা।
খারাপ! নাহ্, মনটাই খারাপ করে দিলেন। তবে কী জানেন, মানুষের চেহারা দেখে, সে কেমন মানুষ সেটা কিন্তু বোঝা যায় না সবসময়। চেহারা দেখে মানুষকে বিচার করা ভুলও হতে পারে
-আপনি আমাকে তাদের মত একজন ভাবলেন নাকি?
-ভাবতে দোষ কী! কার মনে কী আছে কে বলতে পারে।
-সে তো ঠিক কথাই। দেশের পরিস্থিতিওতো খুব একটা ভালো না। একা একটা মেয়ে বসে আছেন, কেউ মনে বদ মতলব নিয়ে আপনার পাশে বসতে চাইতেই পারে।… তবে আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলে জানতে পারবেন আমি খারাপ লোক নই। আমি মোটামুটি ভালগোছের একটা চাকুরি করি। ভদ্র জীবনযাপন করি।
-আমার অত কী ঠেকা পড়েছে আপনার সম্পর্কে খোঁজ নিতে!
-না, কথার কথা বলছিলাম আরকি। … ফুলগুলো কী সুন্দর না?
-ফুল!
-হ্যাঁ, ওইতো সোনালু ফুলগুলোর কথা বলছিলাম আরকি। পুরো গাছ জুড়ে ছোট ছোট হলুদ ঝাড়বাতির মত ফুলগুলো ঝুলছে।
-ওইগুলো সোনালু ফুল? পথেঘাটে কত দেখেছি। নামটা এখনই জানলাম। আসলেই ফুলগুলো সুন্দর।
-জানেন তো, যারা ফুল পছন্দ করে তাদের মন খুব ভাল হয়।
-তার মানে বলতে চাচ্ছেন, আপনার মন ভাল?
-না না। আমি আসলে আপনার কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।
-থ্যাঙ্কস্ ।…তা আপনি কী চাকরি করেন। বলছিলেন ভাল একটা সরকারি চাকরি করেন।
-ঠিক ভাল বলিনি। ভালগোছের বলতে পারেন।
-ওই হল। ভালগোছের আর ভাল একই কথা।
-আমি কিন্তু বলিনি আমার চাকরিটা সরকারি।
-বলেননি? আমার যেন মনে হল, বলেছেন।
-তবে আমার চাকরিটা সরকারিই। ওই হলের সবার দেখাদেখি বিসিএস দিলাম, হয়ে গেল।
-বিসিএস! ভালগোছের বললেন কেন, বেশতো ভাল। তবে পুলিশ শব্দটা শুনতে যেমন, আপনাকে দেখতে তেমন নয়। কেমন নরম সরম।
-বিসিএস মানেই বুঝি পুলিশ?
-না, তা না। আরওতো অনেক ক্যাডার আছে। সে আমি জানি। এইতো পরশুদিনই আমার রুমমেট বিসিএসের ফরম ফিলাপ করলেন। কয়টা ক্যাডার আছে দেখলাম।
-দেখেছেন। তাহলেতো ভাল। কিন্তু আমি যে পুলিশেই সে আপনি জানলেন কীভাবে?
-বোধহয় আন্দাজেই। যদিও আপনাকে দেখে মোটেই পুলিশ পুলিশ লাগে না। … আচ্ছা, আপনি মেয়েদের চাকরি করাটা কীভাবে দেখেন?
-নির্ভয়ে যদি বলতে বলেন, বলি। একটা সংসারে স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে সেটা কেন জানি আমার ভাল লাগে না।
-তার মানে আপনি নারীদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না?
