
শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে থাকে চাবুকের মতো টানটান হয়ে থাকা স্নায়ুগুলো। সারাদিনের এ আধাঘণ্টা সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত চুমুক দিয়ে শুষে নেই। রেশমের মতো নরম কোমর ছাপানো কালো চুল লম্বা সাপের মতো পড়ে থাকে পিঠের ওপর। ছিপছিপে শরীরে পাহাড়ি উপত্যকার মতো ভয়ানক বাঁকগুলো বেয়ে বেয়ে নামতে থাকে ঝরনা ধারা। মসৃণ জলপাই সিদ্ধ রঙের চামড়ার ওপর পিছলে পিছলে নামে। লাইটের আলোতে চিকমিক করে আনাচে-কানাচে মুক্তার মতো জমে কিছু বেয়াড়া জলকনা। ঘাড়ের পাশে কুচকুচে কালো তিল, গাঢ় বাদামি স্তন বৃন্ত, সমতল তলপেট, গভীর নাভি, সুডৌল পা ছুঁয়ে ফ্রেঞ্চ ম্যানিকিওর করা টকটকে লাল নখের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে পানিগুলো। সবার মতো।
লাল খুব প্রিয় রং আমার। বোল্ড, বিউটিফুল এন্ড ব্রেকলেস। কে যেন একবার অনেক আগে বলেছিল আমার এ কালো রঙের সঙ্গে যায় না লাল রং। এরপর থেকে লাল রং নেইলপালিশ ছাড়া অন্য কিছু দেইনি। যে কোনো না কে সবসময় ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসাবে-ই নিই আমি। খুব পরিষ্কার মাথা আমার। শার্প বলে যাকে। যে কোনো জিনিস ন্যানো সেকেন্ডে ধরে ফেলতে পারি। কারও চোখের দিকে তাকালে বুঝতে পারি সে কী টাইপের। যে কোনো ঘটনার শুরুতেই গন্ধ পেয়ে যাই পানি কোনো দিকে গড়াবে। মোটকথা ক্ষুরের মতো মস্তিষ্ক নিয়ে এ দুনিয়ায় এসেছি। প্রথম যেদিন চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম তখন চাকরির বাজারের ডাকসাইটে এক দাতা বের হওয়ার আগে থার্টি ফাইভ সেকেন্ড চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। পিনপতন সাইলেন্ট রুমে গমগমিয়ে উঠেছিল তার ভরাট গলা। বলেছিলেন, মাই গার্ল! য়ু র আ সিলভার লাইটিনিং ইন দ্য ডার্ক ক্লাউড। কিপ ইট আপ। ওনার কথার কোনো উত্তরে থ্যাংক য়ু বলিনি আমি। চোখে চোখ রেখে আমার বিখ্যাত কুল হাসিটাই দিয়ে বের হয়ে এসেছিলাম। যেটা কিনা শুধু ঠোঁটের কোন পর্যন্তই থাকে, কখনো চোখ আর স্পর্শ করে না। আমি তো জানি আমি কী। সাকসেস আর মানি আমার সবচাইতে প্রিয় শব্দ। এর জন্য করতে পারি না এমন কিছু নেই। আমাকে যেভাবেই হোক টপে থাকতে হবে। আমি বিলিভ করি মানি মেইকস এভরিথিং। কতজনকে যে সিঁড়ি হিসাবে ইয়ুজ করেছি। নিজের সৌন্দর্য আর বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েছি। আমি দেখেছি যত বড় পুরুষ মানুষই হোক না কেন, আমার সামনে এসে কেন জানি ম্রিয়মাণ হয়ে যায় কিছু পরে। কাউকে ফাঁদে ফেলেছি, কাউকে মুগ্ধ করেছি; যা লাগবে হাতিয়ে নিয়েছি। জীবনে অনেক বড় হতে হবে আমাকে। অনেক বড়।
এত গল্পের মাঝে নিজের নামটাই বলা হয়নি। আমি লিলিথ। মিথলজির বিখ্যাত বা কুখ্যাত এ চরিত্র লিলিথ কেন যে আমার মায়ের খুব প্রিয় ছিল আমি জানিনা। শব্দটির প্রচলিত অর্থ রাত্রি। এডামকে সৃষ্টির পর ঈশ্বর তার একাকিত্ব দূর করার জন্য সৃষ্টি করলেন বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মসম্মানবোধে পরিপূর্ণ এক নারী, সৃষ্টির প্রথম নারী লিলিথকে। একই মাটি থেকে জন্ম হওয়াতে লিলিথ মেনে নিতে চায়নি এডামের আধিপত্য। লিলিথকে একদিক থেকে যেমন দেখানো হয়েছে অন্ধকারের প্রতিরূপ হিসাবে, আরেক দিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার এক বিদ্রোহী রূপ। স্বর্গের সুখ ছেড়ে আসা এক নির্বোধ নারী, কিংবা নিজের অধিকারের জন্যে একাকী লড়ে যাওয়া এক দৃঢ়চেতা চরিত্র। ইহুদি সাহিত্যিক রুথ ফেল্ডম্যানের ‘Lilith’ সবচেয়ে সুন্দর করে নিজের রূপটি প্রকাশ করেছে— ‘Half of me is beautiful, But you were never sure which half.’
