
একটি কাল্পনিক বিতর্ক। যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
(কোপার্নিকাস Nicolaus Copernicus, ১৪৭৩-১৫৪৩): পোল্যান্ডের গণিতবিদ এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। তিনি প্রথম প্রমান-সহ সূর্য-কেন্দ্রিক সৌরজগতের মডেল প্রতিষ্ঠিত করেন। গ্যালিলিও Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২): ইতালির বিজ্ঞানী। তিনি প্রথম দূরবীন দিয়ে শুক্রগ্রহের অর্ধেকের বেশি কলা (gibbous phase of Venus) আবিষ্কার করে পৃথিবী-কেন্দ্রিক সৌরজগত-তত্ত্বের মরণ নিশ্চিত করেন। ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে,’ এই ঘোষণার জন্যে রোমের ধর্মযাজক পোপের নির্দেশে তাঁকে জীবনের শেষ দশটি বছর গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। এরিসটারকাস (Aristarcus, খৃষ্টপূর্ব ৩১০-২৩০): গ্রিক দার্শনিক এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। তিনি-ই প্রথম সূর্য-কেন্দ্রিক সৌরজগতের কথা বলেন। টলেমি (Claudius Ptolemi , ১০০-১৭০): রোমান গণিতবিদ, কবি, এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। পৃথিবী-কেন্দ্রিক সৌর-জগতের নকশার প্রবর্তক।
ওসিয়ানদের (Andreas Osiander, ১৪৯৮-১৫৫২): একজন খ্রীষ্টান ধর্মজঙ্গি। হিপাটিয়া (Hypatia, ৩৬০-৪১৫): অলেকজান্ড্রিয়ার দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতিবিজ্ঞানী, এবং শিক্ষয়িত্রী। অলেকজান্ড্রিয়ার বিশপের নির্দেশে একদল খ্রীষ্টান ধর্মজঙ্গি তাঁকে হত্যা করে। ব্রুনো : (Giordano Bruno, ১৫৪৮-১৬০০): ইটালির কবি, দার্শনিক, গণিতবিদ, এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। ‘প্রতিটি নক্ষত্র এক একেকটি সূর্য, এবং ওদের চারদিকে ঘুরছে গ্রহ-উপগ্রহ’ এই মতবাদ প্রচারের অপরাধে তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়।)
কোপারনিকাস : আমার মরণের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার লেখা “স্বর্গীয় গোলকদের আবর্তন” বইটির পান্ডুলিপি ছাপাখানায় পাঠিয়ে দিয়েছি। বইটি যখন প্রকাশ পাবে তখন হয়তো আর বেঁচে রইবো না। পৃথিবী এবং আর সব গ্রহ যে সূর্যের চারপাশে ঘোরে তার সব প্রমান বইটিতে দেয়া আছে। আমার সূর্যকেন্দ্রিক (heliocentered ) মডেল থেকে সুপেরিয়র গ্রহদের (মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি) হটাৎ কিছুদিনের জন্যে উল্টো দিকে চলার ধাঁধাটা সহজেই বোঝা যায়। ইনফেরিওর গ্রহদের (বুধ, শুক্র) শুধুই সন্ধ্যে এবং ভোররাতে দেখার ব্যাপারটার বুঝতেও আর কোনো ঝামেলা নেই। আমি বেঁচে থাকতেই যদি বইটি প্রকাশ পায় তবে খৃষ্টধর্মের পেয়াদারা হয়তো আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারবে। আমি একজন ধার্মিক খ্রীষ্টান। বইটি খৃষ্টধর্মযাজক পোপের নামে উৎসর্গ করেছি, তাতে শাস্তি যদি কিছু কমে!
