
ম্যাকেনজি কিং তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ আলোকচিত্রী ইউসুফের কাজের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট। ফলে যারা তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তাদের ছবি তুলতে তিনি ইউসুফকে সুযোগ করে দিতেন। ১৯৩৫ সালে ইউসুফ কানাডার সরকারি আলোকচিত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। বড় বড় মানুষের ছবি তোলা ইউসুফের নেশায় পরিণত হয়ে গেল।
বলছি বিশ্বখ্যাত পোরট্রেট আলোকচিত্রী ইউসুফ কার্শের কথা। তুরস্কের একটি খ্রিস্টান পরিবারে তার জন্ম। যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে ছোটবেলায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, প্রথমে সিরিয়ায়, তারপর কানাডায়। মামা ছিলেন আলোকচিত্রী—তার স্টুডিওতেই ভাগ্নের হাতেখড়ি।
একের পর এক বিখ্যাত ব্যক্তির পোরট্রেট করে যাচ্ছেন। কিন্তু তার জীবনের প্রথম বড় সুযোগটি আসে ১৯৪১ সালের ৩০ ডিসেম্বরে। কানাডা সফরে আসেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। চার্চিলের ছবি তোলার সুযোগ পান তিনি। চার্চিলের ছবি ইউসুফ কার্শকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এটি ইতিহাসের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত ফটোগ্রাফিক পোরট্রেট হিসেবে স্বীকৃত। আলোকচিত্রী নিজেই লিখেছেন, ‘আমার তোলা উইনস্টন চার্চিলের ছবিটি আমার জীবন বদলে দিয়েছে।’ তিনি আরো বলেছেন, এই ছবি এতো ব্যাপকভাবে সমাদৃত হবে তিনি তা কল্পনাও করেননি।

ছবিটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। চার্চিলের একটি সাদাকালো ছবি। একটি চেয়ারে ডান হাত রেখে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। বাঁ হাতটি কোমরে। তার মুখের অভিব্যক্তি অবিস্মরণীয়। অভিব্যক্তিতে ধরা পড়েছে চার্চিলের ব্যক্তিত্ব। অভিব্যক্তি একই সঙ্গে গম্ভীর ও সৌম্য। মনে হতে পারে চার্চিল কিছুটা যেন বিরক্ত, আবার মনে হবে সন্তুষ্ট। এই দ্বন্দ্বই সম্ভবত ছবিটিকে করেছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোরট্রেটের একটি।
কিছুটা যেন বিরক্ত, আবার মনে হবে সন্তুষ্ট। এই দ্বন্দ্বই সম্ভবত ছবিটিকে করেছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোরট্রেটের একটি
সেদিন চার্চিল একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতা শেষে তিনি স্পিকার চেম্বারে ফিরে এলেন। যেখানে ইউসুফ আগে থেকেই ছবি তোলার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ছবি তোলার জন্য রাখা বাতিগুলো জ্বলে উঠতেই চার্চিল গম্ভীরভাবে জানতে চাইলেন, এসব কি! ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। ইউসুফ এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘স্যার, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আপনার একটি পোরট্রেট তুলতে পারলে আমি নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবান মনে করব।’ কিন্তু চার্চিল তবুও কাবু হলেন না। তিনি তার সহকারীর কাছে জানতে চাইলেন, তাকে আগে এবিষয়ে কেন জানানো হল না। সহকারী শুধু হাসলেন। তারপর চার্চিল একটি সিগার ধরালেন এবং ইউসুফ কার্শের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘একটি ছবি তুলতে পার।’ ইউসুফ একটি অ্যাশট্রে এগিয়ে দিলেন, কিন্তু সিগার নেভানো বা রাখার কোনো নাম নেই। ইউসুফ সিগারের ধোঁয়া বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা রইলেন। কিন্তু সেদিকে চার্চিলের কোনো নজর নেই—তিনি সিগার টেনেই যাচ্ছেন। তারপর ইউসুফ যা করলেন—তা বিস্ময়কর। তিনি এগিয়ে গিয়ে ‘স্যার, মাফ করবেন’ বলে চার্চিলের ঠোঁট থেকে সিগারটা সরিয়ে নিলেন। চার্চিল অবাক ও বিরক্ত। কিছু বলার আগেই ইউসুফ কার্শ ঝটপট ছবি তুলে ফেললেন। এভাবেই জন্ম নিল ‘দ্য রোরিং লায়ন’ শিরোনামের উইনস্টন চার্চিলের বিশ্বসেরা পোরট্রেট। পরে ইউসুফ কার্শকে চার্চিল মজা করে বলেছিলেন , ‘ছবি তোলার জন্য তুমি একটি উত্তেজিত সিংহকেও বশ করতে পারবে।’