Author Picture

মঈনুস সুলতান-এর একগুচ্ছ কবিতা

মঈনুস সুলতান

সম্ভাবনা অপার

মিসরের পূরাতাত্ত্বিক সাইট থেকে স্ক্যান করে পাঠিয়েছো ছবি
একটি অনুরোধ মোসাম্মাৎ রোহিত রামেলা—
হাল ছেড়ো না— হলোই-বা আমার ক্লেশ—
করো না তো অবহেলা,
ক্লিয়ার এসেছে ইমেজ— যা দেখছি মনে হয়— অস্থি অনাদী
নীরবে খুঁড়—
ভূগর্ভে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে রহস্যের চাবিকাঠি— গূঢ়,
খুঁজে পাবে হয়তো — ক্লিওপেট্রার সমাধি।
পেয়েছো যে সব হাতিয়ার— মৃৎপাত্র
আমি নই আর্কিওলজির ছাত্র—
কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পাই সম্ভাবনা অপার,
বিশ্বাস রাখো— প্রকল্পটি করো না তো এখনই পরিহার।

ফের তাকাই তোমার পাঠনো আলোকচিত্রে— প্রেক্ষাপটে চিত্রিত ক্লিফ
সমুদ্রের এপার থেকেও দেখতে পাচ্ছি সাজানোর হরেফের হাইরোগ্লিফিক,
পেইন্ট ব্রাশ দিয়ে সাবধানে সরাও বালুকা—
পেয়ে গেছে মনে হয় ডেথ মাস্ক— মৃত্যুর অন্তিম মুখোশ,
হাতে ধরে আছো যে পাঁজরের হাঁড় তার নিচে হাজার বছর আগে
হৃৎকম্পনে মর্মরিত হতো রোমান্টিক কোন ফারাও এর ফুসফুস।

খুঁজে পেয়েছো বেশ কয়েকটি মুদ্রা —ধাতব গোলকে গ্রীক রানির মুখ,
শুভলক্ষণ রামেলা— পা বাড়াও… খননযন্ত্র হাতে তুলে নাও
তুমি তো কখনো ছিলে না ডরপোক।

দেয়ালে—দেবতা আইসিসের আকৃতি—শিরোভূষণে অস্ট্রিচের পালক
সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ছিলো এক জামানায়— গোরতষ্করের সুসংগঠিত দল,
এসেছে তারপর— দফায় দফায় — পাশ্চাত্যের অশ্বযূথ প্রবল
মহর্ঘ কিছু সংরক্ষিত জাদুঘরে— পাহারা দিচ্ছে নীলনদের বৃদ্ধ বক।

খুঁজে পেয়েছো যা আজ
রোমহর্ষক এ প্রাপ্তি— মিসরতত্ত্বে বলা হয় কার্থনাজ,
হয়তো বিপন্ন হবে তোমার তাঁবু মরুভূমির বালুকাদীর্ণ তুফানে
ভেবে দেখো একবার— সামনে সম্ভাবনা অপার,
দৃঢ় পদক্ষেপে উঠে যাও প্রাপ্তির মরীচিকায় সমৃদ্ধ সোপানে।

 

কুর্দি বাগিচায় বুলবুল

কোন কোন নিশিরাতে আধোঘুমে ফিরে আসে স্বপ্ন
দেখি— বিশাল এক মানচিত্রে আঁকা হচ্ছে কুর্দিস্থান,
কয়েকটি মানুষ— পুটলি-পোটলা শিশু ও পুতুল
ঝিরি ঝিরি তুষারপাতে জবুথবু— অগ্নিকুন্ড ঘিরে খোঁজে পরিত্রাণ।

তুর্কি বলয়ের প্রান্তিকে— দূরে আরারাত পাহাড়ের চূড়া
কাছেই বুলগেরিয়ার সীমান্ত,
দেশ ছেড়ে ঘুরছে বিদেশে—
কখনো ঘোড়ার পিটে..রেলগাড়ি কিংবা ফুটো হওয়া ট্রলারে
অনেক ভেবেও খুঁজে পাই না তাঁদের সুনির্দ্দিষ্ট ঠিকানার আদিঅন্ত।

