Author Picture

রাজীব সরকারের ভ্রমণ সাহিত্য

সোহরাব পাশা

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধুমরু, কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু/ রয়ে গেলো অগোচরে বিশাল বিশ্বের আয়োজন;/ মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ,/ সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে/’
কবি অক্ষয় উৎসাহে ভ্রমণকাহিনী পড়তেন। তিনি ভ্রমণ করে এবং ভ্রমণ কাহিনী পড়ে এই বিপুলা পৃথিবী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করেছেন। ভ্রমণ কাহিনী এখন আর নিছক কাহিনী নয়- ভ্রমণ কাহিনী সাহিত্য হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। পাঠকনন্দিত বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক রাজীব সরকার এক বছরের বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। সেই সুবাদে তিনি ভ্রমণ করেছেন ইউরোপের আরও ১১টি দেশ। অন্নদাশংকর রায়ের ‘পথে প্রবাসে’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’র পাশাপাশি উজ্জ্বল সংযোজন রাজীব সরকার এর ‘ইউরোপের পথে পথে’। গ্রন্থটি ইউরোপের ঘটনাবহুল বারোটি ভূখন্ডের উত্তাল স্পন্দনে ভাস্বর। এটি কেবল লেখকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, পাঠক-শ্রোতার আনন্দ ভ্রমণেরও প্রিয় সঙ্গী।

মানুষ চিরপথিক, পথ চলাতেই তার আনন্দ। এই পথ চলা বা ভ্রমণ থেকেই মানুষ বিচিত্র আনন্দলাভ করে। দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ তার সৌন্দর্য পিপাসাকে চরিতার্থ করে। এর উজ্জ্বল আকর রাজীব সরকারের ‘ইউরোপের পথে পথে’। এ গ্রন্থের ভ্রমণকাহিনী পড়তে পড়তে পাঠক লেখকের ছায়াসঙ্গী হয়ে নিজেকে সেই ভ্রমণের জগতে প্রবেশ করিয়ে নিজেই প্রত্যক্ষ পরিব্রাজক হয়ে ওঠেন। হেঁটে যান সীমাহীন আনন্দ ভুবনে।
মেধাবী লেখক রাজীব সরকার ইউরোপের যে ১১টি দেশ ভ্রমণ করেন সেগুলো হলো- ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, চেকপ্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরী, স্লোভাকিয়া, ইতালী, সুইজারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া ও জার্মানি। এই ভ্রমণ ছিলো অল্পদিনের। বলা চলে একদিনে চারটি দেশ ভ্রমণ করেছেন ক্যামেরার মতো নিপুণ নির্ভুল নান্দনিক দৃষ্টি নিয়ে। ভ্রমণের আনন্দ ও ক্লান্তি, চলমান মনোরম দৃশ্যাবলি, প্রতিবেশ, দেশাচার, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মিউজিয়াম, ভাস্কর্য, ইত্যাদির যে বর্ণনা দিয়েছেন, মনে হয় পাঠক তা নিজে প্রত্যক্ষ করছেন এবং নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন। আর এ-কারণেই গ্রন্থটি অসাধারণ সার্থক ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে উৎকীর্ণ হয়েছে, পেয়েছে উৎকৃষ্ট ভ্রমণ সাহিত্যের মর্যাদা।

রাজীব সরকারের ‘ইউরোপের পথে পথে’ নিছক ভ্রমণ কাহিনী নয়, ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসের মিশেলে লেখা ভোগবাদের ঐশ্বর্যভূমি ইউরোপ দর্শনে বিমুগ্ধ একটি অসাধারণ গল্প যে গল্পে রয়েছে কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় নিপুণ চিত্রকল্প। এই গল্পের শুরু হয়েছে এভাবে-‘শীতের প্রতি আমার পক্ষপাত শৈশব থেকেই। রোগজীবাণুর স্বল্পতা, টাটকা সবজি, উৎসবমুখর পৌষ-পার্বণ, লেপের নিচে উষ্ণনিদ্রা, নরম রোদের জন্য অপেক্ষা, শীতের বিচিত্র লীলার আমি মুগ্ধ গুণগ্রাহী। সেই শীত যে এমন মর্মান্তিক হয়ে আমার জীবনে আঘাত হানবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। গায়ে চার-পাঁচটি পোশাক চাপিয়ে কোনোরকমে সেই বিভীষিকাময় রাতটি পার করেছি, বলা বাহুল্য নিদ্রাহীনভাবে’। লেখার বর্ণনাভঙ্গী এমন যেন শীত গায়ে কবিতার প্রান্তরে বিচরণ করছেন তিনি।

ইংল্যান্ডে অধ্যয়নকালে রাজীব সরকার সেখানকার বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ, শিক্ষার মান, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার করুণচিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন,- ‘নানা বিবর্তন ঘটে গেলেও আমাদের দেশে শিক্ষকসমাজ এখনো সমাজের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় আসনে অধিষ্ঠিত। কয়েক দশক আগে এদেশের বিদ্যালয়গুলো ছিল কাঁচা, কিন্তু শিক্ষক ছিলেন পাকা। এখন বিদ্যালয় পাকা, কিন্তু শিক্ষক কাঁচা। বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির প্রতি আগের তুলনায় এ যুগের শিক্ষকমণ্ডলীর ঝোঁক বেশি। কিন্তু এখনো সমাজে এমন শিক্ষক রয়েছেন, ত্যাগ ও নীতিনিষ্ঠায় যারা সমাজের আদর্শ।’ লেখক তাঁর সাহসী উচ্চারণে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘স্কুল-কলেজে এখন শিক্ষার্থী তৈরি হয় না, পরীক্ষার্থী তৈরি হয়। শিক্ষকমণ্ডলী শ্রেণিকক্ষের চেয়ে নিজের বাড়িতে বা কোচিংসেন্টারে পাঠদানে বেশি আগ্রহী। গুরুগৃহ বলতে এখন কিছু নেই, শিক্ষকের বাড়ি যেন সুপারমার্কেট। বিদ্যা নামক পণ্য সেখানে কেনাবেচা হয়। কয়েকজন ত্যাগী শিক্ষক ছাড়া অবশিষ্ট শিক্ষকসমাজ শিক্ষকদের চিরন্তন ঐতিহ্য থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন। এর নেতিবাচক ফলাফল সমগ্র সমাজে বিদ্যমান।’ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এমন মর্মান্তিক চিত্রল বর্ণনা তেমন চোখে পড়ে কি?

ব্রিটিশ মিউজিয়াম বিশ্বের সেরা মিউজিয়াম। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিশ্বাস্য আকর এই ব্রিটিশ মিউজিয়াম। লেখকের কথায়-‘মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তন কেউ যদি চাক্ষুষ করতে চায়, তবে তাকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আসতেই হবে। অতি পুরনো হস্তলিপি, প্রাচীনতম মুদ্রা, ঐতিহ্যাবিষ্ট মমি, প্রাচীনশিল্পীদের কারুকার্য, চিত্রশিল্প, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য, মহা মূল্যবান ধাতু, দেব-দেবীর আদি মূর্তি কী নেই সেখানে?’ তারপরই লেখক অত্যন্ত বেদনার সাথে যে মন্তব্য করেছেন তা যেন এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার হাজারো মানুষের কষ্টের- বেদনার কথা। মিউজিয়াম দেখতে দেখতে লেখকের মনে হয়েছে-‘হাজার হাজার বছর আগের যে গ্রিক মিসরীয় ঐতিহ্য এই জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে তা গ্রিসে বা মিশরে থাকলে কি ক্ষতি ছিল? এমন উদাহারণ দেয়া যায় আরো নানা দেশ প্রসঙ্গে। লুন্ঠন ও সভ্যতা যে সমার্থক হতে পারে তার জ্বলন্ত সাক্ষী এই ব্রিটিশ মিউজিয়াম।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ জুড়ে স্নায়ুযুদ্ধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর একদিকে পুঁজিবাদী বিশ্ব অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব যার নেতৃত্বে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই স্নায়ুযুদ্ধের ফলশ্রুতিতেই পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলো দেশ সমাজতান্ত্রিক বলয় ছেড়ে নিজেরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আলাদা হয়ে যায়। কমিউনিস্ট শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে পুঁজিবাদী বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলতে শুরু করে তারা। প্রাগে অবস্থিত ‘মিউজিয়াম অব কমিউনিজম’ রাজীব সরকারের অভিজ্ঞতায় ছাপ ফেলে যায়। চেক-প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে অবস্থিত সাম্যবাদের জাদুঘর পরিদর্শন করার সময় এক ঘন্টার একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখে লেখক মন্তব্য করেন-‘ সমাজতন্ত্র স্বপ্ন হিসেবে মহৎ, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল জগদ্দল পাথর। ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’ বইয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাই প্রবল উচ্ছাস ব্যক্ত করেছেন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ে। ত্যাগে নয় ভোগেই প্রকৃত সুখ- এই স্বপ্নে আপাদ-মস্তক বিভোর হয়ে উঠেছিল পূর্ব ইউরোপ। …চেক তরুণ-তরুণীদের মনে এসব প্রশ্নের বালাই নেই। পুঁজিবাদ তথা ভোগবাদে নিমজ্জিত তারা।’

