Tuesday, November 18, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    মহামায়া (পর্ব-২)

    পড়ুন—  মহামায়া (পর্ব-১)

    ৩.

    কাঁচা রাস্তায় উঠতে উঠতে কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। পায়ের সাথে কাপড় জড়িয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সবার আগে মনিশঙ্কর হাঁটছে। তার হাতে মাথায় খাবারের টিন। একটা কাপড়ের ট্রাঙ্ক। সকলের হাতেই কাপড়ের পুটুলি। এতটুকু আসতেই হাপিয়ে উঠেছে। আরো অনেকটা দূর যেতে হবে হেঁটে। তারপর নৌকায় সীমানার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায়। মনিশঙ্কর ঠিক জানে না কোথায় যেতে হবে। শিমুলবাড়ি ঘাটে গিয়ে হারু মাঝি অথবা জালাল মাঝিরে পাইলে ঠিক যাওয়া যাবে ওরা পথঘাট চিনে। প্রতিকুল প্রকৃতি অনিশ্চিত অসহায় ঘরছাড়া মানুষগুলোকে নিয়ে আরো উপহাস করতে লাগল।

    সূর্যের তেজ বেড়েছে কিনা তা মেঘের ওপরের আকাশ জানে, মেঘের নিচের মলিন পৃথিবী তেজোদ্দীপ্ত সূর্যের দেখা পায় নাই। তাই বেলা হয়েছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। বাহার বিছানা ছেড়ে উঠেনাই এখনো। একটানা বৃষ্টিতে শরীরে শীতের অলসতা ধরেছে। শুয়ে শুয়েই বিছানা থেকে জানালাটা খুলল বাহার। খোলা জানালা দিয়ে গাছের মাথার ওপর দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে।
    নাস্তা শেষ করে আকবর বারান্দায় বসে হুক্কা টানছে।
    — তোমার পোলার ঘুম ভাঙ্গে নাই অহনও? নবাব কহন উঠব। কামাই কইরা খাইলে নবাবি ছুটব। বাপের টাকায় খায় তো বুঝে না।
    — হুদাই প্যাচাল পারতাছেন। বিষ্টির মইধ্যে উইঠা করব কি? ঘুমাইতে দেন।

    সেলিম কাক ভেজা হয়ে বারান্দায় উঠে এলো। খালি পা কাদায় মাখামাখি ।
    — চাচা বাহার কই?
    — ঘুমায়।
    — চাচা খারাপ খবর আছে। কিছু হুনছেন, মাস্টার বাবুর লাশ পইরা রইছে উত্তর পাড়ায়। স্কুল ঘরের পিছনে। ভিজতাছে। বাহার কই?

    নিস্পৃহ নির্বিকার আকবর আলী। মৃত্যু সংবাদে আকবরের ভাবান্তর হলো না।
    — বাহার ঘুমায়। তুই যা। বাহার উঠলে আমি কমু।
    — চাচা বাহাররে লইয়া যাইতে আইছিলাম।
    — তুমরার অত চিন্তা কেরে? তুমরা তুমাগো কামে যাও।

    বাহার শুয়ে শুয়ে সেলিম আর তার বাবার কথা শুনছিল। এমন একটা কিছু হবে আন্দাজ করেছিল বাহার। মনি গতকাল অনেকবার এসেছিল। মলিন মুখে সারা গ্রাম খুঁজেছে। একটা চিঠি দিয়ে গেছে তার বাবার জন্য। চিঠিটা মাস্টার মশাইকে দেয়ার আর প্রয়োজনীয়তা নাই। ওরা আজ অথবা কাল চলে যাবে। ওইরকম একটা আভাস দিয়েছে মনি। হয়তো এতক্ষণে চলেও গেছে। সুরের সাথে আর কোনদিনই দেখা হবে না। গত বছর রথের মেলায় নিতান্ত সামান্য কথা হয়েছিল। মুখ নিচু করেই কথা শুনছিল। দুই একটার জবাব দিয়েছে। যাওয়ার আগে একবার পূর্ণ চোখে তাকিয়ে বলেছিল যাই। বিকেলের গাঢ় আলোয় গভীর স্নিগ্ধ চোখের চলে যাওয়ায় সন্ধ্যার বিষণ্ণ সুর বহুক্ষণ বেজেছিল। সেই সুর আজীবন বাজবে বুকের গভীরে। অপ্রকাশিত ভালো লাগার গল্পের স্বাক্ষী হয়ে থাকে শুধু নিস্তব্ধ অন্ধকার। এইরকম গল্পের কথা ভালো লাগা মনের কাছে পৌঁছায় কখনো? সুরকে আর বলা হবে না। থাকলেও হয়তো বলা হত না।

