
মাসুদুজ্জামান : (কবি, সাহিত্য সমালোচক, গবেষক
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমী ভাবুকম-লীতে যে চিন্তাসূত্রটি নিয়ে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি হচ্ছে ডিকন্স্ট্রাক্শন (Deconstruction)। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বাংলায় অনুবাদ করে এর নামকরণ করেছেন ‘অবিনির্মাণ’ (স্পিভাক ১৯৯৭)। অনুবাদ বিষয়টিকে অবিনির্মাণ কীভাবে বিশ্লেষণ করে, ‘অনুবাদের সঙ্গে তার কীসের কুটুম্বিতা’, এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো সম্পর্কে দেরিদা তার বিভিন্ন প্রবন্ধে কী বলেছেন, ‘অবিনির্মাণÑঅনুবাদ’ শীর্ষক ওই প্রবন্ধটিতে গায়ত্রী এসব বিষয়েই তার মত ও বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। ডিকন্স্ট্রাকশ্নের বঙ্গানুবাদ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘অবিনির্মাণ কথাটা রাখাই ঠিক করলাম। গোড়ায় ‘বিনির্মাণ’ মনে লেগেছিল। ডিকন্স্ট্রাক্শন যে ‘বিশেষরূপে নির্মাণ’ এটা অনেকে ধরতে পারেন না।’ গায়ত্রীর ব্যাখ্যা অনুসারে এই বিশেষরূপে নির্মাণ আবার ‘অনির্মাণ’ও বটে (গায়ত্রী ১৯৯৭)। কিন্তু গায়ত্রী এই অবিনির্মাণ প্রসঙ্গে যে বিশেষভাবে নির্মাণ ও অনির্মাণের কথা বললেন, তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো আমরা? এখান থেকেই প্রবেশ করা যেতে পারে অবিনির্মাণ তত্ত্বের গভীরে, উন্মোচন করা যায় এর স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য।
কাজটি সহজ নয়, কেননা ভাবনাসূত্র হিসেবে অবিনির্মাণ নিজেই নিজের বড়ো বাধা। এই পরিভাষাটির (terminology) মধ্যে নির্মাণ-অনির্মাণের সুবাদে এমন এক ধরনের বিরোধাভাস অভিব্যক্ত হয়েছে, যার জট খোলা খুবই কঠিন, পশ্চিমের সমালোচকেরাও এটা করতে হিমশিম খেয়েছেন। আরেকটি সমস্যা যে-কোনো বাঙালি পাঠকমাত্রেই অনুভব করবেন, অসংখ্য পরিভাষার ব্যবহার এবং ব্যবহৃত পরিভাষার যথাযথ অর্থ জানা না থাকলে অবিনির্মাণের তাত্ত্বিক তাৎপর্যও উদ্ভাসিত হবে না। এই পরিভাষাগুলো আবার গৃহীত হয়েছে দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন উৎস থেকে। কিছু কিছু পরিভাষা আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে অবিনির্মাণ, তত্ত্ব হিসেবে বুঝতে গেলে পাঠক সহজে স্বস্তিবোধ করবেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বাংলাদেশের পাঠকের ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে বৈশ্বিক ভাবনাভাণ্ডারের সঙ্গে অপরিচয় বা স্বল্পপরিচয়ের কারণে। কিন্তু সাহিত্য-সমালোচনায়, বিশেষভাবে বললে কবিতা, ছোটগল্প কিংবা উপন্যাসের আলোচনা করতে গিয়ে কোনো সমালোচক যদি অবিনির্মাণের আশ্রয় নেন, তাহলে এটি কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে?
অবিনির্মাণ, প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, কোনো সাহিত্যতত্ত্ব নয়, যে-অর্থে আমরা আরস্তলের পোয়েটিক্স বা কাব্যতত্ত্বের কথা উল্লেখ করি, কিংবা ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রের। এটি মূলত একটি
ভাবনাসূত্র যাতে ভাষারখেলা বা অর্থোদ্ধার Ñযে অর্থের আছে বহুকৌণিক বিস্তার, বিভাবÑঅবিনির্মাণের সেই চিত্তাকর্ষক পর্যালোচনার টানেই আমরা প্রাণিত হতে পারি। সাহিত্য-সমালোচনায় এখানেই এর প্রাসঙ্গিকতা। অবিনির্মাণ কোনো পদ্ধতি নয়, নয় দর্শনও, কোনো স্কুল বা ঘরানারও প্রবর্তন করেনি। এর প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান ব্যাখ্যাতা জাক দেরিদা বলেছেন, অবিনির্মাণ হচ্ছে একধরনের ‘কৌশল, পাঠ-ব্যাখ্যা-লেখার কিছু সূত্র’। তত্ত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এটি তত্ত্ব নাকি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিশেষ রীতিপদ্ধতি, তা নিয়ে পশ্চিমী ভাবুকম-লীর মধ্যে প্রবল বিতর্ক আছে।
পটভূমি ও ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত
অবিনির্মাণের পরিচিতি উত্তর-কাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্ব হিসেবে। অনেকেই একে উত্তর-কাঠামোবাদের সমার্থক বলে মনে করেন। কাঠামোবাদকে চূর্ণ করে দিয়ে উত্তর-কাঠামোবাদ সাহিত্য-সমালোচনায় যে বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছিল, সেটি বুঝতে হলে পূর্বসূরীদের ভাবনার প্রতিÑকাঠামোবাদ এবং কাঠামোবাদের যারা বিরোধিতা করেছিলেন Ñ উভয়ের প্রতি কিছুটা হলেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
প্লেতো-পরবর্তী পশ্চিমী সভ্যতা যেভাবে জীবন ও জগৎকে অনুধাবনের চেষ্টা করেছে, সেই ভাবনার প্রতি অবিনির্মাণ ছুঁড়ে দিয়েছে প্রচ- চ্যালেঞ্জ। আঠারশতকের ফরাসি দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) সত্য ও অর্থ সম্পর্কে যে যুক্তিবাদী আরোহী মৌলধারণার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, তিনি তাকে একেবারে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেন। ‘আমি চিন্তা করি, সেটাই আমার অস্তিত্ব।’ দেকার্তে বা কার্তেসীয় এই সংবেদনা ছিল যুক্তির উপর নির্ভরশীল। সত্যসন্ধান করতে গিয়ে তিনি মানবীয় তীব্র আবেগ ও কল্পনাকে সরিয়ে দিয়ে যুক্তির যে ঊর্ধ্বায়ন ঘটান, তার ঢেউ আঠার শতক ছাড়িয়ে বিশশতকের ভাবুকদের চিন্তাজগতে আছড়ে পড়েছে। এরই সূত্র ধরে বিশ শতকের মানবতাবাদী, শিল্পী ও দার্শনিকদের চিন্তা আকার পেয়েছে; আরও উন্নত এক পৃথিবীর কথা তারা ভাবতে পেরেছেন। তারা মনে করেছেন, যুক্তিই হচ্ছে প্রগতি। মানুষ যদি এই যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে সবকিছু করে তাহলে মানবসমাজ সমস্ত সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে এই বিশ্বদৃষ্টি সম্বন্ধে সন্দেহ দেখা দেয়। পদার্থবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়কে ঘিরে বাস্তবতার পুনঃদর্শন বা পুনর্মূল্যায়নের সূত্রপাত ঘটে। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বস্তুগত অভিজ্ঞতাই হচ্ছে সবকিছু, এই ভাবনাকে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এদেরই একজন দার্শনিক-ভাবুক শিরোমণি ফ্রেডেরিক নীৎসে (১৮৪৪-১৯০০) বস্তুগত সত্যের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ঘোষণা করেছিলেন ঈশ্বরের মৃত্যু। তিনি মনে করেছিলেন সনাতন চিন্তার প্রভাব আজ অপসৃত, প্রকৃত বাস্তবতা স্থির, ঐকবদ্ধ কিংবা চূড়ান্ত নয়; আপেক্ষিকতাবাদী, গতিশীল, মুক্ত ভাবনাই সনাতন ভাবনাকে প্রতিস্থাপিত করবে। আলবেয়ার আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) ১৯০৫ সালে একটি প্রবন্ধ (The Electrodynamics of Moving Bodies) প্রকাশের মধ্য দিয়ে সময়, স্থান ও বাস্তবতা সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের সনাতন ধারণা আমূল বদলে দিলেন। গতির সঙ্গে সমীকৃত সময়ের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলো অনন্ত সময়ের ধারণা। চিন্তার এই মৌলিক রূপান্তরের প্রেক্ষপটে বিশ শতকের মানুষ মানবীয় আচরণ, ধ্রুববিশ্বাস ও নৈতিকতা সম্বন্ধে এরকম প্রশ্ন তুলেছিল, ‘সব কিছুই কী আপেক্ষিক?’
