Author Picture

সোয়াজিল্যান্ডের হাউস অন ফায়ার ও সেক্স অফেন্ডার

মঈনুস সুলতান

আমার আজকে কোন কিছু করার কোন তাড়া নেই, তাই অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে হাউস অন ফায়ারের দেয়ালটি দেখি। এর কেল্লার মতো করে স্থানীয় স্থপতি ও কলাকারদের হাতে গড়ার কায়দা দেখে ওয়ালটিকে বরং প্রাচীর বলাই সঙ্গত। তার গায়ে নতশীর হয়ে কতগুলো মূর্তি গভীর চিন্তায় মগ্ন। অর্ধভগ্ন হয়ে কয়েকটি প্রতিমা খামোকা ছড়িয়ে আছে আঙ্গিনায় স্রেফ ভাস্করের খামখেয়ালে। আর দেয়ালে কিছু বাতায়নে স্থপতি এ্যয়সা কেরেসমাতি দেখিয়েছেন যে—ওখানে শিকের পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে মানবিক ইশকের প্রতীক হৃদয়ের নকসা। একটি স্তম্ভের ওপরে দাঁড়ানো পরি। শিঙ্গা দিয়ে বোধ করি ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য দেয়া হচ্ছে এলান। পাশের আরেকটি ক্ষুদ্র স্থাপথ্যকে দেখায় অবিকল মসজিদের মিনারের মতো। পাথর কুন্দে গড়া হজরত আদম (দঃ) এর ফরজন্দদের বেজায় দীর্ঘ সব আকৃতি এমনভাবে নতশির হয়ে আছে যে, ঠিক বুঝতে পারি না তারা কি বিষাদগ্রস্থ, নাকি সন্তস্ত্র শিরোচ্ছেদের সম্ভবনায়। হয়তো স্রেফ শরম পেয়েছে, গন্দম জাতীয় কিছু চুরির ব্যাপার আছে, তাই মূর্তিগুলো মরমে মরে আছে।

সোয়াজিল্যান্ডের মবুবান শহরে পর্যটন করতে আসলে গতরে আগুনের আঁচের মতো এসে লাগে হাউস অন ফায়ারের খোশনাম। যারা এখানে এক দফা ঘুরে গেছেন, তারা অনুপম এ স্থাপনার আলোকচিত্রে প্রণাম করে ইমোশনে আর্দ্র হতে হতে আচানক এ ইমারতকে অভিহিত করেন ‘এন এনচ্যানটিং স্পেস’ বা ‘জাদুময় জগত’ হিসাবে। আর হিপি তরিকার ব্যাকপ্যাকারদের মাঝে যাদের কবিতার ধাত আছে, তারা এ অট্টালিকাকে প্রকাশ করেন টুকটাক পদ্যে,‘বেস্ট হাউস ইন দ্যা গ্রাউন্ড/ অ্যা রিয়েল বিউটি অল এরাউন্ড।’ হাউস অন ফায়ারের তারিফকে ঠিক বেফজুল বলা চলে না, এসব মন্তব্যের বুনিয়াদ যে বেশ মজবুত, তার পরিষ্কার নিশানা পাই অশোক স্তম্ভের কায়দায় গড়া একটি কলামের কাছে আসতেই। স্তম্ভটির গোড়ায় গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে বাটকুল গোছের কয়েকটি বদখত মূর্তি। তার পাশেই প্রস্তর ফলকের কায়দায় উৎকীর্ণ করা হজরত জালালুদ্দীন রুমি’র একটি মসনবীর ইংরেজী তর্জমা। তাতে লেখা,‘আই অ্যাম ওনলি দ্যা হাউস অব ইয়োর বিলাভেড/নট দ্যা বিলাভেড হারসেল্ফ..।’ অর্থাৎ ‘আমি তোমার প্রেমাস্পদ নই, স্রেফ তার বাসগৃহ..।’

একটি বিষয় ভেবে খুবই অবাক লাগে যে—একটি মেয়ে-শিশুর দেহ, এবং তার জীবনের ওপর হিংসাত্মক আচরণের কাহিনী শুনেও আমি কি রকম নিরাসক্ত আছি? এ নির্লিপ্ততা কি ক্রাইম নয়? এবার সচেতনভাবে তীব্র গ্লানি বোধ করি। ফ্রিজের বাইরে সারারাত রেখে দেয়া কাচ্ছি বিরিয়ানীর বাজে গন্ধের মতো এক ধরনের অপরাধবোধে ছড়ায় অস্বস্তি। চকিতে আমি গলেলা শহরের অচেনা সেক্স অফেন্ডারের কথা ভাবি। এ ধরনের ক্রাইম সে করেছে অনেকবার। তার আপত্তিজনক ভায়োলেন্ট আচরণে হয়তো জন্ম হয়েছে একটি কন্যা-শিশুর। সে বাচ্চাটিও কি কোথাও শিকার হচ্ছে আমার নিজস্ব প্রজাতি আরেক পুরুষের হিংসাত্মক প্রবণতার?

