
আবদুল্লাহ ওমর সাইফ
নূহনবীর বংশধরেরা সবাই নাকি প্রথমদিকে একই ভাষায় কথা বলত। তা সে ভাষা কেমন ভাষা, তার আকরণ ব্যাকরণ বলে কিছু আদৌ ছিল কী না, আর থাকলেও সেসব লোকে মেনে চলতে কী না এ ব্যাপারে তেমন শক্ত করে কিছু বলা মুশকিল।
কারণ ধর্মগ্রন্থে সাধারণত বিশদ বিবরণ থাকে না। সেখানে শুধু বলা হয়েছে নূহনবীর এই বংশধরেরা সবাই মিলে একদিন সিদ্ধান্ত নিল তারা একটা বড় শহর গড়বে। পৃথিবীর পুবদিকটা তখন অনেক সুজলা সুফলা, উর্বর আর উষ্ণ অঞ্চল ছিল- শহর তৈরির জন্যে আদর্শ জায়গা। কিন্তু বললেই তো আর সব চট করে তৈরি করা যায় না। একটা শহর বানানো যে সে ব্যাপার নয়। এর জন্যে লাগে অনেক বুদ্ধি, চিন্তা আর কাজের সমন্বয়। তবে যেহেতু সকলে মিলে একই ভাষায় কথা বলত, তাই একে অপরকে কাজকর্ম বা হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিতে খুব একটা বেশি দেরি হলো না। অতি অল্প সময়েই দেখতে দেখতে একটা দুর্দান্ত শহর তারা গড়ে তুলল। আর কী অতুলনীয় তার রুপ। চৌকস ঘরবাড়ি, দালান, প্রাসাদ, সুন্দর নহর। তার ওপর দেখবার মত রাস্তাঘাট, সুবেশী নরনারী। শহরের পাশ দিয়ে কূল কূল বয়ে চলছে স্রোতস্বিনী নদী। যেন ছোটখাট একখানা স্বর্গ। কিন্তু মানুষের মনের ভেতর ময়লা না থেকে উপায় কী। যত ভালোই সে বাইরে থাকুক, অহংকার জিনিসটা আসলে তার মজ্জাগত। এর হাত থেকে নিস্তার নেই। দেখতে দেখতে নূহনবীর বংশধরেরাও একসময় দারুন অহংকারী হয়ে পড়ল। অহংকারের চোটে তারা শুরু করলো ঈশ্বরের বলে কয়ে দেয়া আইনের বিশ্রী লঙ্ঘন। তারা এতদূর বাড়ল যে স্বর্গকে এক হাত দেখে নিতে নিজেরা উঁচু স্তম্ভ বা টাওয়ার পর্যন্ত বানাতে আরম্ভ করল। ভাবখানা এমন যেন খোদ ঈশ্বরকেই তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।
তখন ঈশ্বর ভারী কুপিত হলেন। তিনি ঠিক করলেন মানুষকে একটা অভিনব শাস্তি দেবেন। এর আগে ঈশ্বর নূহনবীর অবাধ্য লোকজনকে সব প্লাবনের পানিতে চুবিয়ে মেরেছিলেন। আর এবার ঈশ্বর করলেন এক অদ্ভুত কাজ। তিনি সব মানুষের মুখের ভাষাকে অদল-বদল করে অনেক রকমের ভাষা তৈরি করে দিলেন। এতে মানুষের দারুন অসুবিধা হল। তারা আর নিজেদের মধ্যে ঠিকঠাক ভাবের আদান প্রদান করতে পারল না। যার দরুন তাদের অহংকারের মাথায় পড়ল প্রচ- বাড়ি। তারা সকলে ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে এক সময় নিজেদের মধ্যে দলাদলি আরম্ভ করল। ফলে একসঙ্গে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। ধীরে ধীরে তাদের প্রিয় অহংকারের শহরটা একেবারে পরিত্যক্ত হল। যে শহরে একদিন তাদের গর্বে মাটিতে পা পড়ত না, সেই শহর বালির আস্তরণে ঢেকে গেল। ঈশ্বর ভাষা দিয়ে মানুষকে জব্দ করলেন।
অদ্ভুত এই কাহিনীটা বাইবেলে আছে। সেখানে এই শহরের নাম দেয়া হয়েছে বাবেল। বাবেল অর্থ বিভ্রান্তি। মানুষের গর্ব ঈশ্বর পছন্দ করেন না। তাই তিনি ভাষাকে অস্ত্রের মত প্রয়োগ করে মানুষের দর্প চূর্ণ করেছেন। তবে কোরান শরীফে এ ব্যাপারে একটা সুন্দর কথা বলা আছে। সেখানে বলছে আল্লাহতালা এত সব জাতি সৃষ্টি করেছেন যাতে মানুষ একে অপরকে জানতে পারে। একে অপরকে জানার ব্যাপারে এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথমদিককার মুসলমানেরা তাই গ্রিক ভাষা শিখে সে ভাষার শ্রেষ্ঠ বইগুলো আরবীতে অনুবাদ করে ফেলেছিলেন। মুসলমান দার্শনিকদের সবাই সক্রেটিস, প্লেটো বা এরিস্টটলকে শেখ বা ওস্তাদ মনে করতেন। সক্রেটিসকে তারা ডাকতেন সুক্রেত, প্লেটোকে আফলাতুন আর এরিস্টটলকে আরিস্তাতালিস।
