
কবি চৌধুরী রওশন ইসলাম এসময়ের মৌলিক কবিদের অন্যতম। ইতোমধ্যে তাঁর প্রকাশিত হয়েছে ১. প্রতিবিম্ব (ঐতিহ্য) ২. অন্য সুখ অন্য অসুখ (ঐতিহ্য) ৩. এসব কথা বলতে নেই (সৃজন) নামে তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং দৈনন্দিন গল্প নামে একটি গল্পগ্রন্থ। ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ এই কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। ২০২৫ বইমেলায় ‘সৃজন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই কবির কাব্যভাষা তাঁর নিজের, বিষয় বৈচিত্র্যসুখ আছে তাঁর কবিতায়। বর্তমান কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতেও আছে ভিন্নমাত্রার অনুভব, যা পাঠককে স্পর্শ করবে। সমকাল যেমন অনুপস্থিত নেই তাঁর কবিতায়, তেমনি আছে প্রেমিকের মন। দৈনন্দিন জীবনের দ্বিধা, ভালো না থাকা মন খারাপের দোটানা জীবনের গান। কখনো ডুবতে ডুবতে, কখনো ভাসতে ভাসতে মৃত্যু-সংগ্রাম থেকে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করা মানুষের এক একটি কবিতা। ভিন্ন স্বাদ ও রসাবেশে মগ্ন করে রাখবে পাঠককে।
নড়াইলের নবগঙ্গা নদী তীরের কালিয়া উপজেলার প্রকৃতিতে বেড়ে উঠা চৌধুরী রওশন ইসলাম পেশার বাইরে তাঁর মনোজগত একজন কবির। তাঁর সবগুলে গ্রন্থের কবিতায় নদী, মাটি ও মানুষের ঘামের গন্ধ আছে। সহজ-সরল শব্দচয়ন, ১৪ মাত্রার পয়ারে (চতুর্দশপদী) বিশেষ অনুরাগ, যাকে তিনি বলেছেন, পদ্য-ছন্দ, অন্তমিলের দক্ষতা কবির কবিতায় ‘সুখ খুঁজে পাওয়ার’ কথাটা প্রগলভতা নয়। এক্ষেত্রে চৌধুরী রওশন ইসলাম আলাদা নির্মাণ বৈশিষ্ট্যে আলাদা হয়ে যেতে পারেন।
কাব্যগ্রন্থটিতে কবিতার সংখ্যা ৬৮। এরমধ্যে ‘পদ্য-ছন্দে’ ১৪ মাত্রার ১৪ পংক্তির অন্তমিলবিন্যাসে কবিতার সংখ্যা অধিক। এছাড়া আছে ১৬, ১৮ পংক্তির মিলের কবিতা। আছে গদ্য কবিতা। পয়ারে পর্বভাগে তিনি স্বাধীনতা নিয়েছেন। এতে কাব্য-শরীর গঠনে কিংবা অনুভবের বিন্যাসে স্বরভঙ্গ হয়নি। কবিতার আঙ্গিক নির্মাণে তাঁর নিরীক্ষা মৌলিক পর্যায়ের যা তাঁর কবিতাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। ক্রিয়াপদে সাধু শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে শ্রুতির অনুগামী বিধায় দক্ষতার গুণে কবিতার রস ক্ষুণ্ন হয়েছে বলা যাবে না। এমন উদাহরণ আছে বিস্তর।
কাব্যগ্রন্থের ভালোলাগা কিছু কবিতার পঙক্তি থেকে কবিকে তুলে আনা যেতে পারে: একটি কবিতার শিরোনাম ‘অসংলগ্ন পঙক্তি’। অন্তমিলে বিষয়ের অর্থ পরস্পর সংলগ্ন জীবনের গান। সমকালের বয়ান। বলছেন,
নেকড়ে কুকুর হায়েনারা রাস্তঘাটে অল্প
ওরা এখন মানব-মনে পেতেছে সব তল্প।…
ভাঙতে ভাঙতে মানুষগুলো টুকরো হয়ে যাচ্ছে,
নেকড়ে কুকুর হায়েনারা টুকরোগুলো খাচ্ছে।
এই কবিও প্রেমিক। জানা কথা, প্রেমহীন কবি হয় না। প্রেম তাঁর কাছে ‘স্বপ্ন রাখা সিন্দুক।’ কবি নিজে স্বপ্ন দেখে, অন্যকে দেখায়। নিজে জাগে, অন্যকে জাগিয়ে তোলে। কবি প্রথমত নিজের দেশের, একই সঙ্গে মানবতাবাদী ও বিশ্বনাগরিক। অন্যায়ে অত্যাচারে অবশ্যই প্রতিবাদী। যেজন্যে অসংখ্য মানুষ ও শিশু খুনের মাটি ফিলিস্তিনের জন্য তাঁর বুকের আগুন বারুদ হয়ে ফোটে
গ্রন্থের মুখে তিনি বলেছেন, কবিতার পাঠক নেই। তবে বিশ্বাস করেন, মানসম্পন্ন কবিতার পাঠক আছে। দুটোই সত্য কথা। পাঠক আছে তাঁর কবিতার। গল্পের মতো এমন কবিতার। যার শিরোনাম ‘উঁকি’। এমন সময়ের জন্য কেবল কবি অপেক্ষা করে,
কেউ একজন এসে আমার জানালায়
একবার উঁকি দিয়েছিল
এই দীর্ঘ জীবনে এর চেয়ে বেশি
কোনো গল্প আমার নেই।….
