Author Picture

সাযযাদ আনসারীর একগুচ্ছ কবিতা

সাযযাদ আনসারী

হৃদয়ের অক্ষর
.
হৃদয়ের একটি অক্ষরও অক্ষত রইলো না আর।
বহু দুঃখের তিমিরান্ধ সময়ের
সংঘাতে ক্ষত বিক্ষত স্বদেশ-স্বরূপ।

এ কোন কলঙ্কিত কাল বোশেখী!
মানুষের ভেতর থেকে মানুষের ভাষা, নদীর ভেতর
থেকে নিঃশব্দ নদী, প্রকৃতির প্রাণ থেকে
গানের ভুবন, এমন কি সুন্দরের সকল সম্ভাবনা
এবং অন্তঃসত্ত্বা মৃত্তিকার একান্ত আপন সুর ও
সুধা-সঞ্চয়, সব… সব কেড়ে নেয়।

আমরা এই দারুণ দূর্দিনে মানুষের
আকাশ আঁকবো কোন বিশ্বাসের বর্ণমালায়!
চিরদিন চিনেছি যে রোদ্রের রঙ,
শৈশবে শুনেছি যে বিহঙ্গের ব্যাকুল বাঁশি,
আমাদের আরাধ্য আগামী অভিজ্ঞতা ও অনুভব,
কোন ধ্বণির ধারণায় লিখে যাবো!

আমাদের নির্জীব নদী, আমাদের বিপন্ন বন ও
বৃষ্টির বিলাপ, নীড় হারা পাখি ও প্রাণের প্রথা,
দূরাগত বিকৃত বিশ্বাসে বিপন্ন।

আমাদের চিরচেনা পথে রাঙা রূপোসীর
রাখালি প্রণয়, প্রসন্ন প্রভাতে পাখির
আনন্দ অভিবাদন…
কোন উপমায় সাজাবো তবে আজ!

এই অন্ধ অন্ধকারের প্রবাহিত অন্ধত্বে,
কি করে আলো দিয়ে আলো জ্বালাবো আজ,
যদি হৃদয়ের সকল অক্ষর অক্ষত না থাকে আর?

 

বর্ষায় শরৎ পুষ্পম
.
রক্তে রঞ্জিত রৌদ্র আর মানুষের সত্য স্বপ্ন গুলি,
পালিয়েছে আজ ক্ষুধার খড়গ খচিত বুকে…
দূর পৃথিবীর অচেনা অবাধ্য অন্ধকারে।

জীবনের সব মায়াবতী ঢেউ তবু, এপার ওপার
আছড়ে পড়ে, মৃত্যুর করুণ শব্দ শুনে শুনে,
ঘনিয়ে আসে ঘোর রাত্রির রিক্ত আকাশ।

এই কলঙ্কিত কর্পোরেটের কৃষ্ণকালে,
পৃথিবীর পুষ্পিত পিপাসা, প্রাণ-পুষ্টি,
আকাঙ্খার আকাশ, পুড়ে যায় বিবিধ মর্ত্য
অমর্ত্যের মতবাদে, পুড়ে যায় বিভৎস বিশ্বায়নে।

বসন্তের হয়েছে মৌন মৃত্যু, ভুল ঝড়ে ঝঞ্ঝায়,
শরৎ সরে গেছে স্বপ্নের সমস্ত বিক্ষত হাত ছেড়ে…
কোনো এক শকুন-সন্ধ্যার সন্তপ্ত অন্ধকারে।
তবুও এমন অসময়ে বিষাদে বিদগ্ধ শিউলী,
ফুটেছে এখন এই বিমর্ষ বর্ষার নিষ্ঠুর নির্জনতায়
আর একবার জীবনের ভোর ভরিয়ে দেবে বলে।
আর একবার শুভ্র সঙ্গীতের অন্তরাটা গাইবে বলে।
আজ তাই ভাসিয়ে দিলাম, ওপারের পুষ্পিত প্রাণে।
যে আমার সুন্দরের পথে পান্থ সখা হলে!
জগতের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি ফুটে যেত
যা আজও পৃথিবীতে ফোটেনি।

