
উত্তম কুমার বড়ুয়া
বিশ্বের অন্যতম নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এদেশে নদীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান সহজে পাওয়া যায় না। তবে এদেশের ওপর দিয়ে সাতশ’র অধিক নদ-নদী, শাখা নদী ও উপনদী প্রবাহমান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উৎসে ঝরা লক্ষ কোটি বিন্দু বিন্দু জলরেখায় সৃষ্টি হয় এক একটি নদ বা নদী। আসলে পানির সমোচ্চশীলতা গুণের কারণে প্রাকৃতিকভাবে উচ্চতর স্থান থেকে নিুতর স্থানের দিকে গিরি বা সমতল খাতের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া জলধারাই নদী। সাধারণত নদীর উৎপত্তি পাহাড় বা পর্বতের অজস ক্ষীণ জলধারায় এবং সমাপ্তি নদী, হ্রদ বা সমুদ্রের পানির মাঝে। বাংলাদেশের বুক চিরে নদীর শত শত জলধারা এদেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে রেখেছে। নদীবাহিত পানি ও পলি এদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। কাব্য রসিক মন তার লেখায় কিছু নদীর নাম উল্লেখ করেছেন বা নদীর অন্তর্নির্হিত সৌন্দর্য নিয়ে কাব্য করেছেন। কেউবা কোন নদীর নামে গল্প উপন্যাস লিখেছেন। কেউ নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ, কেউ নদীর সর্পিল গতিতে বিস্মিত। কেউ এর বিশালতায় ভয় পেয়েছেন। কেউ ঢেউ দেখে পুলকিত, কেউ বা শিহরিত। কিন্তু নদী তার পথে তার মতো করে বয়ে যাচ্ছে যদি না কোন বাধা পায়। নদীর এক পাড় যদি ভাঙতে থাকে অন্য পাড় গড়ে যায়। আবার কখনও শ্রান্ত নদীর বুকে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ চরভূমি। ভাঙা-গড়া স্বপ্ন মেলাই নদীর জীবন। নদীর বুকে নৌকা চলে নানান রকম। কোনটি পাল তোলা, কোনটি পালবিহীন। কোনটির ছৈ আছে আবার কোনটির ছৈ নাই। ছৈ মানে ছাউনি। কখনও ভরা নদী, কখনোবা মরা নদী। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে নদীর চলার গতি ভিন্ন। শীতের মরা নদী বর্ষায় বেগমাবন। নদীর বুকের চলমান জলরাশি আমাদের খেলার জগৎকেও প্রসারিত করেছে নানান জল খেলার মাধ্যমে। আমরা জলতরীর মাধ্যমে অথবা নিজেরাই জলে নেমে জলকেলী করে জলসুখ আহরণ করি।
মানুষের হাসি-আনন্দ, দুঃখ-ব্যথার সাথী নিরন্তর বয়ে চলা এই নদী। নদীকে ঘিরে গড়ে উঠে এক বিশাল মানবমনন। কাহিনী, কাব্য, সাহিত্য, গান ও শত রূপকথায় এর বিস্তৃত পরিচয় মেলে। মানবজীবনে নদী এতটাই প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে যে, ধর্মের বিভিন্ন পর্যায়ে নদীকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সুতরাং মানবজীবনের শুরুতে নদী, অন্তে নদী, মধ্যে নদী, বাস্তবে নদী, কল্পনায় নদী এবং জীবনের গভীরেও নদী। জীবন বোধের গভীরতম স্থানে অন্তঃসলীলা নদী সতত প্রবাহমান, নদী ছাড়া মানবজীবন অচল। নদী ছাড়া সভ্যতার জয়রথ এতদূর এগিয়ে আসা কঠিন ব্যাপার ছিল। যেহেতু জলই জীবন। আর অফুরান বহতা জলের উৎস নদী। জল থাকলেই ঊষর মরু হয়ে উঠে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা ফুলে-ফলে কলকাকলীতে ভরপুর শোভাময় স্বর্গোদ্যান। নদী মানেই জীবনের হাজারো রূপ। ফুল, পাখি, কীটতঙ্গ, বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ চারপাশ। এখানে যাপিত জীবন হয় সদা সুখময়।
এবার কিছু নদ-নদীর নাম মিলিয়ে দেখি। যেমন সাঙ্গু (শঙ্খ) নদ, তুরাগ নদ, নারদ নদ, কপোতাক্ষ নদ, কুমার নদ, ব্রহ্মপুত্র নদ, ভৈরব নদ, বড়াল নদ, কংস নদ, বলেশ্বর নদ, সিন্দু নদ, নীল নদ, দামোদর নদ ইত্যাদি। আর নদীর নাম পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, গড়াই, মধুমতি, কর্ণফুলী, বাকখালী, গোমতী, তিতাস, কীর্তনখোলা, ডাকাতিয়া, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, রূপসা, শিবসা, পশুর, পায়রা, চিত্রা, করতোয়া, গঙ্গা, রূপনারায়ণ, হুগলী, অলকানন্দা, মহানন্দা, ইরাবতী হোয়াংহো, মেকং, ইমজিন, বিপাশা, ঝিলাম, শতদ্রু, টাইগ্রিস, ইউফ্রেতিস, সিন, রাইন, ভোল্গা, টেমস, আমাজান, অটোয়া, মিসিসিপি, কলারাডো, হাডসন, কঙ্গো প্রভৃতি।
যে নদীকে ঘিরে এত কিছু আবর্তিত। আমরা কি তার খবর রাখি? আমরা কি সত্যি করে এদেশে বহমান সব নদীর নাম জানি? নদীগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা, পানির গতি ও বহমান পনির পরিমাণ জানি? দৈনন্দিন জীবনে কত অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা আমরা করি; কিন্তু নদী নিয়ে কি তেমন কোন কথা হয়? আমরা যা জানি না তা নিয়ে আলোচনা হবে কী করে? গবেষকরা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। নদী নিয়েও করেন। নদীর আদ্যোপান্ত তাদের নখদর্পনে এ কথা ঠিক। কিন্তু যাদের প্রতিটি হৃদস্পন্দনে নদীর সুর লহরী ঝংকৃত। যাদের শরীর ও মনে নদীর এত অবদান- সেই মানুষ, মানবজাতি, আমরা এদেশের আপামর জনসাধারণ নদী ও নদের বিষয়গুলো আমলেই আনছি না। যেন নদী থাকলেই কি, না থাকলেই বা কি। ফলে বিশ্বপ্রকৃতির এক মহান অবদান আমরা অবহেলায় বিনষ্ট করছি।
বাংলায় নদী বা নদ যাই হোক, ইংরেজিতে হয় রিভার। তবে ট্রিবিউটারি উপ বা শাখা নদী, ব্র“ক ছোট নদী, রিভিউলেট বা ব্র“কলেট অতি ছোট নদী অর্থে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে একই নদীর কোন অংশ নামের কারণে নদ হয়েছে আবার অপর অংশ হয়েছে নদী। এবার কিছু নদ-নদীর নাম মিলিয়ে দেখি। যেমন সাঙ্গু (শঙ্খ) নদ, তুরাগ নদ, নারদ নদ, কপোতাক্ষ নদ, কুমার নদ, ব্রহ্মপুত্র নদ, ভৈরব নদ, বড়াল নদ, কংস নদ, বলেশ্বর নদ, সিন্দু নদ, নীল নদ, দামোদর নদ ইত্যাদি। আর নদীর নাম পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, গড়াই, মধুমতি, কর্ণফুলী, বাকখালী, গোমতী, তিতাস, কীর্তনখোলা, ডাকাতিয়া, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, রূপসা, শিবসা, পশুর, পায়রা, চিত্রা, করতোয়া, গঙ্গা, রূপনারায়ণ, হুগলী, অলকানন্দা, মহানন্দা, ইরাবতী হোয়াংহো, মেকং, ইমজিন, বিপাশা, ঝিলাম, শতদ্রু, টাইগ্রিস, ইউফ্রেতিস, সিন, রাইন, ভোল্গা, টেমস, আমাজান, অটোয়া, মিসিসিপি, কলারাডো, হাডসন, কঙ্গো প্রভৃতি। নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে নদী, সাগর বা হ্রদে পতিত হওয়া জলধারাকে শাখা নদী বলা হয়। পাহাড়, পর্বত ইত্যাদি উচ্চ স্থান হতে সৃষ্ট নদী সাগরে না গিয়ে নদীতে মিলিত হলে তাকে উপনদী বলা হয়ে থাকে।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই নামক স্থানে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এতে এ নদীর তীব্র স্রোত প্রশমিত হয়েছে। ফলে নদী অববাহিকায় বন্যার পরিমাণ কমে গেছে এবং নদীর পাড় ভাঙার প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে বেশ কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত নদী শাসন করা হয়। যাতে নদীভাঙনের কারণে সেতু বিপন্ন না হয় এবং নদী তার চলার দিক পরিবর্তন করতে না পারে। চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী হোয়াংহো (ইয়েলো রিভার), যা চীনের দুঃখ নামে পরিচিত। কারণ নদীর তীব্র সে াত ও বন্যাপ্রবণতার ফলে নদী অববাহিকার জনগণ প্রায়ই দুর্যোগ ও দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে যেত। এ নদী নিয়ে তাদের প্রাদেশিক টাগ অব ওয়ার থাকা সত্ত্বেও চীন সরকারের নদী শাসন প্রক্রিয়ায় অতীতের দুরন্ত দুর্ধর্ষ নদী বর্তমানে পোষ মানা এক প্রশান্ত জলধারা।
ইংল্যান্ডের প্রধানতম নদী টেমস বন্যাপ্রবণ নয়। তবে একসময় দূষণের কারণে এ নদীতে মাছ, প্লাংটন ও অন্যান্য জলজ প্রাণী, অনুজীব ও উদ্ভিদের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায় এসে পড়ল। পানি হল দূষিত। স্বভাবতই ইংরেজ জাতির প্রিয় মাছ স্যামনও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠল। শহর ও কলকাখানার বর্জ্য নর্দমার মাধ্যমে নদীতে পড়ার ফলে নদীর পানি অপেয় ও দূষিত হয়ে ওঠে। কিন্তু ইংরেজ জাতি নিজেদের নদী বাঁচানোর স্বার্থে নদীতে বর্জ্য ফেলা সম্পর্কিত নতুন আইন প্রণয়ন করল। আইনে এ অবস্থা সংশোধনের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে সংশ্লিষ্ট দূষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তাছাড়া তাদের প্রিয় স্যামন মাছের বংশ বৃদ্ধির জন্য নদীর উজানে নদী সমান্তরাল করে বিকল্প কৃত্রিম নদী ও নদীর পাড়ে বিনোদনের জন্য পার্ক তৈরি করা হল। বিকল্প নদীতে স্যামন মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও লালন-পালন এবং যথাসময়ে মাছগুলো নদীতে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। এতে কয়েক বছরের মধ্যে টেমস নদী আবার পূর্বের ন্যায় দূষিত পানিমুক্ত হল এবং স্যামন মাছ, অন্যান্য জলজ প্রাণী ও অনুজীবের সংখ্যা স্বাভাবিক হয়ে ওঠল।
সনাতন ধর্মের শ্রীশ্রী ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে একদা গঙ্গা ও সরস্বতীর মধ্যে প্রচণ্ড কলহ, পরে বিতণ্ডা হয়। লক্ষ্মী বিষয়টি মধ্যস্থতা করতে চাওয়াতে দেবি সরস্বতী ক্রোধান্বিত হয়ে লক্ষ্মী ও গঙ্গাকে নদীরূপে মতোলোকে পতিত হওয়ার জন্য অভিসম্পাত করেন। এতে দেবি গঙ্গাও ক্রুব্ধ হয়ে সরস্বতীকে ব্রহ্মাবর্তে নদীরূপে পতিত হওয়ার অভিশাপ দেন। সেই থেকে দেবি গঙ্গা ও সরস্বতী বৈকুণ্ঠ ছেড়ে পৃথিবীর বুকে পুণ্যবতী নদীরূপে প্রবাহিত হতে লাগল।পুরাণে স্নানের সময় পবিত্র নদীগুলোকে আহ্বান করার বিধান রয়েছে। যেমন গঙ্গে চ যমুনেচৈব দোগাবরী সরস্বতী/নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু। এভাবে ধর্মে বিধৃত পবিত্র নদীগুলো আমাদের জীবন মিশে আছে। গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থল ত্রিবেণী। ত্রিবেণী তীর প্রয়াগে প্রতিবার বছর অন্তর কুম্ভমেলা ও প্রতি ছয় বছর বছর অন্তর অর্ধকুম্বমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করল সব পাপ হতে মুক্ত হয়। ইসলামের ইতিহাসে নদীর সঙ্গে এক বেদনাদায়ক স্মৃতি জড়িত। ফোরাত (টাইগ্রিস) নদীর পানির দখল নিয়ে ভয়াবহ ফুট রাজনীতি হয়।
ফলে কারবালা প্রান্তরে মরণপণ যুদ্ধ বাধে। অসম এ যুদ্ধের মূল অস্ত্র ছিল পানি। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা কুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগকালে নেপালের অনোমা তীরে অসি দ্বারা নিজের চুল কর্তন করে ফেলেন ও রাজ বসন ত্যাগ করেন। ভারতের নৈরঞ্জনা (ফল্গ-) তীরে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। প্রভু যিশুখ্রিস্ট জর্ডান নদীর ওপর ব্যাপ্টাইজড হয়েছিলেন। হিব্র“ বাইবেলে এ নদীকে ইডেন উদ্যানের দ্বার বলে মনে করা হয়। ফারাও (ফেরাউন) রাজার আইন অনুযায়ী আরবের বনিইসরাইল গোত্রের নবজাত পুত্র সন্তান মুসাকে (পরবর্তীকালে নবী) তার মা কাঠের পাত্রে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। ইউরোপে কিছু নদীর নামের সঙ্গে প্রাচীন দেবদেবি বা পৌরাণিকতার সংযোগ পাওয়া যায়। সেভার্ন নদী প্রাচীন ব্রিটিশ নদীর দেবির ল্যাটিন নাম সাবরিনা থেকে উৎপত্তি। পৌরাণিক আইরিশ রাজকন্যা ইরিনের নামানুসারে নদীর নাম হয়েছে ইরিন। বয়োন নদী আইরিশ নদীর দেবি বোয়ান মানে সাদা গাভীর নামানুসারে হয়েছে। আফ্রিকা মহদেশের নদী ওমি ওসাম মানে দেবি ওসাম এর তেজস্বী জল।
জোয়ার-ভাটা প্রকৃতির এক স্বাভাবিক ধারা। পৃবীর ওপর চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের জলরাশি স্ফীত হয়ে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় তেজ কাটাল, অষ্টমীতে মরা কাটাল অর্থাৎ, পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ে জোয়ারের পানির উচ্চতা সর্বোচ্চ সীমায় থাকে এবং অষ্টমীর সময় পানির উচ্চতা সর্বনিু পর্যায়ে ধাকে। জোয়ার-ভাটা মূলত সমুদ্রের পানির উচ্ছ্বাসের কারণে হয়। জোয়ারের সময়
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার তা নদীতে প্রবেশ করে, এই বৃদ্ধির লেবেল পর্যন্ত যেসব নদীখাত আছে শুধু ওই নদীতেই জোয়ারের পানি উঠে এবং ভাটার সময় তা আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। উচ্চতর ভূমির নদীতে জোয়ার-ভাটা হয় না। এখানে পানি শুধু একদিকে নামতেই থাকে। এক স্রোতা নদী তা।
কোন কোন নদী মোহনার দিকে গভীরতা কম থাকায় ভাটার সময় নদীতে পানি থাকে না। থাকে শুধু কর্দমাক্ত বালুময় কাদাভূমি। জোয়ায়ের সময় নদীখাত আবার জলপূর্ণ হয়। নদীতে জোয়ারের পানি প্রবেশের সময় এক প্রকার ঝরঝর গর্জন করে প্রায় দু’তিন ফুট (কম-বেশি হতে পারে) উঁচু হয়ে দ্রুত বেগে গড়াতে গড়াতে নদীখাত পূর্ণ করে এগিয়ে যায়। এই উচ্চ ঢেউ ও স্রোতধারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। এই স্রোত মানবিক শক্তিকে পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখে। এমনকি গরু, মহিষ ইত্যাদিও এ স্রোতকে সহজে মোকাবেলা করতে পারে না। আমাদের দেশে ফেনী নদীতে এ দৃশ্যটি সহজেই চোখে পড়ে। ‘শোন মা আমিনা ত্বরা করে মাঠে চল’-এর মতো।
নদীর সুপের বিশাল জলরাশি জীবন ধারণের এক অপরিহার্য সম্পদ। তাই পানির অন্য নাম হল ‘নীল সোনা’ (বুলু গোল্ড) পানি নিজেই যে শুধু সম্পদ তাই নয়, পানির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ আহরণ প্রকল্প ও এ কারণে সৃষ্ট সুবিশাল পানির রিজার্ভার, কৃষি ক্ষেত্রে সেচ কাজে ব্যবহার, মিঠাপানির মাছ ও জলজ প্রাণিসম্পদ, বিনামূল্য বা কমমূল্যে প্রাপ্ত নৌরুট, নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা, নদীর সঙ্গে গড়িয়ে চলা পাথর, বালু ও পলিমাটিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর যেখানে সম্পদ সেখানেই স্বার্থ নিয়ে হানাহানি বিদ্বেষ। বিশ্বের ২৭৬টি নদী অববাহিকায় দেশ, প্রদেশ বা রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর পানি নিয়ে দেশে দেশে, প্রদেশ বা রাজ্যে রাজ্যে ব্যাপক পানি কলহ রয়েছে। নদীর পানি নিয়ে কোন কোন দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নজিরও রয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে দ্বন্দ্ব-কলহ বর্তমান। এ নিয়ে জোরালো কোন আন্তর্জাতিক আইনও তৈরি হয়নি। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলো নিয়ে কলহ। এ সমস্যা বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত, বাংলাদেশের মধ্যেও রয়েছে। বাংলাদেশে সীমান্ত নদীর সংখ্যা মোট সাতান্নটি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রয়েছে চুয়ান্নটি, তিনটি বাংলাদেশ-মিয়ানমারে প্রবাহিত। উজান থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাঁধ দিয়ে ও চ্যানেল কেটে চীনের ভাটির দিকে অপসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
আন্তঃনদী সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যৌথ নদী কমিশন রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চুক্তি ও উচ্চ পর্যায়ের অনেক আলোচনা হয়েছে। তবু পানির অভাবে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাবসহ দেশ মরূকরণ হতে চলছে, পক্ষান্তরে এই পানি দিয়েই অন্যদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হচ্ছে। এরপরও আশা রাখতে হবে যে, আন্তঃনদী সমস্যা সমাধানের পথ অচিরেই বেরিয়ে আসবে।
অন্যদিকে ভারতও এ নদের পানি তাদের মরু এলাকায় সরিয়ে নিচ্ছে। গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ফারাক্কা চুক্তি হলেও তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, মনু, খোয়াই, গোমতী, মুহুরী এ সাতটি আন্তঃনদীর পানি ব্যবহার নিয়ে কোন চুক্তি এখনও হয়নি। সুরমা, কুশিয়ারার উজানের নদী বরাকের ওপর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের টিপাইমুখ নামক স্থানে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। যদিও জলবিদ্যুৎ তৈরি হলে নদীতে পানির প্রবাহ থাকার কথা। তবুও কথা থেকে যায় নিয়ন্ত্রিত ধারা আর স্বাভাবিক ধারা এক নয়। সুরমা, কুশিয়ারার মিলিত জলধারা মেঘনায় পড়াতে মেঘনা নদীর ওপর এ বাঁধ ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেজ্ঞদের ধারণা। আন্তঃনদী সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যৌথ নদী কমিশন রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চুক্তি ও উচ্চ পর্যায়ের অনেক আলোচনা হয়েছে। তবু পানির অভাবে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাবসহ দেশ মরূকরণ হতে চলছে, পক্ষান্তরে এই পানি দিয়েই অন্যদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হচ্ছে। এরপরও আশা রাখতে হবে যে, আন্তঃনদী সমস্যা সমাধানের পথ অচিরেই বেরিয়ে আসবে।
নদীর নামে পৃথিবীতে বিভিন্ন গ্রাম, শহর, রাজধানী, প্রদেশ এবং দেশ রয়েছে। মায়ানি, কাসালং, রাইংখ্যান, কাপ্তাই, শিলক, ইছামতি, গতিয়া, সিলোনিয়া, ফেনী, ভোলা, জলঢাকা, হুগলি, অটোয়া, চিকাগো, কাবুল, সিন্ধু, কলারাডো, মিসিসিপি, ইলিয়নস, কলাম্বিয়া, ওহাইয়ো, টেনেসি, আরকানসাস, জর্ডান, কঙ্গো, সেনেগাল, প্যারুগুয়ে, উরুগুয়ে- এগুলো সবই একাধারে নদী ও জায়গার নাম।
যুগ যুগ ধরে নদীভাঙন পলল ভূমিতে এক চলমান সমস্যা। নদীতীরবর্তী একজন লোকের চল্লিশ বছর বয়সে নদীভাঙনর ফলে বেয়াল্লিশবার ভিটেমাটি হতে স্বমূলে উৎখাত হয়েছে, এ উদাহরণ আমাদের দেশে ঘটা এক স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু যাদের জীবনের এই হাল, যাদের নদীর সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ চলছে। তাদের নিজের জীবনের অন্য কিছু করার সুযোগ কোথায়? বন্যাপ্রবণ নদী একটি দেশে নিয়ত দুর্যোগ সৃষ্টি করে। মানুষের ঘরবাড়ি, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, ক্ষেতের ফসল ইত্যাদি সবকিছুই বন্যায় প্লাবিত হয়। শুরু হয় পানি ও মানুষের যুদ্ধ। প্লাবিত ভূমিতে জল অসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কখনোবা প্রতিকূল অবস্থায় মানুষের মড়ক শুরু হয়। বিনষ্ট হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মিঠা পানির সহজলভ্যতা নদীতীরে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে শিল্পপতিদের প্রলুব্ধ করে। কিন্তু অধিক মুনাফা লোভে শিল্পজাত দূষিত ও ক্ষতিকারক বর্জ্য পরিশোধন না করে নদীতে নিষ্কাশন করা হয়। ফলে নদী হয়ে ওঠে শিল্প বর্জ্যরে এক সুলভ ভাগাড়। নদীতীরবর্তী শহরগুলোর তরল নগর বর্জ্য ড্রেনেজ হয় নদীতে। এ প্রক্রিয়ায় বালু, বংশী, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গার পানি এখন স্বচ্ছতা হারিয়ে দুর্গন্ধ পুতিময় বিষাক্ত কালো তরলে পরিণত হয়েছে, যা মৃত নদীর চেয়েও ভয়ংকর ও ভয়াবহ। এরপরও নদীতীরবর্তী অনন্যোপায় মানুষ এই দূষিত তরল নিত্যদিনের কাজে ব্যবহার করে যাচ্ছে। ইদানীংকালে রুগ্ণ অচল নদীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুতহারে, নদী মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। নদীতে চর পড়া, নাব্যতা হারানো, নদী দূষণ এসব আমাদের দেশে চলমান এক সুকঠিন সমস্যা। বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী বিশ বছরে হয়তো বাংলাদেশ মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।