
শীতকাল যখন ফেসবুকে প্রথম পা রাখল, তার অনুভূতি ছিল একেবারে মিশ্র। সে জানে, শীতের সঙ্গেই জন্মেছে তার পরিচিতি— কুয়াশা, সাদাকালো দৃশ্যপট, আর বিষণ্ণতার মোড়কে জড়ানো অনুভূতির কথা। তবু সে মনে করে, শীত মানেই বিষণ্ণতা নয়। শীতের বুকে উষ্ণতার যে আলিঙ্গন, তার গল্প মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে। কুয়াশার একটা সাদাকালো ছবি আপলোড করতে চেয়েছিল প্রথমে। কিন্তু মনে হলো, মানুষ ভুল বুঝবে। ভাববে, বিষণ্ণতা নিয়ে এসেছে সে। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে তার জীবনে কত যে অধ্যায় লেখা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
সেদিন সন্ধ্যায়, প্রোফাইল পিকচার নিয়ে যখন সে ভাবনায় মগ্ন, তখন জানালার পাশে বসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে নরম কম্বলে মোড়ানো এক স্মৃতি তার মনে ভেসে ওঠে। মনের কোণে জমে থাকা স্মৃতির তাপ ছুঁয়েই তার সিদ্ধান্ত হলো— প্রোফাইল পিকচার হবে উষ্ণতার গল্প বলার এক মাধ্যম। তাই সে বেছে নিল সেই রোদ ঝলমল শীতের সকালের ছবি, যেখানে সূর্যের আলো মাঠের ওপর নরম কম্বল বিছিয়ে দিয়েছে। ছবির মধ্যে লুকিয়ে ছিল একধরনের বেঁচে থাকার গল্প। ‘এটাই হবে প্রোফাইল পিকচার,’ নিজেকে বলে। কিন্তু পরক্ষণেই সন্দেহ, রোদটা কি শীতের সঙ্গেই আছে, নাকি বসন্তের দিকে চলে যেতে ব্যস্ত?
শীতকাল কিন্তু বড় মজার। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে সে এক তৃতীয় সত্তার মতো বসে থাকে। চুপচাপ। কখনো দেখায়, সে জীবনকে ভালোবাসে— তুষারের দেশে উষ্ণ চায়ের কাপ, গরম জামার আলিঙ্গন, বা লেপের নিচে স্বপ্নের মিছিল। কিন্তু এই ভালোবাসার মধ্যেও কোথাও মৃত্যুর ছায়া লেগে থাকে। যেমন, মাঠে খেলতে বেরোনো শিশুরা আর ফিরল না। বরফে জমে থাকা একাকী ঘর, যেখানে আগুন নিভে গেছে। শীত তাই জীবনের বন্ধু, কিন্তু মৃত্যুরও।
ফেসবুকের ‘হোয়াটস অন ইওর মাইন্ড’ বক্সে প্রথমবার সে কী লিখবে, তা নিয়ে শীতকালের হিমশীতল হাত কাঁপে। সে লিখতে চায়: ‘আমি এলাম। কিন্তু তুমিই বলো, কার জন্য?’ কিন্তু আবার মুছে দেয়। যেন একটা নিঃশব্দ রেস চলছে তার ভেতরে। কী লিখলে সবাই বুঝবে, সে জীবনকে ভালোবাসে এবং মৃত্যুকেও ভয় পায় না?
