
আফ্রিকার মাসাইমারা সাফারিতে যাওয়ার পর আর কোনো বড় সাফারিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অপর্না সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সিনেমাতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার চরিত্রে রাহুল বোসের মুখে কাজিরাঙার কথা শোনার পর এ রিজার্ভ ফরেস্টে সাফারি করার ইচ্ছা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির খুব কাছের এ জায়গাটাতে যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়, আমাদের উত্তর পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আর মাত্র তিনশ কিলোমিটার পথ গেলেই প্রায় হাজার বর্গ কিলোমিটারের এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলটিতে পৌঁছে যাওয়া যায়। অবশেষে সেই সুযোগ আসে। মাঝে দুটি বছর নষ্ট হলো করোনা ভাইরাসের কারণে। করোনার কড়াকড়ি বন্ধ হওয়ার পর এবার ছুট দেওয়া যায়। এ যাত্রায় আমাদের সঙ্গী ছিলেন সস্ত্রীক অনিল আচার্য। অনিল আচার্যকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে? গত অর্ধশতাব্দী ধরে কলকাতা থেকে ‘অনুষ্টুপ’ সাহিত্য ম্যাগাজিনটি যিনি চালিয়ে আসছেন অক্লান্ত পরিশ্রমে, একই নামের প্রকাশনা সংস্থাটির মাধ্যমে অগতানুগতিক গ্রন্থ প্রকাশে অটল থেকে ১৯৬৬ সাল থেকে কলেজ স্ট্রিটের নবীন কুন্ডু লেনের এক চিলতে ঘরে বসে যিনি বাঙালি পাঠকগোষ্ঠীকে দিয়ে যাচ্ছেন ভিন্ন স্বাদের সব বই, ১৯৯৬ সাল থেকে পরপর তিনবার কলকাতা পাবলিশার অ্যান্ড বুকসেলারস গিল্ডের সেক্রেটারি ছিলেন যিনি, সেই অনিল আচার্যকে চেনাতে হবে? ১৯৯৭ সালে কলকাতা বইমেলায় জাঁক দেরিদাকে নিয়ে এসেছিলেন যিনি, (যে বার এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গিয়েছিল বইমেলার বহু স্টল), ১৯৯৯ সালে কলকাতা বইমেলায় যে বারের থিম ছিল বাংলাদেশ, সেবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যিনি, তিনিই এ অনিল আচার্য। অনিল দা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন।
আমাদের যাত্রাপথ ছিল ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে গৌহাটি পর্যন্ত আকাশপথে। সেখান থেকে সড়কপথে কাজিরাঙা। ঢাকা কলকাতা ঢাকা অংশ বাদ দিয়ে বাকি সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন অনিল দা এবং তার পুত্র অচিরাংশু। অচিরাংশু অনিলদার দুই যোগ্য পুত্রের মধ্যে বড় জন, বিশ্বভারতী থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করে এখন সেখানেই অধ্যাপনায় যুক্ত। একই সঙ্গে ‘অনুষ্টুপ’ ম্যাগাজিনের সহযোগী সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অনিল দা’র দ্বিতীয় পুত্র অমিতাংশু আচার্যও এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি স্কলার, গবেষক, লেখক এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নকর্মী। বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের কোনো এক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন। তার মানে, দুই পুত্র এখন যথেষ্ট লায়েক ও স্বাবলম্বী, অনিল দা ইংরেজির অধ্যাপনা এবং বৌদি স্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন দীর্ঘদিন আগে। এখনই তো ঝাড়া হাত পা হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময়। কিন্তু অনুষ্টুপের বিশেষ সংখ্যা, শারদীয় সংখ্যা আর বইমেলার চক্কর থাকে বছরজুড়ে, বললেই তো ছুটে যেতে পারেন না। অবশেষে ২০২৩-এর বইমেলার ব্যস্ততা চুকিয়ে মার্চ মাসে কাজিরাঙা চূড়ান্ত হলো। এখানে সফরের আদর্শ মৌসুম মার্চেই শেষ হয়।