    বিছানা ছাড়লো বাহার।
    — সেলিম দাড়া। আইতাছি।
    — অই যে নবাব উঠছে। এতক্ষণ পইরা ঘুমাইছে। অহন দেশ উদ্ধার করতে যাইব।
    — খাইয়া যা বাবা।
    — মা পরে খামু। সেলিম একবার মনিগো বাড়ি যাই। ওরা জানে?
    — গেছিলাম। কেউ নাই। রাইতেই গেছেগা মনে হয়।

    উত্তর পাড়ার এইদিকটা নিরিবিলি। বাড়িঘর কম। জায়গাটা উঁচু। টিলার মত। টিলার নিচে সেঁচের জন্য ড্রেন কাটা হয়েছে। সারা রাতের বৃষ্টিতে ড্রেন ভর্তি পানি। রাধাশঙ্করের লাশ অর্ধেকটা পানিতে। বাহার পৌঁছে দেখে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ আরো ভীত হয়ে ভীড় করেছে। ভীড়ের মধ্য থেকে গুন গুন আওয়াজ হচ্ছে। মাস্টার সাবরে মাইরা ফালাইছে। এত ভালা মানুষ।

    রাধাশঙ্করের মৃত খোলা চোখ দেখতে লাগল। বাহার, সেলিম এসেছে। ওরা ছাত্র ছিল। খুব ভাল ছেলে। আকবর আলি এসেছে। গতকাল রাতেও এসেছিল। বেশি কথা বলে নাই। শুধু বলেছিল বেশি দেরি করন যাইব না। যা করার অহনি কর। রাধাশঙ্কর বুঝতে পারছে না তার সৎকার হবে কিনা। সেই রাত থেকে পড়ে আছে। গ্রামে বামুন পুরুত কেউ নাই। তার গতি কি হবে বোঝা যাচ্ছে না।

    রাধাশঙ্করের মৃত খোলা চোখ দেখতে লাগল। বাহার, সেলিম এসেছে। ওরা ছাত্র ছিল। খুব ভাল ছেলে। আকবর আলি এসেছে। গতকাল রাতেও এসেছিল। বেশি কথা বলে নাই। শুধু বলেছিল বেশি দেরি করন যাইব না। যা করার অহনি কর। রাধাশঙ্কর বুঝতে পারছে না তার সৎকার হবে কিনা। সেই রাত থেকে পড়ে আছে

    আকবর ধমক দিল, ওই মিয়ারা যার যার কামে যাও। এইহানে ভীড় কইরো না। নাকি মাস্টারের মত শুইয়া থাকনের ইচ্ছা।
    ভীড় পাতলা হতে শুরু করেছে।
    — আব্বা লাশের সৎকার করন লাগব। দেরি করন ঠিক হইব না। পঁচন ধরবো। মাস্টারমশাই এর আত্মা কষ্ট পাইব।
    — তোর অত কিয়ের চিন্তা? তুই বেরাম্মন? হিন্দু? তুই মন্ত্র পরবি? চিতা ধরাবি? যা বাইত যা। এই লাশ এইহানেই থাকুক। কেউ চিতায় নিলে নিব নাইলে শিয়াল আছে।