গ্যালিলিও : পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা, তারপরে আবার পূর্ণিমা। চাঁদটা কেমন বাড়ে কমে! পূর্ণিমার চাঁদ গোল, ঈদের সন্ধ্যায় সেটি এমন চিকন, প্রায় দেখাই যায় না! এগুলো সবই অবশ্য সূর্য থেকে প্রতিফলিত আলো। চাঁদের মতো শুক্রগ্রহের আকারও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন রকম দেখায় ( phases of Venus), ওরও পূর্ণিমা-অমাবস্যা আছে, আমার টেলিস্কোপ দিয়ে এগুলো স্পষ্ট দেখেছি। টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক (geocentric) মডেল থেকে শুক্র গ্রহের অর্ধেকের বেশি অংশ থেকে প্রতিফলিত আলো (gibbous phase) দেখা সম্ভব নয়।
টলেমি : গ্যালিলিও শুক্রগ্রহের অর্ধেকের বেশি কলা (gibbous phase of Venus) আবিষ্কার করেছেন, সাথে সাথে আমার পৃথিবীকেন্দ্রিক জগৎতত্ত্বের মৃত্যু ঘন্টা বেজে গেছে। কোনো দুঃখ নেই আমার। বিজ্ঞানের জগৎ এমনি করেই সামনে এগিয়ে চলে, পুরোনো বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বসে থাকে না। যদিও ভুল তবুও এক হাজার ছয় শত বছর ধরে টিকে ছিল আমার তত্ত্ব, আর কোনো তত্ত্ব এতো বছর বাঁচেনি।
ওসিয়ানদের : আমি একজন খ্রীষ্টান পন্ডিত, আমি বাইবেলের অনুবাদ করেছি, Harmony of Gospels,” বলে একটি বই লিখেছি। কোপার্নিকাসের বইটির খবর আমি শেষ মুহূর্তে পাই, তাই তড়িঘড়ি করে বইটির ভূমিকাতে লিখে দিয়েছি যে এখানে যা লেখা আছে তা সব ভুল। নিজের নাম লিখিনি, সবাই ভাববে ওটা কোপার্নিকাসেরই কথা! আমি বুদ্ধিমান, সন্দেহ নেই।
গ্যালিলিও : শুনেছি মৃত্যর কয়েকদিন আগে কোপার্নিকাস ছাপার অক্ষরে তাঁর বইটি দেখেছিলেন, কাঁপাকাঁপা হাতে বইটি বুকের উপরে টেনে নিয়েছিলেন। মরে গিয়ে তুমি বেঁচে গিয়েছিলে কোপার্নিকাস। তবে তোমার বইটা ওরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দশ বছর ধরে আমাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। আমার টেলিস্কোপ ধর্মের পেয়াদারা কেড়ে নিয়েছে। আকাশের দিকে তাকানো বারণ। আমাকে বন্দী করার আগে ওরা আমাকে খৃষ্টধর্ম যাজকদের আদালতে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। সেখানে আমাকে বলতে বাধ্য করেছিল যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে না। বুড়ো বয়েসে আর আগুনে পুড়তে চাই নি, ওরা যা বলতে বলেছে, তাই বলেছি। ডান চোখে এখন আর কিছু দেখি না, কেঁদে কেঁদে বাম চোখটাও প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে।
হিপাটিয়া : আমি একজন মহিলা জ্যোতিবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, এবং শিক্ষিকা। আমি পৃথিবীকেন্দ্রিক জগতে বিশ্বাস করতাম, তবে টলেমির মডেলের কিছু ভুল বের করেছিলাম। আমি খৃস্টান বা ইহুদি নই, আমি বিধর্মী পৌত্তলিক (pagan)। আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিটি ছিল আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ওটাই ছিল সে আমলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। ৩৯১ সালে রোমের রাজা থিওডোসিয়াস বিধর্মী হওয়া নিষিদ্ধ করে