সেখানে এই শহরের নাম দেয়া হয়েছে বাবেল। বাবেল অর্থ বিভ্রান্তি। মানুষের গর্ব ঈশ্বর পছন্দ করেন না। তাই তিনি ভাষাকে অস্ত্রের মত প্রয়োগ করে মানুষের দর্প চূর্ণ করেছেন। তবে কোরান শরীফে এ ব্যাপারে একটা সুন্দর কথা বলা আছে। সেখানে বলছে আল্লাহতালা এত সব জাতি সৃষ্টি করেছেন যাতে মানুষ একে অপরকে জানতে পারে। একে অপরকে জানার ব্যাপারে এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথমদিককার মুসলমানেরা তাই গ্রিক ভাষা শিখে সে ভাষার শ্রেষ্ঠ বইগুলো আরবীতে অনুবাদ করে ফেলেছিলেন। মুসলমান দার্শনিকদের সবাই সক্রেটিস, প্লেটো বা এরিস্টটলকে শেখ বা ওস্তাদ মনে করতেন। সক্রেটিসকে তারা ডাকতেন সুক্রেত, প্লেটোকে আফলাতুন আর এরিস্টটলকে আরিস্তাতালিস।
পরবর্তী যুগে ইউরোপ আবার আরবী থেকে ল্যাটিনে সেসব বই অনুবাদ করিয়ে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াত। ইউনানী চিকিৎসা বলে আমাদের দেশে একটা চিকিৎসা পদ্ধতি আছে সেটার নামকরণ হয়েছে গ্রিক ভূখ- আইয়োনিয়া থেকে। আইয়োনিয়া পরবর্তীতে আরবী ভাষাভাষীদের কাছে পরিচিত হয়েছে ইউনান নামে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রিক-আরব উৎসের। পূর্ব পশ্চিমের হাত ধরাধরি করে হাঁটার চমৎকার উদাহরণ।
আসলে ভাষার জন্ম মানুষের মনের ভাবের আদান প্রদানের জন্যে, শ্রেফ যোগাযোগের জন্যে নয়। এটাও ঠিক যে ভাষার উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা যারা করেন তাদের কেউই একশভাগ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না। কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে কিছু বলতে গেলে নিখুঁত প্রমাণের দরকার হয়। অথচ ভাষা গবেষণায় সে জিনিস হয় না। যেমন আদিম মানুষের হাড়গোড় আমরা পেয়েছি ঠিকই এবং তাদের গলার হাড়ের গড়ণ দেখে স্পষ্ট বোঝাও যাচ্ছে তারা কথা কইবার সামর্থ্য অব্দি রাখত। কিন্তু ঠিক কী ছিল তাদের ভাষা সে জিনিস তো আর একদম নিশ্চিত হয়ে বলবার উপায় নেই। এ বিষয়ে বড়জোর থিওরি দাঁড় করানো যায়, কিন্তু সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এক্ষেত্রে ঠকে যাবার আশঙ্কা থাকে অনেক। ভাষার জন্ম নিয়ে মার্কিন প-িত নোয়াম চমস্কিরও সেরকম একটা তত্ত্ব আছে। তিনি মনে করেন শুধু যোগাযোগ তো প্রাণীজগতের সবাই করতে পারে। ছোট্ট ছোট্ট পিঁপড়ারা নিজেদের মধ্যে খাবার তৈরিতে যে রকম পারস্পরিক বোঝাপড়া দেখায় সেটা তো ভাষার সাহায্য ছাড়াই হয়। তাদের না আছে ভোকাল কর্ড, না আছে গ্রে ম্যাটার। চমস্কি মনে করেন যোগাযোগের চাইতেও ভাষা তৈরির অনেক বড় কারণ হচ্ছে আমাদের ভাবের আদান প্রদান করার ইচ্ছা। মানুষ সবসময় চেয়েছে তার মনের কথা আরেকজন জানুক। ভাষার শব্দের ভা-ারও তৈরি হয়েছে এভাবে। বাংলায় আমরা সুড়ঙ্গ বলে যে শব্দটা ব্যবহার করি সেটা কিন্তু আসলে গ্রিক শব্দ। মানুষ এই আধুনিক যুগে এসেও শব্দের ভা-ার ক্রমশ বাড়িয়েই যাচ্ছে। আজকাল গুগলিং বলতে ইন্টারনেটে কোনো কিছু খোঁজাকে বোঝায়। কুড়ি বছর আগে কেউ গুগলিং বললে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হত।
