Tuesday, November 18, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    সিদ্ধার্থ হকের একগুচ্ছ কবিতা

    ঘৃণা

    বহু ঘৃণা সূর্যের মতন, প্রতিদিন ভোরে উঠে,
    প্রত্যহ সন্ধ্যায় ডুবে যায়। কিছু ঘৃণা
    বৃষ্টি, টপ টপ শব্দ। কোন এক নীরবতা
    তোমার কপালে ঝরতে থাকে।
    বহু ঘৃণা, ঘৃণা নয়, প্রেম,
    সাদা মোমবাতি, বিছানার পাশে বসে,
    তোমাকে দেখছে রাত্রিভর।
    অনেক খরার মধ্যে গভীর সবুজ
    গোপনে, সম্পন্ন হতে থাকে।
    আমি প্রকাশিত হই সজাগ থাকায়। ঘুম আসে।
    ঘুম চলে যায়। ঢলি আমি নিজের ভিতরে,
    ঢলে পড়ি ভিতরের রাত্রে কিম্বা দিনে।
    ভ্রমনে এসব হয়— অনিদ্রার ঘ্রাণ
    ক্রমশ শরীরে জমে। উদ্দীপনা দেখে
    ঘৃণা হয়— চুপচাপ ঘৃণা করতে থাকি।
    যে কোন ধ্যানের মত, ঘৃণাও পুনরাবৃত্তিময়,
    সেও এক ধ্যান, চুপ থেকে, বারবার
    ঘৃণা করতে থাকা, নিশ্চয়ই পৃথিবীর ধ্যান।
    ঘৃণার নিজস্ব ইচ্ছা আছে; ঘৃণা চায়,
    যে কাউকেই, একবার নয়, বারবার ঘৃণা
    করা হোক। ঘৃণা এতো অতল বেদনা;
    ঘৃণা চায় এই বেদনার মুখামুখি
    তুমি বারবার হও। বারবার, বারবার হও।
    অংশিক বিশ্রামে ধৃত আমি, টের পাই,
    ঐতিহাসিক সত্যের ধারনা, অবিরাম
    ভুল কথা, ভুল ব্যখ্যা, ভুল বর্ণনায়, মরে গেছে।
    শুয়ে শুয়ে শুনি আমি, পানির ভিতরে ছিদ্র আছে,
    গর্ত আছে। রাত্রি বেলা সব ভেদ করে পানি ঝরে।
    টের পাই, ঘৃনা কিম্বা প্রেম নয়— পানি হতে হয়,
    চেতনার পরিসীমা পার হতে হয়। বুঝতে পারি
    আমিও, আসলে, বুকে গর্ত হওয়া পানি,
    ছিদ্রযুক্ত জল,
    টপ টপ শব্দে ও নৈশব্দে,
    সারারাত বিছানায় গড়াগড়ি করি।

     

    টেলিফোন করিনা

    মৃত্যু হলে আমি আর টেলিফোন করিনা কাউকে।
    পিতাকে করি না ফোন, মাকেও করিনা।
    বাতাসকে ভাবি কিন্তু ফোন করি না।
    আমি ভুলে ডুবে থাকি, অপরাধী করিনা কাউকে।
    যাইনা কোথাও।
    বাইরে গেলেই, হঠাৎ মৃত্যুর সাথে,
    এ সমাজে, দেখা হতে থাকে।
    তাই আমি, চুপচাপ, প্রায় একা থাকি।
    বলা যায়, একা কথা বলি।
    মনে হয়, এ থাকাই ভাল।
    এইভাবে ‘প্রায় একা’ কথা বলা,
    প্রায় ভাল মানুষের এ-জীবন, ভ্রান্তিতে, দুঃখে, বেশ ভালো।
    স্বপ্নগুলো নিরাপদ নেই।
    আমার খেয়াল থেকে উঠে,
    যে স্বপ্ন বাইরে যায়, সে আর ফিরতে চায় না।
    যে ফেরে, তাকে দেখে ভাবি,
    যে ফিরেছে, সে-ই কি,
    আমার চিন্তার বাইরে গিয়েছিল?
    এ এক অদ্ভুত স্থান, এইস্থানে থাকি বলে,
    জানা নাই, হঠাৎ মৃত্যুর পরে
    কি কথা সঠিক হবে বলা।
    মৃত্যু তবু বহুভাবে কথা বলে, ঘটে, শুধু ঘটে।
    মৃত্যুর সহিত,
    মৃত্যুর বিষয়ে,
    কথোপকথনের জ্ঞান, ফলে, জন্মে কি আমার?
    আমার স্বভাবজাত বিমর্ষতা আছে।
    আমি দেখি, বৃষ্টির ঝাপ্টায় দরজা খুলে যায়।
    বৃষ্টির ঝাপটাগুলি, আমার সামনে এসে দাঁড়ায় নগ্ন।
    আমি অবিরাম বসে থাকি; এভাবে থাকাই,
    ভাল লাগে। মৃত্যু মোকাবেলা করা
    ভাল লাগে না আমার। বরং ঔষধ খাই,
    অনেক ঔষধ খেতে থাকি। কত পথ চারদিকে,
    পথই ঔষধ, আমি, সে পথের দেখা,
    পায়ে-চলা-পথে বসে পাই। পায়ে চলা পথে বসে,
    পথ যে ঔষধ, সে ঔষধ আমি, বিবর্তিত
    হতে হতে, ক্রমে পেতে থাকি।
    ধুলায় বিষন্ন ফুটপাতে, মৃত্যু কিম্বা
    বৃষ্টির অদৃশ্য লাইনে,
    সারি সারি চোখ দেখা দেয়,
    চশমা পরিহিত, মিশ্র মানুষের মত।

