Author Picture

যব: বিস্ময়কর এক খাদ্য

ড. ক্ষীরোদ রায়

খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ অব্দে জন্মগ্রহণকারী চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্র্যাটীজের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে মূলনীতির অন্যতম প্রধান ছিল ’খাদ্য আপনার ঔষধ এবং ঔষধ আপনার খাদ্য হউক’। অধিকাংশ লোক আজকের দিনেও একে ধ্রুব সত্য বলে মনে করেন। সেই বিবেচনায় আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে আবাদ করা যবকে একটা অত্যন্ত কার্যকরী ওষুধ বলা যায়।

বিশ্বে যবের চাষ করা হচ্ছে ৯৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। এর ইংরেজি নাম বার্লি। বহু পূর্বে রবিনসন বার্লি অত্যন্ত জনপ্রিয় শিশু খাদ্য ছিল। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানেন না যে বার্লি হলো আমাদের দেশে বহু পূর্ব থেকে প্রচলিত যব। এর বহু রকমের ব্যবহার আছে। বিশ্বে উৎপাদিত যবের বড় একটা অংশ প্রাণী খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া বিয়ারসহ কয়েকটি পানীয় তৈরির প্রধান উপাদান এবং বিভিন্ন প্রকারের সুষম খাদ্য প্রস্তুত করতেও এটা ব্যবহার করা হয়। প্লীহা ও পাকস্থলীর কর্মক্ষমতা বাড়াতে এবং অজীর্ণ রোগ দূর করতে যব খুব ভালো কাজ করে। গরমের সময় বিভিন্ন প্রকার শারীরিক সমস্যা নিরসনে প্রতিষেধক হিসেবে এটা কার্যকরী  ভূমিকা রাখে।

বিশ্বে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনে যবের স্থান চতুর্থ। ভুট্টা, ধান ও গমের পরেই। তবে এর উৎপাদন প্রতিবছর অব্যাহতভাবে কমছে। বাণিজ্যিকভাবে প্রধান যব উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ান ফেডারেশন, জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম যবের উদ্ভব হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের আদি হরপ্পান সভ্যতার সময়- ধান, গম, মটর ও ছোলার ডাল, তিসি, সরিষা, তুলা, খেজুর ও আঙুরের সঙ্গে যব চাষের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটা একটা খরা-সহিষ্ণু ফসল। সারাদেশে শীতকালে ব্যাপকভাবে বোরো ধান আবাদের আগে আমাদের দেশে এ সময় গম, যব, চীনা, কাউন, বাজরা প্রভৃতি দানাজাতীয় ফসলের চাষ হতো। তখন দেশের খুব বড় একটা অংশ বর্ষাকালে ডুবে যেত। বন্যার প্রকোপ বেশি হলে খাদ্যাভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য কৃষকগণ শীতকালে বেশি করে যবের চাষ করতেন। বর্তমানে যবের চাষ খুব সীমিত আকারে করা হয় যা প্রধানত ছাতু তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

হজমশক্তি বাড়ানো ও অন্ত্র দ্রুত খালি হওয়া সুস্বাস্থ্য অর্জনে খুব বড় ভূমিকা পালন করে। এজন্য খাবারে বেশি পরিমাণ খাদ্য আঁশ থাকা প্রয়োজন। এর প্রধান উৎস খাদ্যশস্য, সবজি ও ফল। খাদ্যশস্যের মধ্যে প্রতি ১০০ গ্রাম সাদা চালে খাদ্য আঁশ থাকে মাত্র ০.৪ গ্রাম; যেখানে আটায় ১০.৭, ওটসে ১১ এবং যবের ছাতুতে ১৭.৩গ্রাম। খাদ্য আঁশ বেশি খেলে অনেক বেশি সময় ধরে পেট ভরা থাকে বলে এটা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুব কার্যকরী। এটা কোলেস্টেরল এবং রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কোলনক্যান্সার প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে। খাদ্য আঁশ ছাড়াও মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়ামের খুব ভালো উৎস যব। এটা কপার, ভিটামিন বি১, ক্রোমিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম এবং নাইসনেরও ভালো উৎস। তাছাড়াও এতে প্রচুর লিগন্যান(অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট) থাকে যা ক্যন্সার ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়। যব ভিজিয়ে রাখার পর অংকুরোদ্গম করে খেলে এ থেকে বেশি পরিমাণ ভিটামিন, খনিজদ্রব্য, প্রোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ অব্দে জন্মগ্রহণকারী চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্র্যাটীজের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে মূলনীতির অন্যতম প্রধান ছিল ’খাদ্য আপনার ঔষধ এবং ঔষধ আপনার খাদ্য হউক’। অধিকাংশ লোক আজকের দিনেও একে ধ্রুব সত্য বলে মনে করেন। সেই বিবেচনায় আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে আবাদ করা যবকে একটা অত্যন্ত কার্যকরী ওষুধ বলা যায়।

