
গোলাম শফিক
সমুদ্র সম্পদে সমৃদ্ধ স্বদেশ- এ অনুপ্রাসে একটুও অতিশয়োক্তি করা হয়নি। সমুদ্রের এ সমৃদ্ধির পশ্চাতে যা সেটি হচ্ছে সমুদ্র অমীয় শক্তির এক বিশাল আধার। সম্প্রতি ‘মনোরহ্যাফিশ শুনি’ প্রজাতির যে স্পঞ্জটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সেটি বেঁচে আছে ১১ হাজার বছর যাবৎ। জানিয়েছেন প্রাণি গবেষক মারাহ জে হার্ডট। স্থলচর কোনো প্রাণিরই এ ক্ষমতা নেই। আমাদের শারীরিক ক্ষমতা খুবই সীমিত। তবে আশা করা যায় এ প্রণিটির জিন মানবদেহে প্রবিষ্ট করানো সম্ভব হলে মানুষও বাঁচবে কয়েক হাজার বছর। দুনিয়াটাকে নরক বানাতে ভবিষ্যতে এ চেষ্টা কেউ করতেও পারেন। সমুদ্র সম্পদে সমৃদ্ধ স্বদেশ- এ অনুপ্রাসে একটুও অতিশয়োক্তি করা হয়নি। সমুদ্রের এ সমৃদ্ধির পশ্চাতে যা সেটি হচ্ছে সমুদ্র অমীয় শক্তির এক বিশাল আধার। সম্প্রতি ‘মনোরহ্যাফিশ শুনি’ প্রজাতির যে স্পঞ্জটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সেটি বেঁচে আছে ১১ হাজার বছর যাবৎ। জানিয়েছেন প্রাণি গবেষক মারাহ জে হার্ডট। স্থলচর কোনো প্রাণিরই এ ক্ষমতা নেই। আমাদের শারীরিক ক্ষমতা খুবই সীমিত। তবে আশা করা যায় এ প্রণিটির জিন মানবদেহে প্রবিষ্ট করানো সম্ভব হলে মানুষও বাঁচবে কয়েক হাজার বছর। দুনিয়াটাকে নরক বানাতে ভবিষ্যতে এ চেষ্টা কেউ করতেও পারেন।
ধরিত্রীর মোট আয়তনের ৭১ ভাগই সমুদ্র। এ সমুদ্র এক শক্তির নাম। এ শক্তিই মাতৃবৎ ২৯ ভাগ ভূখ-কে অহর্নিশ শীতল রাখে। সমুদ্রশক্তির দখল নেয়ার জন্য এ যাবৎ পৃথিবীতে বড়ো বড়ো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে (“গ্রিক পুরাণ যদি বাদ দেই তাহলে ত নিশ্চিত জানি/নারী নয়, সমুদ্রের উপর প্রভুত্ব বিস্তারই ছিল/ট্রোজান যুদ্ধের মূল কারণ”, শান্তনু কায়সার, রাখালের আত্মচরিত)। সমুদ্র ও নদী অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানব সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সমুদ্র-নদীতীরেই গড়ে উঠেছে আধুনিক শহর, বন্দর, বসতি ও সভ্যতা। নদী ও সমুদ্রের এ বিশাল জলরাশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে অপরিহার্য। বিশ্ববাণিজ্যের ৮০% পরিবহনই সমুদ্রপথে পরিচালিত হয়। বৈশ্বিক শিল্প ও প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটন সম্প্রসারণে সমুদ্র ও উপকূলীয় পরিবেশ একটি অন্যতম উপাদান। বিশ্বের ৩২% হাইড্রোকার্বন শক্তি (তেল, গ্যাস, অন্যান্য জ্বালানি) বিস্তৃত সমুদ্র তলদেশে থেকে আসে। সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের উপস্থিতি সাগরে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। নবায়নযোগ্য ‘নীল শক্তি’ বায়ু, তরঙ্গ, জোয়ার, তাপ এবং জৈববস্তুপুঞ্জের উৎস থেকে উৎসারিত।
“কি কথা শুনাতে চাও, কাকে কি কহিবে বন্ধু তুমি?