কপালে সিঁদুর মাখার আগে,
দু’হতে শাখা পরার আগে,
খুব অচেনা কোথাও যাওয়ার আগে,
কেন যে আমার জানালায়
একবার উঁকি দিয়েছিল, জানি না।….
বর্তমান সময় তো এমনই, কেউ ‘ভালো নেই’। রাষ্ট্র ও সমাজের অরাজক বিষণ্ন সময়ে খুব বেশি গল্প মানুষের জীবনে নেই। অথবা আছে না থাকার। জীবন অনিশ্চিত, যে জীবন মানুষ প্রতিদিন বয়ে চলে। ‘দ্বিধা’র পাথারে পড়ে থাকে মন।
কে যে ভালো আছে আর কে নাই,
হিসেব মিলছে না কারও।
কেবল নিজের গভীরে বসে,
আমি যদি আমারে শুধায়, ‘আতহার, কেমন আছ?’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একা একা বলি, ভালো নেই।….
এই সময় কবিকে যাঞ্চা করে। কবিকে কবিতা লিঞে, কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে দায়বদ্ধতা থেকে। দেশ, কাল সময় ও চারপাশের মানুষ সবশেষে নিজের কাছে তার দায় থাকে। মাটির কাছে তাঁর ঋণ আছে। কবিতা লিখে কবি কেবল একা পরিতৃপ্ত হন না, পাঠকও তাঁর কবিতার আনন্দরসে ভাসে এবং শুদ্ধতার নিরিখে কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। একজন ভালো কবি আর একজন ভালো মনুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবির চোখ অন্য মানুষের চেয়ে আলাদা।

কবিতা । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৫ । মুদ্রিত মূল্য: ১৮০ টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/445738
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮
চৌধুরী রওশন ইসলামের ভাষায়, সে কেবলই দেরি করে ফেলা মানুষ। সুযোগ সন্ধানী নয়। সব মিলেমিশে একাকারের দলে সে বিভক্ত মানুষ। ফলে তাঁর কাব্য-কথনেও থাকে অন্যভাষা। যাকে সরলতা বলা যায়। যেভাষা সারা জীবনেও কোন কোন কবি অথবা লেখকের অর্জন হয় না।
এই কবিও প্রেমিক। জানা কথা, প্রেমহীন কবি হয় না। প্রেম তাঁর কাছে ‘স্বপ্ন রাখা সিন্দুক।’ কবি নিজে স্বপ্ন দেখে, অন্যকে দেখায়। নিজে জাগে, অন্যকে জাগিয়ে তোলে। কবি প্রথমত নিজের দেশের, একই সঙ্গে মানবতাবাদী ও বিশ্বনাগরিক। অন্যায়ে অত্যাচারে অবশ্যই প্রতিবাদী। যেজন্যে অসংখ্য মানুষ ও শিশু খুনের মাটি ফিলিস্তিনের জন্য তাঁর বুকের আগুন বারুদ হয়ে ফোটে। প্রশ্ন করে,
বিধাতা, তোমার ধরা কেঁদে ভাসায় নিষ্পাপ শিশু;
ওদের জন্য কোথায় তোমার সে প্রেমময় যিশু?
অকপটে বলা যায়, ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার নির্মল জলে কাব্যপ্রিয় পাঠক অনাবিল আনন্দে অবগাহন করবে। পাওয়া যাবে কবিতার সুখ। তাঁর একাধিক ব্যঙ্গ-বয়ানেও আছে আরামের আয়াস। এযেন সময়ের হালখাতা। তথাকথিত কীর্তমান মানুষের মেরুদণ্ড পর্যন্ত খেয়ে ফেলা ‘খ্যাতির ছাগলে’র বিপুল হর্ষ-কলরব, চারিদিকের জয়গান এই সময়ের হালখাতা। নয় পর্বে বিভক্ত দ্বিপদী কবিতাটির নাম: ‘কয়েকটি ছাগল-পদ্য’। চলমান জীবনে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন চেহারা থেকে দুই পঙক্তি,
খ্যাতির ছাগল চৌদিকে ছড়িয়ে গেছে সবখানে,
গরু-ভেড়া নোয়ায়ে শিঙ আজকে তারে খুব মানে।
সত্য কথা বলার আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখার জন্য কবির কলমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ অক্ষর বিন্যাস আর কী হতে পারে! আমাদের চারিত্রিক বিপর্যয়ের এই দুর্দিনে তাই কবির আয়ু ‘প্রাথনা’ করি, প্রভু, এদেশ যতদিন, কবির পরমায়ূ হোক ততদিন।
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ‘সৃজন’। চমৎকার প্রচ্ছদ করেছে দেওয়ান আতিকুর রহমান। প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণ-বিচারি। কথার কথা নয়। ‘ডুবতে ডুবতে ভাসি’ কাব্যগ্রন্থটি হাতে নিলে অনুভব এমন হয়। আঙ্গিক ও বাঁধাই নিটোল। বইটির মূল্য: ১৮০ টাকা। কবির জন্য শুভকামনা নিরন্তর।