ভাষা নিয়ে আরেক ধরনের অচলায়নের সৃষ্টি হয়েছিল যা অব্যাহত ছিল প্রায় দুশো বছর। ভাষাকে এই দীর্ঘ সময়ে ভাবা হয়েছে স্বচ্ছ এমন এক মাধ্যম হিসেবে যার মধ্যে বাস্তবতাকে যথাযথভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে আর তা লাভ করবে চমৎকার নান্দনিক রূপ। শব্দই ব্রহ্ম, শব্দই সমস্ত অর্থ ধারণ করে এবং বস্তু সম্পর্কিত ধারণা শব্দের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়। ভাষা সব অর্থই ধারণ করে, কোনো কিছুর অর্থ পেতে তাই সমস্যা হয় না। ভাষা সংক্রান্ত এই ভাবনার পাশাপাশি সাহিত্যকে ভাবা হয়েছিল জীবন ও মানবীয় অবস্থার অনুকৃতি, প্রতিরূপ আর প্রতিনিধিত্বশীলতার নান্দনিক প্রকাশ হিসেবে। জীবনার্থের রূপক হয়ে উঠেছিল সাহিত্য, যার মধ্যে জীবনের প্রবল উপস্থিতি ঘটে; তারা ভেবেছিলেন এই জীবনের গ্রন্থিমোচন করে অনুধাবন করা যাবে জীবনের সমগ্র স্বরূপ। এরকম একটা পটভূমিতে স্বাভাবিকভাবেই সমালোচকের কাজ ছিল নির্বাচিত সাহিত্যের পুরুষার্থ আর অর্থোদ্ধার।
রুশ প্রকরণবাদীদের কথাই ধরা যাক, তারা উনিশ শতকের অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্বদৃষ্টিকে (empericial worldview)ি বিশ শতকে টেনে এনে মনে করেছিলেন কবিতা হচ্ছে প্রকরণ ও গঠনশৈলীর দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প, যা তার নিজের নিয়মেই গ্রন্থিত Ñ দুর্বোধ্যতা, শ্লেষ, বিরোধাভাসের
সমাহার। তারা কবিতা কী অর্থ দেয় সে বিষয়ে উৎসাহী হওয়ার পরিবর্তে কীভাবে এটি অর্থবোধক হয়ে ওঠে, নজর দিয়েছিলেন সেইদিকে। প্রকরণবাদীদের এই অতি নিরুপিত সমালোচনার পথটিকে অনেকেই আবার একধরনের বদ্ধ, শীতল রীতি বলে উল্লেখ করেছেন; কিন্তু তারা কখনও চূড়ান্ত অর্থের উপস্থিতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেননি। এরপর অবভাসিক সমালোচকেরা (phenomenological critic) এসে হটিয়ে দিলেন প্রকরণবাদীদের। তারা বললেন কবিতার মানে কখনও কবিতার শরীরী সংস্থান বা প্রকরণের ওপর নির্ভর করে না; এটি নির্ভর করে মানবীয় সচেতনতা বা সজ্ঞানতার উপর। তারা জানালেন, একটি রচনার কেবল একটি নির্দিষ্ট পাঠ নয় হতে পারে অসংখ্য পাঠ, কেননা কোনো লেখাই, যিনি লেখাটি পড়েন, তার মনের বাইরে অধিষ্ঠিত নয়। কোনো লেখার তাই সুনির্দিষ্ট কোনো অর্থ করা যায় না, পাঠকের কাছে তা কী কী অর্থে প্রতিভাত হচ্ছে, সেটাই মূল কথা। ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের যেহেতু অভিজ্ঞতা থাকে ভিন্ন, ফলে কবিতার অর্থও নানারকম হয়ে যায়। লক্ষণীয়, পাঠক এক্ষেত্রে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। লেখার মধ্যে যে অভাবটুকু থাকে, পাঠক তা পূরণ করে নিয়ে ওই লেখাকে সম্পূর্ণ করে তোলেন; লেখকের লক্ষ্য থাকতে হবে পাঠককে এ দিকেই টেনে আনা। অন্যভাবে বললে সাহিত্যের ‘সত্য’ তাই ধ্রুব নয়, চূড়ান্ত নয়, একরূপ নয়; এটি আপেক্ষিক, পরিবর্তনশীল আর মুক্ত। বিশ শতকের সাহিত্যের এটাই হচ্ছে মূল বৈশিষ্ট্য।
বিশ শতকের শুরুতে আরও এক ধরনের ভাবনার সূত্রপাত ঘটে। মানুষ কীভাবে এই পৃথিবীকে উপলব্ধি করে, তাই নিয়ে দেখা দেয় তীব্র আগ্রহ। কাঠামোবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন ভাবুকেরা; এই কাঠামোর সূত্রে পদ্ধতির প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়। নান্দনিকতা বা অর্থ নয়, কাঠামো বা সাংগঠনিকতার (structure) উপর ভর করে তারা জগৎতে উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যও তাদের মতে সাধারণ কিছু কাঠামোর মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যেতে পারে বলে তারা মনে করেছেন। তবে কাঠামোর উপরিতল নয়, এর সাধারণ গভীর অন্তঃশীল যে প্যাটার্ন আছে, সেই প্যাটার্নটিই নির্ধারণ করে দেয় আমাদের মানবিক আচরণ, অভিজ্ঞতা ও সৃষ্টিশীলতাকে। কাঠামোবাদীদের মতে কাঠামোর উৎস হচ্ছে মানুষের মন, এই মন যেভাবে কাজ করে পৃথিবীও সেইভাবে মানুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠে। মানবীয় সমস্ত অভিজ্ঞতা একধরনের বিন্যাস বা কাঠামোর রূপ নিয়ে আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে। মন একেই শ্রেণীকরণ করে, পদ্ধতি হিসেবে ধারণ করে, অর্থাৎ এর একটা কাঠামো দাঁড় করায় আর এর মধ্য দিয়েই জগৎকে সে বুঝতে চায়। এভাবেই একটি বস্তুকে সে অন্য একটি বস্তু থেকে আলাদা করতে শেখে। কোনো কিছুর অর্থ তাই বাইরের কিছু নয়, এ হচ্ছে বস্তুগত বাস্তবতা (objective reality)।
কাঠামোবাদের ব্যবহার এই সময় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও নতুনত্ব আনে। ভাষাতাত্ত্বিকেরা ঐতিহাসিকভাবে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে শব্দের অর্থ ও ধ্বনিরূপ পালটে যায়, তার তুলনা করেছেন। কী কারণে এই পরিবর্তন সাধিত হয়, বোঝার চেষ্টা করেছেন সেটাও। তারা লক্ষ করেছেন ভাষা হচ্ছে অনুকৃতি, নিজস্ব নিয়মের দ্বারা গঠিত পদ্ধতি নয়। শব্দ, তাদের মতে প্রতীক, যা বস্তু বা ধারণাকে প্রতিফলিত করে। তবে ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন ফরাসি ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্য সোসুর। ভাষার সমকালীন রূপের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এটা মেনে নিতে পারেননি যে ভাষা হচ্ছে অনুকৃতি কিংবা স্বচ্ছ কিছু। পক্ষান্তরে তিনি বলেছেন ভাষা হচ্ছে এক ধরনের পদ্ধতি। এটি যেমন নিজস্ব নিয়মের অধীন, তেমনি চিহ্নবিশেষ। ভাষার লিখিত বা ধ্বনিরূপকে তিনি দ্যোতক বা চিহ্ন (signifier) এবং অর্থকে দ্যোতনা বা চিহ্নায়ক (signified) বলে উল্লেখ করেছেন। দ্যোতক, সোসুরের মতে, বস্তুকে নির্দেশ করে না, নির্দেশ করে মনের কোনো ধারণাকে। ফলে পৃথিবী নয়, ভাষাই বাস্তবকে মূর্ত করে তোলে। ভাষাই আমাদের অভিজ্ঞতাকে আকার দেয়, কাঠামোবদ্ধ করে। ভাষা একই সঙ্গে আপেক্ষিক (arbitrary) আর পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বস্তুজগত কিংবা ভাবজগতকে আমাদের বোধের সীমায় নিয়ে আসে।
ভাষাগত এই পৃথকতার বোধই পরবর্তী কালে অবিনির্মাণ তত্ত্ব সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি নির্দেশ করেছে সেই বৈপরীত্যকে, কাঠামোবাদীরা যাকে উল্লেখ করেছেন বিপরীত যুগ্মতা (binary opposition) বলে। এই বিপরীত যুগ্মতা হাজির করে পরস্পরবিরোধী নানা শব্দগুচ্ছ, যেমন নারী/পুরুষ, ডান/বাম, দিন/রাত্রি ইত্যাদি। পরম্পরিত এই শব্দগুলোর একটি আবার অন্যটির অর্থ স্পষ্ট এবং গভীর করে তোলে। কালোকে আমরা ভালো বুঝতে পারি যেহেতু শাদার বোধ আমাদের কাছে স্পষ্ট, সেইভাবে নৈঃশব্দ্যের কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে শব্দেরই অনুষঙ্গে। সোসুরের এই বিপরীত যুগ্মতার প্রভাব শুধু ভাষাতত্ত্বে নয়, অন্যান্য বিষয়েও সঞ্চারিত হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, যেখানেই সামাজিক ব্যবহার রয়েছে, সেখানেই আছে চিহ্নপদ্ধতি। সোসুরের ভাবনার মধ্য দিয়ে এভাবেই আরেকটি ভাবনারীতির উদ্ভব ঘটে যাকে চিহ্নবিজ্ঞান (Semiology) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। চিহ্নবিজ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে সংস্কৃতিতে পর্যবেক্ষণ করা যায় এমন চিহ্নপদ্ধতির মাধ্যমে কোনো কিছুর অর্থোদ্ধার। অবিনির্মাণ, যার উদ্ভব ঘটেছিল ৬০-এর দশকে, চিহ্নের ধারণাকে গ্রহণ করে এর তাত্ত্বিক পটভূমি নির্মাণ করে নিয়েছিল। পৃথকতা ও বিপরীত যুগ্মতাকে গ্রহণ করে হয়ে উঠেছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আধুনিক বৈপ্লবিক তত্ত্ব। ভাষার ভূমিকা যে মানবীয় বোধের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, উপলব্ধি করেছিল সেটাও।
কাঠামোবাদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল অবিনির্মাণের ভাবনাসূত্র। কাঠামোবাদী পদ্ধতি, বলা বাহুল্য, যদিও নতুনভাবে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে চেয়েছে, কিন্তু এই পদ্ধতিতে টেক্সটকে যে সূত্রগুলোর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হতো তা ছিল স্থির, অপরিবর্তনীয়। পাঠের তারা দিয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা। অন্যদিকে উত্তর-কাঠামোবাদ টেক্সটকে রূপান্তরশীল সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছে। উত্তর-কাঠামোবাদী ভাবুকেরা মনে করেছেন, একটি লেখাকে অন্যান্য রচনার অনুসঙ্গে বা মিথস্ক্রিয়ার সূত্রে একবার নয়, বার বার নানাভাবে পাঠ করা যেতে পারে। ফলে যে-কোনো লেখার অর্থের দিকটিও থাকবে উন্মুক্ত, বহুমুখি আর সতত চলমান। কাঠামোবাদ টেক্সটের অর্থ করেছে কিংবা টেক্সটকে ব্যাখ্যা করেছে টেক্সটেরই অন্তর্গত কিছু সংকেত (কোড) ও সূত্রের সাহায্যে। কিন্তু অবিনির্মাণ ঘোষণা করেছে অর্থ হবে অনিবার্যভাবে অনির্ধারিত, অনিশ্চিত। একটি রচনা বা টেক্সট কী অর্থ দেয়, কীভাবে অর্থ দেয়, অবিনির্মাণবাদীরা বলেছেন, কিছুতেই তা সুনির্দিষ্ট থাকবে না; কেননা এটা কিছুতেই সম্ভব নয় কোন ব্যাকরণিক বা ভাষাসূত্রের সাহায্যে একটি টেক্সট রচিত হয় সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করা। কোনো সৃজনশীল টেক্সট বা লেখার এটাই হচ্ছে বৈশিষ্ট্য; টেক্সট সবসময় অনন্য, নতুন। ফলে একটি একক রচনার অনেকগুলো অর্থ করতে পারেন যে-কোনো পাঠক, সব অর্থই হবে গ্রহণীয়, একটি অর্থের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা যাবে আরেকটি অর্থকে।
কাঠামোর প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে অবিনির্মাণ তাই দেখে কোথায় লেখাটি স্ববিরোধী হয়ে উঠছে, কোথায় পরস্পরবিরোধী অনুসঙ্গ উপস্থাপন করছে; কোথায় পাওয়া যাচ্ছে একটি শব্দ বা শব্দগুচ্ছের একাধিক অর্থ। অবিনির্মাণের মূল কথা হলো লেখার এই স্ববিরোধী অংশগুলোকেই অবিনির্মাণ করে নিতে হবে, অর্থাৎ নির্মাণ-অনির্মাণের মধ্য দিয়ে লেখাটির অর্থোদ্ধার করতে হবে। সাহিত্যিক রচনার, তাই বলা যেতে পারে, একক কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই যে-অর্থ বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারেন কোনো কর্তৃত্ববাদী সমালোচক বা লেখক। কর্তৃত্ববাদী বলছি এজন্যে যে ইংরেজিতে লেখককে ‘অথর’ (author) বলে উল্লেখ করা হয়, এই অথরের উৎস হচ্ছে ‘অথরিটি’ বা কর্তৃত্বপরায়ণতা। অবিনির্মাণে সমালোচকের এই কর্তৃত্ব একেবারে খর্ব হয়ে গেছে, সে হয়ে উঠেছে একজন পাঠকমাত্র, যদিও তার পাঠটি হবে অন্য অনেকের পাঠের চাইতে গভীর, অন্তর্ভেদী। টেক্সটের ভেতরে নানা ধরনের যে দ্যোতিত পদ্ধতি (signifying system) রয়েছে, সেইসব পদ্ধতির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই রচনার অর্থ করবেন সমালোচক, কখনও কখনও যা স্ববিরোধী অর্থও দিতে পারে।
সত্তরের দশকে সাহিত্য-সমালোচনায় অবিনির্মাণের ব্যাপক প্রভাব পড়ে, বিশেষ করে এর স্রষ্টা জাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪) কিংবদন্তীতুল্য দার্শনিক খ্যাতি পাওয়ায় ইউরো-মার্কিন সাহিত্য সমালোচক পরিম-লে এই বিশ্লেষণ পদ্ধতিটি বিপুলভাবে সমাদৃত ও চর্চিত হয়েছে। নীৎসে ও মার্টিন হাইদেগার (১৮৮৯-১৯৭৬) ছিলেন দেরিদার ভাবনা উৎস, এই দুই দার্শনিক কতকগুলো মৌলিক ধারণা, যেমন জ্ঞান, সত্য এবং ব্যক্তিসত্তার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। বিশ শতকের শেষার্ধে এই প্রসঙ্গগুলোর পর্যালোচনা সূত্রে ইউরো-মার্কিন ভাবুকমণ্ডলী জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে চেয়েছেন। দেরিদাও এ ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন তাও ছিল অনন্য, অভূতপূর্ব। দার্শনিক জিজ্ঞাসার পদ্ধতি ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবিনির্মাণ এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে একে ঘিরে গড়ে উঠেছিল একটা প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এই তত্ত্বটিকে তাই অনেকেই ‘ইয়েল সমালোচনা গোষ্ঠী’ নামে অভিহিত করে থাকেন। প্রখ্যাত বেশ কয়েকজন সাহিত্য-সমালোচক ও তাত্ত্বিক, যেমন জিওফ্রে হার্টমান (জ. ১৯২৯), হ্যারল্ড ব্লুম (জ. ১৯৩০), পল দে মান (১৯১৯-৮৩), জে. হিলিস মিলার (জ. ১৯২৮) অবিনির্মাণকে সাহিত্য-সমালোচনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
তবে বলা বাহুল্য, সবার কাছে এটি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারো কারো অভিযোগ, সাহিত্যের গুরুত্বকে খর্ব করে এতে দর্শনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা, অবিনির্মাণ টেক্সটকে শুধু শব্দক্রীড়া বলে মনে করে, শব্দের কারসাজি দিয়ে আমাদের মন ভোলাতে চায়। সাধারণ পাঠকেরা এই তত্ত্বটিকে দুর্বোধ্য তত্ত্ব বলে এড়িয়ে চলে।১ অবিনির্মাণের যারা সমর্থক তারা অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এটি টেক্সটকে আগের তুলনায় অনেক বেশি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে। ভাষা ও বয়ানের যে বহুমাত্রিকতা আছে, আছে বহুকৌণিক বুনট, অবিনির্মাণ তা খুলে খুলে দেখে আর বহুদূর অব্দি চলে গিয়ে ফিরে ফিরে আসে। অনিঃশেষভাবে উন্মোচন করে দেখায় নানান অর্থ, যার কোনোটিই চূড়ান্ত বা স্থির নয়। অবিনির্মাণে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
অবিনির্মাণের চর্চা
তত্ত্বটির সূত্রপাত এই ধারণা থেকে যে ভাষা অন্তর্গতভাবে জটিল, হেঁয়ালিপূর্ণ, স্বচ্ছ নয়; ভাষার মধ্য দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন তাই দুরূহতম দক্ষতার ব্যাপার। অবিনির্মাণ মনে করে, মানবীয় উচ্চারণের থাকে অর্থের নানা সম্ভাবনা। সহজ কোনো বিবরণকে হয়তো
নানাভাবে নানা দিক থেকে দেখা যেতে পারে। যখনি এর একটা অর্থ করে অন্য অর্থের দিকে যাওয়া যায়, তখনি তা স্ববিরোধী হয়ে ওঠে। কীভাবে এটা ঘটে?
অবিনির্মাণে সোসুরীয় চিহ্ন হচ্ছে দ্যোতক ও দ্যোতিতের সমন্বয়ে সৃষ্ট মানসিক প্রতীতী বা ধারণা যা স্থিতিশীল নয়, নিরন্তর রূপান্তরশীল এক সত্তা। ভাষা একটি পদ্ধতি যা পৃথকতার উপর নির্ভরশীল, দেরিদা পূর্বসূরির এই চিন্তাসূত্রকে গ্রহণ করে আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, যে-কোনো দ্যোতক অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা দিতে পারে। একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি, ‘ফুলদানিতে গোলাপ আছে।’ তিন শব্দের এই বাক্যটির অসংখ্য অর্থ করা যেতে পারে। দ্যোতক গোলাপ আমাদের মনে জাগিয়ে তুলতে পারে অন্য ফুলের অনুষঙ্গ, হতে পারে কোনো স্টিল লাইফ (চিত্রকলা), বাগানের অনুষঙ্গ আনতে পারে, গাছে ফুটে থাকা গোলাপের ছবির ভাব জাগাতে পারে, হতে পারে রূপক, চিত্রকল্প, সৌন্দর্যের বোধ, পরিবেশ, আরও নানান কিছু। এর এই প্রত্যেকটি দ্যোতনা (অন্য ফুল, স্টিল লাইফ, ইত্যাদি) অন্যদের অনুষঙ্গে বা সংশ্লেষে রূপান্তরিত হতে পারে দ্যোতকে, আবার সেই দ্যোতক থেকে পাওয়া যেতে পারে নতুন নতুন দ্যোতনা। সংক্ষেপে বললে, একটি দ্যোতক একটিমাত্র দ্যোতনা বা মানসিক ধারণা দেয় না, অন্য দ্যোতক তৈরি করে, মালার মতো অন্য দ্যোতকের দিকে টেনে নিয়ে যায়। দ্যোতক-দ্যোতিতের সরল ব্যাখ্যা অন্য আরেকভাবে জটিল হয়ে উঠতে পারে। একজন মানুষ শ্লেষ-কৌতুকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, অর্থাৎ বলছেন একটা কিন্তু বোঝাচ্ছেন অন্য কিছু। কণ্ঠস্বরের ওঠানামার ওপরও অর্থ ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। বিশেষ বিশেষ শব্দের ওপর জোর দিয়ে জ্ঞাপন করা যেতে পারে উদ্দেশ্যমূলক কোনো অর্থ।