তার জন্যেই, শুধু তার জন্যেই…
ভাসিয়ে দিলাম এই অকাল আকাল বেলা
সেই শরৎ পুষ্পম বর্ষা বেদনার দিনে একা একা।

 

এখনো পড়নি নিজেকে
.
তুমি কিন্তু এখনো একবারও পড়নি নিজেকে
পড়নি তোমার উন্মোথিত জ্যোৎস্নার ভাষা।

শুধু পড়িয়েছ, তোমার অন্তর্গত আলো-ছায়া,
পড়িয়েছো, তোমার মৃণ্ময় মনের মুদ্রাবলি,
সকল বৈভবের অর্থহীন অহংকার, বিকলাঙ্গ
বাসনার বিলাপ আর অন্তহীন অজানা পিপাসা।

আলোর গর্ভ হতে উৎসারিত অন্ধকার,
অন্ধকারের ভেতর থেকে প্রজ্জ্বলিত আলো,
জীবনের জঠর থেকে মৃত্যু, মৃত্যুর ভেতর থেকে
জীবনের জন্ম, এখনো দেখনি তুমি।

অথচ তোমার মধ্যেই তোমার অরূপের রূপ
তোমার মধ্যেই তোমার সত্যের আসা-যাওয়া।
তোমার মধ্যে, শুধু তোমার মধ্যেই অদৃশ্যের
সাদৃশ্যায়ন। এই সব কিছুই পড়নি তুৃমি।

এরই মধ্যে বেলা গেলো সন্ধ্যা হলো…
এরই মধ্যে হলুদ হয়ে এলো সবুজ পাতারা,
এরই মধ্যে বসন্ত পেরিয়ে শীতের কাঁপন
নামলো, জীবনের শুষ্ক মলিন মাঠে মাঠে।

তবু তুমি পড়নি তোমার আপন বাতিঘর,
পড়নি তোমার সকল খেলার দিনগুলি।
আসলে তুমি, নিত্যই নিজের ভেতর থেকে
নিজেকে নিচ্ছ কেড়ে। একবার অন্তত

একবার দাঁড়াও ঘুরে, তোমার অতল শুভ্র
সত্যে-সুন্দরের ঠিকানায়। যেখানে তোমার
অনন্ত কুসুম, যেখানে ভালোবাসায় বাজে
অনন্তের বাঁশি, যেখানে কালের যাত্রা মুছে,
সময় সন্ধ্যা হয় না কখনো কোনো দিন।

 

প্রাণ পেতে আছি
.
পাহাড়ি ঢলের মত সে এসে নামে হৃদয় সমুদ্রে আমার।
তার কাছে চেয়েছিলাম প্রেমিক পুরুষ হতে,
তার কাছে চেয়েছিলাম, আমার সবুজ ঘাসের দেশ,
আমার চিরচেনা ব্রহ্ম পুত্র নদ ও ঝিনায়ের গান।
গাছের সিম্ফোনি আর নারীর হৃদয়।

গ্রাম ও নগরের গভীর সাম্য-সামঞ্জস্য-শান্তি ও সম্পৃতি,
জল ও জলজের নিভৃত নিবিড়তা, বিহঙ্গের বর্ণীল বন্ধন,
বৃক্ষের বন্দনায় অক্সিজেনের নিশ্চয়তা, আমার বাসনা-বাঁশির
বেজে ওঠা এবং সকল সঙ্গীত তার কাছে চেয়ে ছিলাম।

আজ এই গরল সভ্যতায় উন্মত্ত উন্নয়নে অবরুদ্ধ
আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এখনও প্রাণ পেতে আছি…
এই বিভৎস বিষাদ বিপন্ন বেলায় জাগো তুমি জাগো।

 

বোকা কালিদাস
.
একদিন বিলুপ্ত হবে সব নদী।
বিলুপ্ত নদীর গাঁয়ে ঘর করে
নদী নদী খেলবো… তুমি আর আমি।

