
কবিতা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, চিন্তা ও স্বপ্নের সমাহার। কবির চিন্তায় থাকে বৈচিত্র, থাকে দেখার ভিন্নতা। সাধারণের কাছে চাঁদ নেহাৎ চাঁদই থাকে। কিন্তু কবির কাছে চাঁদ হয় কাস্তের মতো, ডাবের মতো, কখনও ঝলসানো রুটির মতো। আবার এক কবি থেকে আরেক কবির দর্শনও পৃথক হয়। একই গোলাপ প্রেমিককে আনন্দ দেয়, বিরহীকে বেদনাকাতর করে। কবি হাজার বছর ধরে পথ হাঁটতে পারেন, কবি দ্যুলোক-ভূলোক ছেদন করতে পারেন। কবির উপস্থিতি স্বর্গ-মর্ত্য-নরক-পাতাল সর্বত্র।
কবির মানস গঠন প্রক্রিয়া রয়েছে। চিন্তা, দর্শন, উপমা, রূপকল্প, প্রেম, ঘৃণা তিনি জীবন থেকেই সংগ্রহ করেন। বেড়ে ওঠা, সুখ-দুঃখ, অনির্বচনীয় আনন্দ, বিপন্নতা কবিকে ঘিরে থাকে। সেসব শব্দের শাড়ি পরে রূপ নেয় কবিতায়। সম্প্রতি পড়েছি শাহ বুলবুল-এর কাব্যগ্রন্থ মৃত্যু ও নির্বাসন। বইটি পড়ে কবির ভাবনার জগৎ উপলব্ধি করা যায়।
শাহ বুলবুলের কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আবাহমান বাংলা। সাবলীল ভাবে আছে আঞ্চলিকতার উপস্থাপন। আলোচ্য গ্রন্থের অনেক কবিতা ধারণ করে আছে গ্রামীণ জনপদ, স্মৃতি-বিস্মৃতির সাতকাহন। এসব কবিতার মধ্যে ‘পুঁতির বয়সী বালিথুবা’, ‘মেঘের মাদুলি মন’, ‘ এক গাদা ভুলের আউশ’, ‘একটি নৌকো মৃত্যু’, ‘পলিপাড়ার নিনাদি জল’, ‘শ্রাবণের কবিতা’, ‘চরপোড়ামুখী এবং গুপ্তচর পথিক’ ইত্যাদি।কবিতাগুলোয় পল্লী-প্রকৃতির অনুষঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে সুখ-দুঃখ, প্রেম-আক্ষেপের মিশেলে। তিনি প্রকৃতিকে ধরতে পেরেছেন শব্দজালে। এর কারণ তিনি নিজেও পল্লীমায়ের আদুরে সন্তান। তাই তো তিনি লিখতে পেরেছেন: ‘আমিও হেঁটেছি মানুষের প্রাচীর বেয়ে/ কোটি কোটি বছর নিতান্ত পল্লীজীবনের সাথে।’ এ কারণেই কলমিলতার বিল, খেয়াঘাট, গরুর গাড়ি, সুপারি বন, হলুদ ঘাস, পালকি, বরইতলা, কলাপাতাঘর, মরা নদী, বাঁশবন, কুমড়ো লতা, বনচালতা, বালুচর, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, ভাতের ফেন, ঝিঙে মাচা ইত্যাদি বিষয় তার কবিতাজুড়ে দৃশ্যকাব্য তৈরি করেছে। ফলে কবিতা হয়ে উঠেছে মাটি ঘেঁষা এবং চিত্রকল্প দৃশ্যময়। দহন, স্থানান্তর, বিস্মৃতি থাকলেও কবি তাই শেষ পর্যন্ত ফিরতে চান গ্রামের কোলে—
একদিন ফিরবোই দূরের কোন গাঁয়ে
সোঁদামাটির বাউন্ডেলে পথ এক ফালি হেমন্ত ঘুরে
সন্ধ্যা নামা পাহাড়ি লতার ভিড়ে।
(একদিন এলোকেশীর পালকিতে)
