
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল দখলদার পাকিস্তানীদের সাথে। এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন বয়স এবং পেশানির্বিশেষে সকল স্তরের জনগণ। সেই সব ত্যাগীজনগণের অবদানে রচিত হয়েছে আজকের স্বাধীন এবং স্বার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবদান কোনো ভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নাই। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবদান সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার প্রয়োজন আছে। তবে বিভিন্ন সময়ে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্ঠা করা হয়েছে। অনেক তথ্য, ঘটনা আড়াল রয়ে গেছে। প্রাবন্ধিক এবং চিন্তাবিদ একেএম শামসুদ্দিনের লেখা ‘মুক্তযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ বইটির প্রবন্ধসমুহে মুক্তিযুদ্ধের আদ্যোপান্ত এত সহজ এবং সাবলীলভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে পাঠক মুক্তিযুদ্ধের পেছনের ইতিহাস, পটভুমি, সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং যুদ্ধকালীন সময়ের অনেক না বলা ঘটনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ পাবেন।
মুক্তিযুদ্ধ হুটহাট করে শুরু হয়নি। দেশ বিভাগের পর কতৃত্ববাদী পশ্চিম পাকিস্তান পুর্বপাকিস্তানের জনগণ, অর্থনীতি, উন্নয়ন, চাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছিল তার ফলশ্রুতিতে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাধঁছিলো। এরই জেরে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং শেষ অবধি অধিকারবঞ্চিত জনগণের আন্দেলনের চুড়ান্ত বিষ্ফোরণ ছিল এই মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিবাদী মানুষ অস্ত্র হাতে পথে নেমে এসেছিলো। বিজয় অর্জনের লক্ষ্যের পাশাপাশি, নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের প্রেক্ষাপটে সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দেওয়ার ষড়যন্ত্রের যে নীল নকশা ইয়াহিয়া সামরিক সরকার প্রণয়ন করেছিল লেখক বইটির শুরুতে ‘শত ষড়যন্ত্রও টেকাতে পারেনি স্বাধীনতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার প্রহসনমূলক বৈঠক’-এ তার বর্ণনা দিয়েছেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার পক্ষপাতিত্ব এবং হটকারি আচরণ সাধারন জনগণকে ব্যপকভাবে প্রতিবাদী এবং উত্তেজিত করে তোলে। এই প্রতিবাদের ধাারাবাহিক আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেয় রংপুরের শিশু শংকু সমজদার। প্রতিবাদী শাহেদ আলী কসাই দেশীয় অস্ত্রহাতে তার সহযোগীদের নিয়ে অস্ত্রসজ্জিত জীপে ঝাপিয়ে পড়েন, হত্যা করেন পাকিস্তানী সৈন্যদের। রংপুর সেনানিবাস ঘেরাও অভিযানে বিক্ষুব্ধ জনতার সাড়িতে ওরাঁও এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনসহ সাওঁতাল নেতা জয়রাম সরেনকে শামিল হতে দেখা যায়। জর্জ বাহিনী প্রধান জর্জ জে এম দাস এবং তার চার ছোট ভাইয়ের কাহিনীও আমাদের আলোড়িত করে, যারা তাদের দল নিয়ে দিনাজপুরে বেশ দাপটের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে গেরিলা যুুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। লেখকের বর্ণনায় সুনামগঞ্জ এলাকার দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি দাস এবং তার প্রশিক্ষিত দাসপার্টির গেরিলা লড়াই, পাকিস্তানীদের সরবরাহ লাইনে এবং ন্যাশনাল গ্রিডের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে হামলার চিত্র আমাদের চোখে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এসব অভিযানের পেছনে আছে দেশমাতৃকার জন্য যোদ্ধাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, আছে মুক্তিকামী মানুষ এবং নিরীহ মানুষের উপর পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার অনেক মর্মস্পর্শী কাহিনী যা পাঠককে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দেবে।

প্রবন্ধ । প্রকাশক: সৃজন । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩ । মুদ্রিত মূল্য: ৪০০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/289430
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮
এটা বললে অত্যুক্তি করা হবে না যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই কিন্তু দেশবাসীর মনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশকে ভালবেসে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগেই এইসব মুক্তিকামী জনগণ যে যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, সেই সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? লেখক তার প্রবন্ধগুলোতে অত্যন্ত দরদের সাথে আড়ালে থাকা সেই মানুষের দেশপ্রেমের বীরত্বগাঁথা বর্ণনা করেছেন। প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রান্তিক জনগণের অবদান এবং আত্মত্যাগের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে লেখক যে মানবিক কর্তব্য সম্পাদন করেছেন তা যথার্থই প্রশংসার দাবি রাখে। ‘মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরনীয় জর্জ বাহিনী’ প্রবন্ধের শেষাংশে লেখক বলেছেন, ‘আমরা এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথার ফুলঝুরি ফোটাতেই ব্যস্ত! মনে রাখতে হবে, প্রান্তিক এই যোদ্ধাদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে যদি না পারি, তাহলে গর্বিত নাগরিক হিসাবে আমাদের মর্যাদা-ই বা থাকে কোথায়?’
অস্ত্র এবং যুদ্ধকে আলাদা করা যায় না। কৌশলের মারপ্যাঁচ যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারন করে। লেখক অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কৌশলগত দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট সামরিক ইতিহাসের বিরল ঘটনা’ প্রবন্ধে লেখক মুক্তিযুদ্ধে তেজোদীপ্ত কিছু বিমানসেনার চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জের জ্বালানীর ডিপো ধ্বংস করার দুঃসাহসিক অভিযানের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। সামরিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় অভিযান যার জন্য জাতি গর্বিত।
তারামন বিবির স্বদেশপ্রেমের কাহিনী আমাদের যেরকম গর্বিত করে তেমনি রংপুরের সেনানিবাস ঘেরাও অভিযানে স্বাধীনতা প্রত্যাশী মানুষের হত্যাকারী তৎকালীন ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন ওয়াহিদের ইতিহাস জাতিকে ব্যথিত এবং লজ্জিত করে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়েও আছে নানা রকম হেরফের ও জালিয়াতি। বিভিন্ন সরকারের আমলে একশ্রেণির সুবিধাবাদী কর্মকর্তা তালিকাটি ব্যবহার করে ফায়দা লোটার চেষ্ঠা করে আসছে। ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে’ প্রবন্ধে লেখক এই বিষয়ে তার উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেছেন।
পরিশেষে, বইটির শিরোনাম, ‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ নামকরণ বইটিতে গ্রন্থিত প্রবন্ধগুলোর আলোকে অর্থবহ হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ কোনো ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা সংঘটিত হয় নাই। এই যুদ্ধ একটি সমষ্টিগত উদ্যোগ, জাতির প্রতিটি ব্যক্তির আশা-আকাংখা, এবং স্বার্থে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
বইটিতে সংগৃহীত ২৪টি প্রবন্ধের প্রতিটি আলেখ্য যথেষ্ট তথ্যবহুল এবং সহজ ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। পাঠক প্রবন্ধগুলো থেকে মুক্তিযুুদ্ধ সম্পর্কে একটা নিরপেক্ষ ও পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবেন। ‘সৃজন’ কতৃক প্রকাশিত বইটির তৃতীয় সংস্করণ চলছে। এই থেকে বুঝা যায় বইটি কতটুকু পাঠক-নন্দিত হয়েছে।