
২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেই সুবাদে টিএসসিতে আনাগোনা। টিএসসিতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি (ডিইউডিএস) এর কক্ষটি আমাকে খুব টানতো। মাঝেমধ্যে সেখানে বিতর্ক শুনতে যেতাম। এরপর ধীরে ধীরে আমার বিতার্কিক হয়ে ওঠা। যাই হোক সেই গল্প অন্য কোথাও হবে। টিএসসি অডিটেরিয়ামে আন্তঃহল বিতর্ক প্রতিযোগিতা চলছে। জগন্নাথ হলের সাথে অন্য একটি হলের বিতর্ক। সেখানে রাজীব সরকার নামে একজন বিতর্ক করছেন। দেখে মনে হলো এত সুন্দর বিতর্ক করা যায়! ভারি ভারি কথার মাঝে কী চমৎকার সহজ কথা বলছেন তিনি। কোনো কথায় হেসে উঠছি তো কোনো কথায় শিউরে উঠছি। রাজীব’দার বিতর্কের ধাঁচ অন্যদের চেয়ে আলাদা। বিতর্ক যে শুধু নিরেট যুক্তিই নয়, এখানে কথার মাঝে রসালো যুক্তিতে অন্যকে পরাস্ত করা যায় সেটা রাজীব’দার বিতর্কের মাঝেই পেয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল এই মানুষটির সাথে আমার পরিচিত হতে হবে।
সে সময় হলকেন্দ্রিক বিতর্ক চর্চা সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিলনা। একদিন রাজীব’দা বললেন ‘হলের হয়ে বিতর্ক করোনা কেন? এখানে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ বেশি।’ তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় এক বছর পর হলে উঠলাম। হলকেন্দ্রিক বিতর্ক চর্চার শুরুর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাজীব’দার সান্নিধ্য পাওয়া। তার কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে সুন্দর কথা আর যুক্তির মাধ্যমে একজন অতি সাধারণ মানুষের কাছেও বিতর্কের সৌন্দর্য পৌঁছানো যায়। আমার মনে আছে রাজীব’দা যখনই টিএসসির মুক্ত আকাশে বা রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিতর্ক করেছেন সেখানে সবাই দাঁড়িয়ে তার কথা শুনেছে। এমনকি একজন নিরক্ষর রিক্সাচালকও তার বিতর্ক শুনে অন্য শিক্ষার্থীদের সাথে সমান আবেগ প্রকাশ করেছে। এখানেই রাজীব’দা অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র।
শুধু টেলিভিশন বিতর্ক নয়, যেকোনো প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ হল প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায় তার নেতৃত্বে
যখন রাজীব’দা জগন্নাথ হলের বিতর্ক ক্লাব ‘বিতর্ক একটি তার্কিক সংগঠন’ এর সভাপতি তখন তার কাছে সব চেয়ে বেশি শেখা হয়েছে। কীভাবে বিতর্কের স্ক্রীপ্ট তৈরি করতে হয়, একটা বাক্য কীভাবে সাজালে সেটা অন্যদের কাছাকাছি আরো সুন্দরভাবে পৌঁছে সেটা তার কাছেই শিখেছি। সবচেয়ে বেশি শিখেছি জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিতর্ক করার সময়। রাজীব’দা আমাদের দলনেতা ছিলেন। ধারালো আর রসঘন যুক্তিতে প্রতিপক্ষকে কীভাবে পরাস্ত করতেন সেটা তার কাছ থেকে দেখেছি। বিতার্কিক হিসেবে এটা আমার সৌভাগ্য যে তার সাথে একই দলে বিতর্ক করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, রাজীব’দা না থাকলে আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারতামনা। শুধু টেলিভিশন বিতর্ক নয়, যেকোনো প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ হল প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায় তার নেতৃত্বে। বাংলা, ইংরেজী দুই ধরনের বির্তকেই তিনি জগন্নাথ হলকে সাফল্য এনে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং তিনি শ্রেষ্ঠ বক্তার মর্যাদা পেয়েছেন।
বিতর্ক চর্চায় এখন পর্যন্ত যতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে রাজীব’দার ‘যুক্তি+তর্ক=বিতর্ক’ বইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিকদের কাছে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এখনও এই বইটি থেকে সহায়তা নিই। এছাড়াও তাঁর বিতর্কের অন্য বইগুলোও যেমন ‘বিতর্কের প্রথম পাঠ’ কলেজ পর্যায়ের বিতার্কিকদের জন্য, ‘এসো বিতর্ক শিখি’ স্কুল পর্যায়ের বিতার্কিকদের জন্য লেখা। এই তিন স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য এই তিনটি বই সবার কাছে বিতর্কের অন্যান্য বইগুলোর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়