    অবশেষে রাধাশঙ্কর একলা হল। তাকে ফেলে সবাই চলে গেছে। রাধাশঙ্করের খুব হালকা লাগছে। সারাদিন ভিজেও ঠান্ডা লাগছে না। দুপুর পার হয়ে বিকাল হয়ে যাচ্ছে কেউ এদিকে আসে নাই আর। একটু চিন্তা হচ্ছে। চিতায় না নিলে এখানে পঁচতে হবে। তা হোক, পচে গেলে তো মাটিতেই মিশবে। নিজের দেশের মাটি। শুধু ওই শিয়াল গুলোকে ভয়।
    মানুষ পঁচা দূর্গন্ধ নিয়ে দুপুর বিকেল হয়েছে। আকাশে মেঘ থাকায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা লাগছে। বাহার আর সেলিম একটা কোদাল নিয়ে এসেছে। কোনো ব্রাহ্মণ, পুরুত পাওয়া যায় নাই। যে কয়েক ঘর হিন্দু আছে তারা কেউ আসে নাই।
    — সেলিম হাত চালা। লাশের পাশেই গর্ত কর। মাস্টার মশাইরে এইভাবে ফালায়া রাখা যাইব না। লাশ ফুইলা গেছে। গন্ধ হইছে।
    গর্ত হয়ে গেলে বাহার রাধাশঙ্করের পা ধরে ক্ষমা চাইল। ক্ষমা কইরা দিয়েন এইসব জানোয়ারগুলারে। এই মাটিরে ক্ষমা কইরা দিয়েন।
    সেলিম ক্ষমা চাইতে গেল। কান্নার দমকে কথা সব ভেসে গেল। কি বললো বোঝা গেল না। পায়ের ওপর ঝুকে পরে হুম হুম করে কাঁদতে লাগল।

    লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়েছে।
    — বাহার আল্লার কাছে দোয়া করমু?
    — কর।
    মেঘের ওপর আকাশ পেরিয়ে যিনি আছেন তাঁর স্মিত হাসিতে বিদ্যুৎ চমকালো। আবার বৃষ্টি নামবে। রাধাশঙ্করের চিতা জ্বলেনি। কিন্তু রাধাশঙ্কর তার প্রিয় মাটিতে আশ্রয় পেল…

     

    ৪.

    আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন ভারী দিন। দীর্ঘ পথ আরো দীর্ঘতর হচ্ছে পথের কারণে। একটানা অনেকটা পথ হেটে পেরিয়েছে। ঘামে ভেজা শরীর বৃষ্টিতে ধুয়ে পরিষ্কার হচ্ছে। নিরু বার বার পিছিয়ে পরছে। আর হাঁটতে পারছে না।
    — হুনছেন দাড়ান, আর পারতাছিনা। দম বাইর হইয়া যাইতাছে, মনে হয় মাথা গুইরা পইরা যাইমু। একটু বইতে দেন।
    — বউ আর মাইল খানেক।
    — না আর পারুম না। বইলাম।।
    মনি, মহামায়া, রানা, সুর নিরু একটা গাছের নিচে বসল। মানুষজনের আনাগোনা কম। আশে পাশের ক্ষেতে কৃষকের ব্যস্ততা নাই।
    — কিছু খাবি বউ?
    — পানি খামু। আমি আর যাইতে পারুম না। আমারে ফালায়া যাও। আমার লাইগা তোমাগো বিপদ হইব।
    — বউ কথা কইস না। জিরাইয়া ল। বল পাইবি। আর বেশি দূর না এইহান থেইকা। শিমুল বাড়ী ঘাটে মাঝিরে পাইলে আর চিন্তা নাই।
    — না পাইলে কি করবা?

    বহুক্ষণ মেঘের আড়ালে থেকে সুর্য কিছুটা বের হয়ে পৃথিবীর এইসব অসহায় শিকরছিন্ন মানুষের ওপর গোলাপি নরম আলো ছড়িয়ে দিল। পূর্ব দিকের দিগন্তসীমার অনেক ওপরে সূর্য যেখানে উঁকি দিয়েছে সেইখানে মেঘের কাঁচা সোনার মত রঙ হয়েছে। মাঝে মাঝে মেঘের ঘন আস্তরণের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের নীল দেখা যাচ্ছে। এইসব ফাঁক গলে সূর্যের আলো বেরিয়েছে। মেঘের ফাঁকের এইসব মুক্তির পথ। আলোর পথ।
    অনিশ্চয়তায় ডুবে থাকা মনিশঙ্কর আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ আর সূর্যের খেলা দেখতে লাগল । সূর্য ওঠাতে শরীরের ঠান্ডা ভাব দূর হয়েছে। মৃদু ঝিরঝিরে বাতাস শরীরে লাগায় ঘুম আসছে। নিরু একটা কড়ই গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