প্রাণীদের মধ্যে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ কিংবা মৌন ইশারার একটা ব্যাপার আছে, যেটা বাঁদর বা অন্য স্তন্যপায়ীদের মধ্যে হরহামেশা দেখা যায়। বাঁদরেরা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইঙ্গিতের ভাষায় একে অপরকে তথ্য জানাতে সক্ষম। কাছ দিয়ে বাঘ ভাল্লুক গেলে বাঁদরেরা অঙ্গভঙ্গি করে একে অপরকে সতর্ক করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে নানান ধরণের ধ্বনি উচ্চারণ করেও তারা ওয়ার্নিং এলার্মের কাজ করে। বাঁদরের এই ইশারাকে যদি আমরা ভাষায় অনুবাদ করি তাহলে সর্বোচ্চ যেটা দাঁড়াবে সেটা হচ্ছে- ঐ যে বাঘ আসছে। এরপর থেকে যত বার তারা বাঘ দেখবে, ততবার এই একই সাবধান বাণী উচ্চারণ করবে। এর থেকে বেশি কোনো তথ্য বাঁদর জাতির কেউ বোধহয় পায় না।
এখানেই মানুষের সাথে তাদের বিরাট পার্থক্য। বাঁদরের জায়গায় মানুষ থাকলে শুধু ঐ বাঘ আসছে বলেই ক্ষান্ত হতো না। মানুষ তার ভাষাকে ব্যবহার করে জ্ঞান তৈরি করত। বাঘেদের দেখতে কার মত লাগে, লতা পাতা ঘাসে তার গা ঘষার শব্দ কেমন- এসব নিয়ে মানুষ রীতিমত গল্পগাঁথা তৈরি করে ফেলত। দূর-দূরান্তের মানুষ বাঘ না দেখলেও কল্পনার চোখে বাঘের ডোরাকাটা দাগ ঠিক মিলিয়ে নিত। আবার রাতের আঁধারে আগুনের সামনে কু-লি পাকিয়ে বসে প্রাচীন গল্পকাররা বাস্তব আর কল্পনা মিশিয়ে কাহিনি তৈরি করত। এভাবে এক সময় তৈরি হত মিথ। মিথ সত্য না মিথ্যা সে নিয়ে মাথা ব্যথার কিছু নেই। মিথ হচ্ছে সেই গল্প যা মানুষ বলতে চায় কিন্তু ভাষার দৌরাত্ম সীমিত থাকায় সরাসরি সেসব বলতে পারে না। তখন উপমা, গল্প, প্রতীক এসবের মাধ্যমে মানুষ তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। মিথের সমস্যা হচ্ছে হুট করে শুনলে সেটাকে গাঁজাখুরি গপ্পো বলে মনে হয়। কিন্তু গভীরে গেলে একটা জাতির সামগ্রিক সুখ দুখ, জ্ঞান-সবকিছুর একটা আলেখ্য পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, মানুষের গল্প তৈরির এ ক্ষমতাটা একদম নিজস্ব। শুধু প্রযুক্তির ব্যবহার জানে বলে মানুষ সৃষ্টির সেরা এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। মানুষ ছাড়াও প্রাণীজগতের অনেকে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে জানে। আফ্রিকার একদল বাঁদর শুনেছি লাঠির বাড়ি দিয়ে শক্ত খোলসওয়ালা ফল ফাটিয়ে খায়। কাঠবাদাম পিষে খেতে পাথরের শিলপাটা ব্যবহার করে। তারপর বাবুই পাখির বাসা, কাকের বাসা- এসব একেকটা দুর্দান্ত টেকনোলজির উদাহরণ। মজার তথ্য হচ্ছে কাক খেলনা তৈরি করে খেলে এমনটাও নাকি লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা।
তাহলে এদের সাথে মানুষের পার্থক্য কোথায়?