এ লবজের সামনে দেখি দু’খানা ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বোমবাসো ব্যাকপ্যাকার লজে বাস করা এক সাঙ্গাত। তার নাম মি. ভেগার্ভ। আমিও হালফিল বাস করছি বোমবাসো ব্যাকপ্যাকার লজে, তাই মি. ভেগার্ডের সাথে চেনাজানা আছে। এ ভদ্রসন্তানের আদি নিবাস নরওয়ের একটি ছোট্ট শহর গ্রিমস্ট্যাড। তার জামাকাপড় অত্যন্ত হেগার্ড, ছেড়াখুড়া ধুলিমলিন ড্রিল স্যুট, গতর থেকে বেরোচ্ছে এলকোহল, ট্যাবাকো ও ঘামের কড়া বদবুঁ বা দুর্গন্ধ। তিনি কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে মৌলানা রুমির মসনবীর চরণটি পাঠ করে আতান্তরে পড়ে যান। আমাকে দেখতে পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলেন,‘তবে কি এরা বলতে চাচ্ছে— হাউস অন ফায়ারের ফ্যানটাসি এনভায়ারমেন্ট হচ্ছে প্রেমাষ্পদের গৃহ, এখানে কায়দা মতো খুঁজতে পারলে তাঁর নাগাল পাওয়া যাবে?’ আমি তার ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে বলি,‘দ্যাটস্ ইট মি. ভেগার্ড, লেটস্ মুভ অন, খানিক সামনে গিয়ে যার ইশকে মাতওয়ারা হতে চাই তাঁকে বরং তালাশ করি।’ তিনি দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলেন। নরওয়ের এ ভদ্রসন্তান একাধিক ব্যাকপ্যাক ও একটি আস্ত ডাক্তারি ঝোলা ক্যারি করছেন, তাতে আছে প্লাস্টিকের ছোট্ট একটি কংকাল। তো খানিক নাজেহাল দেখায় এসব সামলাতে গিয়ে তাকে । অতঃপর দুখানা ক্র্যাচে ভর দিয়ে তিনি খ্যাচম্যাচ শব্দ করে আগ বাড়েন। একটু সামনে গিয়ে আতকা দাঁড়িয়ে পড়ে ছোট্ট নোটবুক বের করে ঠুকে নেন সুফি সন্ত রুমির চমৎকার চরণটি। দেহে ভারসাম্যের বেজায় খামতি আছে বলে দাঁড়িয়ে কলম দিয়ে লেখা তার জন্য মুশকিল হয়। তিনি একখানা ক্র্যাচ বগলে চেপে লিখতে গেলে— তা পাইপের ডগায় বাড়ি খায়, তাতে চারদিকে ছিটকায় ছাইকনা ও আধপোড়া ট্যবোকোর কুচি।

হাউস অন ফায়ারের দেয়াল

মি. ভেগার্ড মৌলানা রুমির মসনবী মনযোগ দিয়ে টুকে নিচ্ছেন দেখে আমি তাজ্জব হই। দিন কয়েক হয় তিনি মোজাম্বিকের চিকওয়ালাকুয়ালা শহর থেকে বাঝ-বাসে চেপে সোয়াজিল্যান্ডে এসেছেন। বোমবাসো ব্যাকপ্যাকার্স লজের ডরমিটরিতে আমার পাশে বাংক-বেডে বাস করছেন। ভিন দেশে ভ্রমণের সময় বিচিত্র সব কার্স ওয়ার্ড বা গালিগালাজ সংগ্রহ করার বাতিক আছে তার। অবসর সময়ে ‘ব্লাডি, বোহেনচুত’, কিংবা বুয়ারদের আফ্রিকানস্ জবানে ‘নেইয়ার’ অর্থাৎ ‘সঙ্গম করনেওয়ালার’ মতো বিদঘুটে সব লবজ উচ্চারণ করে তিনি পয়দা করেন রীতিমতো সেনসেশন। মসনবীতে তার কোন প্যাশন থাকার কথা না।

হাউস অন ফায়ারের পরিসর বৃহৎ। অনেকগুলো ঘর, ঝুল বারান্দা, পারফরমেন্স হল, ডিসপ্লে সেন্টার, ক্যাফে, পানশালা ও হরেক রকমের খোলামেলা আঙ্গিনা নানা মাপের করিডোর দিয়ে সংযুক্ত। মি. ভেগার্ড আমাকে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সমস্ত কিছু দেখেন। করিডরে বসে জিরিয়ে নেয়ার জন্য আছে কাঠের সিংহাসন, কোন কোন বেঞ্চের আকৃতিতে শোভা পাচ্ছে স্বর্গের দেবদূতের আদল। আবার কোথাও কারুশিল্পের কারিগররা টাইলস দিয়ে বানানো মোমদানে করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছেন পানীয়। হাঁটাহাঁটিতে পেরেশান হয়ে মি. ভেগার্ড আঙ্গিনায় পাতা একটি বেঞ্চে বসেন। আসবাবটির সর্বত্র আসমানের একাধিক রাশিচক্রের নকশা আঁকা। তাতে নক্ষত্রগুলো যেন মানুষের মুখের আকৃতিতে মৃদু মৃদু হাসছে। মি.ভেগার্ড ফ্লাক্স বের করে এক ঢোঁক ব্র্যান্ডি পান করে বিড়বিড়িয়ে বলেন,‘মোস্ট ইমাজিনিটিভ, ইকলেকটিক এন্ড পিওর বহেমিয়ান সেটআপ।’ আমি ‘দ্যাট ইজ ট্রু ফর শিওর’, বলে তার মন্তব্যে সায় দিলে তিনি খানিকটা জনান্তিকে আবার বলেন,‘মনে হয় রাজ্যের সব বাদাম্যা ভাস্কর, বদমাশ কারুশিল্পী ও বেয়াড়া স্থপতিদের জড়ো করে এ হাউসের একেকটি অংশ ইজারা দিয়ে ব্যাটাদের বলা হয়েছে— তোমাদের পছন্দ মোতাবেক তৈরী করো দেয়াল, ডিজাইন করো ফ্লোরের মোজাইক, পানি ঝরাও ফুয়ারায়, কিংবা বানাও প্রতিমা। ব্যবহার করো যার যা খুশি স্টাইল। কুচ পরওয়া নেই। ইউজ অল দি ফ্রিডম ইউ নিড। মেক এনি ড্যাম থিংক ইউ ওয়ান্ট।’ তিনি একটু পজ্ নিয়ে আবার বলেন,‘ লুক,অল দিজ ব্লাডি নেইয়ারস্, দে বিল্ড হোয়াট অ্যা ফাইন হাউস অল টুগেদার।