বিমানের সময়জ্ঞান বিবেচনা করে অনিল দা’কে আভাস দিয়ে রেখেছিলাম, আমাদের কলকাতা পৌঁছাতে দেরি হতে পারে, তাই এয়ারপোর্টে কাউকে পাঠানোর দরকার নেই, প্রিপেইড ট্যাক্সি নিয়ে তার ব্যবস্থা করে রাখা সল্ট লেক স্টেডিয়ামের স্টাডেল হোটেলে পৌঁছতে কোনো সমস্যা হবে না। আমার আশঙ্কাই সত্য হয়েছিল। প্রায় একঘণ্টা দেরিতে পৌঁছে কলকাতা এয়ারপোর্টের বাইরে দীর্ঘ সময় অনিলদাকে অপেক্ষমাণ দেখতে পেয়ে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছিলাম। কলকাতা পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় ছিল ভারতীয় সময় রাত সোয়া আটটা। কিন্তু হোটেলে পৌঁছে তাকে যখন বিদায় জানাই, তখন রাত সাড়ে দশটা। ততক্ষণে হোটেলের রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে, অগত্যা রুম সার্ভিসই ছিল সে রাতের নৈশাহারের একমাত্র উপায়।
পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য আমাদের তুলে নেওয়া গাড়ির ব্যবস্থা অনিলদাই করে রেখেছিলেন। কিন্তু ভোর থেকে দলে দলে নানা বয়সি মহিলাকে স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুকতে দেখে বুঝতে পারিনি মহিলা ম্যারাথনের কারণে পুরো রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনিল দা ফোনে জানালেন, আমাদের নিতে আসা গাড়ি ঢুকতে পারছে না। আমাদের উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি দুটি গাড়ি নিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরের গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিব এবং লেখক অনিরুদ্ধ রাহার সরকারি গাড়িটি সেদিনের জন্য ধার নিয়েছিলেন তিনি। সেই গাড়ির ছাদে বাতি আর হুটার লাগানো দেখে পুলিশ তাকে ঢুকতে দিয়েছিল বলেই সেদিন আমরা গৌহাটির ফ্লাইট ধরতে পেরেছিলাম।

আগের রাতে কলকাতা পৌঁছে বুঝতে পারিনি, দিনের আলোয় দশ বছর আগে দেখা কলকাতা এয়ারপোর্টকে যেন আর চিনতে পারি না। উন্নত বিশ্বের আর দশটা এয়ারপোর্টের মতো অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য উচ্চতা ও দৈর্ঘ্যে বিশাল ধনুকের মতো বাঁকানো টার্মিনাল ভবন। ঢোকার সময় সিকিউরিটির সেপাইরা দীর্ঘসময় ধরে টিকিট আর পাসপোর্ট পরীক্ষা করে একসময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢুকতে দেয়, তবে এমন ভাব করে, যেন তোমাকে ঢুকতে দেওয়া যায় না, তবু এ যাত্রা ছেড়ে দিলাম। এদের সবাই হিন্দিতে কথা বলে, মেজাজও বেশ কড়া, তাই প্রকৃত কোনো ভাষাভাষী, সেটা বোঝার উপায় নেই।
বিমান আকাশে থিতু হওয়ার পর ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের সুন্দরী বিমানবালাদের একজন সব সময়ের মতো জরুরি অবতরণকালে যাত্রীদের করণীয় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। কাজটি করছিলেন দিব্যা, ওদের উচ্চারণে দিভিয়া নামের পরমসুন্দরী এক বিমানবালা। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স আর এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়া বাকি সব প্রাইভেট বিমান কোম্পানিতে বলিউডের নায়িকা হওয়ার মতো অতি সুন্দরী বিমানবালাদের রাখা হয়। জরুরি অবতরণ করার পর কীভাবে ইমার্জেন্সি এক্সিটের দরজা খুলতে হবে সেটি বুঝিয়ে দেওয়ার একপর্যায়ে তিনি ইমার্জেন্সি এক্সিটের ঠিক পাশের উইন্ডো সিটে বসা মধ্যবয়সি মহিলা যাত্রীটিকে জিজ্ঞেস করলেন, এরকম অবস্থায় পড়লে কীভাবে এ দরজা খুলতে হবে বুঝতে পেরেছেন তো? মহিলা যাত্রী বললেন, হ্যাঁ বুঝেছি। দিব্যা তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সেরকম পরিস্থিতি হলে দরজাটা খুলতে পারবেন? মহিলার পেছনের আসনেই বসা ছিলাম বলে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলাম, তাই বলি, কেন খামোখা বেচারিকে ভয় দেখাচ্ছেন? এখন তো ঘাবড়ে গিয়ে কিছুই করতে পারবেন না তিনি। ভদ্রমহিলা দিব্যার যাবতীয় প্রশিক্ষণ প্রয়াসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললেন, না বাবা, আমি ওইসব পারব না। দিব্যা তখন ভদ্রমহিলার পাশে বসা (মহিলার স্বামীই হবেন হয়তো) ভদ্রলোককে বললেন, তাহলে আপনি উইন্ডো সিটে গিয়ে বসুন। তারা দুজন আসন অদলবদল করলে দিব্যা এবার ভদ্রলোককে বললেন, ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিংয়ের পর এ দরজাটা আপনি খুলতে পারবেন তো? ভদ্রলোক আসনটা হারানোর ভয়ে কিংবা অতি উৎসাহী মেয়েটিকে নিরস্ত করার জন্য বললেন, কেন পারব না? তারপর মজা করার ভঙ্গিতে বললেন, চলো ট্রাই করে দেখি। ভদ্রলোকের রসিকতায় কান না দিয়ে দিব্যা এবার সিট বেল্ট বাঁধা-খোলা, বিমান জলে নামলে কীভাবে লাইফ জ্যাকেটের রশি ধরে টানতে হয়, কিংবা কীভাবে ফুঁ দিয়ে ফোলাতে হয়-দেখাতে শুরু করেন।
দিব্যার এসব কসরত শেষ হতে হতে বিমানটা অনেকদূর চলে এসেছে। সময় মিলিয়ে বুঝতে পারি আড়াআড়িভাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি আমরা। আশা করছিলাম একসময় ককপিট থেকে খরখরে কণ্ঠে ঘোষণা আসবে, আমরা এখন বাংলাদেশের অমুক জেলার ওপর দিয়ে এত ফুট উচ্চতায় ঘণ্টায় এত মাইল বেগে উড়ে যাচ্ছি। আবহাওয়া স্বাভাবিক, সবকিছু ঠিক থাকলে বেলা প্রায় এগারটা চল্লিশ নাগাদ আমরা গৌহাটি এলজিবিআই এয়ারপোর্টে নামতে পারব বলে আশা করছি। গৌহাটিতে এখন তাপমাত্রা … ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু গৌহাটির কাছাকাছি না পৌঁছা পর্যন্ত ক্যাপ্টেন সম্পূর্ণ নীরব থাকলেন। তাই কখন বাংলাদেশ পাড়ি দিয়ে আবার ভারতীয় আকাশ সীমায় ঢুকলাম টের পাইনি। অথচ দেড় ঘণ্টার উড়ানে এক ঘণ্টার কাছাকাছি সময় বাংলাদেশের আকাশসীমায় ছিল প্লেনটা। নিজ দেশের আকাশসীমা ছেড়ে অন্যদেশের আকাশসীমা পার হয়ে আবার নিজ দেশে ঢোকার মতো যাত্রা তো পৃথিবীতে বিরল।
গৌহাটি থেকে কাজিরাঙা চার লেনের পরিচ্ছন্ন সড়কটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সাক্ষ্য দেয়। পথচলতি শহরের লোকাল সার্ভিস বাসগুলো দেখে মনে হচ্ছিল দূরপাল্লার লাক্সারি বাস। সাদা রঙের ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন বাসগুলো দেখে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা ঘেয়ো কুকুরের মতো ছালচামড়াহীন বাসের কথা মনে পড়লে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিতে হয়
শেষবার যখন গৌহাটি এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম শিলং যাওয়ার জন্য, তারপর বিশ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে, সময়, স্মৃতি এবং উন্নয়ন-বদলে দিয়েছে সবকিছু। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং পরবর্তী সময়ে আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর নামানুসারে এটির নাম হয়েছে লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। লোকপ্রিয় উপাধিটি দেওয়া হয়েছে তার জনপ্রিয়তার জন্য। ছোট হলেও আধুনিক ছিমছাম পরিচ্ছন্ন অ্যারাইভাল হলো। টার্মিনাল ভবন থেকে বের হওয়ার গেটের দুপাশে মঞ্চ সাজানো, সেখানে দুদল নৃত্যশিল্পী আগত যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পরিবেশন করছিল স্থানীয় লোকনৃত্য। বর্ণিল ব্যানারে ছাপা জি২০-এর অধীন সুপ্রিম অডিট ইনস্টিটিউশনের সম্মেলনে রাজ্যগুলো থেকে বিভিন্ন ফ্লাইটে আসা ডেলিগেটদের উদ্দেশে অভ্যর্থনার বাণী। এমন বর্ণিল আয়োজনের উদ্দিষ্ট ডেলিগেট না হলেও আগত যাত্রী হিসাবে আমরাও এ অভ্যর্থনার ভাগিদার বটে।