যবে পানিতে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় উভয় প্রকার খাদ্য আঁশই থাকে। দ্রবণীয় আঁশে বেটা-গ্লুক্যান থাকে যা অন্ত্রে জেলির মতো একটা দ্রব্য তৈরি করে বলে এটা খাদ্য হজম ও পুষ্টিকর পদার্থ হজম করার গতি কমিয়ে দেয় বলে পেট ভরা আছে মনে হয়। কম খিদে লাগায় প্রধান খাবারের মাঝে অকারণে ক্ষতিকর হালকা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা যায়। বেটা-গ্লুক্যান পিত্ত অ্যাসিডের সঙ্গে মিশে ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল কমায় এবং মলের সঙ্গে বের করে দেয়। দ্রবণীয় আঁশ রক্তচাপ কমাতেও সহায্য করে। এতে থাকা ভিটামিন বি-র উপাদান নাইসন হৃদ্যন্ত্র সবল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যবে tocols নামে একটা রাসায়নিক পদার্থ আছে যা এলডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে সার্বিকভাবে হৃদ্যন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীর থেকে ফ্রি র‌্যাডিক্যাল্স্ বের করে দেয় যা হৃদ্যন্ত্রকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) হৃদ্রোগ ও কোলেস্টেরল কমাতে যবের বেটাফাইবার-এর উপকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। দ্রবণীয় আঁশ কোলন ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী উপাদান দ্রুত শরীর থেকে বের করে দেয়। যবের সেলেনিয়াম এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফাইটিক অ্যাসিড, ফেনোলিক অ্যাসিড ও স্যাপোনিন ক্যান্সার রোধ করে বা এর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। অদ্রবণীয় আঁশ দ্রুত অন্ত্র খালি করে বলেও কোলন ক্যান্সার হওয়া প্রতিরোধ করে। যবে ফেরুলিক অ্যাসিড থাকে যা টিউমার বড় হওয়া রোধ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে যবের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোলন ক্যান্সারের কোষ বেড়ে যাওয়া বন্ধ করতে পারে। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, যব রক্তচাপ ও ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায় এবং কোলন ক্যান্সার রোধ করে।

দ্রবণীয় আঁশের চেয়ে অনেক বেশি অদ্রবণীয় আঁশ থাকে বলে অন্ত্রে মলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত অন্ত্র খালি করে দেয় বলে কোষ্ঠাকাঠিন্য নিবারণে যব খুব কার্যকরী। মহিলাদের মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে অদ্রবণীয় আঁশ তাদের পিত্তথলিতে পাথর জমা কমিয়ে দিতে পারে বলে পিত্তকোষ ফেলে দেয়ার জন্য অস্ত্রোপচার করার ঝুঁকি কমায়। এটা পরিপাক নালীর উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়ায় বলে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া কমিয়ে রাখে।