জানালায় হৃদয়াকৃতির নকশা

স্বগতোক্তি শেষ করে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,‘তোমার জ্বর কমেছে?’ আমি ইতিবাচকভাবে মাথা হেলালে তিনি সন্তুষ্ট না হয়ে ডাক্তারি ঝোলা থেকে থার্মমিটার বের করে আমার তাপ মাপেন। মি. ভেগার্ডের আরেকটি বাতিক হচ্ছে, ঝোলায় করে ব্লাডপ্রেসার মেশিন ও ‘যেখানে ডাক্তার নেই’ গোছের কয়েকখানা কেতবাদি ও প্রচুর ঔষধপত্র নিয়ে ঘুরা। চলার পথে রোগ-ব্যামোতে কোন পর্যটক সাফার করছে দেখলে তিনি তাদের স্টোথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ওষধপত্র দেন। কারো পিট কিংবা হাঁটুর গাঁটে ব্যাথা হলে তিনি প্লাস্টিকের কংকাল বের করে জানতে চান ‘সোর পয়েন্ট’ বা ব্যাথা ঠিক কোথায়? তার দু’পা বিকলাঙ্গ হলেও হাত দুটি এখনো ঠিকঠাক আছে। হাইকিং করে কোন পর্যটকের পায়ের গুছি ফুলে টুলে গেলে, তিনি মাসোল চেপে ধরে মলম মাখিয়ে মালিশও করে দেন অবলীলায়। আমার গেল কয়েকরাত ধরে ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছে। আমাকেও তিনি বিনা মূল্যে এলাজ দিয়েছেন।

থার্মমিটারের পারদ চেক করে মি.ভেগার্ড এবার এক প্যাকেট পেপরনি বের করে জানতে চান,‘আর ইউ হ্যাংরি?’ আমি ক্ষুদার্থ হলেও নিসিদ্ধ মাংসে তৈরী পেপরনি খেতে চাই না। তাতে বিরক্ত হয়ে মি.ভেগার্ড বলেন,‘ অ্যা বেগার ক্যান্ট বি অ্যা চুজার।’ এ ভদ্রলোক সারাক্ষণ চকোলেট, চিপস্, ক্রিমক্রেকার, সোমোসা ও লাবাসকিরি চিজ ইত্যাদি শুকনা খাবার খেয়ে জীবন ধারন করছেন। তাকে কখনো কমপ্লিট মিল খেতে দেখিনি। তিনি স্ন্যাকসের প্যাকেট খুলে বেশ কয়েকবার আমার সাথে শেয়ার করেছেন ড্রাই এপ্রিকট, ব্রেড স্টিক বা কুকি বিস্কুট। সুতরাং আমাকে ‘বেগার’ সম্বোধন করাতে আমি অসন্তুষ্ট হই না। বরং তাকে নিরিবিলিতে ব্র্যান্ডি পান করার সুযোগ দেয়ার জন্য আমি আপাতত বিদায় নেই।

তোরণ ও টাওয়ারে পরি

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। আমারও ক্ষুদা পেয়েছে, তাই অন্য একটি আঙ্গিনায় এসে ক্যাফেতে বসি। কমলার তাজা কোয়ার পুর দেয়া টি-কেক এর সাথে আমি চা পান করি। আদম সন্তানের মুখমন্ডলের মতো দেখতে একটি পোড়ামাটির পেয়ালায় পরিবেশিত হয় রয়বস টি। আমি তা চাকুস চাকুস শব্দে পান করতে করতে মি.ভেগার্ডের কথা ভাবি। আমার ঘুসঘুসে জ্বরের চিকিৎসা তিনি করছেন। কিন্তু তার ব্যাকগ্রাউন্ড ডাক্তারী বা মেডিসিন কিছু না। নরওয়ের গ্রিমস্ট্যাড শহরে তিনি কিছু দিন কৃষি কলেজে পড়াশুনা করেন। ক্রমাগত খারাপ রেজাল্টের জন্য কলেজ তাকে জবাব দেয়। তারও আগে স্কুল জীবনে তিনি ড্রপ আউট হন বার কয়েক, আবার ফিরে আসেন শিক্ষাক্ষেত্রে,কিন্তু পরীক্ষায় কেবলই ব্যার্থ হতে থাকেন।
সামাজিকভাবেও তিনি ছিলেন নরওয়ের সোসাইটিতে মিসফিট। আইন কানুনের তেমন একটা ধার ধারতেন না বলে বার কয়েক জরিমানা দেন, জেলও খাটেন।

অতঃপর ভেগার্ড সাহেব সোয়াজিল্যান্ডে আসেন বছর দশেক আগে। এনিম্যাল ফোডার তৈরীর ব্যবসায় নামেন। গরু ও মেষের খামারে সাপ্লাই দিচ্ছিলেন জীব জানোয়ারের খাবার। তখন তার পলিও রোগে চিরতরে খোঁড়া হয়ে যায় দুটি পা। প্রৌঢ় বয়সের পলিও খুবই বিরল রোগ। মবুবান শহরের হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয় খুব বাজে ভাবে। রোগ নির্ণয়ে মারাত্মক ভুল হয়। অপচিকিৎসার ফলে সম্পূর্ণ সুস্থ তিনি হননি। তবে সোয়াজি ডাক্তারদের ওপর বিলা হয়ে বইপত্র পড়ে কিছু কিছু সরলসিধা রোগের চিকিৎসা পদ্ধতী শিখে নেন। অফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে তিনি আর নরওয়েতে ফিরে যাননি। বর্তমানে মি.ভেগার্ড পাশের দেশ মোজাম্বিকের চিকওয়ালাকুয়ালা শহরেব ইরিগেশনের ওপর ছোটখাট কনসালটেন্সি করছেন। খুবই সাময়িক পেশা। অবসরে অনেকগুলো ব্যাকপ্যাক পিটে ফেলে সস্তায় বাসে চড়ে ঘুরে বেড়ান এ অঞ্চলের সর্বত্র। বছরে একবার করে আসেন সোয়াজিল্যান্ডে। ক্র্যাচ তার চলার গতিকে শ্লথ করে দেয়নি। গতকাল আমার সাথে সম্পূর্ণ খোঁড়া মি. ভেগার্ড সিবেবে রক পাহাড়ের চূড়া অব্দি পৌঁছেছিলেন। সিবেবে রকের হাইক ছিল বেশ ডিমান্ডিং। আমরা হাঁটতে হাঁটতে মাঝপথে বার কয়েক থেমে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। তখন টুকটাক কথা বলে তার জীবন সম্পর্কে বেশ খানিকটা জেনেছিলাম।