-ঠিক তা না। নারী স্বাধীনতা, সেতো অনেক বড় ব্যাপার। চাকরি না করলেই বুঝি মেয়েরা পরাধীন? … আসলে খুব ছোটবেলা থেকেই আমি আমার কাছের আত্বীয়দের মধ্যে যারা মহিলা, তাদের চাকরি করতে দেখেছি। এই যেমন আমার নানী মা খালা চাচী ফুফু। সবাই ছিল চাকরিজীবি। তার ফলে হয়েছে কী, ছোটবেলা থেকে আমি বা আমার কাজিনরা অন্যদের মত মা খালা কাউকে সব সময়ের জন্য কাছে পাইনি। আমাদের সময় কাটত একা একা।… এখনকার বাচ্চারা অবশ্য অন্যরকম। তাদের টিভি আছে, কম্পিউটার আছে, গেইমস্ আছে।
-যুগে যুগে সবই পাল্টায়। পরিবর্তনটা মেনে নিতে হয়।
-তা ঠিক। আমি মানবো না বললে তো আর সময় আমার জন্য থেমে থাকবে না।
-আচ্ছা, আগে এক সময় আপনি চশমা পরতেন বোধহয়?
-পরতাম। এখন চোখের সমস্যা হয় না বলে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আপনি বুঝলেন কীভাবে? এটাও আন্দাজ?
-অবজারবেশন। যারা চশমা ব্যবহার করে চশমা ছাড়া তাদের চোখদুটো কেমন একটু বড় বড় দেখায়।
-আপনার অবজারবেশন ঠিকই আছে। আমিও খেয়াল করে দেখেছি আমার চোখ দুটো যেন একটু বড়ই।
-তাই বলে দেখতে খারাপ লাগছে না কিন্তু। আচ্ছা, আপনার উচ্চতা কত বলুনতো।
-উচ্চতা! আমার উচ্চতা কি জানতেই হবে?
-আমার একজন বন্ধু আছে। বসা অবস্থায় আপনার মতই উচ্চতা মনে হয়। কিন্তু দাঁড়ালে বুঝা যায় ততটা লম্বা নয়। কনফিউশন দূর করার জন্যই জানতে চাচ্ছি।
-আমার উচ্চতা পাঁচফুট আট।
-আপনি আমার বন্ধুর মত না। সে ছিল পাঁচ ফুট দুই।
-আপনারতো বোধহয় পাঁচফুট তিন?
-তিন না, একটু কম হবে। মানতেই হচ্ছে, আপনার আন্দাজ বেশ ভাল। যা বলছেন মিলে যাচ্ছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি ঢাকা ভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানে পড়েছেন। … আপনি কি একটা দীর্ঘশ^াস ফেললেন নাকি?
-ফেললাম। কারণ আমি সমাজবিজ্ঞানেই পড়েছি, এবং ঢাকা ভার্সিটেই। আচ্ছা, আমরা এতক্ষণ কথা বলছি, আপনার নামটাতো জানা হল না। কেতাবি নামের বাইরেওতো মানুষের আরো একটা ডাক নাম থাকে।
-আমার ডাক নাম ইরানি। আপনার?
-অভি। যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি, আমি ক্লাস টেনে পড়াকালীন একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। আপনি দেখতে অনেকটা সে মেয়েরটার মত। সেই মেয়েটা অবশ্য গার্লস স্কুলে পড়ত। এইটে। আমরা একই সাথে প্রাইভেট পড়তাম।
-এমনতো হতেই পারে। একজনের চেহারার সাথে আরেকজনের চেহারার মিল থাকতেই পারে। দুনিয়ায় এমন অনেক উদাহরণ আছে। তাতে মনে করার কী আছে!
-তবে, সে মেয়েটাকে আমি আমার পছন্দের কথা বলতে পারিনি।
-সাহসের অভাব।
-সবাই কিন্তু আমাকে বেশ সাহসীই বলে। তবে কি জানেন, ভালোবাসার কথা বলতে বোধহয় অন্যরকম সাহসের দরকার হয়।… কেমন একটা ভয় যেন কাজ করে। মনে হয়, যদি ভালোলাগার কথা শুনে মেয়েটা না বলে। কেমন একটা হারানোর ভয় কাজ করে মনের ভেতর।
-এমনতো হতেই পারে। আপনার যাকে ভালো লাগবে তারতো আপনাকে ভালো নাও লাগতে পারে। এবং সেটা দোষেরও কিছু না।
-দোষেরতো বলিনি। আমার সাহস নিয়েই কথা বলছিলাম। … আপনি এসব কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছেন নাতো?
