নতুন বালক
দুধের পেয়ালা থেকে পোষা বিড়াল ফিরিয়ে নেয় মুখ,
বেত্রাঘাতে রক্ত জমে জোছনার নরম শরীরে,
বাতাসের শব্দ নিয়ে খেলা করে হিস্ হিস্ সাপ,
মৌমাছি নৃত্য করে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘিরে।
সবুজ লণ্ঠন জ্বেলে পোয়াতিরা অপেক্ষায় নত,
পশ্চিমে কবর খোঁড়ে মৃত্যুহীন মানুষের হাত,
দরোজায় টোকা দেয় অসভ্য মাতালের দল,
বুকের এপাশে দিন পিঠের ওপাশে হাঁটে রাত।
মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে জন্ম নেয় নতুন বালক,
রান্নাঘরে আগুন জ্বেলে শুরু হয় পরীদের ভোজ,
বৃক্ষের শিকড় থেকে উড়ে যায় বর্ষার জল,
যে পুরুষ জন্ম দিলো রাখলো না কেউ তার খোঁজ।
পাথুরে বিশ্বাস
তোমার ব্যস্ত সেলফোন গত দু’দিন ধরে বন্ধ,
আমি খুলে রেখেছি দরোজা
যেন কপাটে আঘাত খেয়ে ফিরে না যায় উতল বাতাস।
আমার পায়ের নিচে জোছনার মেঝে,
দেয়ালে ঝুলন্ত ব্রিজের মতো ঝুলে আছে মলিন ক্যানভাস,
চাঁদ উঠছে, তবু আসর থেকে উঠছে না মাতালের দল,
আমি খুঁজে পাচ্ছি না তোমার দেয়া হলুদ পাঞ্জাবি।
সন্ধ্যায় কি কাক ডাকে?
পাঠশালার নামতাপড়া কিশোর ডেকে ওঠে কাকের মতো,
আমি ঠোঁট থেকে উড়িয়ে দেই চুম্বনের ঘ্রাণ।
আতঙ্কে অথবা দুঃখে।
তোমার ব্যস্ত সেলফোন পড়ে আছে মরা মাছির মতো,
আমার জোড়া চপ্পলের নিচে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়
মুগ্ধ যৌবনের পাথুরে বিশ্বাস।
কাকাতুয়া
আধেক জোছনা দাও, ছেঁড়াফাটা আধেক আঁধার
পূর্ণ চাঁদের মুখ ডুবে যাক যমুনার জলে,
ক্লান্ত মুখের ভাষা ছিঁড়ে খাক প্রেমের খাবার
শুয়ে থাক কাকাতুয়া সারারাত চোখের অতলে।
যে হাত মাছের মতো নড়ে ওঠে আগুনের খোপে,
হাহাকার যৌবন পড়ে থাকে সেজদায় নত,
বন্দনা শুনে শুনে কাকাতুয়া মুগ্ধ ঘেরাটোপে
শরীর দু’ফাঁক করে কবিতার গ্রন্থের মতো।
পয়োমুখ কাকাতুয়া ছিঁড়ে খায় চিতার চোয়াল,
গহিন মধ্যরাত ভেসে যায় আঙুরের রসে,
কাঁধ থেকে ঠেলে ফেলি বুভুক্ষু-হাতের জোয়াল
আকাশের কিনারায় গণিকার দল এসে বসে।
যে ঠোঁট নগ্ন হয়ে মেলে দেয় চিতলের ফালি,
খুলে যায় পাটাতন জল্লাদের অন্ধকার হাতে,
আধেক আলোকিত, আধেক মুখ দেবী কালী,
নড়ে ওঠে মাস্তুল সাগরের ক্ষুব্ধ উৎপাতে।
তুমি তো চাঁদের গাড়ি, পরক্ষেত্র শাদা কাকাতুয়া,
কখনো হারো না তুমি, খেলে যাও জীবনের জুয়া।
মায়াজাল
মোমের আগুনে পোড়ে হাত
আর ছোটো ছোটো পাপ,
বুকের বধ্যভূমি ঢেকে দেয়
জলজ্যান্ত দানবীয় সাপ।
ইতিহাস ছিঁড়েখুঁড়ে খায়
শকুনের কৃষ্ণ তরবারি,
নিজের ছায়ার সাথে যুদ্ধ ক’রে
প্রতিদিন বার বার হারি।
আকাশ উল্টে দেয় রক্তস্রোত
হিমাঙ্কে জমে যায় নদী,
দুঃসময় উড়ে যাবে মেঘ হয়ে
দৃশ্যমান সম্পদ অবধি।
হাহাকার তন্তু দিয়ে মাকড়সা
বুনে যায় মিথ্যে মায়াজাল,
আমাদের স্মৃতিকথা মুছে দেয়
বিস্ময়ে নমিত এই কাল।
বৃষ্টির জলছবি
কাজল আকাশ উল্টে দিয়েছে জলের পাথরবাটি,
তার সবটুকু এই চোখে আজ নীরবে গেড়েছে ঘাঁটি।
ভেসেছে স্বপ্ন চোখের দিঘিতে, কাটছে সময় ঘোরে,
ফেলে আসা দিন স্মৃতির চিহ্ন বাদল হাওয়ায় ওড়ে।
যা ছিলো মনের শব্দগুচ্ছ কবিতা নদীর খেয়া,
তার সবকিছু ধুয়ে মুছে গেছে হয়নি চুমুকে নেয়া।
বুকের বেদীতে প্রতিমার মতো যে ছিলো বাড়িয়ে হাত,
সেখানে এখন শ্রাবণ মেঘের এলোমেলো উৎপাত।
আমার জানালা হারিয়ে ফেলেছে রাতের জোছনাগুলো
জলে ভিজে যায় তবু উড়ে যায় জীবনের সব ধুলো।
সুখের স্মৃতিরা ডানা ঝাপটায় বিছানায় নামে ঢল,
ঘর ছুঁই ছুঁই ঢেউয়ের আঘাতে ফুঁসছে বানের জল।
দেয়ালে ঝোলানো জলছবি আজ জলে খোঁজে মুগ্ধতা,
হারানো দিনের গান বেজে যায় কোথাও নেইতো শ্রোতা।
বর্ষা-বাদলে ভিজে যাই আমি, কোথায় শরীর রাখি?
আষাঢ়-শ্রাবণে ঘর ছেড়ে গেছে ছিন্ন ডানার পাখি।
হিসেবের খাতা খুলে বসে দেখি হিসেব করেছি ভুল,
তাইতো আঙিনা বৃক্ষশূন্য ফোটে নি কদম ফুল।
শাহাবুদ্দীন নাগরী সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি। এবং বাংলাদেশের প্রধান ছড়াকারদের একজন। কথাসাহিত্যেও তার সফল বিচরণ। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর মৌলিক ও সম্পাদিতসহ গ্রন্থ সংখ্যা আশির কাছাকাছি। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘আমি ফিরেছি ভিটেয় নবনীতা ফেরেনি’, ‘যেখানে খনন করি সেথা নেই মধু’, ‘ও দেবী ও জলকন্যা’, ‘মধ্যরাতে পায়ে দিলাম চুমো’ ইত্যাদি। সম্পাদনা করছেন ‘লেখা’ নামের একটি নির্মল সাহিত্য পত্রিকা।