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা জিআই হলো বিভিন্ন খাদ্যের রক্তের শর্করার মাত্রা কীভাবে শরীরকে প্রভাবিত করে তার তুলনামূলক অবস্থান। এটা ৫৫-এর নিচে হলে নিন্ম, ৫৬-৭০ হলে মধ্যম এবং ৭১-১০০ হলে উচ্চ বলা হয়। চাল ও আটার জিআই উচ্চ হলেও চালের চেয়ে আটার কম এবং যব ও ওটসের নিন্ম হলেও ওটসের চেয়ে যবের আরো কম। পাশ্চাত্যে গবেষণা করে দেখা গেছে প্রাতরাশে যব-ফ্লেক খেয়ে ওটমিল খাওয়ার চেয়ে ৯-১৩% রক্তের শর্করা কম থাকে। যবে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম থাকে যা ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে। আবার দ্রবণীয় আঁশ পরিপাক নালীর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রক্তের শর্করা শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যা প্রকারান্তরে ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন, সাড়ে তিনশত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত, পৃথিবীর ১০০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন যে যবের মধ্যে এক ধরনের উপকারী পথ্য আছে যা রক্তের শর্করার পরিমাণ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ডায়াবেটিস রোগীগণকে প্রধানত টাইপ-১ ও টাইপ-২ এই দুই ধরনে ভাগ করা হয় যার মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগীই টাইপ-২ ধরনের। উক্ত গবেষকগণ দেখেছেন যবের মধ্যে আঁশের মিশ্রণ থাকে যা ধীরে ধীরে দেহের রাসায়নিক রূপান্তর ঘটায় যা প্রকারান্তরে মানুষকে ক্ষুধার্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। শরীরের ওজন বেশি হওয়ার সঙ্গে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সংযোগ থাকে বলে ধারণা করা হয়। নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখেছি যে প্রাত:রাশের সময় রুটির পরিবর্তে ওটস খেলে ইনসুলিনের পরিমাণ ৬১ শতাংশ এবং ওটসের পরিবর্তে যবের ছাতু খেলে ১৪ শতাংশ কম লাগে। আমার পরামর্শ নিয়ে কয়েকজন ডায়াবেটিস রোগী একই রকম ফল পেয়েছেন।

আমাদের দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পাশ্চাত্য খাবারে জনগণ বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেই সাথে বাড়ছে নানা ধরনের রোগ বালাই। দেশের বহু এলাকায় যবের চাষ প্রচলিত ছিল না বলে সেসব এলাকার বয়স্ক লোকজনও হয়তো কোনোদিন ছাতু খাননি, তাই এর উপকারের কথাও জানেন না। কিন্তু যাঁরা খেয়েছেন তাঁরা স্বীকার করেন যে এটা একটা চমৎকার খাদ্য।

সারা বিশ্বে ১০-১৫ শতাংশ লোক আইবিএস (Irritable Bowel Syndrome) রোগে আক্রান্ত। আমাদের দেশেও প্রচুর আইবিএস রোগী আছেন যাঁরা চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলেও সুস্থ হন না বা রোগের কারণ জানতে পারেন না বলে হতাশ হয়ে পড়েন। প্রধান তিন প্রকার আইবিএস হলো ১) কোষ্ঠকাঠিন্য-জনিত যেখানে পেট ব্যথা ও অস্বস্তি হয়, ঢেঁকুর ওঠে, মল কঠিন থাকে এবং নিয়মিত মলত্যাগ হয় না, ২) ডায়রিয়া-জনিত যেখানে পেট ব্যথা ও অস্বস্তি হয়, মলত্যাগের বেগ প্রচন্ড ও ঘন ঘন হয় এবং পাতলা বা তরল মলত্যাগ হয়, এবং ৩) কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়ার মিশ্র রূপ। অনেকের আবার খাবার ঠিকমতো হজম হয় না, ঘুম হয় না এবং অবসাদ নেমে আসে। ব্রিটিশ একটা কোম্পানি সিম্প্রুভ নামক একটা তরল সম্পূরক খাবার উদ্ভাবন করেছে যা সুষম খাবারের সঙ্গে খেলে আইবিএস নিয়ন্ত্রণে থাকে। পানি, অঙ্কুরিত যবের নির্যাস, কয়েকটি উপকারি জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে সিম্প্রুভ তৈরি করা হয়। যবের দ্রবণীয় আঁশ মলের পরিমাণ বাড়িয়ে অন্ত্র দ্রুত খালি করে বলে আইবিএস নিয়ন্ত্রণে থাকে বা নিরাময় হয়। রাত্রে রুটির পরিবর্তে ছাতু খাওয়া শুরু করার পরপরই আমার দীর্ঘদিনের ডায়রিয়া-জনিত আইবিএস নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