গুরুগৃহ বলতে এখন কিছু নেই, শিক্ষকের বাড়ি যেন সুপারমার্কেট। বিদ্যা নামক পণ্য সেখানে কেনাবেচা হয়

স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভায় পৌঁছে লেখকের অনুভূতি-‘১৯৯৩ সালে জন্ম নেয়া দেশটিতে সাবেক কমিউনিস্ট শাসনের কোনো চি‎হ্নই যেন নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি সৌধ নির্মিত হয়েছে এখানে।’
হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্টে স্বল্প সময়ের অবস্থানকে লেখক অবিস্মরণীয় বলে উল্লেখ করেছেন। অপূর্ব আলংকারিক প্রাঞ্জল ভাষায় তা বর্ণনাও করেছেন। লিখেছেন- ‘এমন অপূর্ব শহর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দানিয়ুব নদীর ওপর কারুকার্যময় স্থাপত্যমণ্ডিত সেতু, এক নয়; একাধিক। এক সেতু থেকে দাঁড়িয়ে দূরের সেতুর বর্ণিল উজ্জ্বলতাকে মনে হয় রূপসী নদীর কণ্ঠে জ্বলজ্বলে অলংকার। এত প্রাণ, এত লাবণ্য অথচ কত সুশৃঙ্খল-একেবারে অভাবনীয়। হিরো স্কয়ার নামে মুক্ত প্রান্তরটি হাঙ্গেরির সমস্ত বীরের উদ্দেশে নিবেদিত। যেন সীমাহীন এই প্রান্তর, পেছনে হ্রদের টলমল করা জল। পার্লামেন্ট হাউস, চেইন ব্রিজ, চার্চ-সব মিলিয়ে এক অশেষ আনন্দের সমাবেশ এখানে।’

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় স্বল্প সময়ের অবস্থানকালে যেটুকু লেখক দেখেছেন তাও তিনি বর্ণনা করেছেন ভাষার নান্দনিক মাধুর্য মিশিয়ে। ‘এক সময় ‘ইউরোপের রাণী’ বলে পরিচিত ভিয়েনা যেন বিধবার বেশ ধারণ করেছে। বিধবা, তবে অতুলনীয় সুন্দরী। মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য, শৈল্পিক সুষমামন্ডিত প্রাসাদ: রাজকীয় বাগান বিলাস, গীতসুধাময় আবহ- নানা বিবেচনা ভিয়েনাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগরীর মর্যাদা দিয়েছে।’
ভিয়েনার নয়নাভিরাম রাজপ্রাসাদের বর্ণনায় বলেন- ‘নন্দনকানন বা স্বর্গোদ্যান বললে আমাদের মনে যে চিত্রকল্প উপস্থিত হয় তারই মূর্তরূপ এই তিলোত্তমা প্রাসাদ। শ্বেতশুভ্র প্রাসাদের বহিরঙ্গ সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত। ভেতরে ১,৪৪১টি বিলাসবহুল কক্ষ মনোরঞ্জনের পক্ষে অত্যধিক। বাইরে বহুবর্ণা বিচিত্রগন্ধি ফুলের কোলাহল। কিছুদূর পরপর হৃদয় হরণকারী হ্রদ, যৌবনবতী ঝরনার ফল্গুধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। বিশ্বসংঙ্গীতের রাজধানী বলে স্বীকৃত ভিয়েনাতে জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও সৃজনশীল সময় কাটিয়েছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সুরশিল্পী মোজার্ট। শুধু নান্দনিক স্থাপত্যে বা চিত্রকর্মে নয়, ভোগ্যপণ্যের গায়েও মোজার্টের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে এই নগরী।’ অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনায় মুখরিত লেখকের ভিয়েনা দর্শন। ভিয়েনা বর্ণনায় তিনি রীতিমতো কবি হয়ে ওঠেছেন। লেখক ভিয়েনার যে বর্ণনা দিয়েছেন মনে হয়, সদ্যফোটা ভোরের শিশির ভেজা লাল গোলাপ। পাপড়ির ওপর কাঁচা সোনা রোদ ঝিকমিক করছে ফিনফিনে হাওয়ায় নিবিড় উড়ছে রঙিন প্রজাপতি। তার রঙিন ডানার স্নিগ্ধ আলো পড়ছে মগ্ন পাঠকের চোখে। শেষ অব্দি জয় গোস্বামীর ‘স্নান’ কবিতাটি মেলে ধরেছেন।