    সুর ঘর থেকে বের হওয়া অব্দি কথা বলে নাই। বাবার কথা বার বার মনে পরছে। গভীর তরঙ্গায়িত চোখ আর বাধা মানেনি। বাবার সাথে তার আর দেখা হবে না। নিশ্চিত শান্ত জীবনের সমাপ্তি হয়েছে। আগামী দিনের উত্তাল ঝড় কোথায় নিয়ে দাড় করিয়ে দিবে সুর জানে না। কিন্তু সে জীবনে প্রতিদিন দুপুরে ভাত খাওয়ার পর রান্না ঘরের পিছনে মাদুর বিছিয়ে অলস বসে রেডিওতে নাটক শোনা হবে না। যে ঝড়ের রাতে দূর্গা মরে গিয়েছিল সেই রাতের কথা মনে করে মন খারাপ হবে না আর। পরিস্কার করে ধোয়া সাদা বিছানার চাদর বিছানো বিছানায় আর ঘুমানো হবে না। ভোরে বারান্দায় বাবার সাথে বসে চা খাওয়া হবে না আর।

    দুপুরের ভেজা ভ্যাপসা রোদ মাথায় নিয়ে নৌকা ছাড়লো। সর্পিল নদীর বাঁকে বাকে মৃত্যু লুকিয়ে আছে। মহামায়ার জীবনের প্রথম অঙ্কের শুরু হয়েছিল এই নদীতে। আজ দ্বিতীয় অঙ্কের শুরু হল এই নদীতেই। প্রতি মুহুর্তেই মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়ার জীবন

    ক্লান্ত মনিশঙ্করের পরিবার যখন শিমুলবাড়ী ঘাটে পৌঁছল সুর্য তখন মাথার ওপর। ঘাটে নৌকা নাই। দূশ্চিন্তা আর ভয় মনির মনে। মনির চিন্তিত মুখের ছাপ লুকানো যাচ্ছে না।
    — মা এইহানে ছায়ার নিচে ব। নৌকা আয়া পরব।
    নিরুর শঙ্কা অমুলক নয়। নৌকা না পেলে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। ধারে কাছে আশ্রয় পাওয়া অনিশ্চিত। মনি ভাবল ভুল হয়েছে। কাল একবার এসে মাঝির সাথে কথা বলে গেলে ভাল হত। বিপদে মাথা ঠিক ছিল না। বাবাকে খুঁজতে সারাদিন পার হয়েছে কাল।
    সামান্য গ্রাম্য ঘাট। আড়ম্বরহীন। নদীর পারে মাটি কেটে সিঁড়ির মত করা হয়েছে। এই বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে। এই দিককার মাটি লাল। পাশে বাঁশ গেঁথে ধরার ব্যবস্থা। নদীর এইপারে বড় বড় শাল গাছ ছায়া দিচ্ছে। শালের বড় বড় ভেজা পাতা গড়িয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। ওই পাড়ে কাটা ঝোপ। ঘন জঙ্গল। এইরকম ঠাস বুনটের ঘন জংগলে মেছোবাঘ, বাগডাসা, বনবেড়াল এইসব প্রাণী থাকে।
    — বাবা নাউ নাই। অহন কি করবি?
    — মা বইয়া কতক্ষণ জিড়া। নাউ আইব। একটা কিছু হইব। আর ডরাইয়া কি হইব। বেশি হইলে মরণ, এই তো।

    মহামায়া ভাবে, রাধাশঙ্কর তো হারিয়ে যাবার জন্য নয়। কিন্তু রাধা হারিয়ে গেল কেন। কয়েক যুগ আগে কোনো এক হেমন্তের ঝলমলে দিনে এই নদী দিয়েই মহামায়া রাধাশঙ্করের বাড়ি এসেছিল। এই ঘাটে নেমেছিল না আরও সামনে এগিয়ে নেমেছিল তা আর মনে করতে পারে না। তখন নদী আরো প্রশস্ত ছিল। জীবনের প্রথম অঙ্কের শুরু হয়েছিল সেই দিন। ভরসার জীবন, ভালবাসার জীবন। প্রায় ঘন্টা খানেক পর রহিমের নৌকা ঘাটে ভিড়লো।