বিতর্ক চর্চায় এখন পর্যন্ত যতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে রাজীব’দার ‘যুক্তি+তর্ক=বিতর্ক’ বইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিকদের কাছে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এখনও এই বইটি থেকে সহায়তা নিই। এছাড়াও তাঁর বিতর্কের অন্য বইগুলোও যেমন ‘বিতর্কের প্রথম পাঠ’ কলেজ পর্যায়ের বিতার্কিকদের জন্য, ‘এসো বিতর্ক শিখি’ স্কুল পর্যায়ের বিতার্কিকদের জন্য লেখা। এই তিন স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য এই তিনটি বই সবার কাছে বিতর্কের অন্যান্য বইগুলোর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। রাজীব’দার অন্যান্য চিন্তামূলক প্রবন্ধের বইগুলো যেমন- ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ’, ‘নিহত রবীন্দ্রনাথ’, ‘উগ্রবাদ, ফ্যাসিবাদ ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘সাহিত্য ভাবনায় সেকাল একাল’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’-এই বইগুলো একইসাথে সব বয়সী পাঠককে টানে।
এনটিভিতে প্রচারিত ‘দ্বন্দের ছন্দে’ রাজীব’দার অসাধারণ কাজ। তাঁর নির্দেশনায় ছত্রিশ পর্বের রম্য বিতর্ক অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে রম্য বিতর্কের একমাত্র ধারাবাহিক অনুষ্ঠান। সাহিত্য নিয়ে টেলিভিশনে বিতর্ক করা যায় এবং সেটি অন্য যেকোনো বিতর্ক অনুষ্ঠানের চেয়ে জনপ্রিয় হয় সেটি রাজীব’দাই করে দেখিয়েছেন। নিরীক্ষাধর্মী বিতর্কে রাজীব’দার বিকল্প নেই। বিভিন্ন প্রদর্শনী বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য তিনি জনপ্রিয় এবং সবার আগে রাজীব’দাকেই আমরা খুঁজি। পরিশীলিত যুক্তি ও কৌতুকরসের মাধ্যমে তিনি রম্য বিতর্কে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন।
তাঁর নির্দেশনায় ছত্রিশ পর্বের রম্য বিতর্ক অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে রম্য বিতর্কের একমাত্র ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আয়োজনে বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবর্ষ পূর্তিতে বিতর্ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই মহাপুরুষকে উপস্থাপন করার অভিনব কৃতিত্ব দেখিয়েছেন রাজীব’দা। ২০১১সালে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে চ্যানেল আইয়ে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রভিত্তিক বিতর্ক আয়োজন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন তিনি। আমি সৌভাগ্যবান যে দুটি বিতর্কেই অংশগ্রহণ করেছি। তিনি সব সময় বলেন, জয়-পরাজয় নয়, বিতার্কিকের চূড়ান্ত অর্জন মননে ও ব্যক্তিত্বে যুক্তিবাদী হওয়া।
সাহিত্য নিয়ে টেলিভিশনে বিতর্ক করা যায় এবং সেটি অন্য যেকোনো বিতর্ক অনুষ্ঠানের চেয়ে জনপ্রিয় হয় তা রাজীব’দাই করে দেখিয়েছেন
রাজীব’দার যে গুণটি আমাকে বেশি টানে তাহলো মানুষকে টেনে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা। অন্যকে ভালোবাসার অসাধারণ গুণ তাঁর। পেশাগত জীবনে তিনি সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এই পরিচয়টি তাকে ভালোবাসা বা সম্মান জানানোর জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তরুণ ছেলেমেয়েদের নিয়ে সবসময় তার সুন্দর ভাবনা ও দেশের জন্য কিছু করার তার প্রবল ইচ্ছা। ছাত্রজীবনের মতো পেশাগত জীবনেও তিনি বিতর্কসহ নানা সৃজনশীল আয়োজন ও যুক্তিচর্চার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে যুক্তিবাদী ও আলোকিত মানুষ হতে প্রেরণা যোগাচ্ছেন। এদেশের বিতর্কশিল্পে তিনি একটি নতুন দর্শনের জন্ম দিয়েছেন-জোরের যুক্তি নয়, যুক্তির জোর চাই।
আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা’র অমিত রায়কে অন্তর থেকে ধারণ করেন রাজীব’দা। তা না হলে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে যতবার অমিত-লাবণ্য নিয়ে বিতর্ক হয়েছে ততবার রাজীব’দা নিজেকে অমিত রায় বলে উপস্থাপন করবেন কেন? রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের সব চরিত্রেই রাজীবদা সাবলীল। আমি বিশ্বাস করি, সব্যসাচী বিতার্কিক হিসেবে রাজীব’দা একক ও অনন্য।