শুধু একটা ভুল আমি করেছি লাইফে। আমার মতো মানুষ এ ভুল কীভাবে করল আমি ভেবে পাইনা এখনো। লাইফ পার্টনার হিসাবে কীভাবে আমি রাশেদের মতো একজনকে পছন্দ করেছিলাম কে জানে! আসলে আমি হেরে যেতে চাইনি। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই, সম্পর্কের গভীরতা নেই, তারপর ও রাশেদের কেয়ারিং, ভালোবাসা অন্য কেউ পাবে এটি আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। অবশ্য ও তখন ছিল ইউনিভার্সিটির হার্টথ্রব। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল, ফর্সা তামাটে গায়ের রং, খাড়া নাক। ঠিক যেন গ্রিক ভাস্কর্য থেকে উঠে আসা মূর্তি। সব চেয়ে সুন্দর ছিল ওর চোখ। এমন বিষন্ন সুন্দর চোখ চোখে পড়েনি আমার কোনোদিন। আমি অনেক হিসেব কষেই তাকে ভালোবেসেছি। দেখতে ভালো, ইউনিভার্সিটির টপার, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো আর কেয়ারিং। সবচেয়ে ভালো দিক হলো সে বিশ্বস্ত। ছেলেদের মধ্যে এমন মনোগ্যামি ক্যারেকটার আমি কোনোদিন দেখিনি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এটা গ্যারান্টেড।
আস্তে আস্তে বাসার দারোয়ান, ড্রাইভারের মতো ওকে ট্রিট করা শুরু করি। সে বাসা দেখবে, সব ম্যানেজ করবে। আমি ব্যস্ত আমার সোসাইটি, করপোরেট লাইফ আর ওপরে ওঠার সিঁড়িদের নিয়ে। আর কিছুদিন। সব গুছিয়ে ফেলেছি। এ মিনমিনা এইমলেস লোকটা আমার জীবনে একটা বড় অভিশাপ ছাড়া আর কিছু না
তবে তখন ওকে বুঝতে আমার ভুল হয়েছিল। ওর ভেতরে একটা ছোট্ট নরম মানুষ লুকিয়ে ছিল যে কিনা আমাকেই তার শেষ আশ্রয় হিসাবে নিয়েছে। আমাকে সে সত্যি ভালোবেসেছিল কোনো হিসেব ছাড়াই। ওর এ মেন্টালিটি আমার কাছে মিডল ক্লাস ফুল ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি কোনোদিন। জীবন হচ্ছে এনজয় করার জন্য। এত কমিটেড থেকে কী হবে! খাও দাও, ঘোরো ফেরো। নিজের যা লাগবে গুছিয়ে নাও। বিয়ের পর থেকেই বুঝতে পারলাম বেসিক নিডগুলো ছাড়া রাশেদের কোনো মোহ নেই। পুরুষ মানুষ এত কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী কীভাবে হয়! আমার গা জ্বলে যেত, যখন ভালো ভালো অফার পেয়েও সে ফিরিয়ে দিত শুধু শান্তিতে থাকবে বলে। লাইফে টাকা ছাড়াও অন্য কিছুর প্রাধান্য আছে, টাকা আর ক্ষমতার মোহকে এত তাচ্ছিল্য কেউ করতে পারে সেটা ওকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।
আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। রাশেদ খুব অদ্ভুতভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমার ধারালো সব কথা আর ঝগড়াঝাটি তাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। ব্যাকবোন লেস! ও যত নিজেকে গুটায় আমি তত বেপরোয়া হই। ওকে একটা আস্ত কাওয়ার্ড ছাড়া কিছুই মনে হয় না। থাকুক না পরে একপাশে। হাউজ হ্যাসব্যান্ড! নিজের নামের পাশে একটা সাইনবোর্ড না থাকলে মাঝে মধ্যে সোসাইটি ম্যানেজ করা কষ্টকর হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বাসার দারোয়ান, ড্রাইভারের মতো ওকে ট্রিট করা শুরু করি। সে বাসা দেখবে, সব ম্যানেজ করবে। আমি ব্যস্ত আমার সোসাইটি, করপোরেট লাইফ আর ওপরে ওঠার সিঁড়িদের নিয়ে। আর কিছুদিন। সব গুছিয়ে ফেলেছি। এ মিনমিনা এইমলেস লোকটা আমার জীবনে একটা বড় অভিশাপ ছাড়া আর কিছু না।
একদিন ঝুম বৃষ্টির সকালে রাশেদ চলে গেল বাসা ছেড়ে। চলে গেছে মানে তো লিভ ফর এভার এবং সে বাসা থেকে একটা কুটোও নিয়ে গেল না। নিজের টাকায় কেনা ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, অন্য সব ইনভেস্টমেন্ট কিছুই না। নাথিং। আসলে কিছুদিন আগের একটা রিপোর্ট হাতে পেয়েছিল সে। আমারই দোষ। অসতর্ক ছিলাম। তাই আমার ভেতর জন্ম নেওয়া ছোট্ট রক্তবিন্দু টাকে ঝেড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে এক সেকেন্ড বেশি লাগেনি। ওর মতামত তো অনেক পরের ব্যাপার। এসব ঝামেলায় কে যায় এখন! ডাইনিংয়ের পাশে স্থাণুবৎ রাশেদ একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। ওর সব সময়কার বিষণ্ণ সুন্দর চোখে শুধু একটা ঘন কালো মেঘ জমেছিল। সেই শান্ত, বিষণ্ণ দৃষ্টির সামনে কিছুক্ষণ অসার হয়েছিলাম। এই প্রথম কেন জানি কোনো শব্দ বের হলো না মুখ থেকে।
পরদিন সকালে ও চলে গেলে আমি প্রথমে বেশ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যত কিছুই হোক ওর জন্য একটা দুর্বলতা ছিল মনের কোণে। এত দিনের অভ্যস্ত জীবন। মাঝে মধ্যে খারাপ লাগত কেন এমন করি; কিন্তু করেছি তো ওর ভালোর জন্য। লাইফে সাইন করলে ওর কি কিছুই লাভ হতো না! হতো। তাহলে কেন আমাকে লোভী ভাবা। লিগ্যাল কিছু পেপারে সাইন করে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কারও কথায় কান দিলাম না। মা এসে বলে গেলেন, তুমি একসময় দেখবে লাইফ শুধু টাকা আর সাকসেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। টিকে থাকতে হলে তোমাকে কিছু সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তুমি পস্তাবে একসময়। এখনো সময় আছে। ব্যালেন্স করতে শিখো। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেই। রাশেদ মায়ের খুব পছন্দের। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে মা ওকে। আর আমাদের সমাজে ডিভোর্সের দায়িত্ব এখনো শুধু মেয়েদের কাঁধেই চাপানো হয়। এত নীতিকথা শোনার সময় নেই আমার। মা অনেক কষ্ট করেছেন জীবনে। আমি চাই না আমার জীবন এমন হোক। লাইফে অনেক দূর যেতে হবে আমাকে। কারও জন্য এত সময় নেই আমার। কেউ কারও লাইফ লিড করে না। লাইফ একটাই। ভুল মানুষকে ভালোবাসার শাস্তি কেন নিবো। সে তার মতো, আমি আমার।
জীবন আসলে খুব রহস্যময়। প্রতি পাতায় সে কী লিখে রাখবে তা কেউ জানে না। আমরা মিছেই পাতা বুনি। কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম জীবনের রাস্তায় কোনো রোড সাইন নেই। আমরা জানি না সামনে গভীর বাঁক নাকি অন্য কিছু।
আমি রাশেদের দিক থেকে চোখ সরাতে পারি না। মুগ্ধ হয়ে দেখি। জুলফির পাশে অল্প কিছু কাঁচাপাকা চুল ছাড়া বদলায়নি খুব। একটু ভারি হয়েছে শরীর। বিষণ্ণ সুন্দর চোখে সেই শান্ত, গভীর দৃষ্টি। ঠিক আগের মতো। আমার অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল এক দংগল মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি খালি গায়ে। সবাই আমাকে নিয়ে হাসছে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার একসময়ের ভালোবাসার মানুষ। তার নিশ্বাসের স্মেলও আমি জানি
রাশেদের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছিল বিদেশি ডেলিগেটদের সঙ্গে কনফারেন্স এটেন করার সময়। সাগর তীরে। একপাশে আমার মতো বিস্তৃত নীলসাগর আর পেছনে রাশেদের মতো অটল সবুজ পাহাড়। খুব কাছে থেকেও যাদের মিতালি হয়নি কোনোদিন। ততদিনে আরও ওপরে গিয়েছি আমি। কিন্তু আমার প্রিয় সাকসেস, মানি কেন জানি আর আগের মতো টানে না তখন আর। চারপাশে মুখোশ পরা সব নেকড়ের মতো মানুষ। সুযোগ পেলেই ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দেবে। খুব ক্লান্ত লাগে আজকাল। মাঝে মধ্যে মনে হয় কারও খুব কাছে কিছুক্ষণ বসি। চুপ করে। সে আস্তে করে বসে থাকবে আমার পাশে। কিন্তু আমার পাশে এখন আর কেউ নেই। দিনশেষে আমি একা। মা নেই, রাশেদ নেই, স্বজন নেই, কোনো বন্ধু নেই। মাঝে মধ্যে বুকের মধ্যে মুচড়ে ওঠে যখন কোনো এক ছোট্ট ছায়া পাশে এসে বসে। ফিসফিস করে বলে, মা!
আমি রাশেদের দিক থেকে চোখ সরাতে পারি না। মুগ্ধ হয়ে দেখি। জুলফির পাশে অল্প কিছু কাঁচাপাকা চুল ছাড়া বদলায়নি খুব। একটু ভারি হয়েছে শরীর। বিষণ্ণ সুন্দর চোখে সেই শান্ত, গভীর দৃষ্টি। ঠিক আগের মতো। আমার অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল এক দংগল মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি খালি গায়ে। সবাই আমাকে নিয়ে হাসছে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার একসময়ের ভালোবাসার মানুষ। তার নিশ্বাসের স্মেলও আমি জানি। আমার চেহারার যে হাসিটা ফোটানোর চেষ্টা করি সেটা যে কতটা ম্রিয়মাণ নিজেই বুঝতে পারি। সামনে এগিয়ে কিছু বলার আগেই ওর পাশে একজন এসে দাঁড়ায়। বব চুলের মায়াবী মুখ আর তার সঙ্গে টলোমলো পায়ে ছোট্ট একজনের দিকে তাকিয়ে রাশেদের চোখে এক অদ্ভুত সুন্দর নরম আলো জ্বলে ওঠে। তার বিষণ্ণ চোখের সেই আলো প্রবল ঈর্ষার স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপের চোরাবালিতে ডুবিয়ে দেয় আমাকে। আমি বুঝতে পারি এ আলো আমার জন্যও জ্বলেছিল। আমি বুঝিনি। প্রতিটি মানুষের দুইটা ভ্যালু থাকে। একটা হলো সোসাইটিতে তার কমন ভ্যালু, যা তার কাজ বা ইনকাম দিয়ে নির্ধারিত হয়। আরেকটা হলো ভেতরের মানুষটার ভ্যালু যা নির্ধারণের কোনো মাপকাঠি নেই। আমি সবসময় কমন ভ্যালুকে দাম দিয়েছি। তার ইনকাম, জাঁক জৌলুস এসব আমার নজর কেড়েছে। অন্য মানুষের জন্য তার স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা কিছু আমার চোখে পড়েনি কোনোদিন।
খুব কাছ থেকে একবার বাঘ দেখেছিলাম চিড়িয়াখানাতে। খাঁচার একদম কর্নারে পায়চারি করছিল। কী প্রবল ব্যক্তিত্ব। কী রাজসিক। হাঁটার কী রিদম তার! খাঁচায় বন্দি তারপরও প্রতিটি স্টেপে আত্মবিশ্বাস ঝরে ঝরে পড়ছে। বাঘ আসলে বাঘই হয়। তা সে খাঁচায় বন্দি থাকুক বা বনে। কালো হলুদ ডোরাকাটা চামড়া ঠিক যেন ভেলভেট। হাত দিলে পিছলে যাবে এত মসৃণ। এ গায়ে কোনো ধুলো বেশিক্ষণ জমে না। গা ঝাড়লেই পড়ে যায়। আমার সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছিল তার চোখ। পুরো চোখজুড়ে অদ্ভুত এক তাচ্ছিল্য ভরা উদাসীনতা আর নিষ্ঠুরতা। বুকের ভেতর হিম হয়ে আসে দেখলে। সবকিছুর দিকে সে তাকাচ্ছে। কিন্তু দেখছে না কিছুই। কোনো কিছুই দাগ কাটছে না তার মনে। সে আপন জগতে নিবিড়ভাবে ডুবে আছে। এ দৃষ্টি মনে হয় একজন রাজারই থাকে শুধু। পরিস্থিতি হয়তো তার শরীরকে খাঁচায় বন্দি করেছে, কিন্তু তার নিজস্বতাকে বন্দি করতে পারেনি। সেটি অসম্ভব। ওই বাঘটা জানে সে কীভাবে বেঁচে থাকবে সেটি তার ইচ্ছা। হয়তো খাঁচার মধ্যে খাবারের জন্য সে নির্ভরশীল কিছু ম্যাটেরিয়াল বা জাগতিক জিনিসের ওপর। কিন্তু জীবন তার। বাঘের চারপাশে একটা ইঁদুর খাঁচার বড় বড় ফাঁকা দিয়ে ফুড়ুত করে একবার বাইরের গর্তে যাচ্ছে, একবার আসছে ইচ্ছে স্বাধীন। সে বেঁচে আছে বাঘেরই ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে। হয়তো বিরক্ত করছে বাঘটাকে। আমার অবাক লাগছিল। এ ইঁদুরকে মারতে এ বাঘের এক থাবাও লাগবে না। এ নরম তুলতুলে থাবায় সে বুনোমোষের শক্ত ঘাড় ভেঙে দিতে পারে। তাহলে মারছে না কেন! কিছুক্ষণ ভেবেই বুঝতে পারলাম ঠিক তার মতো আরেকজন আসলেই বাঘটা নখ দাঁত বের করবে। শেয়ানে শেয়ানে।। তার আগে নয়। কোনো ইঁদুরকে দেখে তো নয়ই। এটা তার জিনগত। প্রকৃতি তাকে এভাবেই বানিয়েছে। এটাই তার উদারতা বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধুই দয়া।
আমি আস্তে করে সরে আসি। সবসময়ের বোল্ড এন্ড বিউটিফুল আমি বুঝতে পারি, আমি আসলে মায়ের স্বপ্নের বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মসম্মানবোধে পরিপূর্ণ, নিজের অধিকারে লড়ে যাওয়া দৃঢ়চেতা নারী লিলিথ নই। আমি অন্ধকারের প্রতিরূপ।
আমার জীবন আসলে ইঁদুরের। বাঘের নয়।