আগে থেকে রিজার্ভ করে রাখা গাড়ি খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না। একখানা টয়োটা ইনোভা এসইউভি নিয়ে ড্রাইভার পরাগ বড়ুয়া অপেক্ষমাণ ছিল। চশমা পরা ছেলেটিকে ড্রাইভারের চেয়ে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসাবেই মানাত ভালো। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই অনেক ধরনের সাইন পোস্টের মধ্যে একখানা নজর কাড়ল, ‘তীব্রগতি-স্বর্গগতি,’ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে সতর্কবাণীটা বেশ মানানসই হয়েছে। এ স্লোগানটার প্রশংসা করলে অনিল বৌদি বললেন বাংলাদেশের একটা স্লোগান তার খুব পছন্দ, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ গাড়িটার সবকিছু বেশ পছন্দ হয়েছে বলে দাম সম্পর্কে একটা ধারণা করার জন্য পরেশকে জিজ্ঞাসা করে জানা যায় ওটার দাম বিশ লাখ রুপি, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আটাশ লাখ। হায়! আটাশ লাখে আমাদের দেশে তো একটা পছন্দসই রিকন্ডিশনড সেডানও পাওয়া যায় না। পাওয়া যেত, যদি গাড়ির দামের তিন থেকে চার গুণ কাস্টমস শুল্ক দিতে না হতো। আমাদের দেশে তৈরি হলে আমরাও হয়তো এটার কাছাকাছি দামে কিনতে পারতাম। যা নেই সেটা ভেবে মন খারাপ না করে বাইরে শহরের দৃশ্য দেখায় মনোযোগ দিই বরং।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে যখন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালু হয়নি, তখন যুদ্ধের খবরের জন্য আকাশবাণী কলকাতা ছাড়াও শুনতাম গৌহাটি কেন্দ্রের খবর। অহমিয়া ভাষার বচন ও বর্ণমালার সঙ্গে বাংলা ভাষার বেশ মিল রয়েছে, তাই এ ভাষার খবর শুনে পুরোটা বুঝতে না পারলেও তার মর্মার্থ উদ্ধার করতে বিশেষ বেগ পেতে হতো না। আর কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ আমাদের কিছু আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে সমিল বলে শুনতে বেশ মজা লাগত।
গৌহাটি শহর পার হতে হতে রাস্তার দুপাশের সাইনবোর্ডগুলো দেখে অহমিয়া বর্ণমালা সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা হয়ে যায়, তাই পড়তে মোটেই অসুবিধা হচ্ছিল না। বর্ণমালার মিল থাকলেও উচ্চারণ অনেক ক্ষেত্রে আলাদা। যেমন ‘ব’য়ের পেট কাটা থাকলে তার উচ্চারণ হবে ‘র,’ আবার ‘ব’য়ের নিচে মাঝ বরাবর হাইফেনের মতো থাকলে সেটার উচ্চারণ বাংলা ভাষায় নেই, ‘ভ’ এবং ‘য়’-এর মাঝামাঝি, অর্থাৎ ইংরেজি ডব্লিউর মতো। কিংবা ‘চ’য়ের উচ্চারণ হবে বাংলা দন্ত্য‘স’য়ের মতো, আবার দন্ত্য‘স’য়ের উচ্চারণ ‘হ’-এর মতো। যেমন ‘চরকার’ উচ্চারণ হবে ‘সরকার,’ ‘আসাম’ উচ্চারণ হবে ‘অহম।’

