Author Picture

শহীদ সাবেরের আরেক দুনিয়া

মযহারুল ইসলাম বাবলা

সময়টা পাকিস্তান আমল। এক কোরবানি ঈদের দিন। পুরানা পল্টন লেনের দাদার বাড়িতে দুপুরের পর শাহজাহান চাচার সঙ্গে ক্যারাম খেলছিলাম মহিউদ্দিন মন্টু ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু চাচার বেড়ার ঘরসংলগ্ন বেলিম্বু গাছের ছায়ায়। ক্যারাম খেলায় এতটাই মশগুল ছিলাম যে পাশে দাঁড়ানো কারও উপস্থিতি টের পাইনি। বিশ্রী দুর্গন্ধে পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম। ময়লা-ছেঁড়া প্যান্ট-শার্ট। মাথা আর মুখভর্তি এলোমেলো চুল-দাড়ি।

অপরিষ্কার হলুদ দাঁত, বড় বড় হাতের নখ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের আগুন হাতের আঙুল স্পর্শ করলেও সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। পাগল দেখে কিশোর বয়সে ভয় পাওয়ারই কথা।

আমিও ভয় পেয়ে খেলা ছেড়ে স্থান ত্যাগে উদ্যত। শাহজাহান চাচার অভয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছি, তবে ভয়ে ভয়ে। লোকটি নিঃশব্দে আমাদের খেলা উপভোগ করছেন। বড়ই শান্ত ও নির্বিকার। এতে ভয় কমে এলো। আমি খুব ভালো ক্যারাম খেলতাম। আমার ক্যারাম খেলা বেশ উপভোগ করে আমার দিকে তিনি প্রসন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।

চোখে-মুখে খুশি খুশি ভাব। শাহজাহান চাচা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দুপুরের খাবার এখানে খেয়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে, সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিলেন কোনোরূপ শব্দ ও বাক্য ব্যয় না করে।

খেলায় এতটাই মত্ত ছিলাম যে খেয়ালই করিনি কোন ফাঁকে পাগল মানুষটি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। লোকটির নিঃশব্দ প্রস্থানে আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে আশ্বস্ত হই। আমার পাশে যতক্ষণ ছিলেন বিশ্রী দুর্গন্ধ আমাকে যথার্থই অস্বস্তি দিচ্ছিল।

লোকটির পরিচয় শাহজাহান চাচাকে জিজ্ঞেস করলে খেলায় ব্যস্ত শাহজাহান চাচা শুধু ‘মামা’ বলেই আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য লোকটিকে আমার একটুও ভালো লাগেনি।

এর কিছুদিন পর বাবার সঙ্গে জিন্নাহ এভিনিউ থেকে হেঁটে পুরানা পল্টন লেনে দাদার বাড়ি যাচ্ছি। বর্তমানের হাউস বিল্ডিং অতিক্রম করছি, হঠাৎ সেই পাগল লোকটি আমার বাবাকে মৃদুস্বরে ‘মামা’-‘মামাবলে পথ আগলে দাঁড়ায়। আমার বাবা-‘আরে সাবের কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করলে, মাথা ওপর-নিচ নেড়ে ভালো আছেন জানান। আমার বাবার উদ্দেশ্যে পুনরায় ‘মামা-মামা’ বলে মাথা চুলকালেন। আমার বাবা তার উদ্দেশ্য আঁচ করে একটি টাকা হাতে ধরিয়ে দেন। টাকা পেয়ে ভীষণ খুশি, এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত উল্টো পথে পাড়ি জমান।

আমার বাবা বিষণ্ণ চোখে লোকটির এই দ্রুত চলে যাওয়া বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলেন। বাবাকে লোকটির পরিচয় জিজ্ঞেস করলে; বাবা ওই চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে চেয়েই বিষণ্ণভাবে বললেন-‘খাদ্যরসিক ভোজনবিলাসী সালামত উল্লাহ নানার কথা শুনিস নাই? আজিমপুর কলোনিতে থাকতেন। সালমাত উল্লাহ নানার বড় ছেলে সাবের। পেয়ারুর বড় ভাই।’