প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে ঊর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভূমি।’’
কাজী নজরুল ইসলাম-এর ‘সিন্ধু’ কবিতার প্রথম তরঙ্গে এভাবেই ফুটে উঠেছে সমুদ্রের পরিচয়। সমুদ্র এক রহস্যের আধার, সে আকাশের নীল রঙ নিয়ে নিজের জলকে নীলাম্বর করেছে। ঊর্ধ্বে আকাশ, নিম্নে বালুকারাশি যাকে আশ্রয় করে মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অশান্ত সমুদ্র। কিন্তু সে যেন কী বলতে চায় তার রহস্য, প্রাণপ্রাচুর্য আর ঐশ্বর্য সম্পর্কে। পুরাণও সমুদ্রের অন্তহীন প্রাণ-ঐশ্বর্য সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়, “মন্থন-মন্দার দিয়া দস্যু সুরাসুর/মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্নপুর (সিন্ধু, তৃতীয় তরঙ্গ)।’’ সমুদ্র যে সর্বকালেই ধনরত্নে ভরপুর ছিল এ বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ এ রহস্যাধারে প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি ক্রমে যুক্ত হয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট উপাদান। সেটিও নজরুল-সাহিত্যে সুনিপুণ দক্ষতায় প্রতিফলিত হয়েছে:
উড়ে চলে মেঘের বেলুন,
“মাইন’’ তোমার চোরা পর্বত নিপুণ।
হাঙ্গর কুম্ভীর তিমি চলে “সাব্মেরিন’’,
নৌ-সেনা চলিছে নীচে মীন!
সিন্ধু-ঘোটকেতে চড়ি’ চলিয়াছ বীর
উদ্দাম অস্থির!
(দ্বিতীয় তরঙ্গ)
কিন্তু এ ঐশ্বর্যাধারকে চিনতে আমরা অনেক বিলম্ব করে ফেলেছি। পৃথিবীর দেশে দেশে, সমুদ্র সম্পদ আহরণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের যাত্রা শুরু হয়েছে বহু পূর্বেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতই এ কাজে হাত দিয়েছিল আনুমানিক ২ দশকেরও পূর্বে। ২০১২ সালে যে মিয়ানমারের সাথে আমরা ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র জয় করেছি তারাও এ কাজে যথেষ্ট পুরনো। ক্রমান্বয়ে তাদের গবেষণা সমাপ্ত করে এখন তারা সমুদ্রের তলদেশ থেকে জ্বালানি আহরণের কাজে ব্যস্ত। অথচ আমরাও শুনতাম ৩ দশক পূর্বেই যে, তেল-গ্যাসের উপর ভাসছে বঙ্গোপসাগরের জল। কিন্তু কারিগরী জ্ঞানের অভাব, ব্যয় বাহুল্য, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এসব বিষয়ে কোনো আশার সঞ্চার হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের অধীনে দেশের কিছু কিছু ক্ষৈত্রিক (sectoral) উন্নতির প্রেক্ষাপটে সময় ক্রমান্বয়ে পাল্টে যাচ্ছে।
কিন্তু এ ঐশ্বর্যাধারকে চিনতে আমরা অনেক বিলম্ব করে ফেলেছি। পৃথিবীর দেশে দেশে, সমুদ্র সম্পদ আহরণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের যাত্রা শুরু হয়েছে বহু পূর্বেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতই এ কাজে হাত দিয়েছিল আনুমানিক ২ দশকেরও পূর্বে। ২০১২ সালে যে মিয়ানমারের সাথে আমরা ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র জয় করেছি তারাও এ কাজে যথেষ্ট পুরনো। ক্রমান্বয়ে তাদের গবেষণা সমাপ্ত করে এখন তারা সমুদ্রের তলদেশ থেকে জ্বালানি আহরণের কাজে ব্যস্ত। অথচ আমরাও শুনতাম ৩ দশক পূর্বেই যে, তেল-গ্যাসের উপর ভাসছে বঙ্গোপসাগরের জল।
সরকারি উদ্যোগের অনুপুংখ আলোচনার পূর্বে বিশ্বব্যাপী Blue Economy বা নীল অর্থনীতির উদ্যোগটি কীভাবে রচিত হয় সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এটি আসলে এক বিকল্প অর্থনীতি যা কোনো জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অপূর্ণতা ঘোচাতে সক্ষম। সমুদ্রের উপর নির্ভরশীলতার এ বিকল্প পথেই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। ব্লু ইকোনমির মূল উপাদান মৎস্য ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণি, সমুদ্র তলদেশের তৈল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ, সমুদ্রনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য (Meritime Trade), পর্যটন ইত্যাদি। ২০১০ সালে Gunter Pauli’র ‘The Blue Economy: 10 years, 100 innovations, 100 million jobs’ গ্রন্থের মাধ্যমে নীল অর্থনীতি ধারণাটি জনপ্রিয় হতে থাকে, পূর্বের সবুজ অর্থনীতি নীল অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়।