     

    ব্যকটেরিয়া

    বিষণ্ণতা এক গভীর ব্যকটেরিয়া। তার শত শত রূপ।
    যখন সে বাতাস, তখন সে গোলাকার,
    গাছের ভিতরে প্রবাহিত, লম্বা, গাছ সে তখন।
    উজ্জ্বল রৌদ্রের বিষণ্ণতা চারকোনা।
    প্রেম মরে গিয়ে মানুষের পিঠে কুজ
    উঠলে যে রকম হয়, সে রকম কখনো কখনো।
    রূপ তার যাই হোক, বিষণ্ণ ব্যকটেরিয়া,
    কোটি কোটি বংশধর নিয়ে
    আমাদের ভিতরে রয়েছে।
    মাঝে মাঝে তাকে দেখি স্পর্শ থেকে দূরে, মুখ নিচু,
    বসে আছে। যেন তাকে অবহেলা করেছে মানুষ।
    দুই চোখে বাতাসের কুহেলিকা, কিম্বা রৌদ্রের—
    ঘন জীবনের নদীতীর থেকে উঠে আসা ধোঁয়া।
    বিষণ্ণতার দুই চোখে বিষণ্ণতাঃ তার শত
    চোখের ভিতরে রাত্রি দিন, এবং অ-রাত্রি, অ-দিন।
    আরো পরে, মুখ উঁচু করে হেসে বলেঃ
    আমাকে জানো না তুমি, জানো না আমার শক্তি।
    তবু শোনো, তুমি আমি পার হয়ে যাবো
    ক্লান্ত জঙ্গলের ছোট শহরের চিন্তা।
    বর্ণিত নির্ভুল যত ভুল, এরপর,
    দেখবো ঘেটে ঘেটে—
    ভুল করা আমাদের মেধা—,
    ভুলের অসীম শক্তি আছে;
    কোন কোন ভুল শান্ত বোতলের দৈত্য। কোন ভুল
    সত্যের সমান, অন্তত, সেদিকে, কয়েক পা ফেলা।
    আরো পরে, আরো বহু পরে, কি জানি কি হয়।
    ভুল, শুদ্ধ – শুদ্ধ, ভুল— এসবের বাইরে বেরিয়ে
    বিষণ্ণতা অপ্রাকৃত ট্রাক্টরের মত,
    একা একা হাঁটে। খালি হাতে খুঁড়ে তোলে
    অন্ধকার, আলো, এবং আলো-অন্ধকার নয়,
    এরকম কিছু। বিষণ্ণতা, সেই আদি ও অকৃত্রিম
    বিষন্নতা, হয়ে যায়। বাতাসে নড়েনা ঘাস।
    রৌদ্র, রৌদ্র হয়ে আর ওঠে না সকালে।
    সারাদিন-সারারাত, জটিল ব্যকটেরিয়াগুলি,
    দাঁত দিয়ে খেতে থাকে মানুষের মন।

     

    সম্পূর্ণ অস্থায়ী হয়ে

    সম্পূর্ণ অস্থায়ী এক লাল ফুল, ভোর বেলা ফোঁটে—
    কাল হয়তোবা বৃষ্টি হবে; কিন্তু আজ শুধু খরা—
    দহন ও ক্লান্তির মধ্যে জন্ম নিয়ে
    ছায়ায় আবিষ্ট হয় তার ফুল-মন।
    বারান্দায় বসে আমি তার এই ফুটে ওঠা দেখি— ব্যাকুল তা—
    যে গ্রহে মৃত্যুহীন কোন কিছু নয়— সেই গ্রহে
    আমাদের দুজনের অবস্থান এক,
    আমরা তা দেখি।
    সেও দেখে, সম্পূর্ণ অস্থায়ী হয়ে কে যেন রয়েছে
    বসে বারান্দার কোনে, আজ ভোরবেলা।
    কাল হয়তোবা বৃষ্টি হবে তার মনে।
    আজ সেথা কেবলই দহন।
    কোথাও, কাছে বা দূরে, স্থায়ী কেউ নেই; কিছু নাই।
    মানুষ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছ কাটে।
    ভোরে সূর্য ওঠে, কিন্তু সন্ধ্যার অন্য দিকে চলে যায়।
    বোঝা যায়, পৃথিবীতে সবকিছু ভয়ঙ্করভাবে সাময়িক।
    জন্ম নিয়ে ক্ষণকাল বেড়ে ওঠে।
    কিন্তু পরে ঝরে যায়, এক কোনে, স্থায়ীভাবে।
    ভোর বেলা যুগ্মভাবে জন্ম নেয়া মানুষ ও ফুল,
    কিছুদিন আলাদা আলাদা ভাবে হাঁটে।
    অন্য এক ভোরে, কিম্বা অন্ধকারে,
    পরে, কিম্বা বহু পরে, তবু পরে, শেষ হয়ে যায়।
    যুগ্মভাবে ফোটে ওরা, কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে
    শেষ হয়। মাঝখানে কিছুদিন যে যার নিজের মত জ্বলে।

     

    পিপাসা

    বহু জলাশয়ে ডুব দিয়ে দেখেছি যে অবশেষে
    শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাই; পানির উপরে মাথা
    তুলে আনতে হয়। এভাবে বুঝেছি,
    নিঃশাস প্রশাস, জলে ডুবে থাকবার চেয়ে
    বেশি প্রয়োজন, বহু বেশি মৌলিক।
    পানিতে ডুব দেয়া যায়, কিন্তু চিরস্থায়ী
    ডুব শুধু হৃদয়ের ভিতরে সম্ভব।
    অবগাহনের পানি স্বচ্ছ আর নীল হওয়া ভাল।
    কিন্তু তা এক চেষ্টায় কখনো হয় না।
    বহুবার বহুবার ডুব দিতে দিতে,
    অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ একদিন
    স্নানের সকল পানি স্বচ্ছ আর নীল হয়ে যায়।
    তবু দেখি, অনেক জলের গ্লাস তৃষ্ণা না মিটিয়ে,
    নতুন তৃষ্ণার জন্ম দেয়। গ্লাস হাতে নিয়ে,
    এই তৃষ্ণা মেটে, আর এই,
    দুএক মুহূর্ত পরেই, নতুন তৃষ্ণার জন্ম হয়।
    লক্ষ করি তৃষ্ণা ট্রেনের মত, রিলে রেসের মতন;
    এক তৃষ্ণার হাত ধরে শত শত তৃষ্ণা কাছে আসে।
    ক্রমে কম্পমান তুমি স্থায়ী হও আমার ভিতরে।
    মন নয়, শরীরই মৌলিক। মন, ব্যকুলতা শুধু।
    আমার সকল বোধ তোমার শরীর ভেবে জাগে।
    তোমার সহিত এ বিষয়ে আলোচনা
    কনোদিনই হয়নি আমার— তবে, এই নিয়ে,
    পিপাসার সাথে আমি আলোচনা অনেক করেছি।
    তোমাকে দেখেছি স্নানে অদ্ভুত পুকুরে—
    তারপর থেকে আর পিপাসা মেটেনি,
    অন্য জলাশয়ে— অন্য স্নানে— অন্য দৃশ্যে।
    সকল সমুদ্রে, দেহে, মহাকাশে, স্নান ঝোঁক আছে।
    স্নান না করলে তলোয়ারেও মরীচিকা ধরে।
    পাখি আর মানুষেরা একজলে স্নান করে,
    কিন্তু, স্নান শেষ করে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে যায়,
    হেঁটে হেঁটে, উড়ে উড়ে, ক্রমে।
    আমার দুহাতে বহু ধুলো আর শূন্যের স্তন।
    খেয়ালে বিহ্বল সন্ধ্যা কালো বেদনার।
    জেগে আছে সব গ্রহ অসীম তৃষ্ণায়
    এবং তৃষ্ণার সীমাহীন পুনরাবৃত্তিতে।
    তোমাকে দেখেছি আমি স্নান রত, রাত্রিবেলা, একা।
    তাই জানি, স্নানের প্রথম শর্ত নগ্ন হতে পারা।
    তা না হলে, রক্তের ভিতরে
    সন্ধ্যা যদিওবা আসে, জলাশয় কখনো আসেনা।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.