কাব্যগ্রন্থটি পড়ার সময় প্রথমদিকে মনে হয়েছিলো এ যাত্রা একরৈখিক। তবে ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। দ্রোহ, প্রতিবাদ, সংগ্রাম কাব্যগ্রন্থটির সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করেছে। আমরা দেখি, ফিলিস্তিনের জন্যে কবির মন কাঁদে। তিনি সচেতনভাবে হয়ে ওঠেন শোষকের বিপরীতে অকুতোভয় বিপ্লবী। লিখেন অগ্নিকথা। কখনও মনে হয় অবহেলিত কৃষকের কণ্ঠই যেন তাঁর কণ্ঠ। কবি অকপটে বলেন:
মনে রেখো…
আবার সংগ্রামী হবে লাঙল জোয়াল
আরেকবার বিপ্লব হবে— আসুক বিপ্লবী ডাক।
(মনে রেখো)

কবিতা । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৪ । মুদ্রিত মূল্য: ২৫০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/383661
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮
দহন শাহ বুলবুলের কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। দহনের কারণ নানাবিধ। প্রেম বিরহ তো আছেই, স্বপ্নহীনতার দহনও কম নয়। অনেক কবিতায় এই দর্শনকে ধারণ করে আছে। জীবন ও প্রেমের অতলে ডুবে যেতে যেতে কবি বলে যান দার্শনিক উপলব্ধি। জীবন ও মৃত্যু, ভেতর ও বাহির এই স্রোতে একাকার। ‘নামতায় মৃত্যু পাঠ’ কবিতায় রয়েছে বিরহ-স্বপ্নহীনতার দ্বৈত উচ্চারণ:
আমি, আমরা দু’জন…সর্বগ্রাসী প্রতিটি মৃত্যুর রাতে
ছুঁয়ে দেখি নীলচে অতীত খুব বেশি স্বপ্নহীন।
নামতা শব্দটি বোধ করি কবির খুব প্রিয়। তাই এ শব্দটি খুব শক্তভাবে হানা দেয় শাহ বুলবুলের কবিতায়। যেমন:
ক) …অনেক অনেক দূরে
ছিন্ন ভিন্ন নামতায় মৃত্যুপাঠ।
(নামতায় মৃত্যু পাঠ)
খ) কী লাভ প্রতিরাতে জোরে জোরে নামতা পড়ে।
(ভুলে ভুলে যোগ কষ্ট দিয়ে গুণ)
গ) দেবী। অত নামতা পড়ে কী লাভ
বল না— ‘ভালোবাসি’।
(নির্বাসনে যাবার আগে)
অল্প পরিমাণে হলেও কবিতায় মিথের ব্যবহার রয়েছে। কবিতার বক্তব্যকে উপস্থাপন করতে এসেছে বেহুলা, লখিন্দর, কারবালা ইত্যাদি।
কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘মৃত্যু ও নির্বাসন’ শুনলে বিষাদগ্রস্ত মুখ দৃশ্যপটে ভেসে উঠবে। কিন্তু কবিতাগুলোতে বিষাদ-বেদনার গভীরে রয়েছে আশা জাগানিয়া গান। নিজেকে, প্রিয়তমাকে এবং মাটি ও মানুষের প্রকৃত সত্তাকে ধারণ করার প্রয়াস কবির মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে।
শাহ বুলবুলের ‘মৃত্যু ও নির্বাসন’ প্রকাশ করেছে সৃজন প্রকাশনি। এতে প্রায় সত্তরটি কবিতা রয়েছে। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৪। প্রচ্ছদ দেওয়ান আতিকুর রহমান। ৮০ পৃষ্ঠা। মূল্য ২৫০ টাকা। পরিবেশক ঐতিহ্য ও মাত্রা প্রকাশ।