তৎপরবর্তীতে ২০১২ সালে রিও ডি জেনেরোতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) সংক্রান্ত যে ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে এটিকে বলা হয়েছিল ‘নীল সমুদ্র অর্থনীতি’। তখন নেতৃবৃন্দ এর লক্ষ নির্ধারণ করেছিলেন নিম্নরূপভাবে: “Improvement of human well-being and social equity, while significantly reducing environmental risk and ecological scarcities.” সম্মেলনউত্তর গৃহীত দলিলকে জাতিসংঘ শিরোনাম দিয়েছিল ‘Future We Want..’ এতে জাতিসমূহের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সমুদ্রের অবদান বিধৃত হয়েছিল। প্রতিবেদনের এ সংক্রান্ত সারবস্তু ছিল, “We stress the importance of the conservation and sustainable use of the oceans and seas and of their resources for sustainable development.” পরে এ বিবৃতিকেই ঈষৎ পরিবর্তন করে এসডিজির ১৪ নম্বর লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। পরিবেশের অবনতিকে প্রতিরোধ করে যে উন্নয়ন পরে সেটিই এ প্রক্রিয়ার মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। ঐদিকে বিশ্বঅর্থনীতির অন্যতম নিয়ন্তা European Commission এক ধাপ এগিয়ে আসে। তারা নীল অর্থনীতির একটি সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করেন এভাবে, “All economic activities related to the oceans, seas and coasts. This includes the closest direct and indirect supporting activities necessary for the functioning of these economic sectors, which can be located anywhere, including in landlocked countries.” এ সংজ্ঞা অনুসারে আফগানিস্তান, ভুটান, লাও পিডিআর, আর্মেনিয়া, কাজাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, আজারবাইজান, কিরগিস্তান, নেপাল এসব দেশও নীল অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সাথে যুক্ত হতে পারবে যাদের কোনো সমুদ্রসংযোগ নেই।
২০১২ এবং ’১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে বাংলাদেশ প্রতিবেশি মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বিবাদ মিটিয়ে বিপুল পরিমান সমুদ্রাঞ্চল জয় করে। এ বিজিত সমুদ্রাঞ্চলের পরিমান ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার যার মধ্যে এখন Exclusive Economic Zone অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমাদের মোট সমুদ্রসীমার ২০% ভাগ উপকূলীয়, ৩৫% ভাগ অগভীর (shallow shelf sea), বাকি ৪৫% ভাগই গভীর সমুদ্র। প্রতিবেশিদের সাথে আমাদের সমুদ্র বিজয়ের পূর্বে মোট সমুদ্রাঞ্চলের পরিমান ছিল মাত্র ২,২৯৭ বর্গকিলোমিটার। এ বিপুল পরিমান প্রাপ্ত জলরাশির ৪৫% ভাগ গভীর জল থেকে আমরা এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই উত্তোলন করতে পারছিনা, ফলে দেশ মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হচ্ছে (উল্লেখ্য যে, বিজিত সমুদ্রসীমাসহ মোট সমুদ্রের পরিমান বাংলাদেশের প্রায় সমান। মাত্র ২৬,৪৬০ বর্গকিলোমিটার কম)। কারিগরী জ্ঞান ও উপযুক্ত নৌযানের অভাবে এবং সঠিক নেতৃত্বের উদ্যোগের অনুপস্থিতিতে আমরা যুগের পর যুগ কেবল বঞ্চিত হচ্ছি। কিন্তু সরকার এ বঞ্চনার অবসান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সমুদ্র সম্পদের বিপুল সম্ভাবনার সুষ্ঠু ব্যবহার এবং এ থেকে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনই এখন ব্লু ইকোনমির মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সমুদ্রের মতোই এ অর্থনীতির ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক, গভীর এবং হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনাযুক্ত। সংক্ষেপে ক্ষেত্রগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হল:

সরকারের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এ সংক্রান্ত যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ব্লু ইকোনমির সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কাজ সমন্বয় করবে। আর এ উদ্দেশ্যে উক্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে সৃজিত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্লু ইকোনমি সেল। এ সেল সময়ে সময়ে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মাধ্যমে অর্জিত অগ্রগতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করবে। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময়ান্তর বিভিন্ন সভা ও সম্মেলন আহ্বানের দায়িত্বও এ সেলের উপরই বর্তেছে।