তারপর লিখল: ‘উষ্ণতার গল্প শোনাতে এসেছি।’
এই বাক্যের পেছনে লুকিয়ে ছিল এক গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। শীতের জন্য উষ্ণতা যেন এক প্রতীক। সেই প্রতীকের গল্প বলার জন্য শীতকাল তার জীবন থেকে ক’টি অধ্যায়ের কথা মনে করতে শুরু করল।
শিশিরের উষ্ণতা: শীতের সকাল মানেই মাটিতে জমে থাকা শিশির। মাটির বুকে জমে থাকা সেই ছোট্ট বিন্দুগুলো যেনো আকাশের কান্না— অথবা হয়তো আনন্দাশ্রু। সূর্যের প্রথম কিরণ যখন তাদের ছুঁয়ে যায়, তখন মনে হয়, তারা হাওয়ার ডানায় ভর করে ফিরে যাচ্ছে শূন্যে। শীতকালের মনে পড়ে ছোটবেলায় সে এই দৃশ্য দেখে ভাবত, শিশিররা বোধহয় নিজের গল্প নিয়ে ফিরে যায় আকাশে। তখন তার দাদু বলেছিল, ‘শিশির তো জীবনের গল্প। শীত তাকে সময় দেয় আর সূর্য তাকে মুক্তি দেয়।’ শীতকাল তাই এখনো মনে করে, শিশিরে লুকিয়ে থাকা সেই উষ্ণতার গল্প, যা বোঝে কেবল সকালের সূর্য।
মনের কোণে জমে থাকা স্মৃতির তাপ ছুঁয়েই তার সিদ্ধান্ত হলো— প্রোফাইল পিকচার হবে উষ্ণতার গল্প বলার এক মাধ্যম। তাই সে বেছে নিল সেই রোদ ঝলমল শীতের সকালের ছবি, যেখানে সূর্যের আলো মাঠের ওপর নরম কম্বল বিছিয়ে দিয়েছে। ছবির মধ্যে লুকিয়ে ছিল একধরনের বেঁচে থাকার গল্প
এক চাদরের বন্ধুত্ব: স্কুলজীবনের এক শীতের সন্ধ্যার কথা শীতকালের খুব মনে পড়ে। পরীক্ষার পর সবাই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে বাসার ছাদে সিনেমা দেখার আয়োজন করেছিল। সবাই মিলে একটাই কম্বল টেনে একসঙ্গে বসে মুভি দেখা! ঠান্ডা বাতাসে গা শিউরে উঠছিল, কিন্তু সেই কম্বল তাদের এতটাই কাছাকাছি এনে দিয়েছিল যে শীতের পরশ আর টের পাওয়া যাচ্ছিল না। শীত মনে করেছিল, মানুষের উষ্ণতার গল্পগুলোই তাকে বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। মানুষের উষ্ণতা কেবল তাপমাত্রায় নয়, ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের ছোঁয়াতেও।
উনুনের চারপাশে একত্র হওয়া: উনুনের চারপাশে সম্পর্কের গল্প গ্রামের উঠোনে উনুন জ্বালিয়ে সবাই মিলে বসার দিনগুলো আজকের ব্যস্ত শহরের মাঝে এক সোনালী স্মৃতি হয়ে আছে। আগুনের তাপে শরীর গরম করার অজুহাতে সবাই একসঙ্গে জমায়েত হত। কে কাকে কী বলে ঠাট্টা করছে, কার গায়ে কুয়োর পানি ছুঁড়ে দেওয়া হলো— এই সব ছোটো ছোটো মুহূর্তে শীতকাল প্রথম বুঝতে শিখল, উষ্ণতা আসলে মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের আরেক নাম। উনুনের তাপ যেন কেবল শারীরিক নয়, সম্পর্কেরও উষ্ণতা ছড়িয়ে দিত। মানুষে মানুষে জড়িয়ে থাকা গল্প, আনন্দ আর ভালোবাসার টান শীতের সমস্ত শীতলতাকে হারিয়ে দেয়।
সেই সব অধ্যায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই শীতকাল বুঝতে পারে, ফেসবুকে তার উপস্থিতি কেবল নিজের পরিচিতি প্রকাশের জন্য নয়। তার লক্ষ্য হলো, হারিয়ে যাওয়া উষ্ণতার গল্পগুলোকে আবার নতুন করে মানুষের মনে জাগিয়ে তোলা।
একবার জীবনকে মেসেজ করেছিল শীত: ‘আমি আসব, তুমি তৈরি তো? চলো, একটু সময় কাটাই। লেপের নিচে গল্প বলি, গরম চায়ে স্নেহ দিই।’
জীবন উত্তর দিয়েছিল: ‘তুমি এলেই তো আমি আলসেমিতে ঢেকে যাই। কাজ ফেলে কেবল আরাম খুঁজি। তবু এসো। তোমার স্নেহ ভালো লাগে।’
অন্যদিকে, মৃত্যুর সঙ্গেও শীতের এমন কথোপকথন হয়: ‘তুমি কেন এমন কঠোর? আমি তো নরম হতে এসেছি।’
মৃত্যু হেসে বলে: ‘তোমার নরমের মধ্যেই তো আমার কঠোরতা লুকিয়ে। বরফে জমে থাকা শ্বাস তো তোমারই সৃষ্টি।’
