Author Picture

মোজাম্বিকের মুক্তিযোদ্ধাদের নজর কেড়েছিলেন মিয়া কাউতো

মেজবাহ উদদীন

ভালোবাসায় অন্তরের টান আবশ্যিক উপকরণ। যার অভাবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও কি নিঃশব্দে নীরব থেকে যাচ্ছি আমরা। নির্যাতিতের জন্য ন্যায়বিচারের পথ চেয়ে বসে আছি; যখন আমাদের সরব হওয়ার কথা। তবু কবিতার ভ্রুণ জন্ম নেয় মৃত্যুর জরায়ু থেকে। আফ্রিকান কবি মিয়া কাউতোর কবিতার ভিতর সেই অভিজ্ঞতার একটা পায়ে চলা পথের সন্ধান পেয়ে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি হাজির হয়েছে তার নাইরোবির বাড়িতে। বিবিসিতে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন


আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত লেখক ও কবি মিয়া কাউতো নিজেকে একজন আফ্রিকান হিসেবে বর্ণনা করেন, যদিও তার শিকড় ইউরোপে। তার পর্তুগিজ পিতামাতা ১৯৫৩ সালে আন্তোনিও সালাজারের স্বৈরশাসন থেকে পালিয়ে মোজাম্বিকে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কাউতো ১৯৫৫ সালে মোজাম্বিকের তৃতীয় বৃহত্তম শহর বেইরার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার কিছু কবিতা স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ১৯৭১ সালে রাজধানী লোরেনসো মার্কেসে (বর্তমানে মাপুতো) চলে যান; সেই সময়ে ঔপনিবেশিক শাসন উৎখাতের জন্য ফ্রেলিমো বিদ্রোহী এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পর্তুগিজ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছিল।

কিন্তু তিনি উল্লেখ করেন যে, তিনি একটি ‘ঔপনিবেশিক সমাজে’ বাস করছেন— এমন কিছু যা তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়নি, কারণ ‘সাদা এবং কালোদের মধ্যে, দরিদ্র এবং ধনীদের মধ্যে সীমারেখাগুলো এতই দৃশ্যমান ছিল।’ শৈশবে, কাউতো ভীষণ লাজুক ছিলেন, জনসমক্ষে বা এমনকি বাড়িতেও নিজের পক্ষে কথা বলতে অক্ষম ছিলেন। পরিবর্তে, তার কবি এবং সাংবাদিক বাবার মতোই তিনি লেখার মাধ্যমে সান্ত¡না খুঁজে পেয়েছিলেন। ‘আমি কাগজের সাথে একটি সম্পর্ক আবিষ্কার করেছিলাম, এবং সেই কাগজের পেছনে সবসময় কেউ ছিল যাকে আমি ভালোবাসতাম, কেউ আমার কথা শুনছিল, বলছিল: তুমি আছো।’

ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায়, কাউতো সবচেয়ে সহজে মোজাম্বিকে পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ অভিজাতদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন – ‘অ্যাসিমিলাডোস’— যারা সে সময়ের বর্ণবাদী ভাষায় যথেষ্ট ‘সভ্য’ বলে বিবেচিত হতো পর্তুগিজ নাগরিক হওয়ার জন্য। লেখক নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন যে তিনি অ্যাসিমিলাডোসদের সন্তানদের সাথে খেলতে পেরেছিলেন এবং তাদের কিছু ভাষা শিখেছিলেন। তিনি বলেন, এটি তাকে কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। ‘মোজাম্বিকের বাইরে থাকলেই কেবল মনে হয় যে আমি একজন শ্বেতাঙ্গ। মোজাম্বিকের ভেতরে এটা কখনো আসে না।’

তবে, তার শ্বেতাঙ্গত্ব তাকে আলাদা করে তুলেছিল তা ছোটবেলায় তিনি অনুভব করতেন। ‘আমি যে অবিচার এবং অন্যায় সমাজে আমি বাস করছি তা কেউ আমাকে শেখাচ্ছিল না….। এবং আমি ভেবেছিলাম: ‘আমি নিজেকে এখানে খুঁজে পাই না। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই না করে আমি সুখী হতে পারি না।’

‘যিনি সেই সভার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: ‘তুমি কি সেই তরুণ যে সংবাদপত্রে কবিতা লিখছো?’ এবং আমি বলেছিলাম: ‘হ্যাঁ, আমি লেখক’। তখন তিনি বলেছিলেন: ‘ঠিক আছে, তুমি আমাদের দলে আসতে পারো, তুমি আমাদের অংশ হতে পারো কারণ আমাদের কবিতার প্রয়োজন।’