গেরিলার আধভেজা জলপাই পোষাকে এক তরুণী
গুনগুনিয়ে সুর ভাজে— কোথায় কুর্দিস্থান?
পাথরে রেখে মারণাস্ত্র… কমলালেবুর মতো জোড়া গ্রেনেড
একটু আগে সেরেছে সে পাহাড়ি প্রপাতে স্নান;

সঙ্গী আমার প্রিয় হে— বলে স্কন্ধে তুলে নেয় সে বন্দুক
স্বদেশ পেলো যে সবাই— তাজিক, কাজাক ও সেলজুক,
পদশব্দের ছন্দ তালে মৃদু স্বরে ফের গান গায়
স্বদেশের শোণিতে নিয়ত ফোটাই আমি হৃদয়ের ফুল,
কাটে আমার এ বিরাণ জিন্দেগী পাহাড়ের পরিখায়—
কুর্দি বাগিচায় কেন তবে আসে না বুলবুল?

 

এমিলি ডিকেন্সের স্মৃতিঋদ্ধ শহরে

দশক দুই পরে— এমিলি ডিকেন্সের স্মৃতিঋদ্ধ শহরে
ফিরে আসাটা মন্দ কিছু নয়,
উড়োজাহাজ থেকে নামতে নামতে ভাবি—
ঝেড়েমুছে রকমারি রাজ্যের মরুমৃত্তিকা ও তুষার চূর্ণ
অতিক্রম করা যাক আজ— নস্টালজিয়া নিসিক্ত ভয়।

কিছু চেনা তরুবর আর্বান রোষে যদিও হয়েছে উন্মূল,
ম্যাগনোলিয়া ঝাড়টি গোলাপে মিশিয়ে রূপার আভা
ঝরাচ্ছে থোকা থোকা ফুল,
গুলফারোশের দফতরে কিছু অজানা পুষ্প
উজ্জ্বল হয়ে আছে শোণিত-তপ্ত ফাগে,
বয়োবৃদ্ধ ঔক বৃক্ষটিও অনুভব করছে উষ্ণতা
জড়ানো ফার্নের সবুজিম অনুরাগে।

যেখানে বসে ল্যাপটপে মুসাবিদা করেছিলাম
সুফি চিত্রকলা বিষয়ক প্রবন্ধ—
সে ব্ল্যাকশীপ ক্যাফেটি হয়েছে অর্থশাস্ত্রের ফরমানে বন্ধ,

হানাবাড়ির ছমছমে স্তব্ধতায় ঘনীভূত হয়েছে অতীত অতিক্রান্ত আবেশ
বুড়ো হয়েছে বোধ করি— বাদুড়ঝোলা অ্যাটিকে বাস করা কবন্ধ—
অতিন্দ্রীয় রহস্যের ভূর্জপত্র ঘেঁটে ফিরে পাই অনুপ্রেরণা অশেষ,
এসে দাঁড়াই রঙ্গমঞ্চের আঙিনায়—
ব্যালেরিনার একহারা অঙ্গে ছড়ায় কর্পূর দগ্ধ ছন্দ।

হেলে পড়লে সুরুজ— এসে বসি সাইগন রেস্তোরাঁয় নিরিবিলি
ম্যানু হাতে বলি — চাই তপ্ত সুরুয়া— তমইয়াম,
দুয়ার ঠেলে কাউন্টারে এসে দাঁড়ান এক যুগের চেনা ইয়োগা গুরু—
মশলার ছিদ্রময় বোতল থেকে সুগন্ধ ছড়ায় রেড রিভার ডেল্টার চিলি,
বদলায়নি তাঁর তেমন কিছু— শুধু চশমার কাঁচজোড়া হয়েছে ঈষৎ পুরু
বাহুতে উল্কির ঝিলিক পড়া হরফে লেখা ‘নিত্য কর প্রাণায়াম’।

 

পানশীর সড়কের সরাইখানা

সড়কের বাঁকে— পাথুরে টিলায় পুরানো দিনের সরাইখানি
পড়ো পড়ো হয়ে ঝুঁকে আছে— যেন রুকু সেজদায়,
বারান্দায় কিচেনের বাবুর্চি— জায়নামাজে তসবি হাতে ধ্যানি,
বিষ্ফোরণে আধপোড়া রুশি ট্যাংক এক পড়ে আছে পরিখায়।