পার্থক্যটা হচ্ছে গল্প তৈরির ক্ষমতায়। বাঁদর, বাঘ ভাল্লুক, উল্লুক এদের কেউ গল্প বলতে জানে না। আর এটাই সবচেয়ে বড় ফারাক। ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করে মানুষ একে অপরের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে। এসবই একসময় জ্ঞানে পরিণত হয়। আর এই জ্ঞান চর্চাই আদর্শের সূত্রপাত করে। মানুষ একটা আদর্শের জন্যে সংঘবদ্ধ হতে জানে। প্রাণীজগতের আর কেউ এ ক্ষমতা দেখায় না। আপনি দুশোটা পাখিকে একই সঙ্গে চুপ করিয়ে কোনো কথা শোনাতে পারবেন না। অথবা একটা বাঁদর হুপ হাপ করে কিছু বলছে আর একশোটা বাঁদর চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছে- এ বস্তু কোথাও হয় না। অথচ ফিদেল ক্যাস্ট্রোর এক ভাষণে দুশো কেন দুশো হাজার লোক চুপ করে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনত। আদর্শের পেছনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে যাওয়ার এই ক্ষমতা ভাষা না থাকলে হতো না। ভাষাই আদর্শ তৈরি করে। আর শব্দ হচ্ছে ভাষার গাঁথুনি। কবিরা এই যথার্থ শব্দের জন্যেই মাথা কুটে মরেন। উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের ভাষায়- আজ এক হারফ কো ফির ঢুঁন্ডতা ফিরতা হ্যায় খায়াল। কবিরা এই হরফই খুঁজে বেড়ান।
প-িতদের মতে আধুনিক মানুষ নাকি পৃথিবীতে এসেছে কয়েক মিলিয়ন বছর আগে। কিন্তু সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছে এই সেদিন, দশ বারো হাজার বছরের বেশি হবে না। প্রথমদিকে মানুষ ছিল অরণ্যচারী। বনের ফলমূল আর একটা দুটো প্রাণী মেরে খাওয়ার অভ্যাস ছিল। ধর্ম, নগর, কৃষিকাজ- এসব তাদের মাথাতেও আসেনি বহু বছর। শেষ বরফ যুগ শেষ হয় প্রায় পনের হাজার বছর আগে। এর পরেই মানুষের মাথায় কী এক আশ্চর্য ঝিলিক খেলে যায়। যেন উন্নতির চাকা বাঁই বাঁই করে ঘুরতে আরম্ভ করে। বারো তের হাজার বছরের মধ্যে দারণ দারুন সব সভ্যতার জন্ম হয়। অনেকে মনে করেন মানুষের বুদ্ধি খেলে যাবার পেছনে রান্নার হাত আছে। মানুষ যখন কাঁচা খেত তখন নাকি শরীরের এনার্জির সবটাই চলে যেত খাবার হজম করাতে। কাঁচা খাবার হজম করতে পরিপাকতন্ত্রকে লড়তে হত বেশি। কিন্তু রান্না শেখার পর মানুষ কাঁচা খাওয়া বন্ধ করে দিলো। এতে লাভ হলো মাথার। কারণ খাবার সহজে হজম হওয়াতে সব এনার্জির প্রায় পুরোটাই মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে শুরু করল। এর ফলে ভাষার ব্যবহার বাড়তে লাগলো। মস্তিষ্ক বসে বসে চিন্তা করার সুযোগ পেল। সুসংবদ্ধ ভাষা তৈরি হল। এখন ভাবনা ও অভিজ্ঞতা আর শুধু একজন মানুষের মনেই সীমাবদ্ধ রইলো না। সে আলো ছড়িয়ে গেল সবখানে।
পার্থক্যটা হচ্ছে গল্প তৈরির ক্ষমতায়। বাঁদর, বাঘ ভাল্লুক, উল্লুক এদের কেউ গল্প বলতে জানে না। আর এটাই সবচেয়ে বড় ফারাক। ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করে মানুষ একে অপরের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে। এসবই একসময় জ্ঞানে পরিণত হয়। আর এই জ্ঞান চর্চাই আদর্শের সূত্রপাত করে। মানুষ একটা আদর্শের জন্যে সংঘবদ্ধ হতে জানে।
