
মাহুত কি জানে
প্রিয় গোলাপবাগ, তোমার প্রশংসা লিখি।
ধ্বংস হলো সবকিছু—বুনো হাতিদের তাণ্ডব
নেমে এলো শস্যভূমিতে। মাহুত কি জানে,
গীতিসমূহ লীন হয় মাশুকের নামে! মহুয়ার
ঘ্রাণ তাঁর দেহ-উপকূলে। ঢলে পড়ি অন্ধকার
বন্দরে। খোঁপায় নক্ষত্রের গাজরা, ঈর্ষায়
পোড়ে অপ্সরাদের ডানা। জলমগ্ন পৃথিবীতে
জন্ম হলো প্রাণের। আদিতে নিরাকার প্রভু—
সত্য। অরণ্যে কোকিলের কুহুতান, ভূমিতে
ফুলের সৌরভ। তোমাকে বেসেছি ভালো।
গুহার দেয়ালে ষাঁড়ের লড়াই, পরনে পাতার
পোশাক। মাতা প্রকৃতি সত্তা। তোমাকে জানি
মরণরূপে। সাব্যস্ত হয়েছি প্রেমে—কফিনে
ঢুকে পড়েছি। জেনো, এক আশেক ইশকে
তোমার প্রতি হয়েছিল—দিওয়ানা, মাস্তানা।
তেখ উৎসবের নৃত্য
মোনাক প্রজাপতি ও চন্দন বনের উপকথা
শোনাবো বলে, মাসালং নদীতীরে পেতেছি
মাছরাঙার সংসার। শিকার করি, লুকিয়ে
পড়ি কোটরে। গভীর রাত্রি নিয়ে আসবেন
দ্রাক্ষারসের দেবী, যিনি অভিজ্ঞ ঝর্ণা ও
পাখিদের তদারকিতে। বিদীর্ণ হৃদয় নিয়ে
ঘুরেছি অরণ্যে। জেনেছি, পরাগায়ণ বিদ্যা।
হারিয়েছি চন্দ্রিমা, মধুর লগ্ন পেরিয়ে যায়।
তুতেনখামেনের সৌরনৌকা ভাসে নীলনদে।
মেনকৌরে যখন প্যাপিরাস সম্পর্কে বললেন,
তখন সম্রাট আলোকে বন্দী করলেন রাতের
পিঞ্জিরায়। নিদ্রাকে ডুবিয়ে রাখলেন তুলোর
বনে—মত্ততা আমোদ-প্রমোদে। ভীত হৃদয়,
নির্জন শরীরে এলিয়ে পড়ে। আমাকে করলে
হরণ, লুকিয়ে রাখলে প্যাংগং জলাধারে।
যেদিকে তাকাই, রুক্ষ পাহাড় ও জ্যোৎস্নায়
নিজেকে ভারবাহী গাধা মনে হয়। বলি—
এক মদ্যপকে শেখালে তুমি, তেখ উৎসবের
নৃত্য।
আলোর শামাদান
হেঁতাল বনে হবে দেখা। খাদ্যশৃঙ্খল সংগীতের
সুরে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। নিজ প্রাণ ব্যতীত নেই
কোনো রত্নপাথর। জেনো, অভিবাদন, সুন্দরীতমা।
অকিচবি হ্রদে সন্ধান করছিলাম পরাশ্রয়ী বিটপী।
চোরাবালিতে আটকা পড়েছি—উদ্ধারের আশায়
আরও তলিয়েছি; যেন সাভানায় আটক গাধারা।
তোমার বিরহজ্বালা সর্বাঙ্গে বিষক্রিয়া করে,
জীবন্ত আগ্নেয়গিরিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। লাভার
নদীতে ফোটে ডুমুরলতা। বনে ধ্যানমগ্ন সাধু।
বিবিধ আলোর শামাদানে হরিণ চিবোচ্ছে চিংড়ি
ও মহাকাঁকড়ার ফুসফুস— তৃণভোজী প্রাণীটি
মাংসের স্বাদে ভুলেছে গোত্র। তেমনই ভুলেছি আমি
তোমার ছলনার স্বাদ। হৃদয়— ধুতুরা ফুলের ঝর্ণাধারা।
মাথার খুলিতে শব্দের জহর; যেন শ্রেষ্ঠ জাদুগীর
পোকার কাছে গোপন করেছেন জীবনরহস্য।
দোহাই, কুমিরভরা হ্রদের— এ মৎস্যজন্ম থেকে
নিস্তার দাও, হে মৎস্যকন্যা, হে মায়াবী মানবী।
মহুয়া ফলের অরণ্যে
তোমার চাঁদমুখ আমাকে অপরাধী করে তোলে।
কারা-পালানো আসামি ফিরছে, হাতে রক্তাক্ত
ছুরির উল্লাস। হিজলবনে সর্পশিকারি প্যাঁচা
ঘুমিয়েছে। চিতাবাঘিনী টানছে হরিণীর ফুসফুস।
মিঠে স্রোতে ঘড়িয়াল। অরণ্যে সিংহীর আর্তনাদ।
ভেসে আসে তোমার কণ্ঠস্বর, চুড়ির রিনিঝিনি।
কাছে ডাকো। গভীর রাত, বনপথে হেঁটে যাও।
তোমাকে ছায়া দেয় বৃক্ষেরা। জ্যোৎস্নায় ব্যাধের
মতো নেশাতুর হই। তৃপ্ত করো মদ ও মাংসে। শুনি,
কাঠের ঘোড়াগুলো পাড়ি দিচ্ছে নামিবা প্রান্তর।
তোমার প্রেমের ভাষা দুরুহ! ম্যাকাও পাখি হয়ে
উড়ি ক্রান্তীয় বনে। জানি না উড্ডয়ন কৌশল।
তুচ্ছ জীবন, পেয়েছি তোমার দেখা। তুমি ছিলে
পতঙ্গ-পিপাসী, মাংসাশী ফুলের সখী।
ময়ুর নৃত্যের মেঘ
তোমার স্মরণে, আকাশে নক্ষত্রের পিনপতন।
বহুরূপী, হাসনাহেনা-বনে সাপের যুদ্ধ-নৃত্য।
হইনি ময়ুর-নৃত্যের মেঘ। যখন দুপুরের খাঁ-খাঁ
ধ্বনি ভাসছে জৎলং থেকে নীলগিরি—তখন
উপত্যকা ভ্রমণে দেবী। সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ
হও। কাওয়ালির আসরে থেমে গেলে কণ্ঠের
কেরামতি। অরণ্যে অ্যাসিড-বৃষ্টি, ফুলের নির্যাস
ঘটাবে মদিরতা। দাবানল ছড়িয়ে পড়বে অরণ্যে—
পুড়বে বানরের মুখ। এমন দিনে ডেকে নিলে,
বললে, “সোহরাই উৎসবে গাঁয়ে এসো, বাবু।
বরণ করে নেব গুড়-জলে। জমিয়ে রেখেছি
হাঁড়িয়া।” পানে ঢলে পড়ি। শিকারে পারদর্শী
পুরুষ মাথায় পালকের মুকুট পরে, স্ত্রীকে
আলিঙ্গন করে। চার ঋতুর প্রাসাদের জরা,
ব্যাধির হাহাকার—হৃদয়ে জাগে মোক্ষের সুখ।