দেন, বিধর্মীদের সব মন্দির ভেঙে ফেলা হয়। খৃস্টান এবং ইহুদিদের মাঝে দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়। আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। পৃথিবীর সব জ্ঞান নাকি বাইবেলে আছে, আর সব বই রেখে লাভ কি? একদল ধর্মান্ধ খৃষ্টানের দল আমাকে বাড়ি থেকে টেনেহিচড়ে বাইরে নিয়ে আসে, জামাকাপড় ছিঁড়ে আমাকে উলঙ্গ করে ফেলে, পাথর ছুড়ে আমাকে খুন করে, আমার মৃতদেহ থেকে হাত, পা কেটে নিয়ে সে সব আগুনে পোড়ায়।
আমি খৃস্টান বা ইহুদি নই, আমি বিধর্মী পৌত্তলিক (pagan)। আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিটি ছিল আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ওটাই ছিল সে আমলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। ৩৯১ সালে রোমের রাজা থিওডোসিয়াস বিধর্মী হওয়া নিষিদ্ধ করে দেন, বিধর্মীদের সব মন্দির ভেঙে ফেলা হয়। খৃস্টান এবং ইহুদিদের মাঝে দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়। আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। পৃথিবীর সব জ্ঞান নাকি বাইবেলে আছে, আর সব বই রেখে লাভ কি? একদল ধর্মান্ধ খৃষ্টানের দল আমাকে বাড়ি থেকে টেনেহিচড়ে বাইরে নিয়ে আসে, জামাকাপড় ছিঁড়ে আমাকে উলঙ্গ করে ফেলে, পাথর ছুড়ে আমাকে খুন করে, আমার মৃতদেহ থেকে হাত, পা কেটে নিয়ে সে সব আগুনে পোড়ায়
ব্রুনো : আমি কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের একজন উৎসাহী সমর্থক। আমি মনে করি দূর আকাশের নক্ষত্রগুলি এক একটি সূর্য। ওদের অনেকেরই আমাদের সূর্যের মতো গ্রহ আছে, সেখানে অন্য কোনো প্রাণীও থাকতে পারে। আমি একজন গণিতজ্ঞ এবং কবি। কোপার্নিকাস এবং আমার বহু-সৌরজগৎ তত্ত্বকে প্রচার করেছি সারা ইউরোপ জুড়ে। রোমের ক্যাথলিক ধর্মযাজকের দল খ্যাপা কুকুরের মতো আমার পেছনে লেগে আছে। মৃত্যুকে ভয় পাই না আমি।
লেখক : ব্রুনোকে বন্দী করা হয়, রোমান ক্যাথলিক মোড়লদের বিচারের রায় ছিল, “ব্রুনো একজন অনুতাপহীন, অদম্য, জেদি পাষণ্ড। ওকে পুড়িয়ে মারতে হবে।” জিহ্বা বেঁধে উলঙ্গ করে ব্রুনোকে উল্টো দিকে ঝোলানো হয়, তারপরে নিচের কাঠে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
ব্রুনোর মৃত্যুযন্ত্রনা মানুষ ভোলে নি। ১৮৮৭ সালে ইতালিতে ব্রুনোর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মূর্তি ভাঙতে ভ্যাটিকান (ধর্মযাজক পোপের রাষ্ট্র) অনেক চেষ্টা করেছে, সাধারণ মানুষ বুকের পাঁজর দিয়ে ওকে রক্ষা করেছে।
১৯৭৯ সালে পোপ জন পল গ্যালিলিওর কাছে ভ্যাটিকানের তরফ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেন, গ্যালিলিওকে এ যুগের পদার্থবিদ্যার পিতা বলে সম্বোধন করেন। ভ্যাটিকান ঘোষণায় বলা হয়, “আমরা নিন্দা করি এই ধরণের বিচারকে। এ থেকে এই মিথ্যে ধারণার সৃষ্টি হয় যে বিজ্ঞান এবং ধর্ম পরস্পর বিরোধী। “ভ্যাটিকান কোনোদিন হাত জোড় করে হিপাটিয়া এবং ব্রুনোর কাছে ক্ষমা চাইবে কি?
লেখক: পদার্থবিদ ও ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরিটাস প্রফেসর