
তিনি ফুটবলের ঈশ্বর। সবুজ মাঠে তিনিই লিখতে পারেন রূপকথা। আবার তিনিই দেখিয়েছেন, কাঁটার মুকুট মাথায় তুলে একজন মানুষ কতখানি ক্ষতবিক্ষত হতে পারেন। লিওনেল মেসি। সর্বকালের সেরা হয়েও, দেশের হয়ে ব্যর্থ— এতদিন এই কলঙ্কই ছিল শিরোধার্য। অবশেষে শাপমোচন। একুশের কোপা আর বাইশের বিশ্বকাপ জয় শেষে ফুটবলবিশ্বে ফুটল মেসি-রঙের ভোর। দর্শক পালটে যায়, সতীর্থ পালটে যায়, জার্সিও বদলায়- কিন্তু মেসি পালটান না! হয়তো শেষবারের মতোই, তাঁর হাতে ফুটবল বিশ্বের এই সর্বোচ্চ সম্মান উঠল। সময় যেমন অসীম, মেসিও যেন ঠিক তেমনিই। আর তাই তো ব্যালন ডি’ওর-এর মঞ্চে ফুটে উঠল- ‘মেসি ইজ ইনফিনিটি’!
মেসির জন্য তোলা ছিল দেশের হয়ে ট্রফি-খরা সহ্য করার অভিশপ্ত প্রায় দেড় দশক। একরকম নরকদর্শনই। প্রতিবার নীল-সাদা জার্সি পরে কত স্বপ্ন নিয়ে না তিনি নিজে মাঠে নেমেছেন। কত স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাঁর অনুগামীদের। কিন্তু যাঁকে মর্ত্যবাসী ফুটবলের ঈশ্বর হিসেবেই পুজো করেন, তাঁর জন্যও বিরূপ থাকেন অন্তর্যামী। বিশ্ব ফুটবল যে সোনার পা দুখানি পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁর জন্য কেন যে এত ব্যর্থতা তোলা আছে, ভেবে বিমর্ষ হয়েছেন এই পৃথিবীর প্রায় সকল ফুটবলপ্রেমী। অগণন ফুটবলপ্রেমীর মনে তাই ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন, মেসিকে কি এবারও ফিরিয়ে দেবেন ঈশ্বর? বিশ্ব ফুটবলের সবথেকে বর্ণময় তবু বেরঙিন চরিত্র হয়েই থেকে যাবেন মেসি! একুশের কোপা দেখাল, যিনি দহন সইতে পারেন, ঈশ্বর তাঁকে ফেরান না। আর বাইশে মেসি দেখিয়ে দিলেন সব সহ্য করেই আসে সব জয়ের সেরা জয়। আর আর্জেন্টিনা জেতার পাশাপাশিই, সত্যি সত্যি জিতেছেন সেইসব ফুটবলপ্রেমীরা, যাঁরা ভালোবাসেন শিল্পিত ফুটবলকে। আগ্রাসনের সৌন্দর্য নয়, যাঁরা বুক পেতে জায়গা করে দেন সৌন্দর্যের আগ্রাসনকে।
ফুটবল মাঠের প্রতিটি ঘাসের ডগা জানে, বল পায়ে মেসির শরীরী মোচড়, ইনসাইড ড্রিবল, সাইডলাইনের ধার ধরে গতির ঝড় তুলতে তুলতে হঠাতই দিক বদলে ফেলা সর্পিল দৌড়। সবাই জানে মেসির সেই গতিপথ। কিন্তু তিনি যে প্রহেলিকা। ধাঁধা। ‘চিনি চিনি’ করেও মেসিকে যে চিনতে পারেননি তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষরা। সারা বিশ্বের মোট ১০০টি ক্লাবের বিরুদ্ধে গোল করার নজির গড়লেন মেসি। মোট ২৩টি দেশের ১০০টি বিভিন্ন ক্লাবের বিরুদ্ধে গোল করেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। তাই তো নজির গড়ে অষ্টমবার ব্যালন ডি’অর জিতলেন লিওনেল মেসি। দিনটি ছিল ম্যারাডোনার জন্মদিন। মঞ্চে দাঁড়িয়েই মেসি জানালেন, এই ট্রফি কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনাকে উৎসর্গ করছেন।
ফুটবল মাঠের প্রতিটি ঘাসের ডগা জানে, বল পায়ে মেসির শরীরী মোচড়, ইনসাইড ড্রিবল, সাইডলাইনের ধার ধরে গতির ঝড় তুলতে তুলতে হঠাতই দিক বদলে ফেলা সর্পিল দৌড়। সবাই জানে মেসির সেই গতিপথ। কিন্তু তিনি যে প্রহেলিকা। ধাঁধা। ‘চিনি চিনি’ করেও মেসিকে যে চিনতে পারেননি তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষরা
মেসি এর আগে ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৫, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন। এবার যেন নিজেকে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেলেন। মেসি এবার ব্যালন ডি’অর জিতে আর্জেন্টিনাকেও সবার ওপরে তুলেছেন। তাঁর অষ্টম ব্যালন ডি’অর জয়ে সবচেয়ে বেশিবার এই সম্মাননা পাওয়া দেশ আর্জেন্টিনা। সাতবার করে এই খেতাব জিতেছে ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগাল। ফ্রান্স ও জার্মানির পাঁচ, নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগালের তিনজন ফুটবলার তাঁদের দেশকে ব্যালন ডি’অর এনে দিয়েছেন। মেসি একাই আর্জেন্টিনাকে গৌরবান্বিত করেছেন আটবার।
বিশ্বকাপ জয়ের পর যারা ভেবেছিলেন তৃপ্ত মেসিকে বয়স এবার হয়তো গৃহপালীতের লাগাম পরিয়ে বেধে রাখবে গৃহকোণে আলস্য উপভোগের প্রলভোনে। তাদের প্রথাগত ধারণাকে ক্লান্ত করে দিয়ে মেসি এখনও ফুটবল মাঠের অপরিহার্য মুখ। ফুটবল পুরস্কারের মঞ্চগুলো যেন মেসিকে ছাড়া পূর্ণতা পায় না, এখনো মেসিকে খুঁজেই ব্যাস্ত সময় পার করে ক্যামেরার যন্ত্রচোখগুলো। আর এক ক্লান্তিহীন মেসি তার ছন্দের যাদুতে কেটে চলছেন আর্জেন্টাইন ভক্তদের হৃদয়ে কয়েক প্রজন্ম ধরে জমে ওঠা বঞ্চণা আর হাহাকারের পাহাড়।
কেমন ছিল এই মেসি হয়ে ওঠার গল্পটা। শৈশবে মেসি যখন তার বাবার সাথে আর্জেন্টিনা থেকে বার্সেলোনায় আসে-সেসময় সে স্প্যানিশ ভাষা বলতে না পাড়ার কারণে কারো সাথে কথা বলতে পারতো না, একমাত্র তার বাবার সাথে কথা বলেই সময় কাটাতো। শৈশবের মেসি রাতে মা’কে মনে করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরতো। ভাবুন তো- অপরিচিত এক দেশে, অপরিচিত মানুষের মধ্যে ছোট্ট মেসির জন্য হার মেনে বাড়ি চলে আসাটা কতো সহজ ছিল! এক সময়কার বার্সেলোনা এবং মেসির শৈশবের কোচ ফ্রাংক রাইকার্ড বলেন, মানুষ ট্যালেন্ট বা প্রতিভার কথা বলে, কিন্তু মেসির আসল শক্তি হলো— মেন্টাল রেজিলিয়েন্স; যেটা সে সেই বয়সেই দেখিয়েছে। এই মেন্টাল রেজিলিয়েন্সের দুইটা দিক আছে। এক নম্বরে ফ্লেক্সিবিলিটি অর্থাৎ, সাময়িক সফলতা দিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকা। দ্বিতীয়টা হল দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ পূরণের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত আরও উন্নতির চেষ্টা করা। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদী সেই লক্ষের প্রতি অবিচল থাকা এবং প্রতিনিয়ত নিজের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া।
মেসির মত প্লেয়াররা পরাজয়কে স্বীকার করে নেয় এবং সেই পরাজয় থেকে বের হয়ে আসার জন্য এত পরিমাণ পরিশ্রম করেন যে, দ্বিতীয়বার সেই পরাজয়ের মুখোমুখি যেন তাদের না হতে হয়; সেভাবে নিজেদেরকে তৈরি করেন