পেয়ারু ভাইকে চিনি-জানি; কিন্তু সাবের নামের তার এই ভাইকে তো চিনি না। দাদার বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে ফেরার পথে রিকশায় বাবাকে অতি আগ্রহে পাগলটি সম্পর্কে জানতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকি। বাবা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। তার নাম একেএম শহীদুল্লাহ, ডাক নাম সাবের।

শহীদ সাবের নামেই ছিল তার লেখক পরিচিতি। লেখক-সাংবাদিক। ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকায় চার বছর জেল খেটেছেন। জেল থেকেই আইএ পাস করে পরে বিএ পাস করেছেন। সিএসপি এবং সিআইএস পরীক্ষায় পাস করেও জেলখাটা রাজনীতিক বলে সরকারি চাকরি পাননি। নিজ পছন্দের এক জমিদার কন্যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও জেল ফেরত কমিউনিস্ট বলে সেই জমিদার কন্যাকে বিয়ে করা হয়নি। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার নামকরা সাংবাদিক ছিলেন।

সরকারি চাকরি, প্রতিষ্ঠা, বিয়ে কোনোটি না হওয়ায় অজানা কারণে মানসিক সংকটে পাগল হয়ে যান। সালামত উল্লাহ নানার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর দুই ছেলে সাবের ও পেয়ারু। অসম্ভব মেধাবী সাবের কেন এমন হয়ে গেলেন কেউ তা জানে না। সৎমায়ের সংসারে বেড়ে ওঠা সাবের ও পেয়ারু।

সৎমায়ের সংসারে থাকলে যা হয়; এদের দু’ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এদের দুই ভাইয়ের প্রতি অন্যায় আচরণের জন্য এদের সৎমাকে আমার বাবা নাকি রাগে-ক্ষোভে অতিষ্ঠ হয়ে শাসন করতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সাবের বইও লিখেছেন। বেরুনো দুটি বই নিজ হাতে লিখে উপহারও দিয়েছিলেন বাবাকে। বই দুটি এখনও বাসায় আছে তার স্মৃতিস্বরূপ।

বন্দিদের আতঙ্কগ্রস্ত করা এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্যই দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে কমিউনিস্ট বন্দিদের রাজশাহী কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। রাজশাহী জেলের সর্বকনিষ্ঠ রাজবন্দি ছিলেন শহীদ সাবের।

বাসায় ফিরে বাবার সেল্ফ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বই দুটি উদ্ধার করি। কালো মেয়ের স্বপ্ন এবং এক টুকরো মেঘ দুটি বইয়ের ভেতরের পাতায় তার স্বহস্তে লেখা, ‘সিরাজ মামাকে, স্নেহভাজন সাবের।’ পাগল নোংরা লোকটির প্রতি আমার সব ভালো না লাগা নিমিষে উধাও। অপ্রকৃতিস্ত মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বিশাল জায়গা মুহূর্তে তৈরি হয়ে যায়। তার সম্পর্কে জানার কৌতূহল মিটাতে সম্ভাব্য সব সূত্রের মুখোমুখি হয়েছি। জেনেছি শহীদ সাবেরের বৈচিত্র্যপূর্ণ দ্রোহী জীবন।

১৯৩০ সালের ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁওয়ের সোনাপুকুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্ম এবং ঈদগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় নিজ মাকে ছেড়ে পিতার কাছে সৎমায়ের সংসারে কলকাতা চলে যান। কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হয়ে বরাবরই ক্লাসের সেকেন্ড বয় হিসেবে পরিচিতি পান।

ছন্দ শিখা নামক হাতে লেখা পত্রিকার মাধ্যমেই তার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। মুকুল ফৌজেও যুক্ত ছিলেন। আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেহাদে স্কুলছাত্র শহীদ সাবেরের প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে ইত্তেহাদে তার লেখা গল্পও ছাপা হয়েছিল। ইত্তেহাদ পত্রিকার সাহিত্যপাতা দেখতেন জহুরি সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবিব।