এর পূর্বেই ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভার সিদ্ধান্তের অনুবৃত্তিক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক’ ২৫ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হচ্ছেন এ কমিটির সমন্বয়কারী যে কমিটির মূল কাজ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহের স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন মনিটর করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহকে তিনমাস অন্তর সময়াবদ্ধ (স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি) কর্মপরিকল্পনা পেশের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। বর্তমানে সমন্বয়কারী সংস্থা হিসেবে সরকারের পক্ষে ব্লু ইকোনমি সেল সকল মন্ত্রণালয়ের সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা সমন্বয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। এ সেলের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৭ সালের ০৫ জানুয়ারি যেটির উদ্বোধন করেছিলেন বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, এমপি। উল্লেখ্য যে, মন্ত্রী হিসেবে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। সে কারণে পুরো খাতের সার্বিক কর্মকা-ই পরিচালিত হচ্ছে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের ছায়াতলে। বর্তমানে এসডিজির ১৪ নম্বর লক্ষ্য বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকিসহ ব্লু ইকোনমির সার্বিক কর্মকা-ই নিয়মিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মনিটর করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমির কার্যক্রম সমন্বয় সংক্রান্ত যে ১৫টি সিদ্ধান্ত ইতোপূর্বে প্রদান করা হয়েছিল সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ গুলোকে কেন্দ্র করেই পরবর্তী কার্যক্রমসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। বিষয়াটি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা প্রদানের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে এগুলো উল্লেখ করা হল:
এর পূর্বেই ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভার সিদ্ধান্তের অনুবৃত্তিক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক’ ২৫ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হচ্ছেন এ কমিটির সমন্বয়কারী যে কমিটির মূল কাজ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহের স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন মনিটর করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাসমূহকে তিনমাস অন্তর সময়াবদ্ধ (স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি) কর্মপরিকল্পনা পেশের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। বর্তমানে সমন্বয়কারী সংস্থা হিসেবে সরকারের পক্ষে ব্লু ইকোনমি সেল সকল মন্ত্রণালয়ের সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা সমন্বয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। এ সেলের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৭ সালের ০৫ জানুয়ারি যেটির উদ্বোধন করেছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, এমপি। উল্লেখ্য যে, মন্ত্রী হিসেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। সে কারণে পুরো খাতের সার্বিক কর্মকা-ই পরিচালিত হচ্ছে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের ছায়াতলে। বর্তমানে এসডিজির ১৪ নম্বর লক্ষ্য বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকিসহ ব্লু ইকোনমির সার্বিক কর্মকা-ই নিয়মিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মনিটর করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমির কার্যক্রম সমন্বয় সংক্রান্ত যে ১৫টি সিদ্ধান্ত ইতোপূর্বে প্রদান করা হয়েছিল সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ গুলোকে কেন্দ্র করেই পরবর্তী কার্যক্রমসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। বিষয়াটি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা প্রদানের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে এগুলো উল্লেখ করা হল:
ব্লু ইকোনমির কার্যক্রমে মৎস্য খাতের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আমরা গভীর সমুদ্র থেকে এখনও কোনো মৎস্য আহরণ করতে সক্ষম হইনি যেভাবে সক্ষম হয়েছে ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো। বর্তমানে ‘মীন সন্ধানী’ নামক জাহাজটি সীমিত পরিসরে মৎস্য অনুসন্ধানের কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। আশা করা যায় শীঘ্রই তারা টুনামাছসহ অন্যান্য গভীর জলের মাছ ধরতে সক্ষমতা অর্জনের কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ইতোমধ্যেই ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০১৭’ মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। তাছাড়া পিরোজপুর, পটুয়াখালী, মংলা ও লক্ষীপুরে সামুদ্রিক মাছ প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও রপ্তানিকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সমুদ্র থেকে তৈল-গ্যাস আহরণের সম্ভাবনা যেমন অপার, তেমনি এটি দীর্ঘদিন যাবৎ এক গণদাবী হিসেবে বিরাজ করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখনও আমাদের সক্ষমতা অর্জিত হয়নি। এ সক্ষমতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর এবং পেট্রোবাংলা কর্তৃক গবেষণা জাহাজ/ভেসেল ক্রয়ের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। জিএসবি একটি Dynamic Positioning Research Vessel সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। প্রস্তাবিত এ গবেষণা জাহাজটি ভূতাত্ত্বিক জরিপ, Seismic survey, seabed mapping I database তৈরির কাজে ব্যবহৃত হবে।
অন্যদিকে ব্লু ইকোনমির সার্বিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সমুদ্র গবেষণার উদ্দেশ্যে পেট্রোবাংলাও অত্যন্ত দ্রুততার সাথে একটি জাহাজ ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রয়োজনে ২০১০ সালের ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ এর অধীনে এ জাহাজ সংগ্রহ করা হবে। প্রস্তাবিত এ জাহাজ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স ও জিএসবি সম্মিলিতভাবে এবং প্রয়োজনানুযায়ী সময়ে সময়ে ব্যবহার করবে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন সরকারের আমলে ইতোমধ্যেই যে দীর্ঘ অলস সময় ব্যয় করে ফেলেছে সেটির কথা স্মরণ রেখে এ সংক্রান্ত চাহিদা নিরূপন কমিটি অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তার প্রতিবেদন দাখিল করেছে। একটি মাল্টিরোল ওশানোগ্রাফিক জাহাজ (off the shelf/new) ক্রয়ের লক্ষ্যে জিএসবি, বাপেক্স ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে চাহিদা সংগ্রহের জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে যে, ব্লু ইকোনমির স্বপ্ন ও উদ্যোগ বাস্তবায়নের গতি এবং চেতনার সাথে সঙ্গতি রেখে সবাই কর্মতৎপর রয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, ১৬ মার্চ (২০১৭) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ও বিজ্ঞান গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের জাহাজ সংগ্রহের ইচ্ছে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ব্লু ইকোনমির উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কারিগরী জ্ঞানের সবিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সে কারণে নৌবাহিনীর কারিগরী সেবা গ্রহণ ও এর সাহসী ভূমিকার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোর জন্য সকল বিভাগই তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এতোদিন কোনো সাব্মেরিন ছিলনা। কিন্তু সম্প্রতি নৌবাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রমের সাথে দুটি সাব্মেরিন যুক্ত হয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় ৯১ বছর পূর্বে (৩১-০৭-২৬) চট্টগ্রামে বসেই লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী ‘সিন্ধু’ কবিতা যাতে তিনি সাব্মেরিনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এতো বছর পর আমাদের নৌবাহিনী সাব্মেরিনের মালিকানা অর্জন করলো। এ অর্জন নিঃসন্দেহে নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রভূত অবদান রাখবে। এ সংযোজন ব্লু ইকোনমির জন্যও ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। এমতাবস্থায় আশা করি বর্তমান সরকারের গতিশীল নেতৃত্বে সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ব্লু ইকোনমির কর্মসূচী বাস্তবায়নে জাতি কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে। সম্প্রতি (১৪ মার্চ) বাংলাদেশ সরকার কোরিয়ার পোসকো-দাইউর সাথে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তা এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলেই আমাদের বিশ্বাস।
গোলাম শফিক: লেখক, কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক। সরকারের অতিরিক্ত সচিব (সেল চীফ, ব্লু ইকোনমি সেল), বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।