হাউসের অলংকৃত স্তম্ভ

উঠে পড়ে চলে আসি অন্য আরেকটি আঙ্গিনায়। এখানে পাতা বেঞ্চগুলো আমাকে আকর্ষণ করে তুমুলভাবে। একটি বিচিত্র বেঞ্চে এর বাঁদিকে গোলাপি হরফে লেখা ‘লাভ স্টেশন’, আর ডানদিকে ‘ওয়ান স্টপ ওনলি’। এ বাক্য দুটি আদতে কি বুঝাতে চাচ্ছে তা ভাবতে গিয়ে দেখি— অন্য আরেকটি বেঞ্চে বসে অঞ্জু আরনা। তার সামনের টি-টেবিলে চরছে গোটা সাতেক শালিকের ছোট্ট ছোট্ট মূর্তি। তার সাথে হাউস অন ফায়ারে ঢোকার মুখে তোরণের কাছে দাঁড়িয়ে সামান্য কথাবার্তাও হয়েছে। আরো একটু বাতচিত করা অসঙ্গত কিছু হবে না আন্দাজ করে দু পা এগিয়ে যাই। তার হাতে খোলা রূপকথার চিত্রিত শিশুতোষ বইটি। পাশে রাখা আয়নার মতো ট্র্যান্সপারেন্ট একটি ব্যাকপ্যাক। অঞ্জু তার ভেতরে রাখা টেডি-বেয়ারের দিকে ধুন ধরে তাকিয়ে আছে। আমি কাছাকাছি হতেই সে গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকায়। বাগিচায় অলংকার হিসাবে রোপন করা একটি কলার ঝাড়ের ভেতর দিয়ে তার চোখেমুখে এসে পড়েছে সূর্যের তেরছা আলো। তার তীব্র কালো গাত্র বরণে তাতে ছড়িয়ে পড়ছে ডিমের কুসুমের আভা। অঞ্জু মৃদু স্বরে,‘হোয়াটস্ আপ?’ বললে আমি নিমেষে নির্ণয় করতে যাই তার নৃতাত্ত্বিক অরিজিন। তাকে ঠিক তামিল নারীদের মতো দেখাচ্ছে না? তবে কি সে গুজরাতি? আমি আঁতিপাঁতি করে বলি,‘ওয়ানা হ্যাঙ আউট উইথ মি অ্যা বিট অঞ্জু?’ জবাবে সে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে,‘আই ডোন্ট নো রিয়েলি।’ আমি ‘ও-কে দেন,’ বলে একটু দূরে এসে আরেকটি বেঞ্চে বসলে সে উঠে এসে আমার পাশে বসতে বসতে বলে,‘ দিস ইজ সেকেন্ড টাইম তুমি আমার সাথে কথা বলার জন্য এপ্রোচ করেছো।’ আমি জবাব দেই,‘দ্যাট ইজ রাইট। আমার কৌতূহল হচ্ছে তোমার নামের প্রথম অংশ অঞ্জু শব্দটির অর্থ জানতে। তুমি তো অলরেডি বলেছো আরনা শব্দের অর্থ গডেস লাক্সমি। এবার কাইন্ডলি বলবে অঞ্জু শব্দে আদতে কি বুঝায়?’ সে সপ্রতিভভাবে জবাব দেয়,‘গুজরাতি ভাষায় অঞ্জু শব্দের অর্থ হচ্ছে— ওয়ান হু লিভস ইন দ্যা হার্ট। আর ইউ স্যাটিসফাইড নাও?’ আমি একটু দ্বিধার সাথে বলি,‘ ইয়েস, এর বেশী কিছু জানতে চাওয়া বোধ করি সঠিক হবে না।’ আমার মন্তব্য শুনে সে আবার গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকায়। তার চোখেমুখে কেমন যেন একটি লতা নীরবে খুঁজছে বৃক্ষশাখা— এ ধরনের অভিব্যক্তি খেলে যায়। আমি ধৈর্য ধরে নিশ্চুপ থেকে তাকে লিড নেয়ার সুযোগ করে দেই। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার নীরবতায় উত্যাক্ত হয়ে বলে,‘সো কাইন্ডলি টেল মি হোয়াট ইট ইজ দ্যাট ইউ ওয়ান্ট টু নো আবাউট মি?’ জবাব আমার মনে তৈরীই ছিলো, তাই সরাসরি জিঞ্জেস করি,‘হু ইজ লিভিং ইন ইয়োর হার্ট রাইট এ্যট দিস মোমেন্ট? এখন কার কথা ভাবছো তুমি অঞ্জু? তোমার হাতে বাচ্চাদের পড়ার বই, ব্যাকপ্যাকে টেডি-বেয়ার? হোয়াট ইজ ইট অল আবাউট?’