গৌহাটি শহর পাড়ি দিতে গিয়ে চোখে পড়ে নির্মীয়মান বিশাল ফ্লাইওভারের কাঠামো। উল্লেখ্য, আসাম রাজ্য হচ্ছে ভারতের তেল সমৃদ্ধ আরব দেশের মতো। এ রাজ্যের মাটির নিচে রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেলের মজুত, রয়েছে গ্যাসের ভাণ্ডার ও কয়লার খনি। তাছাড়া গত দুই দফায় এখানে সরকার গঠন করেছে বিজেপি। কেন্দ্রের সুনজর আছে বলে উন্নয়নের ধুমধাম চলছে শহরটিতে। গৌহাটি থেকে কাজিরাঙা চার লেনের পরিচ্ছন্ন সড়কটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সাক্ষ্য দেয়। পথচলতি শহরের লোকাল সার্ভিস বাসগুলো দেখে মনে হচ্ছিল দূরপাল্লার লাক্সারি বাস। সাদা রঙের ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন বাসগুলো দেখে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা ঘেয়ো কুকুরের মতো ছালচামড়াহীন বাসের কথা মনে পড়লে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিতে হয়। এসময় ড্রাইভার পরাগ বড়ুয়া জানায়, কাজিরাঙা রওনা হওয়ার আগে আমরা কামাখ্যা মন্দির দেখে নিতে পারি। মন্দিরদর্শন শেষ করে দুপুরের খাওয়ার পর যাত্রা শুরু হবে কাজিরাঙার উদ্দেশ্যে।
কামাখ্যা মন্দিরে যাওয়ার কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। ওর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রস্তাবে বোঝা যায়, এটা স্ট্যান্ডার্ড ট্যুর প্যাকেজের অংশ। কিন্তু এরকম অযাচিতভাবে বিখ্যাত এ মন্দিরটি দেখার সুযোগ এসে যাওয়ায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। মোটামুটি লায়েক হওয়ার পর থেকেই কামরূপ কামাখ্যা নামটার সঙ্গে বিস্তর পরিচয় ঘটেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানতাম, কোনো পুরুষ সেখানে গেলে নাকি ফিরে আর আসে না। যৌবনবতী নারীরা পুরুষদের ছলেবলে জাদু করে রেখে দেয়। কোনোভাবে যদি ওরা বের হয়ে আসতেও পারে, তাদের যৌবন রেখে আসতে হয় সেখানে। এসব রমণীদের দেখা পাওয়ার বাসনায় কামাখ্যা নামটি শুনেই মনের ভেতর গুনগুন করে ওঠে। একাকী পুরুষ হিসাবে যাচ্ছি না বলে জাদু করে রেখে দেওয়া নিয়েও ভাবনা হয় না। আর হলেই বা কী? নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করা যাবে। আরও শুনেছি, এ রহস্যময় নগরী হচ্ছে জাদুমন্ত্রের দেশ। সেখানকার জাদুকরেরা ভিনদেশি পুরুষদের বশ করে ছাগল-ভেড়া বানিয়ে রাখে। জাদুটোনা, তন্ত্র-মন্ত্রের দেশ কামরূপ কামাখ্যার অরণ্য আর নির্জন পথে নাকি দেখা যায় ভূত-পেত্নী আর ডাকিনী-যোগিনীদের। আমাদের দেশের রাস্তায় জাদু দেখানো ভন্ড জাদুকরদের বুক ফুলিয়ে বলতে শুনেছি, তারা কামরূপ কামাখ্যা থেকে জাদুবিদ্যা শিখে এসেছে।
কামাখ্যা সম্পর্কে এসব আজগুবি কথা যারা ছড়ান, তারা একসঙ্গে বলেন কামরূপ কামাখ্যার নাম। প্রকৃতপক্ষে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অস্তিত্বশীল ছিল কামরূপ রাজ্য। বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই রাজ্যের সীমানা। বর্তমানে কামরূপ আসাম রাজ্যের একটা জেলা, আর কামাখ্যা হচ্ছে এ জেলার অন্তর্গত গৌহাটির একটা উপশহর।
মোটামুটি লায়েক হওয়ার পর থেকেই কামরূপ কামাখ্যা নামটার সঙ্গে বিস্তর পরিচয় ঘটেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানতাম, কোনো পুরুষ সেখানে গেলে নাকি ফিরে আর আসে না। যৌবনবতী নারীরা পুরুষদের ছলেবলে জাদু করে রেখে দেয়। কোনোভাবে যদি ওরা বের হয়ে আসতেও পারে, তাদের যৌবন রেখে আসতে হয় সেখানে। এসব রমণীদের দেখা পাওয়ার বাসনায় কামাখ্যা নামটি শুনেই মনের ভেতর গুনগুন করে ওঠে