একদিন শীতকালের মনে হলো, সে তো সবাইকে দেবে, কিন্তু কে তাকে কিছু দেবে? সে একা। মানুষ আসে তার কাছে, কিন্তু তার কথাগুলো শোনে না। আর শীতকালও কাউকে কিছু বলে না। তার প্রোফাইলের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, সে খুব কম পোস্ট দেয়।
শীত যখন দেয়াল টুকে লিখে ফেলে: ‘তোমাদের ছোঁয়ার জন্যই আছি। কিন্তু তোমরা কি সত্যি আমাকে অনুভব করো?’ লাইক পড়ে অনেক। মন্তব্য আসে রকমারি। কেউ লিখে: ‘তোমার কুয়াশা বড্ড বিষণ্ণ, কিন্তু আমি ভালোবাসি।’ কেউ বলে: ‘তোমার ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া গায়ে কাঁটা দেয়, কিন্তু আবার অপেক্ষা করি।’ শীতকাল এইসব পড়ে আর হাসে
তবু শীত যখন দেয়াল টুকে লিখে ফেলে: ‘তোমাদের ছোঁয়ার জন্যই আছি। কিন্তু তোমরা কি সত্যি আমাকে অনুভব করো?’ লাইক পড়ে অনেক। মন্তব্য আসে রকমারি। কেউ লিখে: ‘তোমার কুয়াশা বড্ড বিষণ্ণ, কিন্তু আমি ভালোবাসি।’ কেউ বলে: ‘তোমার ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া গায়ে কাঁটা দেয়, কিন্তু আবার অপেক্ষা করি।’ শীতকাল এইসব পড়ে আর হাসে। ভাবে, মানুষ আসলে তাকে বুঝতে পারে না।
শীতের ফ্রেন্ডলিস্টে বসন্ত আর গ্রীষ্মের জায়গা পাকা। বসন্তকে সে সবচেয়ে ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসা অনেকটা ভাইবোনের মতো। একে অন্যকে ছাড়া টিকে থাকা যায় না। গ্রীষ্মের সাথে অবশ্য তার একট প্রতিযোগিতা চলে। গ্রীষ্ম মাঝে মাঝে তাকে ঠাট্টা করে: ‘তুমি এতদিন ধরে মানুষের কাছে গিয়েও তাদের মন জিততে পারলে না। দেখো, আমার জন্য তারা তৃষ্ণায় ছটফট করে, কিন্তু তারপরেও আমাকেই পছন্দ করে।’
শীত বলে: ‘তুমি জানো না, আমি যখন আসি, তখন মানুষ সবচেয়ে বেশি আরাম খোঁজে। তোমার তৃষ্ণার মতোই আমার আরাম মেলে তাদের।’
শীতের সকালে কুয়াশা যেন এক রহস্যময় দৈত্য, যা গ্রাস করে ফেলে মানুষের দৃষ্টিশক্তি, রাস্তা-ঘাট, বাড়িঘর, শহরের অলিগলি, এমনকি তাদের চিন্তাভাবনাও। যানবাহনগুলো তার জালে আটকা পড়ে থেমে যায় কিংবা গতি হারিয়ে ফেলে, যেনো সেই দৈত্য তাদের চলার শক্তি শুষে নিয়েছে। কেউ তাকে তাড়াতে পারে না— শুধু সময়ের সঙ্গে সূর্যের উষ্ণ আলো তার অস্তিত্বকে মুছে দেয়। তবু সে জানে, এই সরে যাওয়া সাময়িক; রাত পোহালে আবার সে ফিরে আসবে, আবার সবকিছু গিলে ফেলবে তার তৃষ্ণার্ত চোয়াল।
পায়ের কাছ থেকে হালকা চালে টেনে নেওয়া কাঁথা, শিউলির চলে যাওয়া, মাঝে মাঝেই ঠান্ডা-জ্বরে কাবু হওয়া বাঙালি আর আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে মনকেমনের একটা মিল আছে হয়তো। বলা যায় কিছু মিষ্টি দুঃখ! যে দুঃখ কখনো চোখে দেখা যায় না, তবু অনুভবে গভীরভাবে স্পর্শ করে; মনে এক অব্যক্ত দোলাচলের সুরও এনে দেয়। সেই সুর যেনো এক পুরনো রাগের মতো— অর্ধেক শোনা, অর্ধেক হারিয়ে যাওয়া।
এভাবেই এগিয়ে চলা শীত কখনো গল্প শেষ করে না। তার গদ্যভাষা থামে না, এগিয়ে চলে এক অনন্ত স্রোতের মতো। কখনো বরফ হয়ে জমে, কখনো রোদ হয়ে গলে, আবার কখনো হিমেল বাতাস হয়ে মিশে যায় চারপাশে। শীতের প্রতিটি মুহূর্তে যেনো লুকিয়ে থাকে এক রহস্যময় কবিতা। কোনো অজানা ডায়েরির পাতায় লেখা তার পরিচয়— ‘আমার নাম শীত। আমি জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক অসীম সেতু।’
এই একটি বাক্যেই যেনো শীতের সব গল্প লুকিয়ে। সে সময়ের শরীরে গভীর আঁচড় কেটে স্মরণ করিয়ে দেয়— জমাট বাঁধা যন্ত্রণা একদিন গলে যেতে পারে, আর গলে যাওয়া সুখ আবার কঠিন হয়ে ফিরে আসতে পারে। শীত, তাই শুধু একটি ঋতু নয়; সে এক অনন্ত রূপক, যেখানে সময়, সুখ-দুঃখ আর জীবন-মৃত্যুর মেলবন্ধন বুনে যায় এক অমলিন কাব্য।