বার্লি ওয়াটার পাশ্চাত্যে একটা জনপ্রিয় পানীয়। বিশ্বখ্যাত উইম্বলডন টেনিস খেলায় বহু আগে থেকেই খেলোয়াড়দের মধ্যে পানীয় হিসেবে বার্লি ওয়াটার সরবরাহ করা হয়। যব মেশানো পানি ফুটিয়ে বার্লি ওয়াটার তৈরি করা হয়। বার্লির দানা ছেঁকে নিয়ে বার্লি ওয়াটার তৈরি করা হয়। আর বার্লি ছেঁকে নেয়ার পর ফলের রস বা চিনি দিয়ে গুলিয়ে শরবৎ বা লেমোনেড বানানো হয়। বার্লি ওয়াটারের সাথে লেমন, কমলা, আম, আনারস, চেরি, প্যাশন ফল ইত্যাদি মিশিয়ে জনপ্রিয় এবং স্বাস্থ্যপ্রদ পানীয় তৈরি করা হয়। তবে ছেঁকে নেয়ার ফলে খাদ্য আঁশ কমে যায় যা মোটেই কাম্য নয়। এই পানীয় ওজন কমাতে, শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্য বের করে দিতে, নিয়মিত খাবার হজম করতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং আরো নানা রকম উপকার পাওয়ার জন্য খুবই কার্যকরী। রবিনসন বার্লি ওয়াটার পাশ্চাত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা পানীয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পানীয় বাজারজাতকরণ কোম্পানিগুলো তাদের ব্রান্ডের নামে বার্লি ওয়াটার বাজারজাত করে। ভারতেও অনেকগুলি কোম্পানি এ পানীয়টি বাজারজাত করে।

আমাদের দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পাশ্চাত্য খাবারে জনগণ বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেই সাথে বাড়ছে নানা ধরনের রোগ বালাই। দেশের বহু এলাকায় যবের চাষ প্রচলিত ছিল না বলে সেসব এলাকার বয়স্ক লোকজনও হয়তো কোনোদিন ছাতু খাননি, তাই এর উপকারের কথাও জানেন না। কিন্তু যাঁরা খেয়েছেন তাঁরা স্বীকার করেন যে এটা একটা চমৎকার খাদ্য। এটা খেলে পেট ভরা থাকে বলে সহজে খিদে লাগে না। আগে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আইবিএস, ক্যান্সার, কোলেস্টেরল, ওজন বাড়া প্রভৃতি রোগের প্রকোপ এতটা ছিল না বা থাকলেও লোকে জানত না বা রোগ নির্ণয়ের জন্য আজকের দিনের মতো এত সুযোগ সুবিধা ছিল না। বর্তমানে যাঁরা এসব রোগে ভুগছেন, তাঁরা এ থেকে পরিত্রাণ পেতে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে যবের ছাতু খেয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রথমেই জানতে চাইবেন এটা কোথায় পাওয়া যায়। দেশের সীমিত এলাকায় যে পরিমাণ যব উৎপাদিত হয় তা থেকে প্রধানত ছাতু তৈরি করা হয়। যব ওঠার পর এপ্রিল-মে মাসে ঢাকাসহ দেশের অনেক এলাকায় ছাতু বিক্রি করা হয়। এ সময় এটা মোটামুটি ১০০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যায়। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে কেউ কেউ ৩০০-৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। তবে কেনার সময় অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে যাতে ভেজাল ছাতু না দেয়। বেশি দামে বিক্রি করা যায় বলে কেউ কেউ যবের চেয়ে সস্তা দামের গম কিনে ভাজার পর গুঁড়া করে যবের ছাতুর সাথে মিশিয়ে বিক্রি করেন। যাঁরা এটা কখনো খাননি তাঁরা নাস্তার সময় রুটি বা পরোটার পরিবর্তে গরম দুধের সাথে ছাতু মিশিয়ে চিনি বা কলা দিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন। তবে ডায়াবেটিস রোগীরা অবশ্যই চিনির বিকল্প বেছে নেবেন।

