
ঊনবিংশ শতকেই অল্প ক’টি ছবির শিল্পী হলেও ভেরমিয়ারের প্রভাব নবীন শিল্পীদের ওপর পড়তে শুরু করে। নিজ শহর নিয়ে আঁকা ছবি ‘ভিউ অব ডেলফ্ট’ মার্শেল প্রুস্তের ‘দ্য কেপটিভ’ উপন্যাসে চিত্রিত।
২০১২-র নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত কবি টমাস ট্রান্সট্রোমারের একটি প্রবণতা জীবনের জন্য তার কবিতায় একটি পরিসর সংরক্ষণ করা। সেই পরিসর আপাতত শূন্যতায় সজ্জিত হলেও তা শূন্যতাকে ভেদ করে, শূন্যতাকে ভরে দেয়। ট্রান্সট্রোমার তাঁরই একজন প্রিয়শিল্পী ইউহানেস ভেরমিয়ারকে দেখেছেন শূন্যতা ও আত্মমাত্রিকতার সমন্বয় ঘটাতে। তাঁর কবিতা ভেরমিয়ার-এর একটি অনুচ্ছেদ :
‘দেয়ালে ঠেস দিয়ে বাতাসভরা আকাশ
তার জায়গা করে নিয়েছে
ব্যাপারটা শূন্যতার কাছে প্রার্থনার মত
আর যা শূন্য, আমাদের দিকে মুখ ফেরায়
আর ফিসফিস করে বলে
আমি তো শূন্য নই, আমি খোলামেলা।’
ভেরমিয়ার ডাচ শিল্পকলার স্বর্ণযুগে ৩১ অক্টোবর ১৬৩২ ডেলফ্ট নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সিল্ক ও উল শ্রমিক ছিলেন। তার বাবার সঙ্গে লড়াইয়ে একজন সৈনিক নিহত হওয়ার পর তাদের পরিবার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। তিনি শেষদিকে চিত্রকলা বেচাকেনার ব্যবসায় নামেন। ভেরমিয়ার পৈতৃকসূত্রে ব্যবসাটি লাভ করেন এবং নিজেও ছবি আঁকাকেই জীবনের ব্রত করে নেন। ব্যবসায়ে অসফল ভেরমিয়ার যখন দারিদ্র্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন তখনও সেকালের সবচেয়ে দামি রং ব্যবহার করে ছবি এঁকেছেন। ১৫ ডিসেম্বর ১৬৭৫ মাত্র ৪৩ বছর বয়সে যখন মৃত্যুবরণ করেন তার গোটা পরিবার তখন ঋণে জর্জরিত।
জীবদ্দশায় তিনি নিজ শহর ডেলফটি এবং হেগে পরিচিতি লাভ করেন কিন্তু মৃত্যুর পরপর দ্রুত বিস্মৃত হয়ে যান।
তার অধিকাংশ ছবিই ক্যানভাসে তৈল রং। তিনি অত্যন্ত মূল্যবান ল্যাপিস লাজুলাই, প্রাকৃতিক আলট্রামেরিন ও অ্যাম্বর রং ব্যবহার করতেন; রংয়ের ঔজ্জ্বল্য তাঁর ছবিকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সপ্তদশ শতকের কোনো শিল্পীই কেবলমাত্র রংয়ের পেছনে এত বেশি অর্থ ব্যয় করতেন না। তাঁর দারিদ্র্যের সঙ্গে এই বেপরোয়া ব্যয় মেলানো না। তাঁর ছবির সংখ্যা ৬৬টি দাবি করা হলেও চিত্রগবেষকরা দাবিকৃত ছবির মধ্যে ৩৫ বা ৩৬টি তাঁর ছবি এটা নিশ্চিত করেছেন। তখনকার চিত্রশিল্পের ইতিহাসে তিনি প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুল্লিখিত ও উপেক্ষিত রয়ে যান। ২০০ বছরেরও অধিককাল পরে গুস্তাফ ফ্রেডরিখ বাগেন এবং থিউফাইল থোরে-বার্জার ভেরমিয়ারকে পুনরাবিষ্কার করে তার ওপর প্রবন্ধ রচনা করেন। তখন থেকেই ভেরমিয়ার পুনঃমূল্যায়িত হতে শুরু করেন এবং কার্যত তার পুনর্জাগরণ ঘটে। তিনি হয়ে ওঠেন ডাচ স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী।
লক্ষ্মীমস্ত নারী ক্যাথরিনা বোলনেসকে বিয়ে করেন। তাদের চৌদ্দটি সন্তানের মধ্যে দশজন বেঁচে থাকে। আর্থিক সংকটের কারণে ক্যাথরিনা স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে তার মায়ের বাড়ি ওঠেন। সে বাড়িরই দোতলার সামনের একটি কক্ষ হয়ে ওঠে ভেরমিয়ারের স্টুডিও। সেই বাড়ির একেবারে গা ঘেঁষা একটি চার্চও ছিল, ভেরমিয়ারের ল্যান্ডস্কেপে চার্চের উপস্থিতি দেখা যায়।
তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা কোনো শিল্পগুরুর কাছে শিক্ষালাভ করার সুযোগ হয়নি, তিনি নিজেও কোনো স্কুল খোলেননি বা নিজ হাতে অনুগত আঁকিয়ে শিষ্যও তৈরি করেননি। অন্যদিকে তাঁর ছবিগুলো কেবল একজন ক্রেতাই নিজ সংগ্রহে রাখায় শিল্প-সমঝদারদের অন্য কেউ তাঁর সম্পর্কে জানতেও পারেননি।
স্ত্রী ক্যাথরিনা বলেছেন, অর্থকষ্টের চাপ সহ্য করতে না পেরে মাত্র দেড় দিনের প্রচ- উন্মত্ত আচরণের পর তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন। সে সময় ক্যাথরিনা ও তাঁর মায়ের দখলে এসে যায় তার ১৯টি ছবি। এর মধ্যে দুটো ছবি বিক্রি করে ঋণ শোধ করা হয়।
তাঁর উল্লেখযোগ্য তৈলচিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘গার্ল উইথ এ পার্ল ইয়াররিং’, ‘দ্য লাভ লেটার’, ‘দ্য কিচেন মেইড’, ‘দ্য মিউজিক লেসন’, ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য রেড হ্যাট’, ‘দ্য লেইসমেকার’, ‘ওমেন হোল্ডিং এ ব্যালেন্স’, ‘দ্য গিটার প্লেয়ার’, ‘দ্য লিটল স্ট্রিট’, ‘ওমেন রিডিং এ লেটার’, ‘এলোগরি অব দ্য ক্যাথলিক ফেইথ’, ‘ডায়ানা অ্যান্ড হার কম্পেনিয়ন’ ‘ওমেন রিডিং এ লেটার’, ‘খ্রাইস্ট ইন দ্য হাউস অব মার্থা অ্যান্ড মেরি’ এবং ‘ইয়াং ওমেন উইথ এ পিচার’।
ভেরমিয়ারের কেবল তিনটি ছবিতে অঙ্কনের সময়কাল লেখা হয়েছে : দ্য প্রোকিউরেস (১৬৫৮), দ্য অ্যাস্ট্রোনোমার (১৬৮৮) এবং দ্য জিওগ্রাফার (১৬৬৯)।
গার্ল উইথ এ পার্ল ইয়াররিং-কানে মুক্তোর দুল পরিহিত এ ছবিটি সম্ভবত ভেরমিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ। সপ্তদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ছবিকে বলা হয় ‘দ্য মোনালিসা অব দ্য নর্থ’ কিংবা ‘ডাচ মোনালিসা’। কারও ফরমায়েশে তিনি এ ছবিটি এঁকেছেন বা নিজস্ব কোনো নারীকে চিত্রায়িত করেছেন তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ১৮৮১ সালে হেগে অনুষ্ঠিত একটি নিলামে মাত্র দুই গিল্ডার ৩০ সেন্টে ছবিটি বিক্রি হয়ে যায়। ক্রেতার কোনো উত্তরাধিকার না থাকায় শেষ পর্যন্ত আজকের এ বিশ্বখ্যাত ছবিটি ১৯০২ সালে মরিতসুইস জাদুঘরে দান করে দেওয়া হয়।
ট্র্যাসি ক্যাভেনিয়র এ ছবিটিকে নিয়ে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন ‘গার্ল উইথ এ পার্ল ইয়াররিং’ (১৯৯৯)। ২০০৩ সালে চলচ্চিত্রায়িত হলে তা গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
গার্ল উইথ এ রেড হ্যাট-লাল টুপি পরা এই মেয়েটিও এখন শিল্পরসিকদের কাছে পরিচিত মুখ। ভেরমিয়ারের ছোট আকৃতির তৈলচিত্রগুলোর একটি হয়ে ওঠে এই লাল টুপির মেয়ে। ঊনবিংশ শতকেই অল্প ক’টি ছবির শিল্পী হলেও ভেরমিয়ারের প্রভাব নবীন শিল্পীদের ওপর পড়তে শুরু করে। সালভাদর দালি ভেরমিয়ারের ‘দ্য লেসমেকার’ নিজের করে এঁকেছেন। দালির ১৯৩৪ সালের একটি অমর কাজ-‘ভেরমিয়ারের প্রেতাত্মা, যা টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
‘ভেরমিয়ারের মতো আর কেউ নেই’-জোনাথান রিচম্যানের এই গানটি সংগীত প্রেমিকদের কাছে একজন চিত্রশিল্পীকে পৌঁছে দিয়েছে। ট্রান্সট্রোমারের কবিতাও ভেরমিয়ারকে নতুন করে চিনিয়েছে।