যখন কাউতো ১০ বছর বয়সী, মোজাম্বিকে পর্তুগিজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। লেখক সেই রাতটির কথা স্মরণ করেন, যখন ১৭ বছর বয়সী ছাত্র হিসেবে তিনি একটি উপনিবেশ বিরোধী পত্রিকায় কবিতা লিখছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন। তখন তাকে মুক্তিযোদ্ধা আন্দোলন ফ্রেলিমোর নেতাদের সামনে হাজির হতে বলা হয়। তাদের কার্যালয়ে পৌঁছে তিনি দেখলেন, ৩০ জনের ভিড়ে তিনিই একমাত্র শ্বেতাঙ্গ। নেতারা সবাইকে বললেন, তারা কে কী কষ্ট পেয়েছেন এবং কেন তারা ফ্রেলিমোতে যোগ দিতে চান তা বর্ণনা করতে। কাউতো ছিলেন সর্বশেষ বক্তা। তিনি যখন বাকীদের দরিদ্রতা এবং বঞ্চনার গল্প শুনছিলেন, তখন বুঝতে পারলেন তিনি কক্ষে একমাত্র সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাই, তিনি তার নিজের সম্পর্কে একটি গল্প তৈরি করেছিলেন— তিনি জানতেন অন্যথায় তাকে নির্বাচিত করা হবে না। ‘কিন্তু যখন আমার পালা এল, আমি কথা বলতে পারিনি এবং আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।’

সেসময় যেটা তাকে বাঁচিয়েছিল তা হলো— ফ্রেলিমো নেতারা ইতোমধ্যেই তার কবিতা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি তাদের কাজে সহায়তা করতে পারেন। ‘যিনি সেই সভার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: ‘তুমি কি সেই তরুণ যে সংবাদপত্রে কবিতা লিখছো?’ এবং আমি বলেছিলাম: ‘হ্যাঁ, আমি লেখক’। তখন তিনি বলেছিলেন: ‘ঠিক আছে, তুমি আমাদের দলে আসতে পারো, তুমি আমাদের অংশ হতে পারো কারণ আমাদের কবিতার প্রয়োজন।’

১৯৭৫ সালে মোজাম্বিকের স্বাধীনতা অর্জনের পর, কাউতো স্থানীয় গণমাধ্যমে সাংবাদিক হিসেবে কাজ চালিয়ে যান, যতক্ষণ না ১৯৮৬ সালে মোজাম্বিকের প্রথম প্রেসিডেন্ট সামোরা মাচেলের মৃত্যু হয়। এরপর তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন কারণ তিনি ফ্রেলিমো নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। ‘এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছিল; মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষণ এমন কিছু হয়ে উঠেছিল যা আমি আর বিশ্বাস করছিলাম না।’ ফ্রেলিমো সদস্যপদ ত্যাগ করার পর, কাউতো জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। আজও তিনি সমুদ্র উপকূলের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিবেশবিদ হিসেবে কাজ করেন। তিনি আবার লেখালেখিতেও ফিরে আসেন। ‘আমি শুরুতে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তারপর বই, ছোট গল্প, এবং উপন্যাস শুরু করলাম।’

তার প্রথম উপন্যাস ‘স্লিপওয়াকিং ল্যান্ড’ ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি একটি জাদু বাস্তবতাবাদী কল্পকাহিনী যা মোজাম্বিকের স্বাধীনতা পরবর্তী গৃহযুদ্ধ থেকে অনুপ্রাণিত। বইটি তাৎক্ষণিকভাবে সফল হয়েছিল। ২০০১ সালে এটি জিম্বাবুয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলার বিচারকরা বিংশ শতাব্দীর ১২টি সেরা আফ্রিকান বইগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং এটি ৩৩ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

তিনি অন্যদের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। ‘শুনতে মানে শুধু কণ্ঠ শুনতে নয় বা আইফোন, গ্যাজেট বা ট্যাবলেটের দিকে তাকানো নয়। এটি অন্যকে অনুভব করার ক্ষমতার কথা। যদি কোনো বইয়ের চরিত্র আপনাকে স্পর্শ করে, তা হলে বুঝতে হবে সেই চরিত্রটি ইতোমধ্যেই আপনার মধ্যে বাস করছিল, তবে আপনি তা জানতেন না।’

যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তার কাজগুলো আধুনিক আফ্রিকার বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে কি না— কাউতো উত্তর দেন যে এটি অসম্ভব, কারণ মহাদেশটি বিভক্ত এবং অনেকগুলো ভিন্ন আফ্রিকা রয়েছে। ‘আমরা একে অপরকে জানি না এবং আমরা আমাদের নিজস্ব লেখকদের লেখা আমাদের মহাদেশের অভ্যন্তরে প্রকাশ করি না; ফরাসি, ইংরেজি এবং পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক ভাষার সীমারেখার কারণে।’ ‘আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে এমন কিছু পেয়েছি যা ছিল একটি ঔপনিবেশিক নির্মাণ, যেটা এখন ‘ন্যাচারালাইজড’ হিসেবে বিবেচিত হয়, যাকে তথাকথিত অ্যাংলোফোন, ফরাসিভাষী এবং লুসোফোন আফ্রিকা বলা হয়।’

গত জুলাইতে কেনিয়ার একটি সাহিত্য উৎসবে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও, প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর কর বাড়ানোর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হওয়ার কারণে তিনি দুঃখজনকভাবে সেই সফর বাতিল করতে বাধ্য হন। তবে তিনি আশা করছেন যে ভবিষ্যতে আবারও সুযোগ আসবে আফ্রিকার অন্যান্য অংশের লেখকদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার। ‘আমাদের এই সীমানা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আমাদের আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে যাতে আমাদের আফ্রিকানদের মধ্যে এবং আফ্রিকার মধ্যে আরও বেশি সাক্ষাৎ ঘটে।’

আফ্রিকান লেখকরা নিজেদেরে সমাজ এবং সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পাওয়া নিয়ে কাউতো দুঃখ প্রকাশ করেন। ‘বাস্তবে, আমরা এমনকি জানি না মোজাম্বিকের বাইরে শিল্প এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কী হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশীরা— দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, তানজানিয়া— আমরা তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না, এবং তারা মোজাম্বিক সম্পর্কে কিছুই জানে না।’

নতুন লেখকদের জন্য পরামর্শ দিতে বলায় তিনি অন্যদের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। ‘শুনতে মানে শুধু কণ্ঠ শুনতে নয় বা আইফোন, গ্যাজেট বা ট্যাবলেটের দিকে তাকানো নয়। এটি অন্যকে অনুভব করার ক্ষমতার কথা। এটি এক ধরনের অভিবাসন, একটি অদৃশ্য অভিবাসন, অন্য ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার। যদি কোনো বইয়ের চরিত্র আপনাকে স্পর্শ করে, তা হলে বুঝতে হবে সেই চরিত্রটি ইতোমধ্যেই আপনার মধ্যে বাস করছিল, তবে আপনি তা জানতেন না।’

অনেক লেখায় মিয়া কাউতো মোজাম্বিকের আঞ্চলিক শব্দভান্ডার এবং গঠনকে পর্তুগিজ ভাষায় যুক্ত করে এটিকে পুনর্নিরমাণের চেষ্টা করেছেন, ফলে একটি নতুন আফ্রিকান আখ্যানের মডেল তৈরি হয়েছে। ২০০৭ সালে, তিনি প্রথম আফ্রিকান লেখক হিসেবে ল্যাটিন ইউনিয়ন সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন, যা ১৯৯০ সাল থেকে ইতালিতে বার্ষিকভাবে প্রদান করা হয়। কাউতো পর্তুগিজ ভাষায় এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জনকারী চতুর্থ লেখক। ১৯৯৮ সালে কাউতো প্রথম আফ্রিকান লেখক হিসেবে ব্রাজিলিয়ান একাডেমি অফ লেটার্স নির্বাচিত হন।

সূত্র: বিবিসি

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

প্রতিটি শূন্যতা যেন নতুন শোকের জন্ম দেয়

শূন্যতার আকাশে স্মৃতির মেঘ জমে। জীবন সরে সরে আসে মৃত্যুর দিকে। ফুরিয়ে আসা সময়ের দাপট এড়াতে পারে না কেউ। একজীবনে বহু জীবনাবসানের দেখা পাওয়া যায়, হয়তো দুর্ভাগ্যক্রমেই। ব্যক্তির মৃত্যুর পরিসমাপ্তি একবারই হয়, তবে সেই ব্যক্তি যদি বহুপ্রাণের সাথে জুড়ে থাকেন, তাঁর অনুপস্থিতি বারংবার অনুভূত হয়। প্রতিটি শূন্যতা যেন এক নতুন শোকের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালে….

error: Content is protected !!