ক্লক টাওয়ারের আকৃতি

নৌকা থেকে নামার সময় মানুষ যে রকম চরে এক পা দিয়ে দেখে নেয় নিচের মাটি কতোটা শক্ত, সে রকম অঞ্জু আরনা নীরবে আমাকে মাপঝোঁক করে, বোধ করি ভাবে বলা কতোটা সঠিক হবে। আমার আজ কোন তাড়া নেই, তাই বড়শি ফেলা মানুষের মতো চুপচাপ বসে থাকি। ট্র্যন্সপারেন্ট ব্যাকপ্যাকের ঝিপার খুলে টেডি-বেয়ারটি স্পর্শ করে তার তুলতুলে পশমে হাত বোলাতে বোলাতে অঞ্জু বলে,‘এ খেলনাটি এলসা জোহানসনের। নয় বছর আগে আমি যখন তার বেবি সিটার হিসাবে কাজ করতাম, তখন রূপকথার এ বইটি তাকে বার বার পড়ে শোনাতাম। এক বছরের বাচ্চা মেয়ে এলসা গল্পের কিছু বুঝতো না, কিন্তু পড়লে কান্না বন্ধ করে দিয়ে বড়বড় নীল চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতো। তার তৃতীয় বার্থডে-তে আমি তাকে এ টেডি-বেয়ার উপহার দেই। জোহানসন দম্পতি পশমের ভালুকটিকে নেলী নামে ডাকতেন। সুইডিশ ভাষায় নেলী শব্দের অর্থ হচ্ছে টেডি-বেয়ার। এলসা নেলীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পছন্দ করতো। তারপর তো অনেককিছু..। আমি কিন্ডার গার্টেনের টিচার হলে এলসা প্রি-স্কুলে ভর্তি হয়। প্রি-স্কুল ছাড়াও তাকে আবার ক্লাস টিচার হিসাবে খুব কাছে পাই, সে যখন থার্ড গ্রেডে উঠে।’

অঞ্জু বেশ কিছুটা সময় নিয়ে কি যেন ভাবে। তারপর পার্স থেকে বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার একটি লকেল নিউজ পেপারের কাটিং। ছোট্ট এক কলামের সংবাদটি আমি পড়ি। আজ থেকে বছর তিনেক আগে তার বাড়ির সামনে থেকে সাত বছরের এলসা জোহানসন কিডন্যাপ হয়। খবরে কারাগার থেকে চার বছর আগে ছাড়া পাওয়া এক সেক্স অফেন্ডারের শিশুকাম সুলভ লালসা, ধর্ষন ও মার্ডারের উল্লেখ আছে। তথ্যটি খুব ট্র্যাজিক, অত্যন্ত দুঃখজনক ও ভয়াবহ। তবে আমি তেমন একটা অবাক হই না। বছর কয়েক হলো আমি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে বাস করছি। এ অঞ্চলে, বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকায় এ ধরনের সেক্স ক্রাইম এত বেশী যে—পত্রিকায় এ ধরনের ঘটনার বিবরণ ছাপে আকছার।

মিনারের মাথায় গম্ভুজ

অঞ্জুর সাথে আমার মাত্র ঘন্টা দেড়েকের পরিচয়। তার বেদনা আমি বুঝতে পারি, তবে সহানুভূতি জানালে হয়তো তা কপট শোনাবে; আর বিষয়টি এতোই দুঃখজনক যে ঠিক বুঝতে পারি না— কি বলবো। অঞ্জু নিজে থেকে নীরবতা ভেঙ্গে বলে,‘জোহানসন দম্পতি আদতে সুইডেনের লোক। দক্ষিণ আফ্রিকার গলেলা শহরে তারা একটি খামার কিনেছিলেন। এলসার মৃত্যুর পর তারা ফার্মটি বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছেন কেপ টাউনের দিকে। স্মৃতি পীড়া দেবে তাই তারা এলসার ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র একটি এতিমখানায় দান করে দেন। গলেলা শহর ছেড়ে যাওয়ার দিন তারা এলসার প্রিয় এ বইটি ও টেডি-বেয়ার নেলী আমাকে স্মারক হিসাবে দেন।’

অঞ্জুর এ বক্তব্য থেকে শিশুতোষ বই ও খেলনা ভালুক সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তবে এতে কিন্তু তার এসব জিনিসপত্র নিয়ে হাউস অব ফায়ারে আসার বিষয়টি পরিষ্কার হয় না। একটু নীরবতার পর অঞ্জু নিজেই রহস্য ভেঙ্গে খোলাসা করে বলে,‘ গলেলা শহর সোয়াজিল্যান্ডের সীমান্তে। ড্রাইভ করে আসতে মাত্র ঘন্টা খানেক সময় লাগে। আমি মাঝে মাঝে কিন্ডার গার্টেনের অন্যান্য বাচ্চাদের নিয়ে ফিল্ডট্রিপে সোয়াজিল্যান্ডে এসেছি। বাচ্চারা হাউস অন ফায়ারে আসা খুবই পছন্দ করতো। আমি হাউসে ডিসপ্লে করা অনেক আর্ট অবজেক্টের স্লাইড করেছিলাম। থার্ড গ্রেডের ক্লাসে স্লাইডগুলো দেখালে এলসা আগ্রহী হয়ে এখানে আসতে চায়। সে বারবার আমাকে তাড়া দিয়ে বলতো—মিস, কবে তুমি আমাকে হাউস অন ফায়ারে নিয়ে যাবে? তো আমি ফিল্ড ট্রিপের আয়োজন করি। কিন্ত সেদিন তাদের গাড়ি খারাপ থাকায় এলসা স্কুলে আসতে পারে না। সে টেলিফোন করলে আমি তাকে তার আয়ার সাথে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বলি। আমি তো অন্যদের নিয়ে ড্রাইভ করে ওদিক দিয়ে যাচ্ছি সোয়াজিল্যান্ডের বর্ডারে। তাকে পথে পিক করে নিতে অসুবিধা কি? তো এলসা তার আয়ার সাথে সড়কে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ খেয়াল হয় যে, সে তার টেডি-বেয়ার নেলীকে ঘরে ফেলে এসেছে। নেলীকেও সে হাউস অন ফায়ারের রকমারি সব আর্ট অবজেক্ট দেখােেত চায়। আয়া তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে নেলীকে আনার জন্য ফিরে যায় বাড়ির ভেতরে। সে নেলীকে খুঁজে পাচ্ছিলো না বলে তার একটু দেরি হয়। মিনিট দশেক পরে নেলীকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে আয়া দেখে যে— সড়কে এলসা নেই। আমি পেট্রোল পাম্পে থেমেছিলাম বলে আমিও সময় মতো পৌঁছতে পারিনি তার বাড়ির সামনে। এ সামান্য মিনিট দশেক সময়ই কাল হলো। এক সেক্স অফেন্ডার গাড়ি ড্রাইভ করে এসে তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। এলসার মা-বাবা দুজনেই তখন ফার্মের কাজকর্ম দেখছিলেন।’

