Author Picture

ভোলাগঞ্জ: বাংলাদেশের কাশ্মির

মাহবুবা হোসেইন

অনেকগুলো সুন্দরের মধ্য একটাকে বেছে নেয়া যে কি কঠিন কনে দেখা সম্ভাব্য পাত্রই কেবল তা জানে, আমাদেরও তখন সেই অবস্থায়। আমাদের হাতে মাত্র এক দিন, একগাদা সৌন্দর্যের মধ্যে বাছতে হবে মাত্র দুটো। কোনটা? বিছানাকান্দি, মাধবকুন্ড, ভোলাগঞ্জ না রাতারগুল? বিছানাকান্দি আর মাধবকুন্ড প্রচুর জনপ্রিয়, অলরেডি ব্যান্ড, এর-ওর-তার প্রায় সবারই দেখা, আনকোরার মধ্যে কেবল দুটো- ভেলাগঞ্জ আর রাতারগুল, তাদের সৌন্দর্যও অতুলনীয় কিন্তু যোগাযেগের অবস্থা খারাপ তাই অতি উৎসাহী ছাড়া তেমন কেউ যেতে পারেনা বলে ততটা জনপ্রিয় নয় কিন্তু সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ হাইওয়ে হয়ে যাওয়ায় এখন আর সেকথা খাটে না, সুন্দর প্রশস্ত রাস্তায় সিলেট থেকে দেড় ঘন্টায় তেত্রিশ কিলোমিটার অনায়াশে পৌঁছে যাওয়া যায় সাদা পাথরের দেশ ভোলাগঞ্জে।

অনিন্দ্য সুন্দরীর কেন এমন নাম? তার সৌন্দর্যের সাথে নামটা ঠিক যায় না, আগের নামটাই বরং সার্থক, ‘পা-ধোয়া’ মেঘালয়ের খাসিয়া-জৈন্তাপুর-চেরাপুঞ্জির অজস্র বারি-বর্ষন মহান হিমালয়ের পা-ধোয়ে স্বচ্ছ-শীতল জল পিয়াইন-দোলাই নামে আপনার পায়ের কাছে এসে যখন ‘ধোলাই’ নামে নামবে আপনি ‘পা না ধোয়ে’ পারবেনই না। প্রাচীন বাঙালির সৌন্দর্যজ্ঞান এবং নাম দেয়ার ক্ষমতা অসাধারন অন্ততঃ বৃটিশদের চেয়ে অনেক বেশী। হবে না কেন? বৃটিশ কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে যখন অনেক কষ্টে নিস্তব্ধ নির্জন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা দীগন্ত বিস্তৃত সাদা পাথর, স্বচ্ছ নীল সবুজ পানির অপূর্ব সুন্দর দুর্গম এই স্থানটি আবিস্কার করলেন তখন তিনি এর অকৃত্রিম সৌন্দর্যে অভিভুত হয়েছিলেন নিশ্চয় কিন্তু সেই সাথে আদিগন্ত পাথর কোয়েরি দেখে প্রথমেই ঠিক তার মাথায় এসেছিল ব্যবসায়ীক চিন্তা। প্রচুর অর্থ খরচ করে শুরু করে দিলেন পাথর, চুন, হাতির চামড়া বিক্রির ব্যবসা, সেই উদ্দ্যেশে ছাতকে বসালেন পাথর ক্রাশিং প্ল্যান্ট, হাতিয়ে নিলেন কোটিকোটি তংকা, নিজ দেশে কিনলেন ফার্ম সেই সাথে কিনে নিলেন বৃটিশ লর্ডশীপ। পাথর সরানোর জন্য পরবর্তী সময়ে তিন কোটি টাকা খরচ করে বানানো হল বাংলাদেশের প্রথম রোপওয়ে, জায়গাটার নামটাও পরিবর্তিত হয়ে হয়ে গেল ভোলাগঞ্জ। যদিও রোপওয়ে এখন পরিত্যাক্ত, খুঁটিগুলো ছাড়া অবশিষ্ট নাই কিছুই তবুও তা এখনও দর্শনীয়, নামে কিইবা এসে যায়।

পাহাড় থেকে নেমে আসা ধোলাই

সিলেট থেকে বেরুতেই মালিনিছড়া চা বাগান। দেশের বৃহত্তম চা বাগান। নামটা কি সুন্দর না? মালিনিছড়া মালিনিছড়া, সারা পথ আমার মন গাইতে লাগল মালিনিছড়া মালিনিছড়া। ভোলাগঞ্জ বাজার ছাড়াতেই বাঁকা রাস্তার প্রান্ত শেষে ভেসে উঠল পাহাড় শ্রেনীর ধুসর ছায়া, আঁকাবাঁকা ল্যান্ডস্কেপ সমতল বাঙালির কাছে আনন্দ-বিস্ময়, আনন্দে আমার হৃতপিন্ড প্রায় লাফাতে লাগল। সিলেট থেকে মাত্র তেত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে স্বর্গীয় এক ল্যান্ডস্কেপ, নদী পাথর পাহাড় আর মেঘের এক দেশে, নাম তার ভোলাগঞ্জ- টুকের বাজার, কে ভাবতে পারে মাত্র দেড় ঘন্টায় চলে আসা যায় যেখানে অপেক্ষায় থাকে অজস্র দৃষ্টিনন্দন সুসজ্জিত ট্রলার, লাল, নীল সবুজ- যেনবা বিশ্ব সুন্দরীদের কিউই- বেছে নেয়া যায় যে কোনটা, মাত্র আটশ টাকায় আট জনকে তিরিশ মিনিটে দুই ঘন্টার জন্য নিয়ে যাবে মেঘালয়ের পায়ের কাছে, বিস্তর বিস্তৃত সাদা পাথর আর স্বচ্ছ নীল শীতল পানির দেশে। যাবার পথটা কি বলব, দূরে মেঘ আর পাহাড়ের হাতছানী, নীচে পাথর আর হাত দুয়েক স্বচ্ছ নীল পানি, তার নীচে কুচি পাথর-সাদা নীল, হলুদ, সবুজ, সাদারই আধিক্য। মাছেরা খেলা করে আপন মনে, মনে হবে হাত বাড়ালেই ধরা যাবে কিন্তু উহু তড়িৎ সরে পালাবে কিন্তু ততক্ষণে চোখ আপনার আপনি বুজে আসবে আরামে। আহ পানি এত ঠান্ডা? বার বার হাত দিতে ইচ্ছা করবে, কিন্তু পথটা বড় সংক্ষিপ্ত- বড়জোর তিরিশ মিনিট, আশ মেটে না, তবে অপূর্ণ বলেই অবিস্মরনীয়?