কবি আহসান হাবিব শহীদ সাবের সম্পর্কে বলেছিলেন- অমন সপ্রতিভ দ্বিতীয় কাউকে তিনি দেখেননি। বয়সের তুলনায় অসামান্য পরিপক্ব প্রতিভাধর শহীদ সাবের।

১৯৪৭ সালে দেশভাগে সপরিবারে তারা পূর্ববাংলায় চলে আসেন। চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন সাবের। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আইএ পড়ার সময়ে তখনকার একমাত্র অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ও কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যুক্ত হয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রগতিশীল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রজুড়ে তখন কমিউনিস্টদের ওপর চলছে নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন। ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ সেই ধারাবাহিকতায় ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের ওপর ইচ্ছেমত যখন-তখন গুণ্ডা লেলিয়ে হামলা চালায়।

আইএ ক্লাসের ছাত্র শহীদ সাবের ১৯৫০ সালে ছাত্র ফেডারেশনের এক সমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় গ্রেফতার হন। সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা না দিয়ে নিরাপত্তা বন্দি শহীদ সাবেরকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।

পরে তাকে আতঙ্কের জেলখ্যাত রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে সেনাবাহিনী লেলিয়ে রাজশাহী জেলে হত্যা করা হয় সাতজন কমিউনিস্ট রাজবন্দিকে এবং এতে আহত হন শতাধিক রাজবন্দি।

বন্দিদের আতঙ্কগ্রস্ত করা এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার জন্যই দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে কমিউনিস্ট বন্দিদের রাজশাহী কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। রাজশাহী জেলের সর্বকনিষ্ঠ রাজবন্দি ছিলেন শহীদ সাবের।

রাজবন্দিরা তাকে খুব স্নেহ করতেন। এই তরুণের নানা আবদার-উপদ্রব হাসি মুখে সহ্য করতেন তারা, বিশেষ করে ঢাকার রেল শ্রমিক আন্দোলনের নেতা সুকুমার চক্রবর্তী।

১৯৫১ সালে রাজশাহী জেল থেকে আইএ পাস করেন সাবের। রাজশাহী জেল থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে বদলি হয়ে আসা বন্দি শহীদ সাবেরকে তার পিতা বন্ড দিয়ে মুক্তির উদ্যোগ নিলেও শহীদ সাবেরের অসম্মতি ও তীব্র বিরোধিতার কারণে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। সচিবালয়ে কর্মরত তার পিতা অনেক চেষ্টার পর যুক্তফ্রন্ট সরকারের কল্যাণে তাকে জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। শর্ত ছিল ঢাকা থেকে কোথাও যাওয়া চলবে না। যেতে হলে গোয়েন্দা বিভাগের অনুমতি নিতে হবে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসনামলে বিনা বিচারে চার বছর জেল খেটে ছাড়া পান তিনি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১০/জে, আজিমপুর কলোনিতে বাবার সংসারে ফিরে আসেন। সংসারের আর্থিক সহযোগিতার জন্য আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। সাবের একইসঙ্গে জগন্নাথ কলেজের নৈশ শাখায় বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে বিএ পাস করেন।

চট্টগ্রাম জেলে বসেই বন্দি জীবনের কাহিনী নিয়ে লিখেছিলেন ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ নামক রোজনামচা। লেখাটি গোপনে জেল থেকে পাচার হয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত নতুন সাহিত্যের চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায় ছাপা হয়। লেখাটি নিয়ে চারদিকে সাড়া পড়েছিল।

কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখে এই নতুন প্রতিভার আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। নিরাপত্তা বন্দি বলেই স্বনামে লেখা ছাপানোর অধিকার তার ছিল না।

আরেক দুনিয়া থেকে ছাপা হয়েছিল ‘জামিল হোসেন’ ছদ্মনামে। কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে সেই তার যাত্রা শুরু, কিন্তু দুর্ভাগ্য ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ মাত্র এ ক’টি বছরই মূলত তিনি লিখতে পেরেছিলেন।

বিএ পাস করে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। সংবাদের সম্পাদকীয় তিনিই লিখতেন এবং দেখতেন সাহিত্য পাতাও। সংবাদে চাকরিরত অবস্থায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল সুপিরীয়র সার্ভিসে (সিএসএস) অন্তর্গত সিএসপি পরীক্ষায় বসেন; লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চোখের সমস্যার অজুহাতে নিশ্চিত সরকারি চাকরি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়।