এই রান্না থিওরি অবশ্য প্রমাণিত নয়। কারো কারো ধারণার বেশি কিছু নয়। তবে মানুষ উদ্বৃত্ত খাবার যেদিন থেকে তৈরি করা শিখল, সেদিন থেকেই মানুষের হাতে এলো প্রচুর সময়। কৃষিকাজ করার আগে মানুষের হাতে বড় একটা সময় থাকত না। শিকার ও ফলমূল সংগ্রহের জীবনটায় সারাদিনই নষ্ট হত ঘোরাঘুরিতে। তাছাড়া অনেকে আগুন দিয়ে ঝলসিয়ে খাবার চক্করেও যেত না। কাঁচা মাংসই কচকচ করে খেয়ে ফেলত। কিন্তু এক সময় মানুষ ধীরে ধীরে কৃষিকাজ শেখে, উদ্বৃত্ত খাদ্য তৈরি করতে শেখে। প্রাচীন নগরীগুলো খূঁড়লে বড় বড় শস্যাধার খুঁজে পাওয়া যায়। এই শস্যাধারগুলোকে ঘিরেই সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের বিভিন্ন স্তর তৈরি হয়। কারণ অতিরিক্ত খাদ্য তো শুধু তৈরি করলেই হলো না। সেসব রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা পাহারা দেয়াও তো চাই। আর সমাজে বিভিন্ন রকমের কাজের মানুষ থাকলে সেখানে এক সময় শ্রেণী তৈরি হয়। হিন্দুধর্মে যে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের ধারণা প্রচলিত আছে, অনেকে মনে করেন এসবের উৎপত্তির পেছনে প্রথমে কাজ করেছে কাজকর্মের বিভিন্নতা। ব্রাক্ষণ পুঁথি পড়বে, ক্ষত্রিয় যুদ্ধ করবে, বৈশ্য ব্যবসা করবে আর শূদ্র্যরা কায়িক শ্রম করবেÑ শুরুতে ব্যাপারটা হয়ত তেমন জটিল মনস্তাত্ত্বিক কিছু ছিল না। পরে দুষ্টু লোকেরা এটাকে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যবহার করেছে, এক্সপ্লয়েট করেছে। মানুষ নিজের কাজকে সব সময় বড় করে দেখে। আর এখান থেকেই সব সমস্যার উৎপত্তি। নিজেরটুকু ছাড়া আর বাকীদেরটা নগণ্য এই ধারণাটাই শ্রেণী বৈষম্য তৈরি করে। তারপর একবার শ্রেণীবৈষম্য তৈরি হয়ে গেলে ক্ষমতাশীলরা আর কিছু না পেয়ে নিজেদের বংশ গৌরব শুরু করে দেয়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্যে জাত পাতের ধোয়া তোলে। প্রাচীন মিশর থেকে মেসোপটেমিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা সব জায়গাতেই রাজারা প্রথম দিকে নিজেদের দেব সন্তান বলে মানুষের কাছে পরিচয় দিত। কেউ সূর্যসন্তান, কেউ জলদেবতার পূত্র। হাস্যকর হলেও নিজের জন্মটাকে গৌরাবান্বিত করার এ প্রবণতা আজকের দিনেও আছে। তবে এখন রীতি বদলেছে, ভাষাও বদলেছে। এ যুগে সূর্যসন্তান পরিচয় দেয়াটা হাস্যকর। তারপরেও আমার পূর্ব পুরুষ যে বিরাট জমিদার বা নবাব বংশীয় ছিলেন এ কথা আলাপের ফাঁকে গুঁজে দিতে পারলে আমরা আরাম বোধ করি। আবার ভাষার কথায় ফিরে আসি। বোধহয় মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের মানুষই প্রথম একটু আয়েশ করে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পায়। কারণ সংঘবদ্ধ কৃষিকাজের আদি নিদর্শন সেখানেই পাওয়া গেছে। ইরাকের সুমের এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। প্রায় সাড়ে ছয় সাত হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য উরুক, কিশ, উর এইসব নামে দুর্দান্ত সব জনপদ গড়ে তোলে। এখানে শস্যাধার ছিল, দেব-মন্দির ছিল, উন্নত ঘরবাড়ি, বাগান সব ছিল। তবে সবচেয়ে জৌলুসময় সম্পদটা ছিল সম্ভবত তাদের ভাষা। এ ভাষার খোঁজ পাওয়া যায় সুমেরের ইয়েক শহরে প্রাপ্ত পাঁচ হাজার বছর আগের কীলকলিপি থেকে। পেরেকের মত দেখতে এই লিপিগুলোতে প্রায় দু হাজারের মত চিহ্ন ছিল। এখান থেকেই আন্দাজ করা যায় তাদের ভাষা কী রকম উন্নত ছিল। ইরাকের প্রাচীন কিশ শহরে পাওয়া গেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন। পাথরের গায়ে খুঁটে কীলকলিপিতে খোদাই করা এই বস্তুটি আসলে দেবরাজ এনলিলের উদ্দেশ্যে লেখা একটি স্তুতি। এ জিনিস যদি সুর করে মন্দিরে মন্দিরে পাঠ করা হত, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় এটি আদিতম প্রার্থনা সঙ্গীত। এর বয়স পাঁচ হাজার ছশো বছর। এনলিলের স্তুতি নামের এ সব প্রার্থনার ভাষায় কবিরা উপমা ব্যবহার করেছেন দেবতার তুষ্টি সাধনে। একটা ছোট উদাহরণ দিই।
দেবরাজ এনলিলের আদেশ মহান, তার বাণী পবিত্র
তিনি যা বলবেন তার পরিবর্তন হয় না
তিনি যে ভাগ্য দেন তা চির অটুট
তার দৃষ্টিতে পর্বত পর্যন্ত ভয়ে ওঠে কেঁপে…
পিতা এনলিলের সামনে সব দেবতা মাথা নত করে
তিনি আসীন থাকেন পবিত্র বেদীতে
দেবতা আনুনাকী তার সামনে যায়
এনলিলের আদেশ বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করে
(এনলিলের স্তুতি, আনুমানিক ৩ হাজার বছর)
এখানে পর্বত শঙ্কিত হচ্ছে উপমাটা রীতিমত চোখে পড়ার মতন। এখানে ভাষার যে কারুকার্য বা উপমা ব্যবহার করা হয়েছে তার প্রভাব রয়ে গেছে পরবর্তী যুগের সাহিত্যেও। এনলিলের স্তুতির কয়েক হাজার বছর পরে বাইবেলের রচয়িকাররা লিখছেন,
তাঁকে দেখে পর্বত ভয়ে কেঁপে ওঠে
পাহাড় গলে যায়
তাঁর উপস্থিতিতে পৃথিবী ও
তার মধ্যে যারা আছে সব ভয়ে কেঁপে ওঠে
(নাহুম ১ঃ৫)
এই দুই প্রার্থনাতেই ঈশ্বরের ব্যক্তিত্ব বোঝাতে তাঁর ভয়ে পাহাড় পর্বত কেঁপে ওঠার উপমা আছে। এখনো আমরা খুব রাগী কারুর সামনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বলতে গেলে এরকম কিছু একটাই বলি। এ ধরণের অজস্র উপমা মানবজাতি একে অপরের কাছ থেকে খুব সম্ভব শিখে নিয়ে বলেছে। এটা না হলে মানুষের জ্ঞান সমৃদ্ধ হতো না। সাহিত্যে এ জন্যে উপমার ব্যবহার অনেক জরুরি। উপমা ভাষার অর্থকে আরো ব্যাপকতা দান করে।
ভাষার উৎকর্ষ তৈরিতে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা যেমন ছিল, তেমনি ছিল পুরোহিতদের অবদান। পুরোহিততন্ত্র অনেক ক্ষেত্রে নাক সিঁটকোনোর মত শোনালেও তাদের অবদানও কম নয়। আমরা বাঙ্গালিরা অনেক শব্দই বলি যেগুলো সংস্কৃত বা আরবী ফার্সি থেকে এসেছে। সংস্কৃত ছিল দেবভাষা। এ নিয়ে মাথা ঘামাত বৈদজ্ঞ পণ্ডিত পুরোহিতের দল। সাধারণ মানুষের অত সময় কোথায়। আবার আরবী ফারসি ভালো জানত মোল্লা বা মৌলবিরা।