কামাখ্যা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস নিয়ে হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে, ব্রহ্মার পুত্র রাজা দক্ষের চব্বিশ কন্যার মধ্যে পঞ্চদশতম কন্যা সতী পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করেছিলেন শিবকে। শিব তথা মহাদেবকে পছন্দ করতেন না রাজা দক্ষ। তাই জামাতা হয়ে গেলেও শিবের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজা দক্ষ এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। এ যজ্ঞে সব দেবতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও সতী কিংবা তার স্বামীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সতী ভেবেছিলেন ভুলক্রমে তাদের নিমন্ত্রণ করেননি তার বাবা। তাই অনিচ্ছুক স্বামীকে প্রায় জোর করে নিয়ে যজ্ঞানুষ্ঠানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন দুজন। অনাহুত কন্যা আর জামাতাকে দেখে তাদের অপমান করেন রাজা দক্ষ। স্বামীর এ অপমান সইতে না পেরে সতী আত্মহত্যা করেন। স্ত্রী শোকে উন্মত্ত শিব শ্বশুরের যজ্ঞানুষ্ঠান পন্ড করে দিয়ে সতীর শবদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য করতে থাকেন। আমরা তুলকালাম, লন্ডভন্ড কিংবা প্রলয়কাণ্ড অবস্থা বোঝাতে যে দক্ষযজ্ঞ শব্দটি ব্যবহার করি, তার উৎপত্তি পুরাণের এ ঘটনা থেকেই। বহু অনুরোধ সত্ত্বেও শিব প্রলয়নাচ বন্ধ করছেন না দেখে জগতের মঙ্গলের জন্য এ দক্ষযজ্ঞ বন্ধ করতে ভগবান বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহকে একান্ন খণ্ডে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। দেবীর দেহখণ্ড পৃথিবীতে এসে পড়তে থাকে, যার সবগুলোই ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এবং পাথরে পরিণত হয়। কামরূপের পাহাড়ে এসে পড়া অঙ্গের স্পর্শে পাহাড়টা নীল হয়ে গিয়েছিল বলে এটার নাম নীলাচল। হিন্দুশাস্ত্রে এসব স্থানকে পবিত্র মহাপীঠ বা শক্তিপীঠ হিসাবে গণ্য করা হয়। কামাখ্যা সেসব শক্তিপীঠের অন্যতম একটি, কারণ এখানে এসে পড়েছিল সতীর জননেন্দ্রীয় ও গর্ভ। একারণে শিবের স্ত্রী মোক্ষদাত্রী সতী তথা কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বলে মান্য করা হয়। এ মন্দিরে কামাখ্যা দেবীর কোনো বিগ্রহ নেই, আছে কেবল প্রত্যঙ্গটির পাথুরে রূপ। হয়তো এ কারণেই কামাখ্যাকে ঘিরে এত রহস্য ও জল্পনা-কল্পনা।
মন্দিরের বর্তমান কাঠামোটি এটির আদি রূপ নয়। বহু বছর আগে ভিনদেশি আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংস হয়েছিল এটি, যার দুই ধরনের ভাষ্য পাওয়া যায়। একটি ভাষ্যে জানা যায় কররানি রাজবংশের সেনাপতি ধর্মান্তরিত কালাপাহাড়ের বাহিনী এ মন্দির ধ্বংস করেছিল। ভিন্ন মতে, ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ যখন কামতা রাজ্য আক্রমণ করেন, সেসময় এ মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে, কোচ রাজবংশের প্রথম রাজা বিশ্বসিংহ ১৫১৫ সালে ক্ষমতায় বসার পর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়ে সেগুলো ব্যবহার করে আবার তৈরি করেছিলেন মন্দিরটি।
আমাদের নিয়ে গাড়ি উঠতে থাকে নীলাচল পাহাড়ের গা বেয়ে, যার মাথায় কামাখ্যা দেবীর মন্দির। নাম নীলাচল হলেও পাহাড়ের কিছুই নীল রঙের নয়, পুরাণে বর্ণিত ঘটনার সময় হয়তো বা সত্যিই নীলই ছিল। একসময় গাড়ি ওঠার সর্বশেষ সীমানায় নেমে পড়তে হয় আমাদের। সেখান থেকে মূল মন্দিরে পৌঁছাতে খুব বেশি পাহাড় বাইতে হয় না, প্রায় সমতল পথের কিছুদূর পর পর অল্প কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙতে হয়। পথের পাশে দোকানের সারি, সেগুলোতে অন্য সব তীর্থস্থানের মতো ঝোলানো বা সাজানো আছে তাজা ফুল ও মালা, রুদ্রাক্ষের মালা, বিভিন্ন আকারের মূর্তি, পূজার নানা উপকরণ, পাথরের আংটি, জপমালা, শঙ্খ, দেবতাদের ছবি, জরির ঝালর দেওয়া রক্তলাল পাতলা কাপড়ের উড়নি, দেবীকে উৎসর্গ করার জন্য শাড়ি, পিতলের