
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বোসু (১৮৫৮-১৯৩৭) ছিলেন বিজ্ঞানী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কবি। দুজনই ছিলেন বিশ্বমাপের এবং ছিলেন স্রোতের বিরুদ্ধে যাত্রী।
আমরা জগদীশচন্দ্রের নাম প্রথমে উল্লেখ করলাম বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের বড় এই কারণে, নইলে প্রতিষ্ঠা প্রভাব খ্যাতি প্রতিপত্তিতে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই ছাড়িয়ে গেছেন আজ জগদীশচন্দ্রকে।
কবিতার জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য জগদীশচন্দ্রও ওই পুরস্কার পেতে পারতেন, পেলে সেটা ঘটত হয়তো আরও আগে। ভারতের ব্রিটিশ শাসকেরা অবশ্য দু’জনকেই ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করেন, এবং সেটা ঘটে একই বছরে, ১৯১৫ সালে। প্রশ্ন থাকে কি করে তারা একই সময়ে এলেন এবং বন্ধু হলেন পরস্পরের। সেই সঙ্গে প্রশ্ন আরও একটি, তাদের পরে আর ওই মাপের না হোক কাছাকাছি উচ্চতার মানুষকেও কেন পাই না। দুটো প্রশ্নই জরুরি; যেমন তাদের বোঝার জন্য, তেমনি আমাদের নিজেদের বোঝার জন্যও বটে। তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ওইরকম উচ্চতার মানুষ সে-সময়ে পাওয়াটাও বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল বৈকি। বাংলা ছিল একটি প্রান্তবর্তী এবং উপেক্ষিত অঞ্চল। এখানে শাসকেরা এসেছে শোষণ করার জন্য। এর ভূপ্রকৃতি এমন যে বস্তুগত কোনো কীর্তিই স্থায়ী হতে পারে না। পানিতে ভিজে, রোদে তপ্ত হয়ে, এমনকি পোকামাকড়ের কামড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। বিদেশীরা এসে যা কিছু অর্জন চুরমার করে দেয়। এরই মধ্যে আধুনিক যুগে অবশ্য বড় মাপের কিছু মানুষ এসেছেন যাদের কথা আমরা স্মরণ করি- এসেছেন রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; অন্যদিকে অনগ্রসর মুসলিম সমাজেও এসেছেন মীর মশাররফ হোসেন ও তিতুমীর। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনীয় আর দ্বিতীয় কেউ নেই, যেমন নেই জগদীশচন্দ্রের মতো সমান মাপের কোনো বিজ্ঞানী।
ব্যাখ্যা অবশ্য আছে থাকতেই হবে। প্রথম কথা তাদের ব্যক্তিগত মেধা যাকে মনীষা বলাই ঠিক। মনীষা সবসময়েই বিস্ময়কর। তবে মনীষার বিকাশে পরিবেশের আনুকূল্য প্রয়োজন। এ আনুকূল্য তারা উভয়েই পেয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে আনুকূল্যের এ ধারণাটার ভেতর একটা স্ববিরোধিতা রয়েছে। কারণ সময়টা তো ছিল পরাধীনতার। বিদেশী শাসকেরা দেশকে নিঃস্ব করেছে, এবং যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তাদের নিজেদের শোষণব্যবসার প্রয়োজনে তৈরি করে নিয়েছে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াবে, এমনটা কখনো চায়নি, বরং ওই রকমের ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করছে, ভয় ও প্রলোভন উভয়ের সাহায্যে সেই নত মেরুদণ্ড এখনও যে শক্ত হয়েছে তা নয়। আর জগদীশচন্দ্র বসু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই সন্তান। তাহলে?
ভারতের ব্রিটিশ শাসকেরা অবশ্য দু’জনকেই ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করেন, এবং সেটা ঘটে একই বছরে, ১৯১৫ সালে। প্রশ্ন থাকে কি করে তারা একই সময়ে এলেন এবং বন্ধু হলেন পরস্পরের। সেই সঙ্গে প্রশ্ন আরও একটি, তাদের পরে আর ওই মাপের না হোক কাছাকাছি উচ্চতার মানুষকেও কেন পাই না। দুটো প্রশ্নই জরুরি; যেমন তাদের বোঝার জন্য, তেমনি আমাদের নিজেদের বোঝার জন্যও বটে।
হ্যাঁ, মধ্যবিত্তের সাধারণ প্রবণতাটা বশ্যতা ও আনুগত্যের ছিল বৈকি। কিন্তু তাদের ভেতর একটা বিদ্রোহও ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর বড়মাপের মনীষীরা আনুগত্যের নয়, বিদ্রোহেরই সন্তান। তারা মেনে নেননি, সম্মত হননি আত্মসমর্পণে। এবং আত্মসমর্পণে অসম্মতির ভেতর থেকেই তাদের অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছে।