ভেতরে ১,৪৪১টি বিলাসবহুল কক্ষ মনোরঞ্জনের পক্ষে অত্যধিক। বাইরে বহুবর্ণা বিচিত্রগন্ধি ফুলের কোলাহল

ইতালী শিল্প আর কালজয়ী শিল্পীর নগরী। মাদক আর পতিতাবৃত্তির জন্যে আলোচিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ভাগ্যান্বেষণের জন্যে এদেশে এসে ঠাঁই নেয়। লেখকের নান্দনিক উচ্চারণ- ‘পঞ্চদশ থেকে প্রায় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত নবজাগরণের ঢেউ প্লাবিত করে ইউরোপের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কারকে। মিকেলেঞ্জোলো, বতিচেল্লি, রাফায়েল, ভিঞ্চি, গ্যালিলিও-আরো কত শ্রেষ্ঠ মনীষীর কালজয়ী প্রতিভার উদাহরণ হয়ে আছে ফ্লোরেন্স নগরী। মিকেলেঞ্জোলোর-‘ডেভিড’, ‘পিয়েটা’, ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’, ‘দ্য লাস্ট সাপার’, বতিচেল্লির ‘দ্য বার্থ অব ভেনাস’ এর প্রভাব শহরের সর্বত্র।’ এ সবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্পের আশ্রয় নিয়েছেন তা কাব্যসুষমামন্ডিত।
সুইজারল্যান্ডকে তিনি আবিষ্কার করেছেন জোছনাস্নাত সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে। তাঁর ভাষায়- ‘কল্পনায় স্বর্গের যেমন চেহারা আমরা কল্পনা করে থাকি এ যেন ঠিক তা-ই। আল্পসের চূড়ায় অনন্ত জোছনার উৎস- এমন অবিস্মরণীয় সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগ কি আর কখনো পাবো? হ্রদের ত্রিমুখি মোহনায় সবুজ জলের উত্তাল ঢেউ গর্জন করে মাতিয়ে রেখেছে পর্বত বেষ্টিত সরোবর।’ লেখক দেশটির মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে বর্ণনা করেছেন তা পড়ে মনে হয়, কোনো শ্রেষ্ঠ শিল্পীর আঁকা বৃষ্টি ভেজা জোছনার ছবি।