পরে তিনি ফেডারেল ইনফরমেশন সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে পুরো পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন জেলখাটা কমিউনিস্ট, তার সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্ট সন্তোষজনক ছিল না।

দৈনিক পাকিস্তান (দৈনিক বাংলা) পত্রিকার অফিসে গিয়ে কবি শামসুর রাহমানকে বলেছিলেন-‘আপনাকে কিন্তু এক বোতল মদের মতো লাগছে। বেশ তাজা। খুব ফেনা আছে তাই না? আমি ভেবেছিলাম ওয়ান সুড নট বী দি হ্যাসব্যান্ড অফ রিস্কি হুইস্কি।’

এ কারণে তাকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি বিস্তারিত জানালে তিনি এ ব্যাপারে ওভার রুল করে, নিয়োগপত্র প্রদানের সরকারি নির্দেশের প্রতিশ্র“তি দেন।

কিন্তু সেই রাতেই সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। শহীদ সাবেরের পরিবার ও শ্রেণীর আকাক্সক্ষা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণতন্ত্র একই সঙ্গে ভেস্তে যায়।

শহীদ সাবেরের লক্ষ্য-প্রত্যাশা-প্রাপ্তি ছিল সমন্বয়হীন, যা তাকে হতাশ করে তুলেছিল। ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমও ব্যর্থ হয়ে যায়। এক জমিদার কন্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সে প্রেমও টেকেনি। সেই জমিদার কন্যার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়।

হতাশার ধূম্রজাল তাকে চারদিক থেকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে তার মানসিক বিপর্যয় শুরু হয়। ময়মনসিংহের মামাতো বোনের বাড়িতে নিভৃতে পুড়িয়ে ফেলেন প্রেমিকার নীল কাগজের চিঠিগুলো। চিঠি পোড়ানো প্রসঙ্গে তার মন্তব্য ছিল-‘বাজে জিনিস পুড়িয়ে ফেলাই ভালো।’

নিজের অবস্থানে টিকে থাকতে না পারার যন্ত্রণায় জীবনের প্রতি তীব্র অনীহা কিংবা ঘৃণায় নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান শহীদ সাবের। তার সেই মানসিক বিপর্যয়কালে সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই উদ্যোগ নিয়ে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

তার বন্ধু প্রয়াত সাংবাদিক ফাউজুল করীম এবং মন্টু খান (সাংবাদিক আবেদ খানের অগ্রজ) তাকে সঙ্গে নিয়ে পাবনার হাসপাতালে রেখে আসেন। চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও চিকিৎসার ধারাবাহিকতার অভাবে তার আর সুস্থ ও স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব হয়নি। পরে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাওয়া, পেটিকোট, আন্ডারওয়্যার পরে রাস্তায় বের হয়ে যাওয়ার মতো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাও ঘটেছিল। নোংরা ও অপরিষ্কার থাকা তার মজ্জাগত হয়ে যায়।

বেগম সুফিয়া কামাল এবং ওয়াহিদুল হক-সন্জীদা খাতুন তাকে পরিচ্ছন্ন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে নিজেদের বাড়িতে নিয়েও রাখতে পারেননি। ফাঁকি দিয়ে সেখান থেকেও তিনি পালিয়ে যান। তার জীবন হয়ে পড়ে অসংলগ্ন এবং প্রথাবিরোধী।

বংশালের সংবাদ অফিসই হয়ে উঠেছিল সাবেরের একমাত্র আশ্রয়স্থল। সারা দিন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে রাতে ঘুমাতে যেতেন সংবাদ অফিসে। মেঝে, বারান্দা, হাতলবিহীন চেয়ার ছিল তার ঘুমের স্থান।