-এখনো না।
-মানে যে কোন সময় বিরক্ত হতে পারেন? …আচ্ছা আপনি তো ঘুরতে পছন্দ করেন, তাই না?
-খুব।
-আমিও। কেমন জায়গা আপনার পছন্দ? পাহাড় ভাল লাগে?
-কী আশ্চর্য! আপনারও পাহাড় ভালো লাগে! বাবার চাকরির সুবাদে আমরা অনেকদিন রাঙ্গামাটি ছিলাম। পাহাড় আমার অসম্ভব পছন্দের জায়গা। কতদিন যাওয়া হয় না রাঙ্গামাটিতে! আপনার রাঙ্গামাটি কেমন লাগে?
-রাঙ্গামাটির পুরোটাইতো সুন্দর। আমরাও বেশ কবছর থেকেছি ওখানে। আমিতো এসএসসি, ইন্টার ওখান থেকেই পাশ করলাম।…তবে যারা বেড়াতে যায় তারা ঠিক সৌন্দর্যটা ধরতে পারে না। তাদের মধ্যে কেমন যেন একটা উচ্ছ্বাস কাজ করে। বুকের মাঝে সৌন্দর্যটা অনুভব করতে হলে কাছাকাছি থাকতে হয়। … একটা মজার ব্যাপার আছে জানেন? রাঙ্গামাটি শহরের খুব কাছেই একটা নারিকেল বাগান আছে। জায়গাটার নাম আসামবস্তি। বাগানের ধার ঘেষে লেকটা পুকুরের মত গোল হয়ে গেছে। দেখে চট করে পুকুরই মনে হয়। বর্ষায় সেখানে লাল লাল শাপলা ফোটে। অনেক বন্ধুর কাছে শুনেছি, জোছনা রাতে নাকি সেখানে…
-পরী নামে। জানি আমি।
-জানেন! আপনি এসব বিশ্বাস করেন?
-করতাম কিশোরীবেলায়।
-এখন করেন না?
– সব সত্যি কি আসলে সত্যি! আমাদের বাসা ওই পুকুরটার কাছাকাছিই ছিল। এসএসসির পরীক্ষার পর পর আমরা কজন বান্ধবী মিলে এক রাতে অনেক্ষণ পর্যন্ত পরী দেখার আশায় পুকুর পাড়ে জেগে বসে ছিলাম। পরী দেখিনি। তবে জোছনার আলোয় দেখেছিলাম, কয়েকটা বাদুর নারিকেল বাগানের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমার এক বান্ধবী বলেছিল, ওগুলোই নাকি পরী। আমাদের দেখে জলে নামছে না।…জানেন, আপনার মত আমারও একটা ব্যর্থ প্রেমের গল্প আছে। তবে আমারটা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ছেলেটা আমার দু বছরের সিনিয়র ছিল। মজার ব্যাপার কি জানেন?
-ছেলেটাও আপনার দিকে ফিরে ফিরে চাইতো।
-এটাও কি আন্দাজে বললেন?
-না কেন! ধরে নিন না, ছেলেটা আপনাকে আগে থাকতেই চিনত। সেই রাঙ্গামাটি থেকেই।
-আপনি হাসছেন অভি? হাসলে আপনাকে কেমন বোকা বোকা লাগে। কেউ বলেছে আগে?
-না কেউ বলেনি। তবে আমি জানি। মানুষ নিজের দুর্বলতা ভালমতই জানে। আসলে হয়তো অন্য কেউ আমাকে আপনার মত করে খেয়ালই করেনি।
-খেয়াল করেছে হয়তো এর আগেও, আপনি জানেন না।
-কী জানি! হতে পারে।
-হতে পারে না, সত্যি।
-আইসক্রীম খাবেন? আপনিতো পছন্দ করেন। মানে, অনেক মেয়েই আইসক্রিম পছন্দ করে। হয়তো আপনিও…
-তাও জানেন দেখছি। …এখানে আইসক্রীম পাবেন কোথায়?