সোসুর বলেছেন, ভাষা শুধু বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতাকে নির্দেশ করে না, নির্দেশ করে মানসিক ধারণা বা প্রতীতিকে। কিন্তু অবিনির্মাণে ভাষা মানসিক ধারণাকে নির্দেশ করে না, নির্দেশ করে ওই ভাষাকেই। এখান থেকেই চিহ্নক বা দ্যোতকের অব্যাহত খেলা শুরু হয় যা কোনো অবসর আর পায় না। আমাদের চিন্তা, দেরিদা মনে করেছেন, সতত পরিবর্তনশীল; ফলে দ্যোতকগুলো একটি থেকে আরেকটিতে চলে যায়। আমরা ভাবি বা প্রত্যাশা করি স্থিতি, কিন্তু মানুষ ভাষার জালে আটকে যায়, এই ভাষা স্থিতিশীল হতে চায় না, পারেও না। এই ভাষিক ক্রীড়া শুধুই খেলা নয়, অর্থের বিভ্রমও তৈরি করে না। একটি দ্যোতক রেখে যায় পরবর্তী দ্যোতকের চিহ্ন, ওই চিহ্ন থেকে তৈরি হয় আরেকটি অর্থ, ওই অর্থ আবার রেখে যায় যে-দ্যোতক, তা থেকে নতুন অর্থ তৈরি করা যায়; দ্যোতক আর অর্থের প্রক্রিয়াটি এইভাবে চলতে থাকে। একটি টেক্সটের এভাবেই পাওয়া যাবে অনেক অর্থ। একটি শব্দকে আমরা চিহ্নিত করি অন্য শব্দের সঙ্গে পার্থক্যের সূত্রে, শব্দ তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। একটি শব্দ (যা উপস্থিত) চিহ্নিত করে কী তাতে অনুপস্থিত। দেরিদা এই অনুপস্থিতিকে একটি ফরাসি শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করেছেন, শব্দটি হচ্ছে দিফেরঁস (différrance), বাংলায় আমরা একে উল্লেখ করতে পারি ‘বিভেদনা’ বা ‘স্থগন’ বলে। এটি খুবই জটিল একটি পরিভাষা। দেরিদা এর দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন ‘পৃথকতা’ আর ‘স্থগন’ (স্থগিত থেকে স্থগন)। দেরিদার মূল কথাটা হলো, লেখার মধ্য দিয়ে অর্থ প্রকাশ করতে চান লেখক, কিন্তু সবসময় তা স্থগিত হয়ে যায়, যা-ই বলেন না কেন, কোনো না কোনো অর্থ অনুপস্থিত থেকে যায়। জ্ঞান আসে অনৈক্য, পার্থক্য বা অনুপস্থিতি থেকে; এটাই শব্দের গতিশীল দিক বা পটভূমি। দেরিদা আরও বলেছেন, যে-কোনো টেক্সট বা রচনার অর্থ পাওয়া যেতে পারে অন্য রচনার সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কের (interrelatedness) সূত্রে। এটি একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া যা রচনাটির একের পর এক অর্থ দেয়, দেয় নানান পাঠ।
অবিনির্মাণের এই ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে, অর্থাৎ এই স্থির অর্থের অনুপস্থিতি সম্বন্ধে অনেকেই অস্বস্তি বোধ করেছেন। তারা মনে করেন, যা অনুপস্থিত তা থেকে যদি অর্থ পাওয়া যায় এবং সেই অর্থও যদি চূড়ান্ত বলে গণ্য না হয়, তাহলে অবিনির্মাণের মাধ্যমে কোনো ব¯’নিষ্ঠ সত্যে পৌঁছুনো যাবে কি? প্রত্যুত্তরে দেরিদা বলেছেন, অর্থ পাওয়া যায় এমন কোনো অতীন্দ্রিয় দ্যোতনা (transcendental signified) নেই, নেই চূড়ান্ত কোনো বাস্তবতা অথবা শেষ ব্যাখ্যা। আমরা একটা বিষয়ের অর্থ করি অন্য একটা বিষয়ের অনুসঙ্গে। যদি পরিবর্তনহীন না হয়, তাহলে মানুষ সেই দ্যোতকের অস্তিত্ব শিকার করে না। মানুষ চায় স্থির একটা কেন্দ্র, কেননা, দেরিদা বলেছেন, মানবসমাজ, বিশেষ করে পশ্চিমী বিশ্ব পুরোপুরি অর্থকেন্দ্রিক (logocentric)। এর অর্থ হলো মানুষ খোঁজে কেন্দ্র, কেন্দ্রকে ঘিরেই সমস্ত অর্থ আবর্তিত হয়। মানুষের এই যে অর্থ তৈরি করার প্রবণতা, দেরিদা একে পরাতাত্ত্বিক (Metaphysical) প্রবণতা বলে উল্লেখ করেছেন। মানুষের বিশ্বাস ভাষা ও টেক্সটের পেছনে কিছুর উপস্থিতি আছে। সভ্যতার পর্বে পর্বে এই কেন্দ্রের নানা নাম দিয়েছে মানুষ : সত্য, ঈশ্বর, প্লেতোনীয় কাঠামো, সত্তাসার (essence) ইত্যাদি। কী নাম দিয়েছে মানবসমাজ সেটা বড়ো কথা নয়, এর প্রত্যেকটি হচ্ছে স্থির, চলমান ও পরম; এসব থেকেই অন্য জ্ঞানের দিকে যায় মানুষ। পশ্চিমী অধিবিদ্যার এটাই হচ্ছে মূল বৈশিষ্ট্য, পৃথিবীকে পশ্চিমের মানুষ দেখে যুগ্মতার (pair) পরস্পর বিপরীত (binary opposition) সূত্র অনুসরণ করে। দেরিদার মতে এই বিপরীত য্গ্মুতাই হচ্ছে কেন্দ্র। কোনো টেক্সট বা রচনার মতাদর্শকে যদি বুঝতে হয়, তাহলে ওই রচনার মধ্যে বিপরীত যুগ্মতাকে শনাক্তকরণ করতে হবে। অবিনির্মাণের প্রেক্ষাপটে যারা রচনাকে ব্যাখ্যা করেন, তারা মনে করেন এই বিরোধিতার দিকটি সবসময় তেমন একটা সংঘাতপূর্ণ হয় না। অনেকের ধারণা, আমাদের এই পৃথিবীকে সত্য/মিথ্যা, মঙ্গল/অমঙ্গল, প্রেম/ঘৃণাÑ এভাবে অতি সরলভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এরকম ভাবনা আমাদের জটিল ভাবনা ও পৃথিবীকে বুঝতে সেভাবে সাহায্য করে না, এটি সংঘাত ও দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে যায়; ফলে সত্যেরই বিকৃতি ঘটে। অবিনির্মাণ এই সরলতাকেই অগ্রাহ্য করে। সে দেখতে চায় একটি দ্যোতনার বিপরীতে অন্য কোন দ্যোতনাটি কার্যকর রয়েছে, কোন সাংঘর্ষিক অবস্থানে এটি স্থিত। অবিনির্মাণ এভাবেই একটি দ্যোতকের অর্থকে তার নিজের জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়ে উপস্থাপন করে একগুচ্ছ সম্ভাব্য দ্যোতনাকে। এই দ্যোতকগুলো তখন নতুন পৃথকতার প্রেক্ষাপটে নতুন অর্থ দেয় বা অর্থ দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
একটি বিপরীত যুগ্মতাকে দেরিদা খুব গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটি হলো কথন/লিখন। দেরিদা মনে করেছেন, লিখনের উপরে কথনের স্থান, কথা বলেই মানুষ সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে, কথার মধ্যেই ভাষার প্রত্যক্ষ রূপ পাওয়া যায়। দেরিদা একে চিহ্নিত করেছেন ধ্বনিকেন্দ্রিকতাবাদ (phonocentricism) বলে। অন্যদিকে লিখন হচ্ছে কথনের অনুলিপি, কথাকে অনুসরণ করেই লিখনের ব্যাপারটি ঘটে। এটি তুলনামূলতভাবে কথনের তুলনায় নিকৃষ্ট, কেননা এটি উৎসের (কথন) সঙ্গে কম সম্পর্কিত। কথনের মধ্যেই কথকের উপস্থিতি, কিন্তু অনুপস্থিতিই হচ্ছে লিখনের বৈশিষ্ট্য। লিখন তখনই কাজ করে যখন লেখক উপস্থিত থাকেন না। কথন ও লিখনের ক্ষেত্রে যা ঘটে তা হলো উপস্থিতি/অনুপস্থিতি, স্বাভাবিকভাবেই লেখা নয়, কথাই হচ্ছে প্রাধান্যসূচক পরিভাষা। এটাই ভাষার অর্থকেন্দ্রিক অবস্থা, কেননা কথাই মানুষকে কেন্দ্রে স্থাপন করে, ভাষাই তার উপস্থিতি ঘোষণা করে, মানুষকে সত্তাময় করে তোলে।
অনতিক্রম্য কোনো দ্যোতনা যদি না থাকে, বস্তুনিষ্ঠ সত্যও তাহলে থাকবে না; এরকম পরিস্থিতিতে কোনো বিপরীত যুগ্মতাই স্থির থাকে না। এটি পরিবর্তনশীল, একে একেবারে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায়। কেন্দ্রের ব্যাপারটিও এভাবে অকেন্দ্রিক করে দেয়া যায়, নতুন একগুচ্ছ মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের প্রবর্তন ঘটানো যায়। যে-কোনো বিষয়কে এভাবে নতুন প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি ঘটে তাহলো কেন্দ্রকে কেন্দ্রচ্যুত করে কেন্দ্রের বাইরে এসে দেখার, বিশ্লেষণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অর্থকেন্দ্রিকতাকে অস্বীকার করা সহজ হয়। দেরিদা শুধু কথন/লিখনকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেননি, তিনি কথনের আগে লিখনকে স্থান দিয়েছেন। কেননা তিনি মনে করেছেন কথন হচ্ছে লিখনেরই একটা রূপ। কথন ও লিখনের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। লেখার পুনর্পাঠ সম্ভব, কিন্তু কথা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পুনরুক্তিময় দ্যোতকই কথাকে লেখায় পরিণত করে। দেরিদার বলছেন, এ হচ্ছে বিশেষ ধরনের লেখা।