ভাষার উৎকর্ষ তৈরিতে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা যেমন ছিল, তেমনি ছিল পুরোহিতদের অবদান। পুরোহিততন্ত্র অনেক ক্ষেত্রে নাক সিঁটকোনোর মত শোনালেও তাদের অবদানও কম নয়। আমরা বাঙ্গালিরা অনেক শব্দই বলি যেগুলো সংস্কৃত বা আরবী ফার্সি থেকে এসেছে। সংস্কৃত ছিল দেবভাষা। এ নিয়ে মাথা ঘামাত বৈদজ্ঞ পণ্ডিত পুরোহিতের দল। সাধারণ মানুষের অত সময় কোথায়। আবার আরবী ফারসি ভালো জানত মোল্লা বা মৌলবিরা। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তাদের নিত্য ব্যবহার্য অনেক শব্দ সকলে এখনো ব্যবহার করে। কেউ কী পারবে ঠিক ঠিক হিন্দু বা মুসলমান উৎস থেকে পাওয়া শব্দ বাদ দিয়ে কথা বলতে? যে বলার চেষ্টা করবে সে পাগল ছাড়া আর কিছু না। আদিম দেবমন্দিরগুলোতে পুরোহিতের দল সব সময় যে মানুষকে চুষে খাবার আশায় বসে থাকত সেটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। পুরোহিতরা জ্ঞান চর্চাও করত, দেবতার উদ্দেশ্যে চমৎকার সব গান বানাত। সেসবের ভাষার উৎকর্ষতা ছিল। পরবর্তীতে লিপি উদ্ভাবনেও তারা মাথা ঘামিয়েছে। আমরা সবাই জানি মিশরীয় চিত্রলিপিকে হায়ারোগ্লিফস বলে। এটা গ্রীক শব্দ। এর অর্থ খোদাই করা পবিত্র অক্ষর। দেবতাদের খুশি করার এই যে প্রবণতা এটা কিন্তু পরবর্তীতে বর্ণমালা উদ্ভাবনে মানুষকে সাহায্য করেছে। এই সব চিত্রলিপিরও ধরণ ধারণ ছিল। এই হায়ারোগ্লিফ থেকেই পরে গড়ে ওঠে হায়ারেটিক (পুরোহিত লিপি) আর ডেমোটিক (সাধারণ লিপি)। পুরোহিতরা ব্যবহার করতেন হায়ারেটিক। সাধারণ মানুষের কাছে লিপি ছিল দৈনন্দিন হিসাব নিকাশের চেয়ে বেশিকিছুর জন্যে নয়। কে কটা মাছ বিক্রি করল, কার কাছে কয়টা মুরগি ধার রাখা হয়েছে- এ সমস্ত আটপৌরে হিসাব রাখা ছাড়া এর চেয়ে বেশিকিছু তাদের মাথায় আসেনি। কিন্তু পুরোহিতদের কাজটা ছিল অন্য। তারা সাধারণ মানুষের দেয়া ভেটে চলত ঠিকই কিন্তু নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্যে সব সময় অভিনব কিছু ভাবত। ভুলে গেলে চলবে না যে আগের যুগে এক পুরোহিত ছাড়া আর সবাইকে দিন আনি দিন খাই অবস্থায় দিন কাটাতে হত। জ্ঞান চর্চা করতে গেলে সময়ওতো চাই। কাজেই ভাষার প্রশ্নে কারুর অবদানই কম নয়।
মানুষ প্রাচীনকালে ঠিক কী ভাষায় কথা বলত কিংবা তাদের ভাষার মধ্যে সৌকর্য ছিল কী না এ তথ্য জানবার একমাত্র উপায় হচ্ছে অক্ষর তথা লিপি। লিপির উদ্ভব না ঘটলে এত সব কথা পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে হুবহু রেখে দেয়া যেত না। অনেকে মনে করেন ফিনিশীয়দের হাত ধরে লিপির উদ্ভব। আসলে কিন্তু তা না। ফিনিশীয়দেরও হাজার বছর আগে থেকে প্রচলিত ছিল হায়ারোগ্লিফিক্স বা চিত্ররেখা বা কীলক লিপি তথা কিউনিফর্ম। পরে ফিনিশীয়রা সেসব থেকে একটু অদলবদল করে ব্যবহার উপযোগী প্রথম বর্ণমালা তৈরি করে। তাই প্রথম বর্ণমালার কৃতিত্ব তাদের পাতেই পড়ে। আবার ফিনিশীয়দের