উপকরণ, বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্পের নানা সামগ্রী, স্যুভেনিরসহ অগুনতি পশরা। সেদিন রোববারের সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও পূজারিদের ভিড় অসহনীয় নয়। কিছুদূর হাঁটলে হাতের ডান পাশে তারা মন্দির, ওটাতে ঢোকার তোরণের মাথায় দুপাশে দুটি সিংহীর মূর্তি, তবে ফটকটির গ্রিল দরজা বন্ধ। প্রশস্ত দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে আরও কিছুদূর ওঠার পর মূল মন্দিরের ফটক। সেই ফটকের মাথার ওপর মুখোমুখি বসে পাহারা দিচ্ছে কামাখ্যা দেবীর বাহন দুটি সিংহমূর্তি। এটি পার হতে হলে নগ্ন পায়ে যেতে হবে। কিন্তু এখানে জুতো রাখার কোনো ব্যবস্থা দেখা গেল না। অনেক নিচে এক জায়গায় লেখা দেখে এসেছি ‘বিনামূলীয়া জোতা-চেন্দেল রখা ঠাঁই,’ অর্থাৎ বিনামূল্যে জুতা-স্যান্ডেল রাখার জায়গা। এখানে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। এমন সময় একজন হাঁক দিয়ে জানায়, ভেতরে জুতা নিয়ে ঢোকা যাবে না। এখানে জুতা রেখে যেতে হবে, প্রতি জোড়ার ভাড়া দশ রুপি। আমরা সায় দিতেই লোকটা একটা বাজারের থলে নিয়ে এসে আমাদের পাঁচজনের পাঁচ জোড়া জুতা ওটাতে ঢোকায়, তারপর নম্বর লেখা কাগজের টোকেন ধরিয়ে দিয়ে থলেটা নিয়ে আচমকা মিশে যায় ভিড়ের মধ্যে। বের হওয়ার সময় ওকে কোথায় খুঁজব, দেখে চিনতে পারব কি না-এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকি।

ভেতরে পা দিতেই ধূপ-ধুনোর হালকা গন্ধে একটা উপাসনালয়ে ঢোকার আবহ টের পাওয়া যায়। সামনে তাকাতেই প্রাচীন মন্দিরের উঁচু গম্বুজ, সেটিকে ঘিরে নিচু চূড়ার স্তম্ভগুলোর ধূসর গায়ে শিব-পার্বতীর পরিচিত ভঙ্গিমার খোদাই করা কোনারক ঘরানার ভাস্কর্য। মূল গম্বুজটির নিচে গর্ভগৃহ, তার পেছনে উলটানো নৌকার তলার মতো লম্বাটে ছাদের নিচে মন্দিরের বাকি অংশগুলো। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ভক্তসমাগম নেই বলে তীর্থস্থানের চিরাচরিত বিশৃঙ্খলা অনুপস্থিত এখানে। জানতাম মন্দিরে ঢুকলে পান্ডার দল ছেঁকে ধরে, এখানে একই পোশাক পরা পান্ডাদের এখানে সেখানে একাকী দাঁড়ানো কিংবা সদলে আড্ডা দিতে দেখলেও কোনো পুণ্যার্থীর সঙ্গে উমেদারি করতে দেখা যায়নি। সাদা ধুতি, নীল জামা আর গলায় লাল উত্তরীয় পরা কয়েকজন তরুণ পান্ডা অলসভাবে দাঁড়ানো, পূজারি ধরার কোনো তাড়া নেই কারও। ঢোকার পর হাতের ডানে একটা টিনের চাল দেওয়া ঘরের মাথায় কামাখ্যা পুরোহিত (পান্ডা) সমাজের সাইনবোর্ডে রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখে বোঝা যায় এদের সংগঠনটি প্রকৃতই সংগঠিত।
মূল মন্দিরটি নিচু সমতলে তৈরি বলে কয়েক ফুট নেমে যেতে হয় সিঁড়ি দিয়ে। মন্দিরের বাইরের দেয়ালে খোদাই করা রজঃস্বলা মা কামাখ্যার মূর্তিটি জরির কাজ করা রক্তলাল কাপড়ে ঢাকা, সেখানে টাকা-পয়সা ফেলে মানত করছে মহিলা পুণ্যার্থীরা। মন্দিরের চাতালে মানুষের পায়ে পায়ে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কবুতর, পাঠাও দেখা গেল দুয়েকটা। এগুলো পুণ্যার্থীদের দান করা প্রাণী, কোনো একসময় বলি দেওয়া হবে। মূল আকর্ষণ গর্ভগৃহে ঢোকার জন্য টিকিট কেটে ভোর রাত থেকে লাইন দিতে হয়, তাই সেখানে ঢোকার চিন্তা বাদ। অনিল দা কিংবা বৌদির এসবে ভক্তি নেই জানি। কৌতূহল মেটাতে দেখতে যাওয়া যায় বটে, কিন্তু মানুষের যে দীর্ঘ সারি দেখে এসেছি তাতে বিকালের আগে ঢোকা অসম্ভব। নারী জননেন্দ্রীয় আকৃতির একটুকরো পাথর ছাড়া কোনো মূর্তি নেই, ছবি তোলাও নিষেধ, তাহলে গিয়ে আর কী হবে?