-চাইলেই পাওয়া যায়। পাঁচ মিনিট একা বসতে হবে।
-একা একা ওয়েট করার জন্য পাঁচ মিনিট বেশ লম্বা সময়। থাক, আজকে আর আইসক্রীম না খেলাম। তার চেয়ে বাদাম খাই। বাদামওয়ালাকে দেখাও যাচ্ছে।
-পার্কে এসে বাদাম খেলে কেমন কেমন জানি ফিলিংস হয় আমার।
-ওমা, কেমন ফিলিংস আবার হবে! আমারতো বাদাম খাওয়ার ফিলিংসই হচ্ছে।
-আপনি বোধহয় সব কিছু সহজভাবেই নেন।
-পার্কে বসে পরন্ত দুপুরে দশ টাকার বাদাম দুজনে মিলে খাচ্ছি। … এটা খুব স্বাভাবিক দৃশ্যই। এটা সহজ ভাবে না নেওয়ার কী হল!
-না, আসলে স্বাভাবিক দৃশ্যই। কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে… না থাক বলা ঠিক হবে না। এত অল্প সময়ের পরিচয়ে কোন মেয়েকে এ কথা বলা যায় না।
-দুজনে পার্কে বসে প্রেম করছি, তাই মনে হচ্ছেতো?
-অই এমন কিছুই।
-আপনি পুলিশে চাকরি করলেও বেশ বোকা আছেন কিন্তু। এখনকার ছেলে মেয়েরা কত এডভান্সড্। এই ছোট একটা বিষয়কে আপনি এত বড় করে দেখছেন!
-আসলে আমি বোধহয় সময়ের চেয়ে একটু পিছানো মানুষ। ওই যাদেরকে বলে সেকেলে। প্রেম আমার কাছে কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন একটা ব্যাপার।
-প্রেম না করলে এমনটা মনে হয়। একটা প্রেম করতেন, দেখতেন, প্রেম ব্যাপারটা মোটেও যেমন ভাবছেন তেমন নয়। তাতেও তিতা আছে, টেনসন আছে, বিরক্তি আছে।
-আপনার অভিজ্ঞতা অনেক!
-মানে বুঝাতে চাচ্ছেন, আমি অনেক প্রেম করেছি? তা কেন, অনুভূতি দিয়েই ওসব বুঝা যায়। ক্যাম্পাসেতো আর প্রেম ব্যাপারটা কম দেখলাম না।
-আমার অনুভূতি নেই?
– আছে। তবে সেটা বোধহয় একটু বেশিই। আর যাদের আবেগ বেশি তারা একটু কেমন বোকা হয়।
– তা সত্যি বলতে কী, লোকে আমাকে একটু বোকা বলে বটে।
-বোকারা কিন্তু সাধারণত লোক খারাপ হয় না।
– একটু আগেই আমাকে খারাপ লোক বলেছেন কিন্তু।
-বলেছি নাকি? তাহলে সেটা কথার কথা। আর এখনো কিন্তু বলিনি আপনি খুব ভালো। বলেছি বোকারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খারাপ হয় না। তার মানে এই নয় যে আপনিও তেমন।
– বুঝলাম। আমি বদ, ভীতু আর বোকা!
-কথাটা যেভাবে নিচ্ছেন, সেভাবে কিন্তু বলিনি। একটা মানুষকে এত অল্প দেখে তার সম্পর্কে এত কমেন্ট করা যায় না।
– এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। যে কোন মানুষকে চিনতেই সময় লাগে। আর ভালো মন্দ মিলিয়েইতো মানুষ। …আপনাকে কিন্তু ফিরোজা রঙের জামাতে সুন্দর লাগছে।
– সুন্দর! আমাকে সুন্দর কেউ খুব একটা বলে না কিন্তু। গায়ের রঙ কালোতো।
– কালো না, উজ্জল শ্যামলা। সৌন্দর্য আসলে সার্বিক বিষয়। এর সাথে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে অনেক কিছুই জড়িত। যে দেখছে তার দৃষ্টিও বিবেচ্য।
– যত যাই বলেন, শ্যামলা মানে কালোই। অভিধানও তাই-ই বলে। একটু আদর করে শ্যামলা বলা আরকি।…আপনার কিন্তু রঙ সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে। সাধারণত ছেলেরা রঙের সুক্ষতা সহজে আলাদা করতে পারে না।
– যদিও সব ছেলেদের সম্পর্কে কথাটা খাটে না। তাহলেও এতক্ষণে আপনার মুখে একটা প্রশংসা শুনে ভালো লাগছে।
– প্রশংসা করার মত আপনার আরো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু থাকলেই বলতে হবে এমনতো কোন নিয়ম নেই।… আপনার গায়ের চকোলেট রঙের শার্টটা কিন্ত আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে ঠিক যায় না।
প্রশংসা করার মত আপনার আরো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু থাকলেই বলতে হবে এমনতো কোন নিয়ম নেই।… আপনার গায়ের চকোলেট রঙের শার্টটা কিন্ত আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে ঠিক যায় না।
– শার্টটা পরার সময় আমারও অনেকটা তাই মনে হয়েছিল। গিফটের হলেও, শার্টটা আমার ঠিক পছন্দের না। বাসায় ছিল, উপায় না পেয়েই পরলাম। … আমি ঢাকায় আছি অনেকদিনতো হয়ে গেল। কদিন ধরে বাসায় বুয়া আসছে না। তাই ময়লা কাপড় জমছে। ব্যবহৃত শার্টগুলো ধোয়া হচ্ছে না।… আসলে আমার মা-ই আমার কাপড়চোপড় ধুয়ে টুয়ে দিত আগে। ছুটিতে থাকলেও ঢাকায় আসলে আমার ব্যস্ততা খুব বেড়ে যায়। ঘুরাঘুড়ি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, এসব আর কী। নিজে যে কাপড় ধোব সে সময়টা বের করতে পারিনি। ইদানিং মা প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। ঘরের কাজ টাজও তেমন একটা আগের মত করতে পারেন না। খুব যে বয়স হয়েছে তাও না। …আর ছোট বোনটারও পড়ার চাপ এখন বেশি। পরীক্ষা চলছেতো।
-সমস্যা সবার বাড়িতেই। এই দেখেন, আমার বাবা নেই। আমি যে বছর এসএসসি পাশ করলাম সে বছরই বাবা মারা গেছেন। বাবা আমার রেজাল্টও জেনে যেতে পারলেন না। তারপর থেকে মামাদের কাছেই বড় হওয়া। মানে বয়সে আরকি। অন্য কিছুতেতো বড় হতে পারিনি। এদিকে ছোট ভাইটা মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। স্বাবলম্বী হতে তারও দেরী লাগবে।…আমার মা অবশ্য সুস্থই আছেন। আমি, ছোট ভাই দুজনেই হলে থাকি। মা থাকেন বড় মামার সাথে।
– সুখ দুঃখ নিয়েই জীবন। ওসব নিয়ে বেশি না ভাবাই ভালো। …রমনার চাইনিজটা খারাপ না। সন্ধ্যায় আমরা একটু কি বসতে পারি?
– চাইনিজে!…সন্ধ্যা হতে ঢের দেরী। দেখা যাক।
-দেরী আর কোথায়! দেখতে দেখতেই সময় চলে যাবে। ওখানে বসলে সময়টা ভালো কাটে।
– এখানেও খুব একটা খারাপ কাটছে না। সূর্যের তেজ মরে এসেছে, বাতাস বইছে, পাখি ডাকছে, ফুলের সুবাস পাচ্ছি- খারাপ কী!