রাইকার্ড বলেন, কোনো এক দেশে একই সাথে অনেক বাচ্চার মধ্যে ন্যাচারাল ট্যালেন্ট থাকতে পারে। কিন্তু প্রফেশনাল লেভেলের খেলায় যুবক খেলোয়ারদের সেই ন্যাচারাল ট্যালেন্টই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ন্যাচারাল ট্যালেন্ট দিয়ে এই সমস্ত ছেলেরা লোকাল এবং আঞ্চলিক লেভেল খুব সহজেই পার করে যায়, কারণ সেখানে তাদের প্রেসার এবং ফেইলিওরের সামনাসামনি হতে হয় না। এমন ট্যালেন্ট প্রফেশনাল লেভেলের প্রেসার নিতে পারে না, কারণ প্রফেশনাল লেভেলে ভুল করার সুযোগ খুবই কম। সেখানে আপনাকে অনেক ধরনের ফেইলিওরের মুখোমুখি হতে হয় এবং সেই ফেইলিওর থেকে খুব তাড়াতাড়ি শিক্ষা নিতে হয়। আর এই ধরনের মেন্টাল প্রেসার নেওয়ার জন্য আপনার মেন্টাল রেজিলিয়েন্স থাকতে হবে। কোচ রাইকার্ড বলেন, মেসি তার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দিয়ে ন্যাচারাল ট্যালেন্ট’কে ওয়ারর্কিং ট্যালেন্টে পরিবর্তন করেছেন।
অল্প বয়সে মেসি অনেক ধরনের ভুল করতেন। যেমন— প্রয়োজনের তুলনায় বেশিক্ষণ বল পায়ে রাখা, ভুল সময়ে বল পাস দেওয়া, খুব সহজেই বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা। মেসি তার নিজের মানসিক দৃঢ়তকে কাজে লাগিয়ে এই সমস্ত ভুলগুলোকে শুধরে নিয়েছেন বলেই ২০০৫ সালে একই সিজনে ৫ জুনিয়র লেভেল পেরিয়ে বার্সেলোনা সিনিয়র দলে চলে আসেন।
মেসির মানসিক দৃঢ়তার আরেকটি উদাহরণ হল ফ্রি কিক। শুনতে অবাক লাগে — বার্সেলোনায় থাকা অবস্থায় এক সময় মেসি পারফেক্ট ফ্রি কিক নিতে পারতেন না; যদিও সে সময় তার ফ্রি কিক নেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন ছিল না। কারণ তখন বার্সেলোনায় ফ্রি কিকগুলো নিতেন রোনালদিনহো। কিন্তু মেসি যখন ২০১০ সালে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ক্যাম্পের জন্য ফ্রি কিক প্র্যাকটিস করছিল, তখন তার নেওয়া তিনটি ফ্রি কিকের মধ্যে দুটোই গোল পোস্টে গিয়ে লেগেছিল। যেটা মেসিকে অনেক হতাশ করেছিল। মেসি যখন হতাশা নিয়ে ড্রেসিং রুমের দিকে যাচ্ছিল, তখন ম্যারাডোনা তাকে ডেকে, তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘ফ্রি কিক করার সময় আরো কয়েক মিলি সেকেন্ড বলের সাথে কানেক্ট করে রাখো তাহলে বল তোমার কথা শুনবে।’ মেসি খুব দ্রুতই তার স্কিলকে শুধরে নেয় এবং আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেস্ট ফ্রি কিক নেওয়া প্লেয়ারের তালিকায় মেসির নাম ওপরের দিকে।
শুধুই ন্যাচারাল ট্যালেন্ট নয়, মেন্টাল রেজিলিয়েন্স অর্থাৎ কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা এবং উন্নতি করার নিরন্তর প্রয়াস মেসিকে জিনিয়াস করে তুলেছে। এজন্য মেসির সম্মানার্থে ২০১৩ সালে স্প্যানিশ ডিকশনারিতে একটি শব্দ যোগ করা হয়েছে- inmessonante অর্থ- নিজেকে প্রতি মুহূর্তে শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তোলার ক্ষমতা।