রাজীব সরকার তাঁর এই যাত্রায় সম্ভবত একটি শহরকেই মন ভরে দেখেছেন আর হৃদয় উজাড় করে মনের মাধুরী মিশিয়ে পাঠককে উপহার দিয়েছেন নান্দনিক বর্ণনায়। সেই শহরটির নাম প্যারিস। তার বর্ণনায়- ‘বহু বর্ণিল ও বিচিত্র প্যারিসকে চেষ্টা করেছি একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে ভাবতে। চমৎকার রাস্তার দু’পাশে ম্যানসার্ড ছাদ। কালো শিরস্ত্রাণ পরা বাড়িগুলোর দোতলায় রঙিন ফুলের ঝাড় বুকে ছোট ছোট অলিন্দ একতলার দেয়াল জোড়া কাঁচের জানালার পেছনে একজোড়া জুতো যেন চিরন্তন প্রদর্শনী। প্রশস্ত ফুটপাতে সারি সারি ক্যাফেতে সাদা-পোশাকের পরিচারকদের ব্যস্ত আনাগোনা, মাঝেমধ্যে গথিক ছাদের গির্জা, রাজকীয় গম্বুজ মাথায় শতাব্দী-প্রাচীন প্রাসাদোপম অট্টালিকা, পাথর বাঁধানো গলিতে চত্বরে ইতিহাসের লেখাজোখা- এই হলো প্যারিস।’ প্যারিসের পথে পথে রোমাঞ্চ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেক্স শপ, ইরোটিকস মিউজিয়াম এবং লাভ স্টোর। অলিতে গলিতে দেহপসারিণীদের আনাগোনা। প্যারিসের পথ-ঘাট চোর বাটপারদের জন্যও প্রসিদ্ধ। প্যারিসের বাতাসে বাতাসে বিস্ময়, পথে পথে সৌন্দর্য।’

রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেক্স শপ, ইরোটিকস মিউজিয়াম লাভ স্টোর। অলিতে গলিতে দেহপসারিণীদের আনাগোনা

উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত অপেরা হাউজ ঐতিহ্যগত স্থাপত্য শৌকর্যে ও নান্দনিক দ্যুতিতে তুলনাহীন। আইফেল টাওয়ারের শীর্ষবিন্দু থেকে প্যারিসের মনোরম সৌন্দর্য অবলোকন, লুভ মিউজিয়াম পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা ও তার জন্মের নেপথ্য কাহিনীও তিনি বর্ণনা করেছেন অল্প কথায়। লুভ মিউজিয়ামের বিশ্বজয়ের প্রধান কারণ মোনালিসা। ভার্সাই প্রাসাদ যা ফরাসী বিপ্লবের পর রাজকীয় প্রাসাদে পরিণত হয়- তারও সংক্ষিপ্ত অথচ চমকপ্রদ বর্ণনা করেছেন লেখক। তিনি বর্ণনা করেছেন আর্মি মিউজিয়ামের- যেখানে রাজনৈতিক সামাজিক, সংস্কৃতি, নৃতাত্বিক, সামরিক নানা বিষয়ে বিশ্লিষ্ট করে ইতিহাসকে লালন ও সংরক্ষণ করা হয়। মধ্যযুগের শেষ পর্ব থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ফ্রান্সের সামরিক ইতিহাস সাড়ম্বরে এখানে সংরক্ষিত। ফরাসী ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বীর নেপোলিয়নের সমাধি এই জাদুঘরের সব চেয়ে বড় আকর্ষণ। শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি আর সভ্যতার মানদন্ডে প্যারিস তুলনাহীন। স্বপ্নের প্যারিসকে লেখক তার লেখায় সেই অসামান্য নান্দনিক বর্ণিল দৃশ্যাবলি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন পটে আঁকা ছবির মতো।
‘ভুবন ভ্রমিয়া শেষে, আমি এসেছি নিজের দেশে’- প্যারিস থেকে লন্ডনে ফেরার পথে রবীন্দ্রনাথের এই গান লেখকের মনে পড়ে। ব্রজেন দাসের কীর্তিধন্য ইংলিশ চ্যানেল পার হতে হতে আনন্দের জল ছুঁয়ে যায় লেখকের চোখ। ‘কুয়াশা মিলিয়ে গেলো, সূর্যের আলো ঠিকরে পড়লো চোখে-মুখে। স্বাগত জানালো লন্ডন।’ লন্ডন থেকে বিদায় নেওয়ার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই আরো নিবিড়ভাবে লন্ডনকে দেখার ইচ্ছে জাগে লেখকের। লন্ডনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ‘ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি’। প্রায় আড়াইহাজার পেইন্টিং, ছয় শতাব্দীর শিল্পের ইতিহাস। রেমব্রান্ট, মিকেলেঞ্জোলো, ভিষ্ণি, রাফায়েল কে নেই এখানে ? লেখককে সবচেয়ে আকৃষ্ট করে রেমব্রান্ট। বিশ্বখ্যাত চিত্রীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই কখনো সৌন্দর্যের পূজা করেননি- এর পেছনে আছে ব্যক্তিজীবনের গোপন ট্র্যাজেডি। ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারি থেকে ভালোবাসার চোখ ফেরাতে পারেননি রাজীব সরকার। পাঠক শ্রোতাকেও মগ্ন রাখেন নিবিড় ভাবে। এই গ্যালারির সূচনা হয়েছে শেক্সপিয়রকে দিয়ে। লেখকের ভাষায়- ‘ঈশ্বরের পর তিনিই সবচেয়ে বেশি মানুষ (চরিত্র) সৃষ্টি করেছেন।’ পোর্ট্রেট গ্যালারিতে রাণী ভিক্টোরিয়া, প্রিন্স আলবার্ট মেরিলি মনরো দ্যুতি ছড়িয়েছেন। স্মৃতির অটোগ্রাফ নিয়ে এবার ফেরার পালা। সংবেদনশীল লেখকের সংগত কারণেই মনে পড়েছে; রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের কথা। মনে পড়বেই তো শেষে রবীন্দ্রনাথেই সান্ত্বনা ‘জীবনে এমন কত মৃত্যু, কত বিচ্ছেদ আছে। ফিরিয়া ফল কী? পৃথিবীতে কে কাহার?’