সেচ সুবিধাবঞ্চিত কম উর্বর জমিতে চাষাবাদ করা যায় এবং গমের চেয়ে কম ফলন হওয়া সত্ত্বেও প্রায় দ্বিগুণ দাম পাওয়া যায় বলে দেশের অনেক এলাকার কৃষকগণ যব চাষ করতে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। কৃষকগণ কৃষির সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে যবের বীজ কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর(ডিএই) যবের চাষ বাড়ানোর জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দেশে প্রধানত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএআরআই) যবের উপর গবেষণা করা হয়। সেখান থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আটটি উচ্চ ফলনশীল যবের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে যার মধ্যে লবণ-সহিষ্ণু এবং খোসামুক্ত জাতও আছে। ডিএই এবং বিএআরআই দেশে যবের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য যবের নানাবিধ উপকারিতা আছে বলে সম্প্রতি দেশের একটা বড় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি গমের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ যব মিশিয়ে আটা হিসেবে বাজারজাত করা শুরু করেছে যা স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিগণ আগ্রহভরে কিনছেন। এসবের ফলে আশা করা যায় ভবিষ্যতে দেশে যবের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে।

 

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট

আরো পড়তে পারেন

হাঁটার দর্শন ও বরেণ্যদের হাঁটাহাঁটি

মানুষ দু’পায়ে হাঁটা প্রাণী। জন্মের প্রথম বছর হাঁটতে পারে না। মানুষের বাচ্চা হাঁটা শুরু করতে এক বছরের বেশি গড়ায়। যদিও অনেক প্রাণীর বাচ্চারা জন্মের পরেই হাঁটতে পারে। মানুষ প্রাণীর বাচ্চারা জন্মের ছয় মাস পরে হামাগুড়ি দিতে শুরু করে। এরপর হাঁটতে শুরু করে এক থেকে দেড় বছর সময়ের মধ্যে। মানুষ হাঁটে। মানুষকে হাঁটতে হয়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। হাঁটা….

ঝালকাঠি জেলার পেয়ারা বাগান ও এশিয়ার একমাত্র ভাসমান হাট বাজার

‘এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায় -সন্ধ্যায় ঘুমায় নিরবে / মাটির ভিটের পরে— লেগে থাকে অন্ধকার ধুলোর আঘ্রান/ তাহাদের চোখে মুখে’— জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার মতো ঝালকাঠির নিভৃত পল্লীর পেয়ারা গ্রাম। ব্যবসা বাণিজ্যে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ঝালকাঠিকে ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ বা ‘ছোট কলকাতা’ বলা হতো ব্রিটিশ আমলে। সেই অতীত ঐতিহ্যের সাথে ঝালকাঠির পেয়ারা বাগান, পেয়ারার ভাসমান….

আর্কটিক থেকে উপসাগর পর্যন্ত: কানাডা ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ হুমকি

এটি শুধু একটি ভৌগলিক বা স্থানিক ব্যাপ্তির  বর্ণনা নয় , যা আর্কটিক অঞ্চল থেকে উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভ্রমণ বা পরিসরের পরামর্শ দেয়। আর্কটিক বলতে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের অংশকে বোঝায়, যা আর্কটিক মহাসাগর এবং আশেপাশের ল্যান্ডস্ক্যাপ জুড়ে রয়েছে। অন্যদিকে উপসাগর জলের শুধু একটি অংশ নয় যা ভূমি দ্বারা আংশিকভাবে ঘেরা ও একটি প্রশস্ত মুখ দিয়ে সামনে….

error: Content is protected !!