শ্রেণীগতভাবে ইংরেজের শাসনকে জোর গলায় না-বলার কাজটা মধ্যবিত্তের পক্ষে সম্ভব ছিল না, এবং ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে ওই পথে তারা যে এগিয়েছেন তা মোটেই নয়। এ মধ্যবিত্তের চরিত্রটাই ছিল পরগাছার, তাকে নির্ভর করতে হয়েছে ইংরেজের অনুগ্রহের ওপর। চাকরি, পেশা, জমিদারি কোনো ক্ষেত্রেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভবপর ছিল না, ইংরেজের কৃপা ছাড়া। ১৮৫৭ সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছে, সিপাহীরা মধ্যবিত্ত ছিল না, তারা ছিল উর্দিপরিহিত কৃষক। ওই অভ্যুত্থানের সময় সদ্য-উত্থিত মধ্যবিত্তের ভূমিকাটা ছিল ইংরেজের সঙ্গে থাকার। প্রকৃষ্ট উদাহরণ ঈশ্বরগুপ্তের সাহিত্য সাধনা। মধ্যবিত্তকে নিজের দিকে ধরে রাখার জন্য ইংরেজরা চেষ্টার ত্রুটি করেনি ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, আদালত স্থাপন আদালতে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজির প্রচলন, মেডিকেল কলেজ খোলা, চাকরি-বাকরির সুযোগ প্রসারিত করে দেয়া, প্রথমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং পরে নিখিল-ভারতীয় মুসলিম লীগ সৃষ্টিতে সহায়তা দান, ব্যবস্থাপক পরিষদে সীমিত হলেও স্থানীয়দের জন্য আসন করে দেয়া, এসব অনেক কিছুই তারা করেছেন। তাতে যে কাজ হয়নি, এমনও নয়। কিন্তু বিদ্রোহ দমেনি। বড় আকারে না হলেও ছোট আকারে বিদ্রোহ হয়েছে বৈকি। কৃষক, সন্ন্যাসী, ফকির, সাঁওতাল এসব বিদ্রোহের খবর ইতিহাসে আছে, ইংরেজরা যে ধাক্কা খায়নি তা নয়।
এক ধরনের বিদ্রোহ শিক্ষিত মধ্যবিত্তও করেছে। স্বভাবতই সেটা ছিল শান্ত প্রকৃতির। অসন্তোষ বাড়ছিল। পরাধীনতার অপমান স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগিয়ে তুলছিল। সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে, মধ্যবিত্ত সেটা টের পাচ্ছিল, দেখছিলও। তারা দরখাস্ত করেছে, আবেদন-নিবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে; আবার নীরবে এবং ধারাবাহিকভাবে বিদ্রোহও করেছে, পরে প্রকাশ ঘটেছে দুইভাবে- জ্ঞানচর্চা এবং মাতৃভাষায় সাহিত্য সৃষ্টিতে।
বাঙালি লেখাপড়া শিখুক ইংরেজ এটা চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের সম্মতির একটা সীমা ছিল। সেটা হল কাজে লাগানোর সীমা। কাজটা তাদেরই। বাঙালি মধ্যবিত্ত ততটুকুই শিক্ষিত হোক যতটুকুতে শাসক ইংরেজের সুবিধা হয়- নানাবিধ সেবা পাওয়ার ব্যাপারে, এটাই ছিল কাম্য। সেবক চেয়েছে, বিদ্রোহী চায়নি, মোটেই। কিন্তু বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছিল।
বাঙালি মধ্যবিত্তের জ্ঞানচর্চা স্থানীয় ইংরেজ আমলাদের তো অবশ্যই, বিলেতের ইংরেজদেরও চমকে দিচ্ছিল। আর ছিল সাহিত্য। বাঙালি জ্ঞান ও সাহিত্যের চর্চা করবে এমনটা ইংরেজরা চায়নি; নিরুৎসাহিত ও নিবৃত্ত করার চেষ্টা থামায়নি। মধ্যবিত্ত নিষেধ মানেনি; তার স্বাধীনতার স্পৃহা এবং জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সাহিত্যচর্চা এবং সাহিত্যের বিষয়বস্তু উভয়দিক দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে। শাসকের নিষেধাজ্ঞা গৃহীত হয়নি। জগদীশচন্দ্র এসেছেন বিশেষ ধরনের জ্ঞান, অর্থাৎ বিজ্ঞানের পথে; রবীন্দ্রনাথের আগমন সাহিত্যচর্চার পথ ধরে। ভূমির কর্ষণ চলছিল। নানা রকমের বীজের বপন ঘটেছে- আগাছা ছিল তবে বৃক্ষও কম জন্মায়নি, কিছু হলেও জন্মেছে। দুটি অসাধারণ বৃক্ষ অন্যদের ছাপিয়ে উঠেছে, একটির নাম বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, অপরটির নাম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শ্রেণীগতভাবে ইংরেজের শাসনকে জোর গলায় না-বলার কাজটা মধ্যবিত্তের পক্ষে সম্ভব ছিল না, এবং ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে ওই পথে তারা যে এগিয়েছেন তা মোটেই নয়। এ মধ্যবিত্তের চরিত্রটাই ছিল পরগাছার, তাকে নির্ভর করতে হয়েছে ইংরেজের অনুগ্রহের ওপর। চাকরি, পেশা, জমিদারি কোনো ক্ষেত্রেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভবপর ছিল না, ইংরেজের কৃপা ছাড়া।