নান্দনিক ভাষাশৈলী ও বর্ণনার প্রসাদগুণে অতীব আকর্ষণীয় গল্পের ভেতর আরও এক নতুন গল্প পাঠ করা যায়

রাজীব সরকারের শেষ উচ্চারণ বড়ো প্রাপ্তির, আনন্দের, ‘জ্ঞানরাজ্যের রাজধানী ইংল্যান্ড শূন্য হাতে আমাকে ফেরায়নি। আত্মিক, জাগতিক-দুদিক থেকেই ঋদ্ধ হয়ে ফিরেছি।’ অসঙ্কোচে বলা যায় এ আনন্দ কেবল লেখকের নয়, ‘ইউরোপের পথে পথে’ পাঠকেরও। প্রসঙ্গক্রমে লেখক অন্নদাশংকর রায়ের দু’বছর ইউরোপে অবস্থানের সীমাহীন মুগ্ধতার কথা স্মরণ করেছেন।
গ্রন্থটি শেষ করেছেন আনন্দের জ্যোৎস্নাজল চোখে, ‘ইউরোপের হৃদয়জুড়ে বিহার যখন শেষ প্রান্তে তখন মনের কোণে উঁকি মারলো স্বদেশের এক চিলতে আলো। বাংলাদেশের বিমান বন্দরে অবতরণের আগমুর্হূতে প্রাণভরে দেখে নিলাম লাল সবুজ বাংলাদেশকে।’
‘ইউরোপের পথে পথে’ গ্রন্থভুক্ত আলোকচিত্রসমূহ সংশ্লিষ্ট দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা। এই ছবিগুলিই বহন করছে তাদের জাতীয় চেতনা ও মূল্যবোধ। লেখকের সচিত্র বর্ণনা বড়ো মনোমুগ্ধকর। নান্দনিক ভাষাশৈলী ও বর্ণনার প্রসাদগুণে অতীব আকর্ষণীয় গল্পের ভেতর আরও এক নতুন গল্প পাঠ করা যায়। সে গল্প কল্পলোকের স্পর্শহীন অতৃপ্ত বেদনার নয়। বাস্তবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা ঘাস, ফুল নদীর মতো, জয়নুল, যামিনী, ভ্যানগগের ছবির মতো। আর এখানেই ভ্রমণ কাহিনী লেখক রাজীব সরকার সৃজনশীল সাহিত্যের একজন দক্ষ ভাষাচিত্রী হয়ে ওঠেন। গ্রন্থে নিরাসক্ত মুগ্ধতা, গতিশীল ভাষা, সূক্ষ্ণ কৌতুকবোধ শিল্পকর্মের অপূর্ব বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনা, সুচিন্তিত মন্তব্য, সুগভীর পর্যালোচনা, সমকালীনতা ও চিরকালীনতার দর্শনঋদ্ধ। আর এখানেই লেখক হিসেবে রাজীব সরকারের বিশিষ্টতা।

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!