    — মনি ভাই চল্লা? মাস্টার বাবু কই?
    — বাবারে থুইয়াই আইছি।
    — বুঝছি। কাইল খবর দেও নাই কে?
    — কাইল সারাদিন বাবারে খুঁজতে গিয়া স্মরণ আছিল না।
    — মাসি আর দেরি কইরেন না। নৌকাত উইঠা আহেন।
    — রহিম ভাই তুমি এই রাস্তা চিনো?
    — পুরা চিনি না। তয় বর্ডারের কাছাকাছি দিয়া আইবার পারমু।
    — মাসি শাখা্ডা খুইলা রাহেন। কপালডা মুইছা লন ভাল কইরা। পাটাতনের নিচে বুরখা আছে। মনি তুমার বইনেরে পরাইয়া লও। আর তুমি ধুতি ছাইরা একটা শুকনা লুঙ্গি আছে, অইডা পরো।
    — রহিম ভাই তুমি এত কিছু রাখছ?
    — কি করমু কয়দিন ধইরা এই কামই করতাছি। করতে করতে শিখছি কিছু।
    — হনছি লুঙ্গি খুইলা দেখে।
    — দেখলে আর কি করবা?
    — এই পথে মিলিটারি আছে?
    — একদিন ধরছিল।
    — কি করছিল রহিম ভাই? তোমার নৌকাত কারা ছিল হেইদিন?
    — কি করবা শুইনা মনি ভাই। বাদ দাও। মাসি কিছু খাইয়া লন। অল্প ভাত আছে।
    — না বাবা। তুমি নৌকা ছাইরা দাও।
    — মাস্টার বাবুর কাছে আমার অনেক ঋণ গো মাসি। বাবা যেই বছর আমার স্কুল ছারায়া দিছিল, সেই বছর স্যার আমাগো বাড়িত আইছিল। কতদুর রইদের মইধ্যে হাইটা আইছিল। ফর্সা মুখডা লাল হইয়া গেছিল। বাবারে কইছিল, মাঝি তোমার ছেলের মাথা ভাল। স্কুল ছাড়াইও না। বাবায় মানে নাই। মাঝির পোলা মাঝি হইব। পড়া লেহা কইরা কি হইব। আমার টেহা লাগব। অত পুলাপান লইয়া আর চলতে পারতাছি না। পড়া ছাইরা আমার অত খারাপ লাগে নাই। মাস্টার মশাইয়ের মুখটা দেইখা বেশি খারাপ লাগছিল।

    মহামায়া দূরে ঝাপসা ভেজা চোখে কাল্পনিক সীমারেখার দিকে তাকিয়ে রইল। কি যন্ত্রণা হচ্ছে মহামায়ার তা কোনোভাবেই বোঝানো যাবে না। নিজের দেশ, নিজের মানুষ অন্ধকারে কালো হয়ে আরো দূরে চলে গেল। ঘন অন্ধকারে আর কিছু দেখা গেল না

    দুপুরের ভেজা ভ্যাপসা রোদ মাথায় নিয়ে নৌকা ছাড়লো। সর্পিল নদীর বাঁকে বাকে মৃত্যু লুকিয়ে আছে। মহামায়ার জীবনের প্রথম অঙ্কের শুরু হয়েছিল এই নদীতে। আজ দ্বিতীয় অঙ্কের শুরু হল এই নদীতেই। প্রতি মুহুর্তেই মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়ার জীবন।

    মনি রোদ মাথায় নিয়ে সামনের দিকের গলুইয়রে ওপর বসে আছে। সতর্ক দৃষ্টি। চোখের সীমানায় যদি কিছু ধরা পড়ে, তবে সাবধান হওয়া যাবে।
    রহিম ডাক দেয়, ‘মনি …। ভাই ভিতরে বইয়া একটু জিরাও। হেই দুপুর থেইকা বইয়া রইছ। আবার তো মেলা রাস্তা হাডন লাগব। আর মিলিটারি আইলে ভাই কিছু করার নাইরে ভাই। সব উপর অলার ওপর ছাইড়া দাও।
    মনি কিছু বলে না। শুধু ওপরের দিকে তাকিয়ে একবার আকাশটা দেখার চেষ্টা করে, সূর্যটাকে দেখে আর ভাবে উপরওলার হিসাব উপরওলাই জানে।