অঞ্জু এবার জানতে চায়— আমি কি জাতিস্মর বা পুনরজন্মে বিশ্বাস করি? আমি নির্দ্দিষ্ট কোন জবাব না দিলে সে নিজে থেকেই বলে,‘আই ডোন্ট রিয়েলি নো ইফ আই বিলিভ ইট অর নট। তবে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার গুজরাতি হিন্দু, আমাদের পরিবারে পুনরজন্ম এবং জতিস্মর এসব নিয়ে সংস্কার আছে। মাঝে মাঝে আমি স্বপ্নে দেখি এলসা বলছেÑ মিস, নট টু ওয়ারি, আমি তো আবার জন্মাবো, তারপর একটু বড় হলে চলে যাবো হাউস অন ফায়ারের ফ্যানটাসটিক সব জিনিসপত্র দেখতে।’ অঞ্জু একটু পজ নিয়ে আবার বলে,‘প্রতিবছর তার কিডন্যাপ হওয়ার দিনে আমি হাউস অন ফায়ারে আসি। বইতে পড়েছি যে—জাতিস্মর হওয়া বাচ্চারা তাদের আগের জন্মের জিনিসপত্র দেখলে চিনতে পারে। তাই রূপকথার বইখানা আর খেলনা টেডি-বেয়ার নিয়ে এখানে আসি। বসে থাকি। নতুন করে জন্মালে তার দৈহিক আকার-আকৃতি গাত্রবর্ণ সব বদলে যাবে। কিন্তু তার চোখমুখের দিকে তাকালেই আমি তাকে চিনতে পারবো। ’

অঞ্জু এবার কী যেন এক আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকায়। রেসপন্সে আমি নীরব থাকলে সে উঠে পড়ে বলে,‘নাইস টকিং টু ইউ।’ আমি বলতে চাই,‘সি ইউ এগেইন অঞ্জু,’ কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে তার একহারা দেহ নিয়ে দ্রুত হেঁটে যায় বাগিচায় শৌখিন কলাগাছের ঝাড়ের আড়ালে।

আমিও উঠে হরেক কিসিমের কারুপণ্যে সুসজ্জিত হাউস অন ফায়ারের করিডর ধরে হাঁটি। একটি বিষয় ভেবে খুবই অবাক লাগে যে—একটি মেয়ে-শিশুর দেহ, এবং তার জীবনের ওপর হিংসাত্মক আচরণের কাহিনী শুনেও আমি কি রকম নিরাসক্ত আছি? এ নির্লিপ্ততা কি ক্রাইম নয়? এবার সচেতনভাবে তীব্র গ্লানি বোধ করি। ফ্রিজের বাইরে সারারাত রেখে দেয়া কাচ্ছি বিরিয়ানীর বাজে গন্ধের মতো এক ধরনের অপরাধবোধে ছড়ায় অস্বস্তি। চকিতে আমি গলেলা শহরের অচেনা সেক্স অফেন্ডারের কথা ভাবি। এ ধরনের ক্রাইম সে করেছে অনেকবার। তার আপত্তিজনক ভায়োলেন্ট আচরণে হয়তো জন্ম হয়েছে একটি কন্যা-শিশুর। সে বাচ্চাটিও কি কোথাও শিকার হচ্ছে আমার নিজস্ব প্রজাতি আরেক পুরুষের হিংসাত্মক প্রবণতার?

হাউস অন ফায়ারে আমি গ্লানি ও অস্থিরতা নিয়ে ঘুরপাক করি বিকাল অব্দি। একজন আধকানা শিল্পী শশা, মিষ্টি কুমড়া ও কুডু হরিণের মাটির মূর্তি বিক্রি করার জন্য খুব জোরাজুরি করেন। তাকে পাশ কাটিয়ে আমি চলে আসি, ক্লক টাওয়ারের মতো করে গড়া একটি মিনারের পাশে। দেখি বোমবাসো ব্যাকপ্যাকার্স লজের আরেক গেস্ট এ্যানমারি ডানকান তার বাঁধানো গোড়ায় বসে মগ্ন হয়ে আছেন বিপাসনা মেডিটেশনে। তার পিছনে পরির মূর্তির আবডালে টি টি টিভ টিভ করে একমনে ডেকে চলেছে বোধকরি একটি টিট্টিভ পাখি। কাছেই একটি বেঞ্চে বসে আমি এ্যামমারির ধ্যান ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করি। এ্যানমারি বোমবাসোতে এসে ওঠেছেন মাত্র দিন তিনেক আগে। পয়সাওয়ালা পর্যটক তিনি। এসেছেন আমেরিকার মিশিগান থেকে। আমাদের মতো ডরমিটরির বাংক বেডে বাস না করে তিনি ভাড়া নিয়েছেন আস্ত একটি প্রাইভেট রুম। যানবাহন হিসাবে হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন সাউথ আফ্রিকা থেকে রেন্ট করা ঝকঝকে এস-ইউ-ভি জাতীয় জীপ গাড়ি।