রাত কাটাতে ঢুকি— শুনি— দিনকয়েক আগে ভিন্ন এক মুসাফির
ঠিক এ কামরার চারপাইয়ে টেনেছেন তাঁর জীবনের যবনিকা,
চেরাগদানের তলায় পুঞ্জিভূত হয়ে আছে রহস্যময় তিমির
ভাবি—অচেনা পর্যটক কী আধপোড়া মোমে জ্বেলেছিলেন শিখা?

সদ্য জন্মদেয়া শিশুটিকে কোলে নিয়ে কাঁদেন এক নারী সহযাত্রী
নিশি কাটানো যাত্রীদের মাইফেলে শোনা যায় নবজাতকের পয়গাম,
মঠো মুঠো বাদাম কিশমিশ বিলিয়ে দিয়ে মৃদু হাসেন বয়োবৃদ্ধা ধাত্রী,
আঙিনায় রাশি রাশি গালিচা মেলে ধরে নকশা খুঁটিয়ে চলে দরদাম।

আধপোড়া ট্যাংকের নল ধরে ঝুলে কিজিলবাস গোত্রের বাচ্চা
সামানে শুখা নদীর শুভ্র বালুকায় কাঁটঝোপ—নেই এক বিন্দু জল,
ভিখ মাগে কোমরে গুলি লাগা বৃদ্ধ— ফুকারে— দিল আমার সাচ্চা,
সাঁজগোধূলির রঙিলা চামরে নুড়িপাথরগুলো হয়ে আছে উজ্জ্বল।

দাঁড়িয়ে থাকি— দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে নিশ্চুপ… জানালা খুলে
উপত্যকার পাহাড় থেকে পাহাড়ে ছড়ানো পরাক্রান্ত পানশির,
চেনার গাছের পরিজাত পত্রালী বাউলা বাতাসে ওঠে ব্যাপক দুলে,
ফুরোলে ঝরা পত্রের মৌসুম— শুখা নদীতে বাহিত হবে কী নীর?

আরো পড়তে পারেন

বেওয়ারিশ প্রেমের কবিতা

১. জীবনকে বিজ্ঞাপনের মতো সেঁটে দিয়ে দেখেছি, আমাকে গ্রহণ করেনা কেউ। আমাকে ভালোবাসে না ঘুমগন্ধওয়ালা সকাল— আমাকে ভালোবাসে না বাজারের জনবহুল রোদ, আমাকে ভালোবাসে না কেউ, ভিক্ষুক, শ্রমিক, চাষী আমাকে ভালোবাসে না, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভালোবাসে না, শোষক কিংবা শোষিত, শাসক ও প্রজা কেউই ভালোবাসে না, আমাকে ভালোবাসে না তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ বা যুবা, পার্থিব কোনো….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সহজাত মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে যে কোন দিন যে কোন সন্ধ্যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ঘোরতর বর্ষার দূপুরে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে। পথের পাশে ওত পেতে থাকা শিকারির মত সন্তর্পনে উঠে আসা মানুষ পায়ে পা ঘষে তোমাকে অবহেলা করবে। কোথাও না কোথাও কোন এক বয়সে কোনও না কোনও ভাবে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে।….

হোসনে আরা শাপলা’র একগুচ্ছ কবিতা

আলতু ব্যথা কোন এক শুভ্র সময় আমাদেরও ছিল পাশাপাশি-মুখোমুখি বসে থাকা শুধু হিসেব-নিকেশ, দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া এসবের বালাই ছিলো না কোন শুধু কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো ভালোবাসা। চোখের তারায় ডুবে গিয়ে অন্বেষণ শুধু শত জনমের সুখ। ওইসব স্বপ্নমাখা দিন কোন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল কোথায় তারই জন্য মনের মধ্যে কেমন আলতু ব্যথা।   তৃপ্তি ভরসার হাত….

error: Content is protected !!