    বিকেল হয়েছে। মিস্টি বাতাস হচ্ছে। ভারতের কাছাকাছি কোনো গ্রাম। নাম জানা নাই। নৌকা নদী থেকে খালে নেমেছে। চারিদিকে উঁচু টিলা।
    — রহিম ভাই কোন দিকে নামাইবা।
    — অইযে সামনে সমান জায়গা আছে।
    — হেরপর কেমনে যামু? এই জায়গার নাম কি?
    — গোপীনাথপুর। উত্তর দিকে গেলে একটা মসজিদ পাইবা। এই দেশেই পরছে। তয় এইহানে ঝামেলা নাই। হের পরেই ইনডিয়া।

    মসজিদ বেশি দূরে নয়। আছরের নামায শেষ হয়েছে। মুসুল্লিরা মসজিদ থেকে বের হয়ে আসছে। এদের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ নেই। সীমানার কাছাকাছি। যুদ্ধ এত দূর অব্দি পৌঁছায়নি। মনিদের দেখে খুব ভাবান্তর হয়নি কারো। প্রতিদিনই হয়তো দেখছে।
    আব্দুর রহমান এগিয়ে এসে মনিকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা ঐপারে ক্যাম্পে যাইতে যাইতে রাইত হইয়া যাইব। আমার বাড়িত রাইতটা থাইকা সককালে বাইর হইয়া যাইও। মনি একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকল।একজন বয়স্ক মানুষ। শান্ত অবয়ব। বুঝলো অপরিচিত ভিন্ন ধর্মের কিন্তু ভাল মানুষ। কি অদ্ভুত এই পৃথিবী। নিজের গ্রামের চিরচেনা মানুষগুলোর ভয়ে পালিয়ে এসে এই অপরিচিত মানুষটাকে একদম ভয় লাগছে না। মনে হচ্ছে কতজন্মের চেনা আপনার লোক।

    — কাকা এতদুর আইয়া পরছি যখন তখন আর থাকমু না। এহনও আলো আছে। ওইপার থেইকা ক্যম্প পর্যন্ত যাইতে যদি বুঝি বেশি রাইত হইয়া যায় তয় ফিরা আসমু। এশার নামযের সময় এইহানে আপনার লাইগা বইসা থাকমু।
    — দেহ বাবা তুমি যেইডা ভালা মনে কর। ঐ যে দুইডা তালগাছ দেখছ হের পরেই ইনডিয়া।

    তাল গাছ পেরিয়ে মনিরা ইন্ডিয়ায় ঢুকল। অদুরে বিএসএফ চৌকি দেখা যাচ্ছে। পরিশ্রান্ত একটা পরিবার খোলা মাঠে পা ছড়িয়া বসল।

    মহামায়া ফেলে আসা নিজের দেশ আর ইন্ডিয়ার মাঝখানে সীমারেখা খুঁজতে লাগলো। কোনো রেখা দেখল না। দুটো দেশ একই রকম। একই রকম গাছ, একই রকম মানুষ। সূর্য নেমে এলো নারিকেল গাছের মাথায়। দ্রুত অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চারিদিক। মহামায়া দূরে ঝাপসা ভেজা চোখে কাল্পনিক সীমারেখার দিকে তাকিয়ে রইল। কি যন্ত্রণা হচ্ছে মহামায়ার তা কোনোভাবেই বোঝানো যাবে না। নিজের দেশ, নিজের মানুষ অন্ধকারে কালো হয়ে আরো দূরে চলে গেল। ঘন অন্ধকারে আর কিছু দেখা গেল না।

    আব্দুর রহমান এশার নামাযের পর আরো কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর ধীর পায়ে নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

    সেই সন্ধ্যায় বাহার আর সেলিম রাধাশঙ্করের সৎকারের পর আর বাড়ি ফিরে যায়নি। কিছু দিন ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিল। বাহার ফিরে আসেনি। সেলিম মনির খোঁজে স্বাধীনতার পর কলকাতা গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল তা সেলিম জানে।

     

    [ সমাপ্ত ]

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.