সংবাদ অফিস থেকে তাকে প্রতিদিন দুই টাকা দেয়া হতো। প্রেসক্লাবে খাওয়া ছিল ফ্রি। ফ্রি খাওয়ার বেলায়ও ছিলেন অনিয়মিত। সিগারেট, একমাত্র সিগারেট খেতেই সবার কাছে হাত পাততেন নির্দ্বিধায়। জীবনের বোঝা বয়ে বয়ে উদভ্রান্ত জীবনে অভ্যস্ত শহীদ সাবের মূলত বন্ধুদের সাহায্যেই বেঁচে ছিলেন মাত্র। ছিল না বোধ। ছিল না স্বপ্নপূরণের সামান্য মানসিক শক্তি। কেউ খাওয়ালে খেতেন নয়তো না খেয়েই থাকতেন। অনাহার ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ভালোবাসাহীন সামাজিক-পারিবারিক কক্ষচ্যুত শহীদ সাবের ঘৃণায়-যন্ত্রণায় নিজের প্রতি নিজে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন কি?

দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পাগলামি না করেও পাগলের খ্যাতি-দুর্নাম নিয়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কবিতা লিখতে পেরেছিলেন কীভাবে? যদি পাগলই হবেন তবে তাকে নিয়ে পত্রিকায় কেউ কিছু লিখলে তার প্রতিবাদে বলতেন কীভাবে-‘আমি কি পণ্য? আমার কথা লিখেছেন কেন?’

দৈনিক পাকিস্তান (দৈনিক বাংলা) পত্রিকার অফিসে গিয়ে কবি শামসুর রাহমানকে বলেছিলেন-‘আপনাকে কিন্তু এক বোতল মদের মতো লাগছে। বেশ তাজা। খুব ফেনা আছে তাই না? আমি ভেবেছিলাম ওয়ান সুড নট বী দি হ্যাসব্যান্ড অফ রিস্কি হুইস্কি।’

পরিবার পরিজন থেকেও মানুষটি পাননি যথাযথ ভালোবাসা ও সহমর্মিতা। তার সুচিকিৎসা হয়নি। ভালো হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা থাকলেও সুচিকিৎসা ও পরিচর্যার অভাবে তার আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি।

বিভিন্ন মহল থেকে তাকে সুস্থ করার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক ইউনিয়নের জনৈক নেতার উক্তি ছিল-‘সুস্থ লোককে বাঁচাব? না পাগল সাবেরকে বাঁচাব? ইউনিয়ন তো সাবেরের পরিবার পরিজন নয় যে সারাক্ষণ তার পেছনে লেগে থাকবে?’

বাবা মৃত্যুপথযাত্রী, শোনামাত্র সাবেরের অনুজ পেয়ারু বাবার কাছে ছুটে গেলেন। যাওয়ামাত্র বাবার প্রশ্ন-‘সাবের কোথায়? তাকে নিয়ে আসোনি কেন?’

উত্তরে পেয়ারু বলেছিলেন, ‘সাবের ভাইকে আনতে গেলে আমারই আসা হতো না। সে কখন কোথায় থাকে তার হদিস পাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব না।’ বাবার অন্তিম কথা ছিল-‘আমার জীবনটা ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ। যা চেয়েছি তা পাইনি।

তোমাদের যা করতে চেয়েছি তাও পারলাম না।’ পরিবারের আকাক্সক্ষার প্রতি নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার ইচ্ছে না থাকলেও উপায় ছিল না সাবেরের। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব সচেতন ছিলেন বলেই ওয়েস্ট অ্যান্ড স্কুলে শিক্ষকতা এবং সংবাদে চাকরি করে বেহিসেবি বাবাকে নিয়মিত অর্থ দিতেন। সৎমায়ের পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসারে দায়িত্ব পালনে ছিলেন না উদাসীন।

১৯৭১-এর ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি হানাদাররা প্রগতিশীল ও জাতীয় চেতনার দৈনিক সংবাদ অফিস আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। সংবাদের স্থায়ী বাসিন্দা ঘুমন্ত শহীদ সাবের সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। তার দেহের সৎকার তো দূরের কথা, শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি। পুরো সংবাদ অফিসের সঙ্গে ছাই ভস্ম হয়ে যায় দৈহিকভাবে বেঁচে থাকা শহীদ সাবের।