কেবল সময়ের নয়, উভয় ক্ষেত্রেই পৃষ্ঠপোষকতা ছিল পরিবারেও। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক পটভূমি সুপরিজ্ঞাত, তবু স্মরণ করা আবশ্যক। প্রস্তুতিটা ছিল তিন পুরুষ। তিন পুরুষ ধরে তারা জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়ে-ওঠা কলকাতা শহরের কমিন্দর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের অগাধ বিষয়-সম্পত্তি ছিল। উপাধি দাঁড়িয়েছিল প্রিন্সের। আবার উদ্যোগ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যেও। জাহাজ ও ব্যাংকিংয়ে হাত দিয়েছিলেন। বন্ধু ছিলেন রাম মোহনের, হিন্দু ধর্মের আধুনিকায়নে হাত লাগিয়েছিলেন বন্ধুর সঙ্গে। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনিও একজন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপাধি মহর্ষী; সেটি ব্রাহ্মসমাজ-দ্বারা অর্পিত। মহর্ষী সাহিত্যচর্চা করেছেন; পরিচালক ছিলেন ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার’ তত্ত্ববোধিনীসভার ও পাঠশালার। ওদিকে বিষয়বুদ্ধিতে যে খাটো ছিলেন তাও নয়। ছিলেন একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক এবং ইহজাগতিক। মিলিয়েছিলেন আপাত দুই-বিপরীতকে। রবীন্দ্রনাথ এই পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধারণ ও প্রসারিত করেই মহৎ হয়েছেন; ওটি না-থাকলে আর তাকেই পাই না কেন রবীন্দ্রনাথকে যে পেতাম না সেটা ঠিক।
জগদীশচন্দ্রের পটভূমি অতটা বিসৃত নয়, অমন সমৃদ্ধও নয়, তবে মোটেই খাটো নয়। তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ; তবুও ব্রাহ্ম পরিবারের যে সদস্য সেটা তো সত্য। তার পিতা ভগবানচন্দ্র বসু সেকালের ডেপুটি ছিলেন। ইংরেজের ভৃত্য ডেপুটিরা কী রূপ পরিগ্রহ করতে পারে তার অবিস্মরণীয় ছবি পাই বঙ্কিমচন্দ্র অঙ্কিত ডেপুটি সুচিরাম গুডের জীবনকাহিনীতে। কিন্তু ভিন্ন ধরনের ডেপুটিও দু’চারজন অবশ্যই ছিলেন; তাদেরই একজন বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং অপর একজন বঙ্কিমের পূর্বসূরি ভগবানচন্দ্র। জগদীশচন্দ্রের লিখা থেকেই আমরা জানি শুধু ব্যতিক্রম নন, ভগবানচন্দ্র ছিলেন অসাধারণ। তিনি ছিলেন একাধারে লোকহিতৈষী এবং উন্নত অর্থে বুর্জোয়া। কাপড়ের কল যখন এলো তখন তিনি তাতে বিনিয়োগ করেছিলেন, উদ্যোগ নিয়েছিলেন আসামে স্বদেশী চা বাগান স্থাপনে। প্রশাসক হিসেবে তার চেষ্টা ছিল কৃষকদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করার। আয়োজন করেছেন শিল্প ও কৃষি মেলার; স্থাপন করতে চেয়েছিলেন কারিগরি বিদ্যালয়। উদযোগগুলো সফল হয়নি। পুত্র জগদীশচন্দ্র লিখছেন, তাহার জীবন দেখিয়া শিখিয়াছি যে, সার্থকতাই ক্ষুদ্র এবং বিফলতাই বৃহৎ। এই রূপে যখন ফল ও নিষ্ফলতার মধ্যে প্রভেদ ভুলিতে শিখিলাম, তখন হইতেই আমার প্রকৃত শিক্ষা আরম্ভ হইল। যদি আমার জীবনে কোনো সফলতা হইয়া থাকে তবে তাহা নিষ্ফলতার স্থির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি একজন যথার্থ বৈজ্ঞানিকের প্রত্যয়। যিনি অনুমান নিয়ে এগোন, জানেন না কোথায় গিয়ে পৌঁছাবেন, অনুমান ব্যর্থ হয়ে যাবে কিনা নিশ্চিত নন; ব্যর্থ হলে বসে পড়েন না, ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার সামনে চলেন। আমাদের এই বিজ্ঞানীটি ছিলেন একাধারে দৃঢ় প্রত্যয়ী ও সংবেদনশীল। ভালোবাসা ছিল মানুষের প্রতি। প্রকৃতির প্রতি। শিক্ষাটা পিতার কাছে পেয়েছিলেন মাতার কাছেও। জগদীশচন্দ্র স্মরণ করেছেন যে তার পিতা তাকে অভিজাত্য চিহ্নিত ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করেননি। যেমনটা সুবিধাভোগী অন্যপিতারা করেছেন; পড়তে পাঠিয়েছেন বাংলা মাধ্যমের স্কুলে যেখানে তার ডান পাশে বসত পিতার মুসলমান চাপরাশীর পুত্র, বা পাশে এক ধীবরের সন্তান, যাদের কাছ থেকে তিনি পশুপাখি জীবজন্তু ও জলজন্তুর গল্প শুনতেন। বাড়িতে ফিরলে তার মাতা তার ওই সহপাঠীদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতে দিতেন। ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে,
ছেলেবেলায় সখ্য হেতু ছোটজাতি বলিয়া যে এক স্বতন্ত্র প্রাণী আছে এবং হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে এক সমস্যা আছে তাহা বুঝিতে পারি নাই।