বিপরীত যুগ্ম দ্যোতকগুলো জড়াজড়ি করে পরম্পরিত হয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ এরা একেবারে ধ্রুব কিছু নয়। যুগ্ম দ্যোতকের একটি অন্যটিকে বুঝতে সাহায্য করে; যেমন রাত্রির বোধ আছে বলেই আমরা দিনের কথা ভাবতে পারি, অথবা দিনের বোধ থেকে রাত্রির কথা ভাবা সহজ হয়। ভাষার রয়েছে আসলে অসংখ্য পরস্পর প্রতিস্পর্ধী নানান বৈশিষ্ট্য; ফলে একটি দ্যোতক থেকে আরেকটি দ্যোতককে আলাদা করা যায়। একই সঙ্গে এর উপস্থিতিও নিশ্চিত করা যায়। কী নেই, কী হারাচ্ছি, ভাষা আমাদের সেটাও মনে করিয়ে দিতে পারে। মূল কথা হলো যুগ্মের একটি আরেকটির পরিপূরক বা পরস্পরকে তারা সাহায্য করে। একটির যদি কিছু অভাব থাকে তাহলে অন্যটি সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিতে পারে; অর্থাৎ এরা পারস্পরিকভাবে কিছু যোগ করে, একটির স্থান অন্যটি নিয়ে নেয়। লিখন শুধু কথনে কিছু যোগ করে এমন নয়, বরং বিকল্প হিসেবেও কাজ করে, যদিও এই বিকল্পের বিষয়টি হুবহু ঘটে না। এই প্রক্রিয়াটি কখনই সম্পূর্ণতাও পায় না। বিকল্পের বিষয়টি মানবজীবন ও আচরণের সব ক্ষেত্রেই ঘটে।
পশ্চিমী সভ্যতা কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত সচেতন, সমন্বিত আত্মসত্তার উপর প্রতিষ্ঠিত। সমস্ত মানবীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে এর অবস্থান। দেরিদা একে আখ্যায়িত করেছেন ‘পরাতাত্ত্বিক উপস্থিতি’ (metaphysical presence) বলে। অর্থকেন্দ্রিকতা (শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত), ধ্বনিকেন্দ্রিকতা (ধ্বনির সঙ্গে সম্পর্কিত) এবং অতীন্দ্রিয় দ্যোতনা (সমস্ত জ্ঞানের উৎস) এই পরাতাত্ত্বিক ধারণারই অংশ। প্লেতো-পরবর্তী প্রতীচ্যের এটাই হচ্ছে মূল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দেরিদা একে ত্রুটিপূর্ণ, খ-িত, বিকৃত বলে আখ্যায়িত করেছেন, কেননা অন্তিমে অর্থের বিষয়টি অনিশ্চিত। অধিবিদ্যার এই সীমাবদ্ধতাকে, দেরিদা মনে করেন, গঠন-পুনর্গঠন, নির্মাণ-পুনঃনির্মাণ ইত্যাদির সূত্রে অতিক্রম করা সম্ভব। লেখা, রচনা বা টেক্সটের কথা যদি ধরি, তাহলে দেরিদা নিঃসন্দেহে পাঠের একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছেন।
অবিনির্মিত পাঠ ও বিশ্লেষণরীতি
সনাতন সমালোচনামূলক পাঠে একটি রচনা কী অর্থ দেয় তা অনুসন্ধান করা হয়। কিন্তু অবিনির্মিত পাঠের লক্ষ্য হয়ে ওঠে রচনাটি কী অর্থ দিতে চেয়েছিল আর প্রকৃতপক্ষে কী অর্থ দিতে পেরেছে, সেই দিকটির অনুসন্ধান। কোনো রচনা তার অভ্যন্তরীণ ঐক্য, সংগতি এবং অর্থ প্রকাশের যে ভাবটা দেখায়, অবিনির্মাণ চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সেই অনুমিত ভাব ও অর্থ যে রচনাটি দিতে পারেনি, বা দিলেও কতটা দিতে পেরেছে বা ব্যক্ত করতে পেরেছে, সেটি বিশ্লেষণ করে দেখায়। অবিনির্মাণ মনে করে রচনার অর্থ সম্বন্ধে চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়, কেননা প্রত্যেকটি পাঠই হ”েছ সাময়িক। একটি পাঠ অন্যান্য অসংখ্য যে পাঠ রয়েছে, যে-পাঠগুলো পরম্পরাক্রমে বিন্যস্ত, গ্রথিত, এদের একটি শুধু অন্যটিকে কেন্দ্রচ্যুত করে এবং একের পর এক অর্থ উন্মোচন করতে থাকে; আর এভাবেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকে অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া। অতীন্দ্রিয়, ধ্রুব দ্যোতনার অনুপস্থিতির কারণে কোনো রচনার পূর্বে এবং বাইরে যে-কেন্দ্র বা কেন্দ্রগুলোর অবস্থান, তার সঙ্গে রচনাটি একেবারেই সম্পর্কিত নয় আর অর্থ সম্বন্ধে চূড়ান্ত কথাও বলা যাবে না।
দেরিদা নিজে এ সম্বন্ধে বলেছেন, ‘সবসময় সম্পর্কের কিছু সূত্র ধরিয়ে দেওয়াই হবে পাঠের আবশ্যিক লক্ষ্য। যে-ভাষারীতি তিনি ব্যবহার করেছেন তার উপর লেখকের নিয়ন্ত্রণ ছিল কী ছিল না সেটা লক্ষ করেই লেখক যে বিষয়টিকে অনুধাবন করতে পারেননি সেটা বিশ্লেষণ করা।’ শ্যারন ক্রাউলি বলেছেন, রচনার যে অপূর্ণতা থাকে, থাকে অসংগতি, অবিনির্মাণ সেটাই দেখতে চায়। নিজের সংস্কৃতি অনুসরণ করতে গিয়েই এরকম কিছু কৃষ্ণ গহ্বরের সৃষ্টি করেন রচয়িতা। অবিনির্মাণ রচনাকে পুনর্লিখনের জন্যই আবার পাঠ করে। পদ্ধতিগতভাবে পশ্চিমী ইতিহাসের যে-বিষয়টিকে নিস্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, দেরিদা সেটি পাঠ করে কণ্ঠস্বর দিয়েছেন (ক্রলি ১৯৮৯)। অবিনির্মাণখ্যাত সমালোচনক পল দে মান (১৯১৯-৮৩) তার অন্ধত্ব ও অন্তর্দৃষ্টি (১৯৮৩) শীর্ষক গ্রন্থে আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, সমালোচককে ‘অদ্ভূত আঁধারে’র মধ্য থেকে অর্জন করতে হবে অন্তর্দৃষ্টি। একী সেই একই অদ্ভূত আঁধার যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ?
অবিনির্মাণের প্রতি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের অনিঃশেষ আগ্রহ। কী নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা, কী নিম্নবর্গ, কী সমকালীন এশীয় রাজনীতির বিশ্লেষণ, সব ক্ষেত্রেই তিনি অবিনির্মাণকে অনিবার্য সহায় বলে মনে করেন। তিনি বলেছেন, অবিনির্মাণ ভাষার জটিলতাকে ছিন্ন করার দিকেই অবিনির্মাণের ঝোক :
ভাষাও হয়তো একটা তাপ্পি, মৌলিক তর্ক অনর্থকে নিয়তই ঢেকে রাখে, সূত্রাবলির জাল, গ্রন্থের গ্রন্থি ভুলিয়ে দেয় যে জগতের জাল চিরছিন্ন হওয়ার কোনো সংগত বাধা নেই। এই জন্যই, পারমাণবিক পদার্থবিদরা যখন দর্শনের দিকে এগোন, তবে জর্জ সুদর্শনের মতো তুরীয়বাদে অনুপ্রাণিত হন, নয় ইলিয়া প্রিগোজিনের মতো আকৃষ্ট হন অবিনির্মাণে। (স্পিভাক ১৯৯৭ : ২১)
স্পিভাকের মতে অবিনির্মাণের লক্ষ্য শুধু ভাষা নয়, ভাষা যাতে দর্শনের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে না যায়, অর্থের সূত্র ধরিয়ে দেয় :
অবিনির্মাণ প্রশ্ন করে : কী বাকি রইল, কী উপচে গেল : রিমেন্স। বিচাওে কী বাকি পড়তে বাধ্য, এ প্রশ্নের উত্তর বিচারবুদ্ধি দিয়ে দেওয়া যাবে না। কাজেই অবিনির্মাণ সাধারণ ভাবজীবনের কোণঠাসা ভাষা নিয়ে বিচার সভায় আকুলিবিকুলি করে।…ভাষার বৃহত্তর ইতিহাসে বিদ্রোহী যে আক্ষরিক সম্ভাবনা থাকে, অবিনির্মাণ তাকেও ব্যবহার করে। অবিনির্মাণের মতে কিš’ ভাষাই সব নয়; শুধু দর্শন যেন ভাষাকে সংকীর্ণ না-করে এই তার ইচ্ছা। এবং ইচ্ছাপূরণ অসম্ভব এক্ষেত্রে এ স্বীকৃতিতে সে এগোয়। (স্পিভাক ১৯৯৭ : ২১)
প্রকরণবাদের মতো অবিনির্মাণের লক্ষ্য হচ্ছে সন্নিহিত নিবিড় পাঠ, খুবই কাছ থেকে পাঠ করা। যা-কিছু উপস্থিত এবং যা-কিছু পাঠের সঙ্গে সংযুক্ত, সক্রিয়, সেইসব উপাদানকে চিহ্নিত করা, বিশ্লেষণ করা। তবে প্রকরণবাদ ও অবিনির্মাণের পরিসমাপ্তির মধ্যে কোনো মিল নেই। প্রকরণবাদ রচনাকে সামগ্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ মনে করে, অন্যদিকে অবিনির্মাণ রচনাকে পরস্পরবিরোধী দ্যোতনা হিসেবে বিবেচনা করে।
দেরিদা নিজে টেক্সটকে কীভাবে পড়েন তার একটা সূত্রের কথা বলেছেন, সেটি হচ্ছে দুই বার করে পাঠ করা। একবার পড়ে যেতে হবে সনাতন পদ্ধতিতে, দেখতে হবে কোন কোন ক্ষেত্রে ঠিক কী অর্থ রচনাটি দিতে পারে। রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার কথাই ধরা যাক। কবিতাটির নাম Stopping by Woods on a Snowy Evening, শামসুর রাহমান এর চমৎকার অনুবাদ করেছেন ‘শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’।
শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে
এই বন কার আমি জানি ব’লে মনে হয়।
বুঝি বাড়ি তার ঐ গাঁয়ে নিশ্চয়;
জানবে না সে তো দেখছি দাঁড়িয়ে আমি
বন তার হলো এখন তুষারময়।
ঘোড়াটা ভাবছে ব্যাপার চমৎকার!