অনুজ পেয়ারু ম্যাট্রিক পাস করেই চাকরিতে ঢুকে যান। চাকরিরত অবস্থায় আইকম ও বিএ পাস করেন। বাবার সংসারের অভাব দূর করতে দুই ভাই ছিলেন সদা তৎপর। খেলার বয়সে খেলাধুলা পর্যন্ত করতে পারেননি।

সৎভাই-বোনদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাদের দুই ভাইয়ের কোলে পিঠে তারা বড় হয়েছে। অথচ এই সৎভাই-বোনেরা মিলে ১৯৭০ সালে বাবার জাল স্বাক্ষরে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরার পৈতৃক বাড়ি থেকে শহীদ সাবের ও তার অনুজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক (পার্সোনাল) সাইফুল্লাহ পেয়ারুকে চির বঞ্চিত করেছে। পেয়ারু মামলা করলেও মামলার দীর্ঘসূত্রতায় আজ অবধি পৈতৃক ভিটার অধিকার ফিরে পায়নি।

২৫ মার্চের গণহত্যা-পরবর্তী সান্ধ্য আইন শিথিল হওয়ামাত্র পুরানা পল্টন লেনের দাদার বাড়ির সবাইসহ ঢাকার আমাদের পুরো পরিবার আত্মরক্ষার্থে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কুশিয়ারবাগে আশ্রয় নিয়েছিল।

শহীদ সাবেরের অনুজ পেয়ারুও সঙ্গে ছিলেন। দাদার বাড়ির লাগোয়া অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদের মায়ের কাছে জেনেছিলাম, শহীদ সাবের নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দাদার বাড়িতে এসেছিলেন। তালাবন্ধ শূন্য বাড়িতে কাউকে না পেয়ে অগত্যা নিঃশব্দে ফিরে গেছেন আদি ঠিকানা বংশালের সংবাদ অফিসে।

১৯৭১-এর ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি হানাদাররা প্রগতিশীল ও জাতীয় চেতনার দৈনিক সংবাদ অফিস আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। সংবাদের স্থায়ী বাসিন্দা ঘুমন্ত শহীদ সাবের সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। তার দেহের সৎকার তো দূরের কথা, শনাক্ত পর্যন্ত করা যায়নি। পুরো সংবাদ অফিসের সঙ্গে ছাই ভস্ম হয়ে যায় দৈহিকভাবে বেঁচে থাকা শহীদ সাবের।

রাষ্ট্রীয় খড়গে জেল ফেরত শহীদ সাবের রাজনীতিতে যুক্ত থাকতে পারেনি। সাংবাদিকতা পেশাও তাকে দিতে পারেনি আর্থিক নিশ্চয়তা। পরিবার ও শ্রেণীর চাপে এবং ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমকে সফল করতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছুটতে হয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠার পিছু। শাসক সহযোগী সরকারি আমলা হওয়ার জন্য নিজের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে সিএসপি এবং সিআইএস পরীক্ষা দিতে হয়েছে।

নিয়োগপ্রাপ্তির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ধরনা পর্যন্ত দিয়েছেন। নিজের মতাদর্শিক চিন্তা-চেতনার আত্মাহুতির মানসিক যন্ত্রণা-কষ্টে শহীদ সাবের দ্রোহী হয়ে বদলে গিয়েছিলেন।

করেছিলেন ভিন্ন মাত্রার নীরব প্রতিবাদ। মতাদর্শিক অঙ্গীকার এবং নিজস্ব সত্তার বিকাশের বিপরীতে পিতা-পরিবার-শ্রেণী থেকে ব্যক্তিগত প্রেম তাকে ঠেলে দিয়েছিল সনাতনী প্রতিষ্ঠার পেছনে, যা তার পক্ষে ছিল অসহনীয়।

ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলতে গিয়ে মতাদর্শ ও বিবেক দংশনে বৈরী সমাজব্যবস্থার উপহাসে শহীদ সাবের অপ্রকৃতিস্ত হয়ে যান। শ্রেণীর চাপে ক্ষতবিক্ষত শহীদ সাবের নীতি ও মূল্যবোধের এই বিচ্যুতি সহ্য করতে পারেননি।

