Author Picture

মনরোর উড়ন্ত স্কার্ট

সুদীপ্ত সালাম

পঞ্চাশের দশকে সাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন মার্কিন অভিনেত্রী, মডেল ও কণ্ঠশিল্পী মেরিলিন মনরো। বলা যায় প্রায় এক দশক মার্কিন সাংস্কৃতিক দুনিয়া শাসন করেছেন তিনি। ১৯৬২ সালে মৃত্যুর পর তার জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়—তিনি হয়ে ওঠেন ‘পপ কালচার’-এর সমার্থক। তাকে নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই সর্বস্তরের মানুষের। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত বিস্তৃত ‘সেক্সচুয়াল রেভুলেশন’ বা ‘যৌন বিপ্লব’-এরও অন্যতম পুরোধা মেরিলিন মনরো। ১৯৬২ সালের ৪ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

এই যে তিনি পপ কালচার কিংবা যৌন বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠলেন—তার পেছনে কাজ করেছে তার ইমেজ। আর মানুষের চোখ ও মনে ওই ইমেজ তৈরি করেছে প্রধানত ফটোগ্রাফি। দর্শকের কাছে মনরোকে যৌন আবেদনময়ী হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে যাদের তোলা ছবি ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছে তাদের মধ্যে রিচার্ড অ্যাভেডন, ইভ আর্নোল্ড, মিল্টন গ্রিন, বার্ট স্টার্ন ও সিসিল বিটন অন্যতম। কিন্তু মনরো সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবিটি কিন্তু তুলেছিলেন মার্কিন প্রযোজক ও ফটোসাংবাদিক স্যাম শ।

স্যাম শ’র তোলা মনরোর বিখ্যাত সেই আলোকচিত্র

ছবিটি ‘ফ্লাইং স্কার্ট’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। ছবিতে দেখা যায় মনরোর সাদা স্কার্ট বাতাসে মাতালের মতো উড়ছে, অনিয়ন্ত্রিত সেই স্কার্ট সামলাতে সামলাতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছেন মনরো। ছবিটি স্যাম তুলেছিলেন ১৯৫৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। সেসময় চলচ্চিত্র নির্মাতা বিলি ওয়াইল্ডার মনরোকে নিয়ে তৈরি করছিলেন ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’ সিনেমা। নিউইয়র্কের ল্যাক্সিন্টন এভিনিউতে সিনেমার শুটিং চলছে। এই সিনেমার আলোকচিত্রী ছিলেন স্যাম। সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখা যায় মনরো ও তার সহ-অভিনেতা টম ইয়েল একটি সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসছেন। ঠিক সে সময় বাতাসে মনরোর স্কার্ট উড়তে থাকে। মেঝে থেকে কৃত্রিমভাবে বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্যাম নির্মাতাকে বুদ্ধি দিলেন এই দৃশ্যের—এই স্কার্ট ওড়ার ছবি দিয়ে সিনেমার প্রচার হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। কথাটা বিলি ওয়াইল্ডারের মনে ধরে। তিনি রাজি হন এবং স্থিরচিত্রের জন্য দৃশ্যটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। সেই শুটিং দেখতে আসে শত শত মানুষ। পাবলিসিটির জন্য ডাকা হয় সাংবাদিকদেরও। সেই ছবি মনরোর বন্ধু আলোকচিত্রী স্যাম ছাড়াও ম্যাগনাম ফটোসের আলোকচিত্রী এলিয়েট এরউইটও তুলেছিলেন। কিন্তু স্যামের ছবিটিই বিখ্যাত ও সমাদৃত হয়। কারণ বাতাসে যখন স্কার্ট উড়ছিল তখন মনরো স্যামের ক্যামেরার দিকেই মুখ করে ছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘হাই! স্যাম স্পেইড!’ (‘স্যাম স্পেইড’ ১৯৩০ সালের একটি উপন্যাসের চরিত্র, স্যামকে তিনি এই নামেই ডাকতেন)।
স্যামের নাতি ম্যালিসা স্টিভেন্স জানিয়েছেন, স্যাম এই ছবিটি করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তারই করা চল্লিশের দশকের একটি ফটোশুট থেকে। কোনি আইল্যান্ডে ফটোশুটটি স্যাম করেছিলেন ‘ফ্রাইডে’ ম্যাগাজিনের জন্য। সেখানে এক নাবিক এবং এক তরুণীকে দেখা যায়, বাতাসে তরুণীর স্কার্ট উড়ছিল।

২৬ ফুট উচ্চতার মনরো-ভাস্কর্য

ছবিটিতে মেরিলিন মনরো পুরোপুরি ফুটে উঠেছেন। তার ব্যক্তিত্ব, জীবনকে উপভোগের উচ্ছ্বাস এবং শিশুসুলভ মনের প্রতিচ্ছবি ধরে পড়েছে ফ্রেমটিতে। ছবিটি দেখলেই দর্শকের মন ভালো হয়ে যেতে বাধ্য। আনন্দময় জীবনের প্রতীক যেন এই ছবি। ছবিটি দেখে মনে হয় বাতাসে শুধু স্কার্টই ভাসছে না—ভাসছেন মনরো নিজেও। উড়ন্ত স্কার্টকে মনরোর পাখা বলেও ভ্রম হয়।

স্যাম শয়ের জন্ম ১৯১২ সালে, নিউইয়র্ক সিটিতে। চল্লিশের দশকে পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার আগে তিনি চিত্রশিল্পী ছিলেন। ‘‘কলিয়ার’স’’ ম্যাগাজিনে ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। আলোকচিত্রী হিসেবে পঞ্চাশের দশকে সিনেমা জগতে আসেন। ১৯৫১ সালে তার সঙ্গে মনোর পরিচয় হয়। মনরো তখন মনরো হয়ে ওঠার সংগ্রাম করছেন। মনরোই চলচ্চিত্র নির্মাতা এলিয়া কাজানকে বলে সিনেমা সেটে কাজ পাইয়ে দেন। এভাবেই মনরোর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয় যায় স্যাম শর।

স্যামের এই ছবি নির্ভর করে বিভিন্ন সময় মনরোর চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার পাম স্প্রিংসে ২০১২ সালে তৈরি করা হয় ২৬ ফুট উচ্চতার একটি ভাস্কর্য। দৃশ্যশিল্পী সুয়ার্ড জনসনের করা ভাস্কর্যটির নাম রাখা হয় ‘ফরএভার মেরিলিন’। যদিও এই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে যৌণতার অভিযোগ ওঠে।

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!