খামার ছাড়াই কী যে লাভ থামবার,
বন আর এই জমাট হ্রদের মাঝে
আজকে সন্ধ্যা সবচে’ অন্ধকার।
ভুল হয়ে গেছে ভেবে সে শব্দ ক’রে
নাড়ার ঘুণ্টি, এবং বনের ’পরে
শুধু আরেকটি শব্দ যা”েছ শোনা :
হালকা বাতাসে বরফের কুচি ঝরে।
কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে,
কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকী আছে।
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে,
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে।
প্রথম পাঠের সময় এই কবিতাটির বর্ণনাকারী শান্তির জন্য যে ইচ্ছা প্রকাশ করছে, তা অবিনির্মাণ করে নিতে পারি। কবিতাটির চমৎকার নিয়ন্ত্রিত সংগঠন, রাত্রি, শীতকাল ও ঘুমের শান্ত স্থির চিত্রকল্পগুলো তখন সহজেই আমাদের চোখে পড়বে। কিন্তু দ্বিতীয় পাঠের সময় খুঁজে দেখতে হবে বিকল্প কী কী অর্থ কবিতাটি দিচ্ছে এবং এর বিশেষ কোনো অর্থকে গ্রাহ্য করার প্রয়োজন নেই। তবে আবিষ্কার করতে হবে এটি প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিস্পর্ধী, সাংঘর্ষিক অথবা খাপছাড়া কোনো অর্থ দিচ্ছে কিনা। অর্থ এভাবেই অনিশ্চিত, অপ্রকাশিত থেকে যায়। অর্থকেন্দ্রিকতা যেভাবে প্রতীজ্ঞা করে, রচনা সেরকম ঐক্যবদ্ধ, সংগতিপূর্ণ, সুনিশ্চিত নয়। রচনার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ হয়, পাঠক নিজেই রচনাটি বারবার পড়ে অনেকরকম অর্থ করে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পাঠ করলে অর্থও ভিন্নরকম হয়ে যায়। কোনো পাঠই তাই অনিবার্য নয়, একটি পাঠের দ্বারা অন্য পাঠটি প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। পাঠবিশ্লেষণ বা সমালোচনার কাজটি তাই সৃজনশীল। একই রচনা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সমালোচক ভিন্ন ভিন্নভাবে সেটি পাঠ করে থাকেন, বিশ্লেষণ করে দেখান। টেক্সট বা রচনা যেমন সৃজনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সমালোচনাও সৃজনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে রচনা হয় একটি, পাঠ হয় নানা ধরনের, বহুমুখি, অনেকান্ত। নানাভাবে দেখার বা আবিষ্কার করার আনন্দটাই হলো যে-কোনো লেখা পাঠের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কোনো সন্দেহ নেই, পাঠক বা সমালোচক তার পাঠপ্রতিক্রিয়া বা আবিষ্কারকে অর্থকেন্দ্রিক ভাষায় প্রকাশ করবেন, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি তার বিশ্লেষণকে অবিনির্মাণ করে নেবেন।
কিন্তু কীভাবে সমালোচক রচনার বিকল্প অর্থগুলো খুঁজে পাবেন? কীভাবেই বা খুঁজে পাওয়া যাবে এর স্ববিরোধী অথবা মানানসই নয় এমন অর্থগুলো? শুরু করতে হবে রচনার বিপরীত যুগ্মতাকে ধরে ধরে। শনাক্তকরণ করতে হবে কোন শব্দ বা শব্দগুচ্ছ প্রাধান্যের জায়গায় আছে এবং কোনগুলো নেই। যেমন ফ্রস্টের এই কবিতায় ক্রমোচ্চতা বা উঁচু-নিচু অবস্থান (hierarchical position) থেকে এই ধরনের শব্দগুলো লক্ষ করা যায়। সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করে কবিতাটির একটি অবিনির্মিত বিশ্লেষণ যে-কোনো পাঠক দিতে পারেন। নিচে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে, এই প্রশ্নের উত্তরের ভেতর দিয়ে অবিনির্মাণ কীভাবে কাজ করে তার কিছুটা হদিস পাওয়া যাবে।
কোন পুরুষার্থ, মূল্যবোধ বা ভাব উচ্চাবচ (hierarchy) ওই বিপরীত শব্দগুলো প্রকাশ করছে? প্রথমেই এই উত্তরটি হবে পূর্বজ্ঞান বা আভিধানিক জ্ঞান থেকে উদ্ভূত। সনাতন পাঠের দিকেই চলে যাবে আলোচনাটি।
পাঠক বা সমালোচক যদি মনে করেন এই যুগ্মতার প্রথমটি হচ্ছে প্রাধান্যসূচক, তাহলে তিনি যে মূল্যাঙ্কনে বিশ্বাস করবেন বলে মনে হবে তাহলো শান্তি, একত্ব, প্রকৃতি, আত্মতার (self) স্বীকৃতি। মুহূর্তের একটা সৌন্দর্য আছে, আদিমতার সঙ্গে যুক্ত হলে ওই সৌন্দর্যকে অনুধাবন করা যায়।
বিপরীত যুগ্ম জোড়া শব্দগুলোকে যদি উল্টে দেওয়া যায়, তাহলে কী ঘটবে? কোন ধরনের নতুন সজীব পটভূমি কবিতাটি থেকে পাওয়া যাবে বা বিচ্ছুরিত হবে? মনে রাখা দরকার উচ্চাবচ অবস্থাটি হচ্ছে আপেক্ষিক (arbitrary)। একে উপরে-নিচে স্থাপন করে কিংবা অদল-বদল করে নতুন ধরনের পুরুষার্থ পাওয়া যেতে পারে যা ওই যুগ্মতার মধ্যে অন্তঃশীল রয়েছে। এই নতুন অপ্রচলিত, অপ্রথাবদ্ধ সম্পর্ক শব্দগুলো সম্বন্ধে অথবা টেক্সট সম্বন্ধে সমালোচকের অথবা পাঠকের মনে এমন ভাবনার উগ্রেক করতে পারে, যা বৈপ্লবিক, অভূতপূর্ব, আগে কখনও ভাবা হয়নি।
ফ্রস্টের কবিতাটির বিপ্রতীপ আগ্রহোদ্দীপক দিকগুলো হচ্ছে, যে-শব্দগুলো কবিতার শুরু থেকেই প্রাধান্য পেয়ে আসছিল, শেষের দিকে এসে যখন ভ্রমণকারী তার ভ্রমণ অব্যাহত রাখার কথা বলছে, তখনই হঠাৎ তা পাল্টে গেল। প্রথম তিনটি স্তবকে কোলাহলের পরিবর্তে নৈঃশব্দ্যের, সভ্যতার পরিবর্তে প্রকৃতির, গোষ্ঠীর পরিবর্তে একাকীত্বের প্রাধান্য। যখন ভ্রমণকারী অন্ধকার এবং গভীর বনের সৌন্দর্যকে অস্বীকৃতি জানালো তখনই সে বুঝতে পারলো সে এমন এক পৃথিবীতে বাস করে, যে-পৃথিবীতে আত্মমগ্ন স্বপ্নের মধ্যে বাস করা যায় এবং তার পথচলাকে অব্যাহত রাখা যায়। সে একটা সমাজেরই অংশ, যে-সমাজ সম্প্রদায়কে গুরুত্ব দেয়, গুরুত্ব দেয় কাজ, সচেতনতা এবং বাস্তবতাকে।
কবি যদিও কবিতাটিকে এভাবে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, পাঠক এরপরও ভাবতে পারেন এমন কী এতে বদলালো? কী ভাবের সৃষ্টি হলো? কী ঘটতে পারতো যদি পথচারী প্রকৃতি, অন্ধকার আর স্বপ্নকে বেছে নিত? কী হবে যেসব বিষয় কবিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করছে তারা তাদের প্রাধান্য অব্যাহত রাখে? কী ঘটতো যদি গোষ্ঠীর চাইতে বিচ্ছিন্নতাকে আরও আকর্ষণীয় করা হতো? কী হতো যদি এই বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটি একা একা কিংবা বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের মধ্যে ঘটতো? তাহলে এই বন কারোরই অধীনে থাকতো না। একথা তো বলাই যায়, বর্ণনাকারী তাহলে উপলব্ধি করতে পারতো না বনের শান্ত, সমাহিত, গম্ভীর রূপটি। আত্মসচেতনতাও তৈরি হতো না প্রকৃতির শান্তবিহ্বল রূপ নিয়ে। উধাও হয়ে যেত সামাজিক রীতিনীতি ও চাপে থাকার অনুভূতির। পৃথিবীতে তখন কোনো চাপই উপস্থিত থাকতো না, উপস্থিত থাকতো শুধু শান্তি। কবিতার বর্ণনাকারী তখন কঠোর শ্রম, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্ব পালন থেকে দূরে-শান্তিতে থাকতে পারতেন। কবিতটির শেষাংশে তারই ইঙ্গিত আছে। কাঠামো আর কঠোর অনুশাসনেরও অবসান ঘটতো আর সেখানে স্থান অধিকার করে নিত স্বতঃস্ফূর্ততা, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি ঘটতো তা হলো যে কেউ অনুভব করতো প্রকৃতির সঙ্গে সংলগ্নতা ও ঐক্য। একাকীত্বের বিষয়টি তাই এই কবিতার একটা অস্থায়ী ব্যাপার, এই বিষয়টিই সাময়িকভাবে কবিতাটির অর্থের কেন্দ্র হয়ে আছে।
প্রাধান্যপ্রাপ্ত শব্দগুলোর মধ্যে কী কোনো স্ববিরোধ দেখতে পাওয়া যায়? এর অর্থ কবিতার মধ্যে অনুস্যূত নৈঃশব্দ্য, বিচ্ছিন্নতা, স্থিরতা, অবচেতনা কী সমস্বরে স্থাপিত নাকি বিষমস্বর লক্ষণীয় হয়ে উঠছে? অথবা এরা কী কবিতায় যথাযোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়নি?