পিতা তাকে বিলাতে পাঠান অধ্যয়নের জন্য। নিয়ম ছিল সন্তান যদি বিলেতে যায়, যাবে আইসিএস না হোক অন্তত ব্যারিস্টার হবে। ভগবানচন্দ্র তার পুত্রকে ওই চিহ্নিত পথে যেতে বলেননি, বলেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার অপরিচিত ও অন্যের জন্য উপকারী হওয়ার পথ ধরতে। জগদীশচন্দ্র চিকিৎসকই হতেন হয়তো, যদি না বিলেতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। অসুখের কারণে তার পক্ষে ডাক্তার হওয়া সম্ভব হয়নি, গিয়ে বিজ্ঞান পড়েছেন, লন্ডনে এসে সেই শিক্ষাকে মজবুত করেছেন, কিন্তু দেশে এসে বিদ্যা বিক্রি করে অর্থোপার্জন করেননি, শিক্ষকতা শুরু করেছেন। পিতার স্বপ্ন ব্যর্থ হতে দেননি, ধনী হননি। প্রভু হননি, সেবক হয়েছেন মানুষের। তুলনীয় ঘটনা রবীন্দ্রনাথের জীবনেও ঘটেছে। তিনিও একাধিকবার বিলেতে গিয়েছেন, অনায়াশে আইসিএস কিংবা ব্যারিস্টার হতে পারতেন, তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের একজন তো ভারতের প্রথম আইসিএস বটে; কিন্তু ওসব কিছু না হয়ে তিনি কবি হলেন। না-হয়ে উপায় ছিল না।
শিক্ষাতে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ সর্বজনবিদিত। তার সময়ে এ বিষয়ে তার মতো করে কম মানুষই শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন। তিনি পল্লীগ্রামে তার আশ্রমকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেছিলেন, সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে। জগদীশচন্দ্রের জন্য তেমনটা করা সম্ভব ছিল না, তিনি তখনকার প্রধান কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দিয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবে। তার যে যোগ্যতা তাতে তার প্রফেসর হওয়ার কথা। কিন্তু যে-ইংরেজ ভারতীয়দের জ্ঞানচর্চাকে বিদ্রোহের লক্ষণ বলে জ্ঞান করত তারা সম্মত হয়নি তাকে অধ্যাপক করতে। বলেছে পদ খালি নেই। পরে যখন দেখল বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত যোগ্য একজন শিক্ষক পাওয়া গেছে, কিন্তু কলেজ তাকে নিচ্ছে না, বঞ্চিত করছে শিক্ষার্থীদের, তখন নিরুপায় হয়ে নিয়োগ দিল, তবে পুরোপুরি প্রফেসর করল না, বলল অফিসিয়েটিং প্রফেসর হিসেবে থাকতে হবে, পরে দেখা যাবে। প্রফেসরের বেতন ছিল মাসে ৩০০ টাকা। ভারতীয়দের দেয়া হতো ২০০ টাকা। জগদীশচন্দ্র যেহেতু অফিসিয়েটিং তাই তাকে দিতে চাইল মাত্র ১০০ টাকা। প্রতিবাদে জগদীশচন্দ্র বললেন পুরো বেতন না দিলে তিনি বেতনই নেবেন না।
রবীন্দ্রনাথের চারপাশে অনেক মানুষ থাকত, কিন্তু তিনি নিঃসঙ্গই ছিলেন। তার দাম্পত্য জীবন ছিল মাত্র ১৯ বছরের। একের পর এক তিনি সন্তান ও নিকটজনকে হারিয়েছেন। নিঃসঙ্গতা জগদীশচন্দ্রের ক্ষেত্রেও সত্য। বিজ্ঞানীরা চরিত্রগতভাবেই একাকী হন, তদুপরি জগদীশচন্দ্রের কোনো সময়ে ছিল না। এই নিঃসঙ্গতাও উপযুক্ত বন্ধু সন্ধানে তাদের উৎসাহিত করে থাকবে।
এক মাস দু’মাস নয়। পুরো তিন বছর তিনি বেতন গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন; অথচ কলকাতায় তার জন্য আয় উপার্জনের ভিন্ন কোনো পথ খোলা ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাকে নয়, পরাভব মানতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকেই। পুরো বকেয়াসহ প্রাপ্য বেতন তিনি পেয়েছেন। এই হচ্ছে সেই মেরুদণ্ড আঘাতে যা ভেঙে পরেনি এবং যেটা তাদের সংস্কৃতিতে ও নিজের মধ্যে ছিল বলেই জগদীশচন্দ্র হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ যেমন রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন। দু’জনের কারও জন্যই শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়ানোটা বীরত্বের ব্যাপার ছিল না, ছিল অন্তর্গত মনুষ্যত্বের অংশ। এই মনুষ্যত্বের বিষয়ে জগদীশচন্দ্র নিজেই উল্লেখ করেছেন তার একটি বক্তব্যে। তিনি বিক্রমপুরের লোক, বিক্রমপুরবাসীর এক সম্মেলনে তাকে বলতে শুনি, ‘এই বিক্রমপুর বিক্রমশীল সন্তানের জন্মভূমি, মনুষ্যহীন দুর্বলের নহে।’ তার দৃষ্টিতে বিক্রম অন্য কোনো ক্ষমতার নির্ভর করে না, নির্ভর করে মনুষ্যত্বের ওপর। মনুষ্যত্ব না থাকলে মানুষ দুর্বল হয়, তা তার অন্যগুণ যতই থাকুক না কেন।