তাই ভেঙেছেন, কিন্তু মচকে যাননি। আজকের মতো সাংবাদিকতা তখন পেশা হিসেবে নিশ্চিত কিছু ছিল না। অনিয়মিত বেতনপ্রাপ্তির বিড়ম্বনায় বাবা-মা-ভাইবোনদের ঢাকায় বাসা ভাড়া করে এনেও সংসারের ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়নি।

সেজন্য তার বাবা আত্মীয় পরিজনদের কাছে উপহাস করে বলতেন-‘সাবের আমাদের অনাহারে না খাইয়ে মারার জন্য ঢাকায় এনেছে।’ আর্থিক অনিশ্চয়তায় পুরো পরিবারকে চট্টগ্রাম ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

সাবের নিজের স্বাধীন স্বকীয়তায় চলতে পারেননি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাকে অন্য পথে ঠেলে দিয়েছিল। যে পথের বিরুদ্ধে ছিল তার মতাদর্শ।

শ্রেণী উত্তরণের মোহ কিংবা নেশা তার ছিল না। থাকার কথাও নয়। চাপিয়ে দেয়া নানা চাপে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শহীদ সাবেরকে পাগলের খ্যাতি নিয়ে বাঁচতে হয়েছে এবং সবার অলক্ষে পুড়ে মরতে হয়েছে।

তার নির্লোভ-নির্মোহ সমষ্টিগত জগতটিকে বাঁচতে ব্যর্থ হয়েই জীবন ও সৃষ্টির জগৎ থেকে স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেছেন। নিজে হেরে সবাইকে হারিয়ে দিয়েছেন তিনি। আত্মসমর্পণের চেয়ে উত্তমই ছিল বোধ করি তার এই হারিয়ে যাওয়া।

শহীদ সাবেরের রচনাগুলোর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ রোজনামচা আরেক দুনিয়া থেকে (১৯৫৭), ছোট গল্পগ্রন্থ এক টুকরো মেঘ (১৯৫৫), কিশোর গল্পগ্রন্থ ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান (১৯৫৮), অনুবাদগ্রন্থ পুশকিনের ইস্কাপনের বিবি, গোগলের পাগলের ডায়েরি, ক্যাথরিন ওয়েন্স পিয়ারের কালো মেয়ের স্বপ্ন (১৯৫৮)। অসংখ্য কবিতা লিখেছেন তিনি, তবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন দৈনিক ও পত্রপত্রিকায় তার প্রচুর কবিতা ছাপা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ছোটগল্পে (মরণোত্তর) বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন শহীদ সাবের।

আরো পড়তে পারেন

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি (সব পর্ব)

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ভাষা আন্দোলনের পর্যায় বিশ্লেষণ সূচনা ও বিকাশ পর্ব (১৯৪৭-১৯৪৮) বায়ান্নর প্রস্তুতি পর্ব (১৯৪৯-১৯৫১) বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

হারুন আল রশিদের সৃষ্টির ভুবনে ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’

হারুন আল রশিদ দুই দশকের বেশি সময় ধরে গদ্য সাহিত্য রচনার আধুনিক কলা-কৌশল রপ্ত করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যে স্থায়ী অবদান রাখা শতাধিক লেখকের উপন্যাস তিনি নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেছেন। ইংরেজিতে লেখা তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ উপন্যাস, The Memoirs of An Unrequited Love ও The River Flows Upstream, নতুন আঙ্গিকে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। ইংরেজি ভাষায় এ যাবৎ….

রাজীব সরকারের সৃষ্টির ভুবন

রাজীব সরকার এই সময়ের শক্তিমান লেখক। প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার কাজগুলোও সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। বিতর্ক বিষয়ে রাজীব সরকারের একাধিক বই মেধাবী তরুণদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার রম্যরচনার আলাদা পাঠকশ্রেণি গড়ে উঠেছে। গল্প ভ্রমণকাহিনি ও লিখেছেন। চলমান বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় মতামতধর্মী কলামও লিখে থাকেন বিভিন্ন সময়ে। জন্ম কিশোরগঞ্জ….

error: Content is protected !!