প্রাধান্যসূচক শব্দ বা পরিভাষা প্রাথমিকভাবে সহজেই একটা একক দৃশ্যের মধ্যে ধৃত ছিল। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে কিছু কিছু অসংগতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কবিতাটির মধ্যে এমন কিছু স্ববিরোধ আছে যা চোখে পড়ে না; যেমন পথচারী বা ভ্রমণকারী একাকীত্বকে উপভোগ করে, কিন্তু শেষের দিকে এসে সমাজ-সংলগ্ন হতে চায়। সে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে অনুভব করে, কিন্তু বেছে নিয়েছে সভ্যতাকে। যখন সে ভ্রমণ করতে থাকে, তখন সমাজ ও সভ্যতার দ্বারা বিচ্ছিন্নতা ও প্রকৃতি অকেন্দ্রিক হয়ে যায়। পরিশেষে আমরা পেয়ে যাই স্ববিরোধী ক্রমোচ্চ পরিভাষা ও বিপরীত যুগ্মতাকে : বিচ্ছিন্নতা/সামাজিকতা এবং সামাজিকতা/বিচ্ছিন্নতা, প্রকৃতি/সভ্যতা এবং সভ্যতা/প্রকৃতি এইসব। বিরোধী পরিস্থিতি একসঙ্গে থাকতে পারে না, যদিও কবিতাটিতে এই বিষয়টি কখনই স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। ভ্রমণকারী নিজেই এখানে স্ববিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এটি কবিতা বা জীবনের অস্থিতিশীল ও পরিবর্তনশীল অর্থই প্রকাশ করছে। এই স্ববিরোধ একধরনের নান্দনিকতা, নিন্দাযোগ্য নয়।
এবার বিবেচনা করা যাক, এই কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ বা পরিভাষা কী চিন্তার উদ্রেক ঘটায়? অন্য উচ্চাবচ শব্দগুলো কোথায় নিয়ে যায়? এইধরনের ভাবনা, বলা নিষ্প্রোজন, বিকল্প পাঠ দেবে। এই মুহূর্তে যে শব্দগুলো বা বিপরীত যুগ্ম শব্দগুলো কবিতার বিশ্লেষণকে নিয়ন্ত্রণ করছে, নতুন যুগ্ম শব্দগুলো তাকে অকেন্দ্রিক করে দেবে। এসব শব্দ থেকে পাওয়া যাবে বিকল্প পাঠ।
প্রতীক হিসেবে স্থিরতা, নৈঃশব্দ্য, বিচ্ছিন্নতা, অবসর ইত্যাদি শব্দ অবচেতনা আর মৃত্যুকে আভাসিত করে। দুটি প্রধান যুগ্মশব্দ অবচেতনা/চেতনা এবং মৃত্যু/জীবন পুরানো ব্যাখ্যা অনুসারে সম্ভাবনা ও কর্তব্যবোধের কথা আভাসিত করতো, কিন্তু অবিনির্মিত ব্যাখ্যা অনুসারে এই যুগ্মশব্দ চারটি বৈধতা আর উপস্থিতির দ্বারা অকেন্দ্রিক হয়ে গেল। কবিতার সনাতন অর্থও গেল পাল্টে। এভাবেই চিহ্নের গুচ্ছগুলো আবর্তিত হতে থাকে, একটা অর্থ থেকে চলে যায় আরেকটি অর্থের দিকে।
বিপরীত যুগ্মতা কীভাবে পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে? কীভাবে প্রতিটি প্রতিস্পর্ধী শব্দ পাঠকের কাছে অর্থপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়? কীভাবে তারা উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি উভয়কে গ্রাহ্য করে তোলে?
ফ্রস্টের কবিতাটির শেষে বর্ণনাকারী যখন একাকী শান্তি অনুভব করার পরিবর্তে পৃথিবীর সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত হওয়ার কথা বললেন, তখন প্রকৃতি ও সভ্যতা, নিষ্ক্রিয়তা ও সক্রিয়তা, লোকালয় আর বন, বিপরীত অবস্থানে রইলো না; বর্ণনাকারীর অভিজ্ঞতা আর সত্তার অংশ হয়ে উঠলো। পূর্বে নৈঃসঙ্গ্য, একাকীত্ব ছিল কবিতাটির কেন্দ্রে, কিন্তু এখন তা অকেন্দ্রিক হয়ে গেল এবং পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠলো। বর্ণনাকারী শীতের বনভূমির দৃশ্যের দ্বারা ছিল বিমু, কিন্তু পরিশেষে সে বেছে নিল বাইরের পৃথিবী আর কাজ করার দায়। বর্ণনাকারীর সত্তা, বলাই বাহুল্য, সংগতিপূর্ণ ছিল না, ছিল বিচূর্ণ, দ্বিধান্বিত; অবচেতন স্তর থেকে সে কথা বলে গেছে। কিন্তু সবশেষে সে ফিরে গেছে চেতনাময় পৃথিবীতে। স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে ঘিরেই তার অস্তিত্ব ও অধিষ্ঠান।
অবিনির্মাণের আরও একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, যে-ব্যাখ্যাটি প্রান্তিকতাকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠতে পারে কেন্দ্র। যে-সব বিষয় খুব অনুল্লেখযোগ্য সেইসব বিপরীত যুগ্ম শব্দগুচ্ছ দিয়ে কিংবা শব্দগুলোকে উল্টে সে-সবের উপর আলোকপাত করা হলে আরেক রকম অর্থ পাওয়া যেতে পারে। সাধারণ যেসব মন্তব্যকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা গ্রাহ্য করি না, সেইসব মন্তব্যকে কেন্দ্রে এনে দেখা যেতে পারে কবিতাটি কী নতুন ধারণা দিচ্ছে। কোনো অপ্রধান বা প্রান্তিক চরিত্রও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’র ঘোড়াটি লক্ষণীয়। এই ঘোড়াটি প্রায় আমাদের চোখেই পড়ে না। কিন্তু কবিতায় তার উপস্থিতি আশ্চর্যজনকভাবে বেশ অর্থপূর্ণ, ইঙ্গিতবহ। বলা হচ্ছে বটে ‘আমার ছোট্ট ঘোড়া’,২ তবে সে পালন করছে খুব বড়ো একটা ভূমিকা। সে তার ঘুণ্টিটা নাড়িয়ে এই কবিতার বর্ণনাকারীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার দায়িত্ব, কর্তব্য এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা। সে নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছে শব্দ দিয়ে, ঘুণ্টি নাড়িয়ে। শান্ত অবস্থার বিকল্প তৈরি করছে সক্রিয়তা আর শব্দ দিয়ে। অনুপস্থিতিকে প্রতিস্থাপন করছে উপস্থিতি দিয়ে। এই ঘোড়া এক অর্থে হয়ে উঠেছে সচেতন, সভ্য-পৃথিবীর কণ্ঠস্বর, প্রতিনিধি। সে নিজেকে করে তুলেছে আলোচনার কেন্দ্র। ভ্রমণকারী তার স্বপ্নকে বাস্তবে অনূদিত করে নিয়েছে। ঘোড়ার ঘুণ্টির শব্দ যদিও কোনো ভাষা নয়, তবু অর্থের কেন্দ্র থেকে সে বিচ্ছিন্নতাকে সরিয়ে দিচ্ছে। কবিতাটির গতিমুখও একই সঙ্গে যাচ্ছে বদলে। প্রাণীর প্রতিক্রিয়া সহজেই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, তবে অবিনির্মাণ তাকে কেন্দ্রে নিয়ে আসে। প্রান্তিক এভাবেই হয়ে ওঠে কেন্দ্র আর তখনই রচনাটি আরও গভীর কোনো অর্থ দেয়।
কোনো রচনার মধ্যে যদি গোপন, অন্তর্লীণ স্ববিরোধ থাকে, যেমন রচনাটি কী বলতে যাচ্ছে আর কী বলছেÑ এর মধ্যে যদি ফারাক দেখা দেয়, সেই বিষয়টিও অবিনির্মাণ বিবেচনায় নিয়ে থাকে। লেখার মধ্যে এরকম অসঙ্গতি প্রায়ই দেখা যায়, যা বলা দরকার তা বলা হয়নি, অথবা তথ্যের অভাব থাকে, কোনো বিষয়কে হয়তো স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, লেখক রূপক ব্যবহার করেন কিন্তু সেই ব্যবহারটি যথার্থ হয় না। যে-অর্থ লেখক করতে চাননি সেরকম অর্থও দিতে পারে কোনো রচনা। এই ধরনের স্ববিরোধিতার সূত্রে রচনাটির ভিন্ন আরেকটি পাঠ তৈরি করা যায়। ফ্রস্টের এই কবিতার মধ্যেও এমন কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যাদের মধ্যে ভাবের বা অনুষঙ্গের দূরত্ব অনেক বেশি। ফ্রস্ট বনের বর্ণনা প্রসঙ্গে এরকম কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন : সুন্দর, ঘনকালো, গভীর/ lovely, dark, deep। শামসুর রাহমান এর অনুবাদ করেছেন : কাজল গভীর মধুর। প্রথম বিবরণধর্মী শব্দটি (‘সুন্দর’) নান্দনিক আনন্দকে প্রকাশ করে, কিন্তু পরের দুটি শব্দ (‘ঘনকালো’, ‘গভীর’) আতঙ্ক এবং রহস্যময়তাকে প্রাধান্য দেয়। সার্বিকভাবে পাঠকের যে অনুভূতি জাগে তা হলো বন আজ বিলুপ্তি বা ধ্বংসের মুখে। পরিশেষে মনে হয়, বনের বুঝি কোনো স্থায়ী, স্থির, সুনির্দিষ্ট সত্তা নেই। ব্যবহৃত শব্দের অন্তর্লীণ স্ববিরোধকে শনাক্তকরণ করার মধ্য দিয়ে অবিনির্মাণ এরকম অর্থ পেতে পারে। এই অন্তর্লীণতাও অবিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