রবীন্দ্রনাথ তো আগাগোড়াই মানুষ ও মনুষ্যত্বের পক্ষে, সে জন্যই তিনি অত বড়; জগদীশচন্দ্রও একই পথের পথিক ছিলেন। বিজ্ঞানী হিসেবে তার জন্য সহজ ছিল পদার্থ বিজ্ঞানী হওয়া। পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন, ওই বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা তিনি করেছেনও; সে ক্ষেত্রে তার সাফল্যও ছিল বিশ্বমাপের। বেতারে বার্তা পাঠানোর ও গ্রহণের যন্ত্র তিনিই প্রথম উদ্ভাবন করেন। একই সময়ে ওই বিষয়ে ইটালির পদার্থ বিজ্ঞানী মার্কোনিও গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে, একই ধরনের কাজ সমান্তরালে এগোতে থাকে; জগদীশচন্দ্র ও মার্কোনির ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে। ইউরোপীয় হওয়ার দরুন যে সুযোগ-সুবিধা মার্কোনি পেয়েছেন, জগদীশচন্দ্র সেগুলো পাননি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে সারা দিন ব্যস্ত রাখত ছাত্রদের শিক্ষাদানে; তিনি গবেষণা করতেন দিনের শেষে। উপযুক্ত ল্যাবরেটরি ছিল না। কোনো অনুদান পাননি। ইউরোপীয় হলে কাজের জন্য যে রকমের প্রচার পেতেন উপনিবেশিক আমলে কলকাতাবাসী অধ্যাপকের পক্ষে সেটা পাওয়া সম্ভব ছিল না। সর্বোপরি তিনি তার আবিষ্কার খণ্ডকে প্যাটেন্ট করতে উদ্যোগ নেননি। প্যাটেন্ট করলে কে জানে যে আবিষ্কারের জন্য ১৯০৯ সালে মার্কোনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুই হয়তো সেটি পেয়ে যেতেন। তাছাড়া যন্ত্র বিক্রি থেকে প্রচুর মুনাফাও আসত। তেমন পরামর্শ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে আসেনি তা নয়; এসেছিল; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে বাণিজ্যের কাজে ব্যবহার করতে তার আগ্রহ ছিল না। বিজ্ঞানকে সব মানুষের সাধারণ সম্পত্তির হিসেবেই দেখতেন তিনি। পুঁজিবাদে দীক্ষা নেননি। তাছাড়া ততদিনে তিনি বৃক্ষের কাছে চলে গেছেন। ক্ষেত্রটা কেবল ভিন্ন ছিল না, ছিল নতুনও। সেখানে গিয়ে যে সংবেদনশীলতা ও অনুসন্ধিৎসা তার ভেতরে ছিল তাদের ওপর ভর করে প্রমাণ করলেন যে গাছেরা নীরব থাকে বটে, কিন্তু তাদেরও প্রাণ আছে, আছে মায়া-মমতা এবং স্পর্শকাতরতা। অব্যক্তকে তিনি ব্যক্ত করলেন।
ঠিক ওই কাজটাই রবীন্দ্রনাথও করেছেন। সমাজে, প্রকৃতিতে, ইতিহাসে এবং বিশেষভাবে মানুষের মনে যেসব কথা অব্যক্ত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাজ ছিল তাদের ব্যক্ত করা। দু’জনের ভেতর ভীষণ মিল এইখানে। রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর সর্বত্রই প্রাণ আছে বলে জানতেন, পৃথিবীর বিচিত্র জ্ঞান তিনি শুনতে পেতেন; ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে তিনি বই লিখেছেন; ‘বৃক্ষবন্দনা’ নামে তার কাব্যগ্রন্থ আছে, যেটি তিনি উৎসর্গ করেছেন জগদীশচন্দ্রকে। উৎসর্গে লিখেছেন-
তোমার প্রতিভাদীপ্ত চিত্তমাঝে কহে আজি কথা
তরুর মর্মর-সাথে মানব-মর্মের আত্মীয়তা।
তরুর প্রতি মমতার ক্ষেত্রে কবি ও বিজ্ঞানী এক হয়ে গেছেন। দুই পাশের ভেতর ঐক্যের এই ব্যাপারটা তাত্ত্বিক পর্যায়ে যে একটি সাধারণ সত্য এমন বক্তব্য জগদীশচন্দ্রের ‘অব্যক্ত’ বইতে আছে। তিনি বলছেন কবি ও বৈজ্ঞানিক উভয়েই সত্যের অন্বেষী, তাই দু’জনের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন হলেও লক্ষ্য অভিন্ন।’ পদ্ধতিটাও অবশ্য স্বতন্ত্র। কবির ভরসা তার কল্পনা ও অনুভবের ক্ষমতা; বিজ্ঞানীর ভরসা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সত্য অন্বেষণের এ লক্ষ্যের ব্যাপারে যেহেতু তারা অভিন্ন, তাই তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই এবং তারা যে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হবেন এতে কোনো অস্বাভাবিকতা থাকার কথা নয়। উপমা দিয়ে বলা যায় এ যেন দুটি নৌকার একই ঘাটে মিলিত হওয়ার মতোই স্বাভাবিক। আবার যেহেতু তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে অগ্রসর হচ্ছেন তাই তাদের ভেতর কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। মিলনের ক্ষেত্রটা সেদিক থেকেও প্রশস্ত।
জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের ভেতর বন্ধুত্বের অন্য কারণও ছিল। তারা সমসাময়িক এবং একই জনপদের বাসিন্দা। উভয়েই মাতৃভাষার চর্চায় বিশ্বাসী এবং গভীর রূপে দেশপ্রেমিক। আত্মসমর্পণের স্রোতের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহী। আবার দু’জনেই খুব বড় মাপের মানুষ এবং একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নন। তারা উভয়েই নিঃসঙ্গ ছিলেন, যে জন্য বন্ধুর প্রয়োজন ছিল। বন্ধু হয় সমানে সমানে, সেও একটা দেখার বিষয় বৈকি। রবীন্দ্রনাথের চারপাশে অনেক মানুষ থাকত, কিন্তু তিনি নিঃসঙ্গই ছিলেন। তার দাম্পত্য জীবন ছিল মাত্র ১৯ বছরের। একের পর এক তিনি সন্তান ও নিকটজনকে হারিয়েছেন। নিঃসঙ্গতা জগদীশচন্দ্রের ক্ষেত্রেও সত্য। বিজ্ঞানীরা চরিত্রগতভাবেই একাকী হন, তদুপরি জগদীশচন্দ্রের কোনো সময়ে ছিল না। এই নিঃসঙ্গতাও উপযুক্ত বন্ধু সন্ধানে তাদের উৎসাহিত করে থাকবে। বন্ধুদ্বয় পরস্পরকে অনুপ্রাণিত করেছেন, একে অপরকে যে প্রভাবিত করেননি এমনও বলা যাবে না। কবির ভেতর একজন বৈজ্ঞানিক ছিলেন, কোনো বড় কবিই আসলে অবৈজ্ঞানিক নন, তাদের বৈজ্ঞানিকতাকে আমরা সাধারণত দার্শনিকতা বলে থাকি। অন্যদিকে বৈজ্ঞানিকের সংবেদনশীলতাও কবির মতোই।
কাব্যিক ভাষায় বৈজ্ঞানিকের সরল ও পরিষ্কার উক্তি। মেহনতিরা আছে বলেই, ভদ্রলোকেরা তাদের ভদ্রতাসমেত টিকে আছে, উল্টোটা সত্য নয়। কেবল যে আছে তা নয়, তারাই ভারবাহী, তারা যদি ‘অনুগ্রহ’টা প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে ভীষণ বিপদ হবে। সবকিছু ভেঙে পড়বে।
দৃষ্টিভঙ্গিতেও মিল ছিল। উভয়েই জনশিক্ষায় বিশ্বাস করতেন। শ্রমজীবীর শ্রমই যে মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির ভরসা এ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের বেলাতে অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল। জগদীশচন্দ্রও তেমনটাই মনে করতেন। এ বিষয়ে তার পক্ষে অনেক করে বলার সুযোগ তেমন একটা ছিল না, তবু সুযোগ তৈরি করে নিয়ে তিনি কথাটা বলেছেন। ‘পতিত অস্পৃশ্য’ নামে তার একটি প্রবন্ধ আছে। তাতে তিনি শ্রমজীবী মানুষকে বন্ধু বা হরিজন বলে পিঠ চাপড়ানোর ভঙ্গিতে সম্বোধন করেননি, ভদ্রলোকদেরই বরং স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শ্রমিকের কাছে তাদের ঋণের কথা। জগদীশচন্দ্র লিখছেন-
তুমি ও আমি যে শিক্ষালাভ করিয়া নিজেদেরকে
উন্নত করিতে পারিয়াছি এবং দেশের জন্য
ভাববার অবকাশ পাইয়াছি, তাহা কিসের
অনুগ্রহে? এই বিস্তৃত রাজ্যের ভার পাইয়াছি
তাহা প্রকৃতপক্ষে কি বহন করিতেছে? …পঙ্কে অর্র্দ্ধ নিমজ্জিত,
অনমানক্লিষ্ট, রোগে শীর্ণ, অস্থিচর্মসার
এই ‘পতিত’ শ্রেণীরাই ধন-ধান্যসহ
সমগ্র জাতিকে পোষণ করিতেছে।
কাব্যিক ভাষায় বৈজ্ঞানিকের সরল ও পরিষ্কার উক্তি। মেহনতিরা আছে বলেই, ভদ্রলোকেরা তাদের ভদ্রতাসমেত টিকে আছে, উল্টোটা সত্য নয়। কেবল যে আছে তা নয়, তারাই ভারবাহী, তারা যদি ‘অনুগ্রহ’টা প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে ভীষণ বিপদ হবে। সবকিছু ভেঙে পড়বে।
রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রের ভেতর মিলের ক্ষেত্রটি প্রশস্ত হয়েছে আরও দুটি বিশেষ কারণে। ওই দুটি হল তাদের জাতীয়তাবাদ এবং আধ্যাত্মিকতা। উভয়েই জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তারা নিজেদের একই সঙ্গে বাঙালি ও ভারতীয় বলে চিনতেন। এই ক্ষেত্রে জগদীশচন্দ্র বরং অধিকতর ভারতীয় ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের চেয়েও। নিজেকে তিনি ‘বঙ্গভূমি এবং ভারতের সেবকরূপে’ দেখতে পেয়েছেন। সত্য এই যে ইতিহাসের ভেতর থেকেই ইতিহাস বদলের চেষ্টাটা করতে হয়। এই দুই অসাধারণ মানুষও ইতিহাসের ভেতরেরই মানুষ; তাদের কালে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বোধটা তৈরি হয়নি; এখনো যে তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তা নয়। আর আধ্যাত্মিকতা সেটিও ইতিহাসের অবদান।
সামন্তবাদের অন্ধকার এবং পরাধীনতার পাষাণ প্রাচীর ভেদ করে যে নির্ঝর প্রবহমান হয়েছিল সেটির আরেক প্রতিনিধি হচ্ছেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় [১৮৬১-১৯৪৪]। রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রের মতোই মহৎ মানুষ একজন; সমান মাপের না হলেও খাটো নন মোটেই। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার কাজটাও বিশ্বমাপেরই। তিনিও ছিলেন ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান, অকৃতদ্বার এবং সে কারণে অনেকটা নিঃসঙ্গ। শিক্ষাগ্রহণের ও বিতরণে ছিলেন গভীরভাবে আগ্রহী। মাতৃভাষায় লিখেছেন এবং ছিলেন যথার্থ দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী।