তার চেয়ে বাইরে ঘুরে তান্ত্রিক বা সাধু দেখা যায় কি না সে চেষ্টা করা ভালো। চাতালের একপাশে শেডের মধ্যে লম্বালম্বিভাবে লোহার কয়েক ধাপ তাক করে দেওয়া আছে। সেখানে পিলসুজে মোমের দীপ জ্বেলে ভক্তিতে করজোড়ে প্রার্থনারত পুণ্যার্থী নারীপুরুষ। একসঙ্গে জ্বলা সারিসারি অনেক দীপের ধোঁয়া, মোমপোড়া গন্ধে মাখামাখি হয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁয়া’র পরিবেশ রচনা করেছে যেন। এসব উপেক্ষা করে ছোট বোনকে নিয়ে এক কিশোরীকে দীপ জ্বালাতে দেখি, তার মুখে দিওয়ালীর আনন্দ। শেডের সামনের উঠোনে প্রসাদী নারকেলের ভাঙা মালার অর্ধেক টুকরোগুলো তুলে নিয়ে যাচ্ছেন ম্লান মুখের দুয়েকজন মলিনবেশ সধবা। এক পাশে পূজারিণীর হাত থেকে টাকা বুঝে নিতে গিয়ে মাঝবয়সি এক পান্ডার মুখে চওড়া হাসি দেখে বোঝা যায় নজরানাটা প্রত্যাশাতীত হয়েছে। চাতালের পাশে বড় এক বৃক্ষের গোড়ায় বাঁধানো বেদিতে বসে নিবিষ্ট চিত্তে সেলফি তুলছিলেন এক যুবতী। এটা তবু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু কাউকে কবরে শোয়ানোর সময়, হজে গিয়ে শয়তানকে পাথর মারা কিংবা কাবা প্রদক্ষিণের সময়, এমনকি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরানোর সময়েও কেউ একখানা সেলফি তুলতে কসুর করেন না।
দাঁড়িয়ে এসব লক্ষ করছিলাম। পূজারি, পূজারিণী, পান্ডা, সন্ন্যাসী-সবাইকে দেখা যায় মন্দিরে, কিন্তু এতকাল ধরে শুনে আসা ডাকিনী-যোগিনীদের দেখা মিলল না কোথাও, তারাও আছে এ ভিড়ের মধ্যে। আমার উৎসুক চোখ তাদের খুঁজে ফেরে, কিন্তু ডাকিনীবিদ্যা জানা মোহময়ী রমণী বলে মনে হলো না কাউকে। এমন সময় ‘কামাখ্যা মাই কি জয়’ লেখা লাল ফেট্টি মাথায় বাঁধা আঁটোসাঁটো শরীরে কালো শাড়ি পরা একজনের ওপর চোখ পড়ে, শেডের ভেতর অনেকের ভিড়ে দীপ জ্বালাচ্ছিলেন, একমাত্র এঁকেই সেরকম মনে হচ্ছে, বাড়তি কি একটা যেন আছে তার ভেতরে, ঠিক ধরতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর এক ছোট কন্যাশিশুর হাত ধরে তরুণী মা হয়ে বের হয়ে আসার পর তাকে একজন জননী ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। খামোখাই এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অগত্যা আরও কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে ফিরে বের হয়ে আসি। ফটকের বাইরে যার কাছে জুতা রেখে গিয়েছিলাম তার চেহারা মনে নেই, দেখলেও চিনতে পারব না। তাই নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য না করে গলা চড়িয়ে বলি, ‘জুতা কৌন লে গায়া থা?’ এই ডাকে লোকটি আসে না, কোথা থেকে এক মহিলা এসে টোকেনটা নিয়ে একটা সরু গলির ভেতর ঢুকে পড়ে। ঠিক জায়গায় টোকেনটা দিলাম কি না ভাবতে ভাবতে জুতা ভর্তি বাজারের থলেটা এনে দেয় মহিলা। পাঁচ জোড়া জুতা রাখার ভাড়া পঞ্চাশ রুপি বুঝে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে চলে যায় মহিলাটি। এটি ওদের পিক বিজনেস আওয়ার। দৈনিক কত জোড়া জুতা জমা পড়ে এখানে, তার দশগুণ রুপিতে কত আয় হয়, সে হিসাব নিতে চেয়েছিলাম, নেওয়া হলো না।