দেরিদা বলেছেন, বিপরীত যুগ্মতাকে যদি উল্টে দেওয়া হয়, যেমন উপস্থিতি/অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে ‘অনুপস্থিতি’ তখন প্রাধান্যের জায়গায় চলে আসবে আর তাহলে পাঠক রচনাটিকে আরও একভাবে অবিনির্মাণ করে নিতে পারবেন। ফ্রস্টের ‘শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’ শীর্ষক কবিতাটির বর্ণনাকারীর অনুচ্চারিত শব্দগুলো উঠে এসেছে তার সত্তার গভীর থেকে। তার ভাবনাকে আমরা শুধু চিন্তার স্তরে উপস্থিত দেখি, উচ্চারিত/কথিত হতে দেখি না। ধ্বনিকেন্দ্রিক (phonocentric) দৃষ্টিকোণ এই শব্দগুলোকে প্রাধান্যের জায়গায় নিয়ে আসতে পারে। ধ্বনিকেন্দ্রিকতাই তখন কবিতার যে বর্ণনাকারী তার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তার পক্ষে দাঁড়াতে পারে অথবা তাকে স্থানচ্যুত করে পাঠকের কাছে কবিতাটি আরও অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারে। অন্তর্গত অকথিত কথা বা ভাবনা তখন লিখিত রূপ পেয়ে যাবে, যেমনটা দেখা যেতে পারে এই কবিতার ক্ষেত্রে। ‘শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’র বর্ণনাকারীর কথা বা ভাবনাকে আমরা অনুপস্থিত দেখছি, কিন্তু তার ভাবনা আভাসিত হয়েছে ঘোড়ার ঘুণ্টির মধ্যে। ঘুণ্টির এই ধ্বনি (ভাষাগত নয়) বর্ণনাকারীকে মনে করিয়ে দিয়েছে তার দায়বদ্ধতার কথা, জীবনের অনিঃশেষ চলমানতার কথা। ঘোড়াই হয়ে উঠেছে চলমান মানুষ ও সভ্যতার প্রতিনিধি। ফলে কবিতার যিনি বর্ণনাকারী, তিনি সরে যাচ্ছেন কবিতার কেন্দ্র থেকে, ঘোড়াই হয়ে উঠছে কেন্দ্র। কথাকে (speech) স্থানচ্যুত করছে ধ্বনি (sound)। প্রাণী স্থানচ্যুত করছে মানুষকে। অনুপস্থিতি এভাবেই উপস্থিতির উপরে স্থান করে নেয়।
সংক্ষেপে বললে, ফ্রস্টের এই কবিতাটির বর্ণনাকারী বা কথক অর্থকেন্দ্রিক সত্তাবিশেষ, কেননা সে খুঁজছে একটা কেন্দ্র, অথচ সেই কেন্দ্র কোথাও নেই। সাময়িকভাবে অর্থ খুঁজে নিয়ে সে কাজের জন্যে বা মানব সম্প্রদায়ের জন্য একটা কেন্দ্র খুঁজছে। শান্তিই হচ্ছে তার আরাধ্য, কিন্তু এই শান্তিকে সে কাজ দিয়ে, কর্তব্যপরায়ণতা দিয়ে স্থানচ্যুত করছে। সংগতি যদিও তার অন্বিষ্ট, কিন্তু তা অনুপস্থিত; শান্তি শুধু মেলে বনের কিনারে পৌঁছে ভাসমান বা চলমান অবস্থায়।
পরিশেষে, অবিনির্মাণের লক্ষ্যে পাঠক রচনার সবকিছু প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবেন। প্রশ্ন তুলবেন সমস্ত কাঠামো সম্বন্ধে। কেননা চূড়ান্ত অর্থ সবসময় স্থগিত থাকে কিংবা ঘুরিয়ে দেয়া হয়, অর্থের অস্পষ্টতা থেকেই যায়। অর্থোদ্ধার করতে হলে প্রত্যেকটি নতুন কেন্দ্রকে তাই অকেন্দ্রিক করে দিতে হবে। পূর্ববর্তী সমস্ত সংশ্লিষ্ট তত্ত্ব বা ভাবনা সম্বন্ধে সন্দিহান হতে হবে। কোনো একটি অর্থ নয়, সম্ভাব্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অনন্ত সংখ্যক পথ খুলে দিতে হবে। সমালোচনার অনন্ত সম্ভাবনা তৈরি করতে হবে। ‘শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’ কবিতাটিতে দেখা যায়, একটি অর্থ নয়, পাওয়া যায় অনেক অর্থ। ফলে কোনটি প্রকৃত অর্থ তা নির্ণয় করা যায় না। পুনরাবৃত্তমূলক শেষ বাক্যটি অর্থবোধের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিংবা দেয় অনেকান্ত বা বহুমুখি পাঠ। কেননা এই কবিতায় উল্লিখিত রূপকের জটিল দিকগুলো অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ; তবে বিশ্লেষণের জন্যে চমৎকার। নানাভাবে কবিতাটি বিশ্লেষণ করা যায় আর কোনো বিশ্লেষণই চূড়ান্ত নয়।
বারবার পাঠের মধ্য দিয়ে বিপরীত যুগ্ম শব্দগুলোকে যদি আবার উল্টে দেওয়া যায়, তাহলে যুগ্মতার সূত্রে পাওয়া যায় নতুন নতুন অর্থ। একটি যুগ্ম শব্দ আবিষ্কৃত হলেই অন্য আরেকটির অর্থ পাওয়া যাবে। পাঠক এভাবেই একটি লেখাকে এগিয়ে-পিছিয়ে নানাভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেন অথবা একটি অর্থ দিয়ে আরেকটি অর্থকে স্থানচ্যুত করতে পারেন। এভাবেই চলবে স্থগনের (différrance) অশেষ খেলা। এই স্থগনই পাঠককে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ বা গুচ্ছঅর্থ পেতে দেবে না। এটি আসলে একধরনের অনিঃশেষ প্রক্রিয়া Ñ প্রত্যেকটি নতুন বিশ্লেষণ দেয় আরেকটি বা একাধিক নতুন বিশ্লেষণ। এইভাবে নতুন অর্থকে গ্রহণ করার অর্থ হলো পূর্বে যে-দৃষ্টিভঙ্গি পাঠক অর্জন করেছিল, তা স্থগিত হয়ে গেল, পাঠক অর্জন করলো আরও স্বাধীনতা। সনাতন যে-ধারণা বা মতাদর্শিক বৃত্তে তিনি আবর্তিত হচ্ছিলেন, বা হতে পারতেন, তা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখার দৃষ্টি অর্জন করতে পারেন।
শেষকথা
অবিনির্মাণ সাহিত্য সমালোচনার নতুন পথ খুলে দিয়েছে। তবে প্রতীচ্যের দর্শনচর্চা ও জীবনের অর্থ সম্বন্ধে এটি যেভাবে প্রশ্ন তুলেছে, সেই বিষয়টিকে অনেকেই ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করতে পারেননি। কেউ কেউ আবার মনে করেন, অ্যাকাডেমিক সমালোচনা রীতিকে এতদিন যারা শাসন করে আসছিলেন, সাহিত্য সমালোচনা, পাঠপদ্ধতি, ইত্যাদির অভূতপূর্ব বিশ্লেষণসূত্রে দেরিদা তাদের সেই সনাতন পদ্ধতিকে আরও গভীর ও অন্তর্ভেদী করে তুলেছেন; খর্ব হয়ে গেছে তাদের প্রাধান্য। তবে প্রায় সবারই অভিযোগ অবিনির্মাণে ব্যবহৃত পরিভাষা নিয়ে। তাদের মতে এগুলো অস্পষ্ট, জটিল, বিভ্রান্তিকর। পরিভাষা ছাড়া আরও এক ধরনের বিরোধিতা আছে অবিনির্মাণ সম্বন্ধে। একজন সমালোচক মনে করেন, অবিনির্মাণ যে পদ্ধতি ব্যবহার করে তা প্রত্যক্ষবাদী
(positivist) ও অভিজ্ঞতামূলক (empericial), ফলে অবিনির্মাণবিরোধী। তিনি লিখেছেন, আমরা সাহিত্য পড়ি কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি না; আমরা যেন বিশ্লেষণ পদ্ধতির একটা অংশমাত্র হয়ে উঠি, হয়ে উঠি সংকেত বা কোড। পাঠক একটি পদ্ধতি থেকে আরেকটি পদ্ধতিতে চলে যান, টেক্সট যেন সমালোচনার মুক্তমঞ্চ (টম্পকিন ১৯৯০)।
দার্শনিক রিচার্ড রর্টি এবং নন্দনতাত্ত্বিক-ঔপন্যাসিক উমবার্তো একো অবশ্য বলেছেন, জনপ্রিয় ব্যাখ্যা-বয়ান বা প্রতিবেদনের তুলনায় অবিনির্মাণ একটি সজীব, চমৎকার পদ্ধতি। এই দুই প্রখ্যাত নন্দনতাত্ত্বিক-দার্শনিক ভিন্ন ভিন্নভাবে অবিনির্মাণকে ব্যাখ্যা করেছেন। একোর মতে অবিনির্মাণ হচ্ছে পাঠকনির্ভর চরমপন্থী বিশ্লেষণতত্ত্ব। রর্টির ধারণা, অবিনির্মিতপাঠ টেক্সট বা রচনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত, শাসিত। এতে লেখা বলতে সেই রচনাকেই বোঝায় পাঠক যাকে গুরুত্ব দেবে, পাঠকই এর অর্থোদ্ধার করবে। তার মতে টেক্সট পাঠকের জন্যে অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে ঠিকই, কিন্তু এরও একটা সীমা থাকা উচিত। সমালোচনার সীমা না থাকলে তা অতিবিশ্লেষণের শিকার হতে পারে যা গ্রহণযোগ্য নয়। একো এবং রর্টি দুজনেরই সাহিত্য সমালোচনার অতিব্যাখ্যা নিয়ে আপত্তি করেছেন, কিন্তু অবিনির্মাণকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি। অবিনির্মাণ সাহিত্য সমালোচনায় যে বিশেষভাবে সহায়তা করে, দু-জনেই বলেছেন সেকথা (কোলিনি ১৯৯২)। বিশশতকের ভাবনাকে অবিনির্মাণ যে নতুন মাত্রা দিয়েছে, সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
টীকা
১. দেরিদার ব্যাখ্যা অনুসারে অবিনির্মাণকে তত্ত্ব বলা ভুল হবে, তবু যেহেতু এটি টেক্সট বা রচনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে, ফলে একে আমি তত্ত্ব বলেই এই লেখায় উল্লেখ করেছি।
২. শামসুর রাহমান এই little বা ‘ছোট্ট’ শব্দটিকে এড়িয়ে গেছেন। কেন যে তিনি এড়িয়ে গেলেন বোঝা মুশকিল, হয়তো অনুবাদের সাবলীলতার জন্যে, অথবা ভেবেছেন এই শব্দটি অনুবাদে না আনলে হয়তো মূল অর্থের কোনো হেরফের হবে না, কিংবা ছন্দ-মিলের কারণেও এটি বাদ পড়তে পারে। কিন্তু এই শব্দটি বাদ পড়ায় কবিতার অর্থ যে এতে অনেকটা ক্ষয়ে গেছে, সেকথা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যেত।
তথ্যসূত্র
রাহমান, শামসুর (১৯৬৫) ফ্রস্টের কবিতা, ঢাকা : সাহিত্যিকা।
স্পিভাক, গায়ত্রী চক্রবর্তী (১৯৯৭) ‘অবিনির্মাণÑঅনুবাদ‘, আকাদেমী পত্রিকা, দশম সংখ্যা, পৃ. ১৭-৩৩।
Collini, Stefan (1992) Interpretation and Overinterpretation (ed.), Cambridge: Cambridge University Press.
Crowley, Sharon (1989), A Teacher’s Introduction to Deconstruction, Urbana: National Council of Teachers of English.
Culler, Jonathan (2007) ‘Interpretation: Defending Overinterpretation,’ The Literary in Theory, Stanford: Stanford University Press.
Miller, J Hillis (1972) ‘Tradition and Difference’, Diacritics 2.4: 6-13.
Tompkins, Jane (1990) ‘A Short Course in Post-Structuralism’, in Conversations, ed. Charles Moran and Elizabeth Penfield, Urabana: National Council of Teachers of English.