রবীন্দ্রনাথের পিতা বীরভূমের ভুবন ভাঙায় যে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেটিকে প্রথমে বিদ্যালয় এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। আশ্রম শিক্ষালয়ে পরিণত হল। এ ক্ষেত্রে জগদীশচন্দ্রকে কিছুটা ভিন্ন রকমের বলে মনে হয়। অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ১৯১৭ সালে তিনি একটি বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। নাম রেখেছিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দির। মন্দির নামকরণ এবং নামের সঙ্গে পরিবারকে যুক্ত রাখা এই দুই কাজকে ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ হিসেবে বিবেচনা, করতে কোনো অসুবিধা নেই। সত্য তো আসলে সেটাই; ইতিহাসের ভেতরে থেকেই ইতিহাসকে বদল করার চেষ্টা।
এ ক্ষেত্রে প্রফুল্লচন্দ্রকে দেখা যায় ব্যতিক্রমদের মধ্যেও ব্যতিক্রম। তিনিও প্রেসিভেন্সি কলেজের প্রফেসর ছিলেন, পদার্থ বিজ্ঞানের নয়, রসায়ন বিজ্ঞানের। গবেষণা ও উদ্ভাবনার কাজ তিনিও করেছেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি যা করলেন তা কিছুটা ভিন্ন রকমের। প্রতিষ্ঠা করলেন একটি রসায়নিক ও ওষুধ তৈরির কারখানা; নাম দিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড। এর কাজটা ছিল রাসায়নিক বস্তু আবিষ্কার ও উদ্ভাবনা এবং ওষুধ প্রস্তুতের। বাণিজ্যকে নিয়ে এসেছিলেন বাঙালির অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা দূর করার ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে। এই যে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমও বিদ্যালয় এবং জগদীশচন্দ্রের কারখানায় চলে যাওয়া এটিকে অগ্রগতির দ্যোতক বললে ভুল করা হবে না। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এটিও যে প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি ‘বেঙ্গল’ নামে অভিহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ চন্দ্র উভয় তুলনাতে তিনি নিজের বাঙালিত্ব বিষয়ে অধিক সচেতন ছিলেন। সেই জন্যই নিজের ভারতীয় না বলে বাঙালি বলেছেন। ইংরেজিতে লেখা তার আÍজীবনীর নাম ‘লাইফ অ্যান্ড একসপেরিয়েন্স অব এ বেঙ্গলি কেমিস্ট’। বাংলায় দুটি বই লিখেছেন একটির নাম ‘বাঙালির মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’, অপরটির নাম ‘অন্নসমস্যায় বাঙালির পরাজয় ও তাহার প্রতিকার’। বাঙালির পশ্চাৎপদতা ছিল তার সার্বক্ষণিক উদ্বেগের কারণ।
কে অস্বীকার করবে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা টিকে আছে? এ ব্যবস্থা আগের মতো আত্মবিশ্বাস রাখে না, তাই অবরোধ বহাল রেখেই সন্তুষ্ট থাকছে না, বিষ ছড়ানোর কাজটাও করছে। বিষ আগেও ছড়াত, কিন্তু এখন তার মাত্রাটা অধিক। মুস্কিল এই যে বিষকে বিষাক্ত বলে চিহ্নিত না করে আমরা তাকে সুখের আকর ও অবলম্বন বলে ধরে নিয়েছি।
১৯৩২ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে প্রফুল্লচন্দ্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যে তার প্রতিভা-
অর্ঘ্যরূপে ভারতের বেদীমূলে নিবেদিত/ভারতবর্ষ
তাকে গ্রহণ করেছেন। … ভারতের আশীর্বাদের
সঙ্গে আজ আমাদের সাধুবাদ মিলিত হয়ে
তার মাহাত্ম ঘোষণা করুক।