লাভ স্টেশন নামের বেঞ্চ

বোমবাসো ব্যাকপ্যাকার্সের লাউঞ্জে তার সাথে আমার কথাবার্তা হয়। আমি একা বসে মাইন্ডফুল মেডিটেশনের ওপর একটি বই নাড়াচাড়া করছিলাম। তার ওপর আমার দীর্ঘ চুলদাড়ি দেখে তার ধারনা হয়েছে, আমি নির্ঘাৎ কোন এক সাঁই বাবার সাক্ষাৎ মুরিদ। এ্যনমারি আমার সাথে ভারতীয় ফিলসফি নিয়ে বাতচিত করতে চাইলে আমি কৃষ্ণ মেননের লেখা একটি গ্রন্থের ওয়েভসাইট থেকে ডাউনলোড করা কয়েকটি পৃষ্টার প্রিন্ট আউট তার হাতে ধরিয়ে দেই। মহিলা সম্ভ^বত তা পাঠ করেছেন। এবং তার ধারনা হয়েছে যে, আমার বুদ্ধিসুদ্ধি আকল-পছন্দ যথেষ্ট, জ্ঞান-প্রজ্ঞাও প্রচুর। আমিও ভান করেছি, নিজে যে নেহাত গন্ডমূর্খ তা খোলাসা করে ঘোষণা করার কোন উদ্যোগ নেইনি।

তো সন্ধ্যাবেলা তিনি আমাকে ডিনারে দাওয়াত করেন ইড্ল্যাডলোনি নামের একটি সোয়াজি রেস্তোরাঁয়। ইড্ল্যাডলোনি শহরের প্রান্তিকে মোভোবু ওয়াটার-ফলের কাছে। ওদিকে বাঝ-বাস এর কোন রুট নেই বলে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। আজ কপালে খাদ্যযোগ আছে দেখে আমি খদ্দরের কোর্তা-পাজামা পরে আতর মেখে তার এসইউভি’তে সওয়ার হই। রেস্তোরাঁটি নাম খটমটে হলেও এর লকেশনটি চমৎকার। নদীর পাড়ে লন্ঠন ঝুলানো গাছের ডালের নিচে পাতা টেবিলে বসে আমরা সোয়াজি কেতায় রান্না করা ভেজিটারিয়ান ডিশের স্বাদ চাখি। এ্যনমারি পাইনোপোল জুসের সাথে মিশিয়ে পান করেন প্রচুর পরিমানে উমকমবতসি নামের স্থানীয়ভাবে চোলাই করা পানীয়। এতে তার কথা বলার ব্যামো বেড়ে যায় বিঘতভাবে। ডিনারের শেষে আমরা রোস্তারাঁ থেকে লন্ঠন ধার করে নিয়ে হেঁটে যাই মোভোবু জলপ্রপাতের কাছাকাছি। এ সুযোগে মহিলা তার জীবনের অনেকগুলো বিষয়ই আলাপ করে ফেলেন। ভবিষ্যতে তার সাথে আলাপের আর কোন মওকা না আসলে আমার আফসোসের কিছু নেই।

যতোটা জেনেছি, গেল সাত বছরে এ্যনমারি বিবাহিত হয়েছেন মোট চারবার। তার কোন এক স্বামী ছিলেন সঙ্গীত শাস্ত্রে কলাকার, অন্যজন ছিলেন সম্পূর্ণ উন্মাদ, তার সাথে কাজিয়া বিবাদ করার কোন কুদরত ছিলো না, কারণ তিনি সর্বদা ক্যারি করতেন পিস্তল, কিন্ত আদতে দুর্বল ছিলেন মানসিকভাবে এ ভদ্রসন্তান, অবশেষে জগৎসংসার থেকে পরিত্রাণ পান তিনি আত্মহত্যা করে। তার ডিভোর্সের কাহিনীগুলো ফিকশনের চেয়েও মনমুগ্ধকর। এ্যানমারি যে এডিকশনে নিমগ্ন হন এসব ঝঞ্ঝাটে— তাও ছিলো খুবই মারাত্মক। বছর দেড়েক তিনি কোকেনের কুয়াশায় ছিলেন দস্তুরমতো কুলহারা। কিছুদিন আগে তিনি মিশিগানের এক ডিটক্সিফিকেশন প্রোগ্রাম বা মাদক মুক্ত হওয়ার কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন সাফসুতরা হয়ে। ইদানিং তিনি ক্লিন ভাবে দিন যাপনের কোশেশ করছেন।

মেডিটেশনে নিমগ্ন এ্যনমারি

মিশিগানের যে ছোট্ট শহরে তার বসতবাটি, ওখানে তার কয়েকটি সেহেলিও জুটেছিলো— যারা সর্বদা চড়তে ভালোবাসে ড্রাগসের দূরন্ত ড্রাগন। তার জীবন যাপনে যন্ত্রণা বাড়লেই তারা কুমন্ত্রণা দিতো। তিনি মাস ছয়েকের জন্য সেহেলিদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছেন। তাই চলে এসেছেন আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে। প্রথমে এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন এ্যনমারি সাউথ আফ্রিকায়। কোকেনের নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে বিকল্প হিসাবে তিনি ওখানে তার দেহে প্রচুর পরিমাণে এ্যাড্রেনেলিন তৈরীর উদ্যোগ নেন। এ্যড্রেনেলিন হচ্ছে মানব দেহের অত্যান্ত শক্তিশালী একটি হরমোন। মানুষ স্নায়ুবিক ভাবে উত্তেজক বা উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়লে দেহ থেকে নিসৃত হয় এ হরমোন। তো তিনি সাউথ আফ্রিকার একটি নদী একা ডিঙ্গি বেয়ে অতিক্রম করেন। তার নৌপথের দুধারে ছড়ানো আধভাসা পাথরের উপর বসে ছিল নয়টি কুমির। অত্যন্ত আতংকজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যখন তিনি কুমিরগুলোর ছবি তুলতে যান, তখন সচেতনভাবে অনুভব করেন যে—তার করোটিতে উঠছে এ্যড্রেনেলিনের ঝড়। পরদিন তিনি হেলিকপ্টার থেকে ঝাপ দেন। তার স্নায়ুতে এতোই এ্যড্রেনেলিন রাশ হাচ্ছিলো যে—তিনি প্যারাসুটের বোতাম টিপতে বেমালুম ভুলে যান। ফ্রি-ফলে বেশ খানিকটা নেমে পড়ার পর তার বোতাম টেপার কথা মনে আসে। তাতে চাপ দিয়ে ‘ও মাই গড, হেল নো..যিশাস’ আওয়াজ তুলে চমকে যাওয়ার মুহূর্তে তিনি পৌঁছে যান এ্যড্রেনেলিন রাশের তুঙ্গে।

সোয়াজিল্যান্ডে এসে এ্যানমারি অবশ্য কোকেনের তীব্র তাড়নাকে মোকাবেলা করছেন অন্যভাবে। তিনি তার শরীরে তৈরী করছেন এনডরফিন। প্রচুর পরিমানে ব্যায়াম করলে অথবা সঙ্গমে সফল হলে শরীর আপনা আপনি প্রস্তুত করে এনডরফিন। ভালোবাসার সময় মানুষ অনুভব করে যে অনির্বচনীয় সুখ, তাও সৃষ্টি হয় এনডরফিনের কল্যানে। হালফিল গবেষকরা জানাচ্ছেন যে—মেডিটেশন করে দেহমনে তৈরী করা যায় এনডরফিন। সোয়াজিল্যান্ডে আসা অব্দি এ্যামমারি লিপ্ত হয়েছেন নানাবিধ মেডিটেশনে। গতকাল তিনি সিবেবে রক বলে একটি একটি দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ের বিপুল একটি মনোলিথিক পাথরের ছায়ায় বসে অনেকক্ষণ মেডিটেশন করেন। তো আজ এ্যনমারি তার মেডিটেশনের জন্য লকেশন হিসাবে বেছে নিয়েছেন হাউস অন ফায়ারের ক্লকটাওয়ারের মতো মিনারের গোড়া।

অনেকক্ষণ ধরে এ্যানমারি মেডিটেশনে নিমগ্ন আছেন। তার শরীরে নির্ঘাৎ তৈরী হচ্ছে বিস্তর এনডরফিন। এতে আমার আপত্তির কিছু নেই। খুবই ইতিবাচক উদ্যোগ। তিনি আমাকে দরাজহাতে ভরপেট ভোজন করিয়েছেন। আমি তার কুশল কামনা করি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি আখি মুদে আছেন বলে বেচইন লাগে। আমার অধৈর্য হওয়ার পেছনে আছে ছোট্ট একটি ব্যক্তিগত স্বার্থ। তার ধ্যানমগ্নতা ভাঙ্গলে আন্দাজ করছি— তিনি ফিরে যাবেন বোমবাসো ব্যাকপ্যাকার্স লজে। লিফ্ট নিয়ে তার এস-ইউ-ভি’তে সওয়ার হতে পারলে আর বিকাল বেলা বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে বাঝ-বাসের স্টপে দাঁড়ানো ঝামেলা পোহাতে হয় না।

আরো পড়তে পারেন

আগ্নেয়গিরি থেকে পায়ে হেঁটে বেস-ক্যাম্পে ফেরা

ইথিওপিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে ‘অ্যারতে-আলে’ নামে লাভা উৎক্ষেপণে প্রজ্বলিত একটি আগ্নেয়গিরি। আমরা বেশ কয়েকজন পর্যটক আজ জোট বেঁধে, একটি ট্যুর কোম্পানির গাইডের তত্ত্বাবধানে ওই আগ্নেয়গিরির পাশের একটি লাভা-হ্রদের পাড়ে ক্যাম্পিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। ওখানে যেতে হলে প্রথমে একটি বেস-ক্যাম্পে এসে প্রস্তুতি নিয়ে ট্র্যাক করতে হয় ঘণ্টাকয়েক। বেস-ক্যাম্পে পৌঁছানোও ঝকমারি বিশেষ, আমরা ঘণ্টাকয়েক ল্যান্ডরাবারে প্রায়-দুর্গম এক….

মনে করি আসাম যাব

আফ্রিকার মাসাইমারা সাফারিতে যাওয়ার পর আর কোনো বড় সাফারিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অপর্না সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সিনেমাতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার চরিত্রে রাহুল বোসের মুখে কাজিরাঙার কথা শোনার পর এ রিজার্ভ ফরেস্টে সাফারি করার ইচ্ছা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির খুব কাছের এ জায়গাটাতে যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়, আমাদের উত্তর পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আর….

শিল্পের দেশে সৌন্দর্যের দেশে

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভেনিসে পা রেখেছিলাম এক রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দুপুরে। যাত্রীবোঝাই পাবলিক বাসে চেপে যাত্রা করলাম সেন্ট মার্কোসের উদ্দেশে। সেন্ট মার্কোসে অবস্থিত বিখ্যাত স্থাপত্য ক্যাথেড্রাল। ক্যাথেড্রালের চারদিকের দেয়াল সুসজ্জিত কারুকার্যে খচিত। চিত্রকর্ম ও অক্ষরে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন কাহিনি মুগ্ধতা তৈরি করে। এখানেই ভেনিসের প্রাণভোমরা, সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানেল যা যুক্ত করেছে শতাধিক জলরাশিকে। বিশাল খাল ভেনিসকে….

error: Content is protected !!