
তবুও মানব থেকে যায়
~
পৃথিবীর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের একজন আমি,
বৃদ্ধ কনফুসিয়াস, সেও বয়সে কনিষ্ঠ আমার;
আমি দেখেছি মানুষের সমস্ত উত্থান-পতন
বেবিলন-আসিরিয়ার গড়ে ওঠা
আবার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া—
তাও প্রত্যক্ষ করেছি আমি;
আমার চোখের ’পরে
বারবার ব্যর্থ হলো মানুষের মুক্তির কত আয়োজন।
তারপরও
‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’
ক্রুশবিদ্ধ যিশু, হেমলকের পেয়ালা হাতে সক্রেটিস
সেই সাক্ষ্য দেয়।
আজও যখন
আমার মাংস নিয়ে শেয়াল আর শকুনের কাড়াকাড়ি,
যন্ত্রণাক্লিষ্ট, বিচলিত, মৃতপ্রায় আমি,
তবু মনের গভীরে বিশ্বাস হারাতে ইচ্ছে করে না
দানব নির্বংশ হবে, মানুষের হবে জয়, একদিন…
একটি প্রার্থনার পূর্বকথন
~
যে দেশে
কবিও চাকর হতে চায়,
তাঁবেদার বনে যায় বিজ্ঞানী-দার্শনিক,
স্থপতি-প্রযুক্তিবিদ
কর্তার কথার মাপে তৈরি করে গর্ভশূন্য ইমারত,
কোতোয়ালের বয়ানকেই বেদবাক্য বলে রায় দেয়
আইনবিশারদ,
জনস্বার্থ পায়ের নিচে ফেলে
নিজের উচ্চতা নিয়ে আত্মকলহে লিপ্ত সুশীলসেবক।
সেই দেশের অঙ্গারকলুষিত বায়ুমন্ডল
আমার জন্য হারাম করে দাও
হে পরওয়ারদিগার!
মানুষ এত রেগে আছে কেন
~
ক্রোধ-হিংসা-রিরংসায় উন্মত্ত মানুষের কল্যাণে
শান্তি চলে গেছে ‘মানুষের দূরবিনে’,
কথায় কথায় হানাহানি
কথায় কথায় বোমা-পিস্তল, কিরিচের ঝলসানি
মানুষের মাংস নিয়ে মানুষের টানাটানি।
উজির নাজির সব যুদ্ধংদেহি—
পান্থজনের প্রাণ
কোতোয়ালের হাতের মুঠোয়।
প্রপঞ্চ জগতে মগ্ন নমস্যজনেরা
ভাগ্যের ভাগাভাগি নিয়ে
একে অপরের ছবি আঁকেন বিশ্রী ভাষায়!
তাঁদের হৃদয় ক্ষমাহীন, দয়াহীন—
তাঁদের হৃদয়ে প্রতিহিংসার অবাধ বসবাস।
দান কর, দয়া কর, দমন কর—
এসকল মহামূল্য বাণী ব্যর্থ হয়ে গেছে
এই ‘অদ্ভূত আঁধারে’…
নিয়তি
~
সুমধুর পরিহাস নিষ্ঠুর নিয়তির—
যাদের অশ্রুবিন্দু করতে মোচন
বারবার হাতের মুঠোয় নিয়েছি প্রাণ,
একিলিসের ক্রোধ উপেক্ষা করে
ভূমধ্যসাগরের অন্ধকার থেকে
খুঁজে এনেছি গন্ধমাদন,
রাক্ষসের সজাগ পাহারা ফাঁকি দিয়ে
পদ্মের নাভিমূল থেকে
তুলে এনেছি দানবের প্রাণভোমরা—
সেইসব মহাত্মা, প্রাতঃস্মরণীয় গুণীজন
বিপুল আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গোনেন—
কখন সম্পন্ন হবে
আমার মৃত্যুর আয়োজন!
শব্দকোষ মন্থন করে তাঁরা তূণে সাজান
বিষবাষ্পে সজ্জিত অব্যর্থ বাক্যশর,
যার নিখুঁত আক্রমণে
যে-কোনো শুভক্ষণে
নিভে যেতে পারে
আমার হৃদয়যন্ত্রের হাজার বছরের কোলাহল!
আমি ও আমার পাপের উপাখ্যান
~
অন্যের বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা ফুল
আমাকে নিয়ত বিদ্ধ করে গ্লানির কাঁটায়;
সুন্দরকে করেছি জবরদখল
অন্যের খেতের বেড়া ভেঙে;
কোনো এক গেরস্তের বুকের আঙিনায় হানা দিয়ে
গড়ে তুলেছি উপনিবেশ
লুন্ঠন করেছি তার প্রাণের সঞ্চয়;
সেই অভিশাপে আমার উঠোন ভরা শুকনো পাতা
আমি কবে যে পাপমুক্ত হব
অন্ধকারে ডুব দিয়ে—
যেমন পুণ্যার্থী আসেন গঙ্গাস্নানে
পাপক্ষালনের দুরাশায়!