রবীন্দ্রনাথ এখানে নিজেকে বাঙালি হিসেবে না দেখে ভারতীয় হিসেবেই দেখছেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নিজের দৃষ্টিতে কিন্তু তার বাঙালিত্বই ছিল প্রধান, ভারতীয়ত্বের তুলনাতে। কলকাতায় একটি স্বদেশী কারখানা গড়াকেই তিনি অধিক প্রয়োজন মনে করেছেন। প্রফুল্লচন্দ্র তার দুই মহৎ সমসাময়িকের সঙ্গে তুলনা দাবি করেন না ঠিকই, তবে তিনি যে ইহজাগতিকতা ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে তাদের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী এবং অগ্রসরমনস্ক ছিলেন সেটা না-মেনে উপায় নেই।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা রয়ে গেছে। জগদীশচন্দ্র বসু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মহৎ মানুষের সাক্ষাৎ একালে কেন পাই না? জবাবটা হয়তো এ রকমের যে পরাধীনতার কালে যে বিদ্রোহটা ছিল একালে সেটা নেই। ইংরেজরা এসেছিল পুঁজিবাদী হিসেবে, এসে প্রথমে বাণিজ্য এবং পরে বাণিজ্য ও শাসন উভয় পন্থায় শোষণ করে আমাদের অন্ধকারে রুদ্ধ রাখার জন্য পাষাণ প্রাচীর খাড়া করেছিল। প্রাচীরটা আসলে পুঁজিবাদেরই। সেই প্রাচীরে আমরা আঘাত করেছি। এক সময়ে মনে হয়েছে আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। কিন্তু প্রাচীর তো ভাঙেনি, সেটি আগের মতো দৃশ্যমান নয় এইটুকুই যা স্বতন্ত্র। প্রাচীর যদি দৃশ্যমান থাকে তবে তার বিরুদ্ধে লড়াইটা জমে ওঠে, কিন্তু সে যখন লুকিয়ে থাকে তখন মনে হয় লড়াই করার দরকার নেই, কেননা, আমরা জয়ী হয়েছি। অথচ জয় ঘটে না।
কে অস্বীকার করবে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা টিকে আছে? এ ব্যবস্থা আগের মতো আত্মবিশ্বাস রাখে না, তাই অবরোধ বহাল রেখেই সন্তুষ্ট থাকছে না, বিষ ছড়ানোর কাজটাও করছে। বিষ আগেও ছড়াত, কিন্তু এখন তার মাত্রাটা অধিক। মুস্কিল এই যে বিষকে বিষাক্ত বলে চিহ্নিত না করে আমরা তাকে সুখের আকর ও অবলম্বন বলে ধরে নিয়েছি। পুঁজিবাদ বিচ্ছিন্নতা ও ভোগবাদিতা তৈরি করে। আমরা উভয় ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত। বিচ্ছিন্নতা ও ভোগবাদিতার বর্তমান দৌরাত্য রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রের কালে ছিল না। যুদ্ধ ছিল তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই ওই সব মহৎ মানুষের আবির্ভাব।
বঙ্গভূমির কথাই ভাবছি, ভাবা দরকার। রবীন্দ্রনাথ ও জদীশচন্দ্রের বৃক্ষের মতোই আমরা ভূমিতে দাঁড়িয়েই আকাশমুখো হব। কিন্তু ভূমিতে দাঁড়ানোটা শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনুসমস্যার কাছে বাঙালির পরাজয় দেখে প্রফুল্লচন্দ্র অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন; সে সমস্যা যে পুরোপুরি মিটবে তা নয়, তবে কিছুটা মিটেছে, কিন্তু ক্ষুধা মেটেনি, ‘খাই খাই’ চলছে। তাদের ক্ষুধাটাই বেশি যাদের প্রাচুর্য আছে। এ ক্ষুধা বস্তুতান্ত্রিক। এর নাম ভোগবাদিতা। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র ভাবতেন অনুসূয়াদের হাত থেকে বাঁচার উপায় অর্থনৈতিক উন্নতি। এখন আমরা বুঝি যে সমস্যাটা কেবল উৎপাদনের নয়, বণ্টনেরও। পুঁজিবাদী বণ্টন ব্যবস্থা যেমন ক্ষুধা বাড়ায় তেমনি বৈষম্য সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদীই শত্রু, এর হাত থেকে মুক্তি না পেলে মহত্ব যে বিকশিত ও সর্বজনীন হবে তার কোনো উপায় নেই। এই যে বাংলাভাষার ‘ী’ কারগুলোকে কেটে ‘’ি কার করছি, যার ফলে ‘শ্রেণী’ রূপ নিয়েছে ‘শ্রেণি’র, ‘কাহিনী’ আত্মগোপন করেছে ‘কাহিনি’র আড়ালে, এটি তো মনে হয় আমাদের খর্ব হওয়ার এবং পরস্পরকে খর্ব করার স্থানীয় ও বিশ্বায়তনিক প্রচেষ্টারই প্রতিফলন। এখানে কেউ দীর্ঘ থাকবে না, সবাই হ্রস্ব হবে, রবীন্দ্রনাথ আর আসবেন না ভিড় করবে অজস্র কবি যশপ্রার্থী, জগদীশচন্দ্রের দেখা মিলবে না পাওয়া যাবে ইন্টারনেট পারদর্শী- এটাই বোধ করি আমাদের বিধিলিপি।
প্রফুল্লচন্দ্র পরাজয়ের কথা বলেছিলেন। আমরা কি পরাজিত নাকি অধঃপতিত? অধঃপতিত বলাটা সহজ, কিন্তু আসলে মনে হয় আমরা পরাজিত, এবং পরাজিত হওয়ার কারণেই অধঃপতিত। কিন্তু কার কাছে এ পরাভব? ব্যক্তি, ঘটনা, নাকি ব্যবস্থা? পরাজয় আসলে ব্যবস্থার কাছেই, ব্যক্তি ও ঘটনা এসেছে ব্যবস্থার প্রতিনিধি হিসেবে। ব্যবস্থাটা পুঁজিবাদের। বস্তুত তার বিরুদ্ধেই আমরা লড়াই করেছি, কিন্তু জিততে পারিনি। কারণ শত্রু নির্ণয়ে ভ্রান্তি ছিল, ভ্রম ছিল পথ নির্ধারণে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জগদীশচন্দ্র বসু হওয়াতো অনেক দূরের কথা, আমরা মানুষ হিসেবেও বাঁচতে পারব না পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে যদি ভাঙতে না পারি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক