Author Picture

গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকা

ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান

পৈতৃক নিবাস বরিশাল হলেও সরকারী কর্মকর্তা বাবার চাকরি সুত্রে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসানের জন্ম ১৯৮০, সালে চট্টগ্রামে। ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে। লন্ডন ইউনির্ভাসিটি থেকে আইনে স্নাতক। ইনার টেম্পল থেকে ব্যারিস্টার এট ল। ২০০৫ সাল থেকে হাই কোর্টে আইন পেশা চর্চা শুরু ড. কামাল হোসেনের জুনিয়র হিসেবে। প্রায় ১৩ বছর কামাল হোসেনের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ্ মাহমুদ হাসানকে ঋদ্ধ করেছে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। অল্প বয়সেই সুনাম অর্জন করেছেন তার মেধা প্রতিভা এবং কর্মগুণের মাধ্যমে। আইন পেশা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অবস্থা এবং ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় সৃজনের। সেই আলোচনার অংশ বিশেষ পত্রস্থ হলো।

সৃজন : আইন পেশায় আগ্রহী হওয়ার পেছনে কোন কারণ আছে?
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : দেশে অনেক পেশা থাকা সত্ত্বেও আমার আইন পেশা বেছে নেয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে এই পেশাটিতে যথেষ্ট স্বাধীনতা রয়েছে। আমার নিজস্বতার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজের মতো থাকতে এবং ভাবতে আমি পছন্দ করি। তাছাড়া আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই প্রকৃতি প্রদত্ত বিশেষ প্রতিভা থাকে, স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ পেলে ব্যক্তি তার প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। এই পেশাটিÑ মানুষ সমাজ রাজনীতি অর্থনীতির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে ধারনা রাখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এতে নিজেকে সমৃদ্ধ করারও অনেক উপাদান থাকে। যেমন: শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বারাক হোসেন ওবামাসহ অনেক বড় মানুষ আছেন যারা এই পেশাটির মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন।

সৃজন : বয়সের বিচারে আপনি তরুণ হলেও কাজের দিক থেকে এই পেশায় আপনার অবস্থান এবং সুনামকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : আদালত পাড়ায় আমার সহকর্মী এবং বন্ধুরা যখন আমার প্রশংসা করে আমার ভালো লাগে, আমি উৎসাহিত হই।
তবে এটাও ঠিক যে, একজন বড় আইনজীবি হওয়ার জন্য যে মেধা ও পরিশ্রম দরকার আমাকে সেটা অর্জন করতে হবে। আমি এর জন্য অনেক শ্রম দিতে চাই। অনেক লেখাপড়াও করতে চাই।
ডঃ কামাল হোসেন, প্রয়াত মাহমুদুল ইসলামের মতো কিংবদন্তি তুল্য আইনজীবীদের আমি কাছে থেকে দেখেছি এবং ওনাদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল দীর্ঘ ১৪ বছর। তাদের সততা, নিষ্ঠা, শ্রম, লেখাপড়া, দায়িত্ববোধ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি চেষ্টা করে যাবো ওনাদের মতো সৎ, পরিশ্রমী এবং নিষ্ঠাবান হতে।

সৃজন : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে আপনার ভাবনা জানতে চাই
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা মানে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবের উর্ধ্বে থেকে কাজ করা। তবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিচারকদের নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকা। ন্যায়ের পক্ষে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ যেমন একটি যুগ-উপযোগী পদক্ষেপ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে এটি নিশ্চিত করা যে, বিচারকরা নিজেদের কাছে যেন সত্যিকার অর্থে দায়বদ্ধ থাকে। তাহলেই বিচার বিভাগ প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন হওয়ার রেজাল্ট পাবে এবং জনগণ উপকৃত হবে।

সৃজন : প্রকৃত অর্থে বর্তমানে বিচার বিভাগ কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে বলে মনে করেন?
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেমন দৃশ্যমান, সেই সঙ্গে বিচার বিভাগের উপর কিছু কিছু প্রভাবও দৃশ্যমান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতার স্বার্থকতা উপলদ্ধি করা যাচ্ছে না। তার বিশেষ কয়েকটি কারন রয়েছে। যেমন, বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠিত হলে সেই সচিবালয় থেকে মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার নিজস্ব জনবল ও অবকাঠামো দ্বারা কর্মরত বিচারকের কার্যাবলী, বিচারিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে পারতেন। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর নিম্ন আদালতগুলোয় বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও তত্ত্বাবধানসহ অন্যান্য বিষয় দেখভালের জন্য হাইকোর্টের ওপর একটা বিরাট দায়িত্ব বর্তেছে। এ দায়িত্ব পালনের জন্য যদি তাদের উপযুক্ত সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকে, তাহলে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজই করা সম্ভব নয়। পৃথক একটি সচিবালয় থাকলে তবেই সুপ্রিমকোর্ট তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন। এটি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন ও শৃঙ্খলাবিধিসহ সব কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর সুপ্রিমকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই মাননীয় প্রধান বিচারপতির পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়ের সেসব সুপারিশের স্বচ্ছতা, এমনকি ন্যায্যতার যথার্থতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না।

সৃজন : বিচার বিভাগকে স্বাবলম্বী করে দিলে এবং সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে দিলেই কি বিচার বিভাগীয় সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আপনি মনে করেন? সকল মানুষ আইনের সুফল ভোগ করবে?
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : ব্যাপারটা ঠিক পুরোপুরি এরকমও না। আমাদের ৪৫ বছরের দেশ। সেটা যেমন বয়সের দিক থেকে কম না, আবার কালচারাল ডেভলপমেন্টের দিক থেকে খুব বেশিও বলা যাবে না। আইন মানতে ইচ্ছুক আমাদের এরকম একটি জাতি হয়ে উঠতে হবে। আবার কিছু কিছু বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। আমরা হয়ত সে পথেই এগুচ্ছি। যদিও আমাদেরই তৈরি নানা প্রতিবন্ধকতা আমাদের চলার পথকে কঠিন করে তোলে মাঝেমধ্যে। এর মধ্য দিয়েই আমরা এগিয়ে যাবো। আমাদের বিচার বিভাগও আরো স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।

সৃজন : একজন আইনজীবী হিসেবে আইনজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : দেশ ও জাতীয় স্বার্থে আইনজীবিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনজীবিদের জোরালো ভূমিকা রয়েছে। সাংবিধানিক সংকটেও আইনজীবিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচারক মহোদয় এবং আইনজীবীদের যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি বহু সাংবিধানিক সংকট অতিক্রম করেছে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, যখন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সরকার সুপ্রীম কোর্ট ভেঙ্গে দিয়ে বিকেন্দ্রীকরণ করেছিল তখন আইনজীবীদের কারণে সেই সংকটের সমাধান হয়েছিল।

সৃজন : আপনি পেশাগত কারণে অবশ্যই একজন ব্যস্ততম ব্যক্তি। পেশার পাশাপাশি আপনার পারিবারিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বলবেন কি?
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : আমি চেষ্টা করি পরিবারকে ব্যস্ততার মাঝেও সময় দেওয়ার। পারিবারিক সম্পর্কগুলো ব্যক্তিজীবনের মানবিক গুণাবলীকে সতেজ রাখে। পরিবার জীবনের রসদ যোগায়। জীবনীশক্তি বেড়ে যায় পারিবারিক ভালোবাসার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। আমি বিশ্বাস করি পরিবারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে না পারলে যে ক্ষতি হবে- তা অপূরণীয়।

সৃজন : আপনার আইন পেশায় আসার পেছনে নিশ্চয়ই কোন বিশেষ কারন বা পরিকল্পনা আছে। থাকতে পারে বিশেষ কোন স্বপ্নও…
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : প্রধানত আমি একজন সৎ নিষ্ঠাবান ও দক্ষ আইনজীবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাই। স্বপ্ন তো আছেই। সেটা নিয়ে আমার চিন্তা না, আমার চিন্তা স্বপ্ন পূরণের লক্ষে করণীয় নিয়ে। আমি সেই কাজগুলো করতে চাই। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চাই। তারপরে কতোটুকু যেতে পারবো সেটা আমার কর্মই বলে দেবে।

সৃজন : আমাদের সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহম্মুদ হাসান : আপনাকেও ধন্যবাদ। বিশেষ করে সৃজন পরিবারের জন্য শুভ কামনা।

আরো পড়তে পারেন

মুখোমুখি: আন্দ্রেজ আল-আসাদি

১৯৯৭ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা আন্দ্রেজ আল-আসাদি বর্তমান সময়ে মেসিডোনিয়ান ভাষায় লেখালেখি করা প্রধানতম তরুণ কবিদের অন্যতম। তার বহুসাংস্কৃতিক পটভূমি এবং তার ও অন্যান্য সমসাময়িক মেসিডোনিয়ান কবিদের কাজকে অনুপ্রাণিত করার প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক অনুবাদক পিটার কনস্টানটাইনের সাথে। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে কর্তৃক প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন আপনার জন্ম লন্ডনে, আপনার….

রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিম: মিখাইল শিশকিন

অন্য দেশে ইমপেরিয়াল অথবা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বর্তমানের রুশ ফেডারেশনের নির্বাসিত লেখকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসেবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রুশ বুকার (২০০০), বিগ….

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডূকতা পাঠকদের কূপমণ্ডূক করেছে : হারুন আল রশিদ

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন উপন্যাসের লেখক হারুন আল রশিদ বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রম ও সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠ। তার  গদ্যের শক্তি ও গভীরতা পাঠকের কাছে যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার তেমনি তার ভাষার সহজবোধ্যতা বাংলা গদ্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্য উপন্যাসটি হল— ‘রেণুর আবির্ভাব’। তাঁর তৃতীয়….

error: Content is protected !!