বৃক্ষও থাকবেনা একদিন
চোখ জুড়ে সমস্ত সবুজ শান্তি মুছে যাবে।
বিশ্বাস ভঙ্গে বিদ্রূপবিব্রত বিহঙ্গেরা
চলে যাবে আকণ্ঠ অভিমানে।

ভুলেও একটি ঘুঘু ডাকবেনা কোনোদিন,
ঘাসের গভীরে, উকুনের মত মরে যাবে
রৌদ্রদগ্ধ পতঙ্গ-পোঁকারাও।

আত্মঘাতি উদ্ভ্রান্ত উন্নয়নে
শিশুরা জ্বালাবে যন্ত্রের যন্ত্রণা, পাড়ায় পাড়ায়।
…জীবনের জলহীন জলের জগত
ভরে উঠবে চঞ্চল চোখের জলন্ত জলে।

একদিন সব গ্রাম হত্যা করা হবে।
নিহত গ্রামের গন্ধে ভরে উঠবে
নিষ্ঠুর নগরবিলাস।
একদিন এই ভোর, ভোরের আকাশ,
নির্জন ঝিনাই এর বুকে নিমগ্নতরী,
সন্ধ্যার স্বাতী তারা… বিলুপ্ত হবে।

সেদিন লেপটপে বসে…
তুমি আর আমি… নদী নদী খেলবো।

আসলে আমরা মৃত্যু মৃত্যু খেলবো
আসলে আমরা বোকা কালিদাস হব।

 

পাহাড়
.
পাহাড় পাহাড় পাহাড়
তুই কোন মাতালের ঝি
মাতাল ছেড়ে আয় না দেখি
নুপুর পায়ে দি

নুপুর পায়ে চলল ছুটে
ঝরনা বালিকা
মনের পাতায় পড়ে দেখি
তাহার তালিকা।

পাহাড় পাহাড় পাহাড়
নদীর যদি মা হয়েছিস
আমার গাঁয়ে আয়
ঘাসের হৃদয় বিছিয়ে দিব
প্রেম জলজের পায়।

আরো পড়তে পারেন

বেওয়ারিশ প্রেমের কবিতা

১. জীবনকে বিজ্ঞাপনের মতো সেঁটে দিয়ে দেখেছি, আমাকে গ্রহণ করেনা কেউ। আমাকে ভালোবাসে না ঘুমগন্ধওয়ালা সকাল— আমাকে ভালোবাসে না বাজারের জনবহুল রোদ, আমাকে ভালোবাসে না কেউ, ভিক্ষুক, শ্রমিক, চাষী আমাকে ভালোবাসে না, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভালোবাসে না, শোষক কিংবা শোষিত, শাসক ও প্রজা কেউই ভালোবাসে না, আমাকে ভালোবাসে না তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ বা যুবা, পার্থিব কোনো….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সহজাত মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে যে কোন দিন যে কোন সন্ধ্যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ঘোরতর বর্ষার দূপুরে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে। পথের পাশে ওত পেতে থাকা শিকারির মত সন্তর্পনে উঠে আসা মানুষ পায়ে পা ঘষে তোমাকে অবহেলা করবে। কোথাও না কোথাও কোন এক বয়সে কোনও না কোনও ভাবে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে।….

হোসনে আরা শাপলা’র একগুচ্ছ কবিতা

আলতু ব্যথা কোন এক শুভ্র সময় আমাদেরও ছিল পাশাপাশি-মুখোমুখি বসে থাকা শুধু হিসেব-নিকেশ, দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া এসবের বালাই ছিলো না কোন শুধু কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো ভালোবাসা। চোখের তারায় ডুবে গিয়ে অন্বেষণ শুধু শত জনমের সুখ। ওইসব স্বপ্নমাখা দিন কোন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল কোথায় তারই জন্য মনের মধ্যে কেমন আলতু ব্যথা।   তৃপ্তি ভরসার হাত….

error: Content is protected !!