-আচ্ছা, আপনি আমার পছন্দের সে মেয়েটার নাম জানতে চাইলেন না যে?
– তার নামতো আমি জানি। আসার আগে খালা বলে দিয়েছেন।
– ও। এখানে যে আসবেন, আপনার খালা জানতেন?
-হ্যাঁ। খালার বুদ্ধিতেইতো অন্য কোথাও দল বেঁধে না গিয়ে এখানে আসলাম। আমার রেস্টুরেন্ট টেস্টুরেন্টে দেখা করাটা ভালো লাগে না। …তা আমার পছন্দের ছেলেটার নামও তো কেউ জানতে চাইল না।
– জানা থাকলে কে আর জানতে চায় বলুন।
– কাকতালীয় শব্দটাই কেমন অদ্ভুত না?
– কাক আর তাল! হবে হয়তো। তবে ফেসবুকের কারণে হারানো কত কিছু খুঁজে পায় মানুষ। যাকে কোনভাবেই আর পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, তাকেও খুঁজে পাওয়া যায়।
-তবে, আপনার ফুফু আমার খালার কলিগ না হলে ফেসবুকে আপনাকে খুঁজতে যেতাম না।
– তাঁরা অবশ্য কিছু না জেনেই আমাদের নিয়ে চিন্তা করেছিল।
– সে জন্যইতো বলছিলাম, কাকতালীয় শব্দটাই অদ্ভুত!
-আচ্ছা, মাকে কি বলব সময় করে আপনাদের বাসায় যেতে?
-বলা যায়। উনার মতামতেরওতো দাম আছে। আমিও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে পরিচিত হয়ে নিলাম। সারাজীবনতো তাদের সাথেই কাটাতে হবে।
-সারা জীবন!
-এমন গাধা জীবনে দেখিনি! বিয়ের পর কি আমি আবার মায়ের কাছে ফিরে আসব?
-ওফ্ । তাইতো! আসলে বিয়ে আগে কখনো করিনিতো, তাই ব্যাপারটা মাথায় ছিল না। না হলে আমি কি আর অত গাধা।!
-সে আমি বুঝেছি। আর বিশদ করে বলতে হবে না। বলতে কী গাধাদের আমার পছন্দই। তারা হাসবেন্ড হিসাবে খারাপ হয় না।
– গাধা হলেও আমার বাকী জীবনটা খারাপ যাবে না বোধহয়?
-আগেতো বিয়েটা হোক। তারপর না হয় দেখা যাবে। কত কারণে ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙ্গে যায়!
– পাত্র পাত্রীর মত থাকলে সেটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
– আমার কেমন জানি লজ্জা লাগছে হঠাৎ। আমরা কি অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে পারি?
– পারবো না কেন!…বিকেল শেষের আলোতে আকাশটা কেমন মায়াবী হয়ে উঠেছে। আমার মনে একটা কবিতা আসছে।
– নিজের কবিতা!
– আরে না। ফাঁসির ভয় দেখালেও কলম থেকে এক লাইন কবিতা বের হবে না আমার। রবীন্দ্রনাথের কবিতা। আমার দৌড় রবীন্দ্রনাথ পর্যন্তই। …প্রহর শেষের আলো রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস/ তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
– আমার লজ্জাটা আবার ফিরে আসছে যে।
– আসুক না। লজ্জা পেলে কারো কারো সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। লাজুক মেয়েদের আমার ভালো লাগে।
-আর আমার ভিতু ছেলেদের। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আমার যাওয়া দরকার।
-কালকে বিকালে দেখা করা যায় না?
-আসব। কোথায়?
-এখানেই? রমনায়?
-ঠিক আছে। আসি। দেখা হবে।
– সাথে আসব? গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি?
-না না। আমি একাই যেতে পারব।
– ওকে। কাল তাহলে দেখা হবে?
-দেখা হবে।