ফুটবলের হাত ধরেই, সারা বিশ্বের সামনে উদাহরণ হয়ে উঠলেন মেসি। বিশ্ব ফুটবল বদলাবে। মেসির জায়গা নেবে অন্য কেউ। আর্জেন্টিনার বদলে বিশ্বকাপ জিতবে অন্য কোনও দেশ। তবু ফুটবলপ্রেমীরা আজীবন জানবেন, টুর্নামেন্ট জেতা উছিলা মাত্র, আসলে জিততে হয় জীবনের যুদ্ধ
এই মেন্টাল রেজিলিয়েন্স এর সাথে সাথে মেসির আরেকটা দক্ষতা হলো ডিসিপ্লিন। মেসির সমান গোল, ট্রফি আর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হলে একজন প্লেয়ারকে বছরে ৬০টির মতো ম্যাচ খেলতে হবে এবং প্রত্যেক ম্যাচে সর্বোচ্চ লেভেলের খেলাটা খেলতে হবে এবং এভাবে দশ বছর খেলে যেতে হবে। এক সিজনে ৬০ ম্যাচ অর্থাৎ, প্রতি ছয় দিনে আপনাকে একটা করে ম্যাচ খেলতে হবে। এটা কেবল সে-ই করতে পারে, যে প্রতিদিন শারীরিক এবং মানসিকভাবে ফিট থাকে।
মেসির গ্রেট হয়ে ওঠার আরেকটা কারণ হলো পরাজয়ের মোকাবেলা করা। পিছন ফিরে তাকালেই দেখবেন ২০১১ সালে দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে মেসির পেনাল্টি মিসের কারণে আর্জেন্টিনা টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে যায়। সেই ম্যাচের পর মেসি পুরো আর্জেন্টিনার শত্রু হয়ে ওঠে। মেসির জার্সি পোড়ানো হয় প্রকাশ্যে। নিউজ চ্যানেল, পত্রিকা— সব জায়গায় একই কথা; দেশের জন্য মেসির কোন আবেগ ভালবাসা নেই; মেসি ক্লাবের জন্যই খেলে দেশের জন্য না। এমনকি কিছু লোক মেসির পরিবারের ওপরও হামলা চালায়। এমন মানসিক স্ট্রেচ মেসি কিভাবে সামলিয়েছেন। বার্সেলোনা ক্লাবের সাইকোলজিস্ট অ্যন্ডি ওয়েস্ট মেসির ওপড়ে একটা বই লিখেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন মেসির মত প্লেয়াররা পরাজয়কে স্বীকার করে নেয় এবং সেই পরাজয় থেকে বের হয়ে আসার জন্য এত পরিমাণ পরিশ্রম করেন যে, দ্বিতীয়বার সেই পরাজয়ের মুখোমুখি যেন তাদের না হতে হয়; সেভাবে নিজেদেরকে তৈরি করেন।
ফুটবল আর জীবনের গল্প যেন অনেকটা একই রকম। লড়াই, হার-জিতের নিরিখে এই খেলার সঙ্গে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিগুলো কোথাও যেন মিলেমিশে যায়। আর তাই এই বিশ্বের অসংখ্য মানুষ ফুটবল খেলাটিকে ভালবাসেন প্রাণ দিয়ে। সেই ফুটবলের হাত ধরেই, সারা বিশ্বের সামনে উদাহরণ হয়ে উঠলেন মেসি। বিশ্ব ফুটবল বদলাবে। মেসির জায়গা নেবে অন্য কেউ। আর্জেন্টিনার বদলে বিশ্বকাপ জিতবে অন্য কোনও দেশ। তবু ফুটবলপ্রেমীরা আজীবন জানবেন, টুর্নামেন্ট জেতা উছিলা মাত্র, আসলে জিততে হয় জীবনের যুদ্ধ।
আর্জেন্টিনাকে ২৮ বছর পর কোপা আর ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতানো মেসি জিতলে সঙ্গে সঙ্গে যেন গোটা বিশ্বে জিতে যায় অসংখ্য ফুটবলপ্রেমী। না, তাঁরা সবাই আর্জেন্টিনার সমর্থক নন। তাঁরা ভালোবাসেন মেসি নামে এক মহাজাগতিক প্রতিভাকে, যিনি সম্ভব করে তুলতে পারেন সব অসম্ভব। প্রতিদিন বিশ্বে প্রতি কোনায় হেরে যাওয়া মানুষের কানে কানে গিয়ে যিনি বলে আসতে পারতেন, এ পৃথিবীতে সত্যি হয় রূপকথা। তাই ভেঙে পড়তে নেই।