হাতে বর্নের উদ্ভব ঘটার পর এর প্রভাব কেউই এড়াতে পারেনি। প্রাচীন গ্রীক ও ভারতবর্ষের ব্রাক্ষী হরফের মধ্যে প্রচুর মিল পাওয়া গেছে। ভাষাবেত্তাদের মধ্যে অনেকে মনে করেন ফিনিশীয়দের বর্ণগুলো ক্রমশ একটু অদল বদল হয়ে পৃথিবীর অন্যান্য হরফের মধ্যে ঢুকে গেছে। এসবের পক্ষে বিপক্ষে মতামত নেই তা নয়। তবে মিল যে এক রকম আছে সেটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেন। প্রশ্ন হচ্ছে এগুলো সব হলো কী করে? চিন্তাভাবনা একে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি না করলে মানুষের শব্দভাণ্ডার বাড়তো কী না সন্দেহ। একই জাতির লোক যে নিজেদের মধ্যেই শুধু কথা বলেছে তাও নয়। বিভিন্ন জাতির মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিশেছে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা বলাবলি করেছে। এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় ঢুকে মানুষের জ্ঞান বাড়িয়েছে।
মানুষ সভ্যতা গড়েছে অনেকদিন ধরে। হুট করে একদিনে এতসব কিছু গড়ে উঠেনি। এর জন্যে বহুদিন ধরে মানুষকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। আর সেসব চিন্তার সবই যে একদম ঠিক ছিল তাও নয়। অসংখ্য ভূল চুক হয়েছে। যুদ্ধ বিগ্রহ, মারামারি, খুনোখুনি হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সভ্যতার অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। একটা বরফের ছোট্ট গুঁড়ি যেমন ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ার সময় একটু একটু করে নিজের গায়ে তুষারের গুঁড়ো লাগিয়ে এক সময় প্রকা- বরফ-বলে পরিণত হয়, সভ্যতাও ঠিক সেইভাবেই এগোয়। দেখা যায়, প্রতিটা সভ্যতাই কোন না কোন ভাবে আরেক সভ্যতার কাছ থেকে আইডিয়া বা অভিজ্ঞতা ধার করে নিজে সমৃদ্ধ হয়েছে। সুদূর রোমের পম্পাই নগরীর ধ্বংসাবশেষে ভারতীয় সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। সেই হরপ্পা ও মহেনজোদাড়ো আমল থেকে পশ্চিমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। শুধু এসবই নয়। বৈদিক যুগের দেবতা মিত্রের পুজো অর্চনা ভারত পারস্য ছাড়িয়ে সেই ইউরোপের জার্মানি পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে। পৌত্তলিক রোমানরা প্রথম শতাব্দীতে মিত্রদেবের পুজো দিত। সারা ইউরোপ জুড়ে তার অনেক মন্দির ছিল। সেখানে ভক্তিভরে দেবতার আরাধনাও করা হত। এই মিত্র কাল্টের প্রভাব পরবর্তীতে গিয়ে আবার খ্রিস্টীয় রোমানদের ওপর পড়েছে। রোমানরা আগে ছিল পৌত্তলিক, পরে হয়েছে খ্রিস্টান। কিন্তু পৌত্তলিক রীতিনীতির অনেক কিছুই তাদের ধর্ম সংস্কারে ঢুকে গিয়েছে। সেসব অন্য কথা। কিন্তু যার মাধ্যমে এতসব ভাবের আদানপ্রদান হল সেটা কিন্তু শ্রেফ ভাষা। যেকোনো ভাষাতেই মানুষ যদি সুন্দর সুন্দর অর্থবাহী শব্দ তৈরি করার ব্যাপারে উৎসাহ না দেখাত তাহলে কিন্তু এত ভাববদলের কিছুই হতো না আর মানব সভ্যতাও এগোতে পারত না।