দূরে মেঘ আর পাহাড়ের হাতছানী, নীচে পাথর, হাত দুয়েক স্বচ্ছ নীল পানি, তার নীচে কুচি পাথর-সাদা নীল, হলুদ, সবুজ

জিরো পয়েন্টে নেমেই অবাক হয়ে যেতে হয়, ওমা এযে পাথরের সমুদ্র, দূরে স্বচ্ছ নীল পানি, মনে হবে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পরি কিন্তু না অত সহজ নয়, পাড়ি দিতে হবে পাথরের সমুদ্র, সে এক ভীষন ভীষন কঠিন কাজ কিন্তু পানির কাছে পৌঁছে গেলে নিজেকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন, নেমে পরতেই হবে পানিতে, তবে সাবধান পাথরগুলো বড় পিচ্ছিল। ছেলেরা নেমে নিজেকে ভাসিয়ে দেয় পানিতে, মেয়েরা বড় বড় পাথরে বসে ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকে। কিছু দূর বাঁ পাশে ভারত সীমান্ত তা পাড়ি দেয়া নিষেধ তবে নোটিশ বোর্ডের সামনে ছবিটবি তুলে ভারত ভ্রমনের আশ মিটিয়ে নেয়া যায়।

পাথরের সমুদ্র পাড়ি দেয়ার আগেই মুগ্ধতা আপনাকে গ্রাস করে নিবে। ওপারে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘের ভেলা, নীচে সবুজাভ নীল পানি, স্বচ্ছ আকাশে পেঁজাপেঁজা মেঘ। অপূর্ব। মেঘালয়ের অসংখ্য ছড়া, পিয়াইন আর দোলাই নদীর মিলিত ধারা ভোলাগঞ্জের ধলাই নদী ওপাশের অসংখ্য উঁচু নীচু পাহাড়, শতশত পাহাড়ী ছড়া আর বর্ষায় পাহাড় থেকে নেমে আসা দিগন্ত বিস্তৃত পাথর কোয়ারি, আকাশের ছেড়া ছেড়া মেঘের মিলিত নির্যাস- এর সৌন্দর্য কি বর্ননা করা যায়? শীতে তবুও কিছুটা বর্ননারযোগ্য- তখন সৌন্দর্যের সমাহার মিলিত না হয়ে আলাদা আলাদা থেকে নিজস্ব বৈশিষ্ট কিছুটা বজায় রাখে কিন্তু বর্ষার মিলিত সৌন্দর্য-বর্নাতীত।
মেঘালয়ান মেঘের অনবরত বর্ষন, বালুকাময় দোলাইয়ের ডেউভাঙ্গা পাড় আর সাদা পাথরের সমুদ্র ভ্রমণ পিপাসুকে বিমোহিত করবেই। বর্ষাই ভোলাগঞ্জ ভ্রমণের সঠিক সময়।

ভোলাগঞ্জকে বলা হয় বাংলাদেশের কাশ্মির, হাসবেন না সত্যি কিন্তু তাই, আমাদের ছোট্ট দেশ, শিশিরেই আমাদের সমুদ্র দর্শন, নান্দনিকতা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ আকারে কিবা এসে যায়, একবার গিয়েই দেখুন না।

আরো পড়তে পারেন

আগ্নেয়গিরি থেকে পায়ে হেঁটে বেস-ক্যাম্পে ফেরা

ইথিওপিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে ‘অ্যারতে-আলে’ নামে লাভা উৎক্ষেপণে প্রজ্বলিত একটি আগ্নেয়গিরি। আমরা বেশ কয়েকজন পর্যটক আজ জোট বেঁধে, একটি ট্যুর কোম্পানির গাইডের তত্ত্বাবধানে ওই আগ্নেয়গিরির পাশের একটি লাভা-হ্রদের পাড়ে ক্যাম্পিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। ওখানে যেতে হলে প্রথমে একটি বেস-ক্যাম্পে এসে প্রস্তুতি নিয়ে ট্র্যাক করতে হয় ঘণ্টাকয়েক। বেস-ক্যাম্পে পৌঁছানোও ঝকমারি বিশেষ, আমরা ঘণ্টাকয়েক ল্যান্ডরাবারে প্রায়-দুর্গম এক….

মনে করি আসাম যাব

আফ্রিকার মাসাইমারা সাফারিতে যাওয়ার পর আর কোনো বড় সাফারিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অপর্না সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সিনেমাতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার চরিত্রে রাহুল বোসের মুখে কাজিরাঙার কথা শোনার পর এ রিজার্ভ ফরেস্টে সাফারি করার ইচ্ছা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির খুব কাছের এ জায়গাটাতে যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়, আমাদের উত্তর পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আর….

শিল্পের দেশে সৌন্দর্যের দেশে

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভেনিসে পা রেখেছিলাম এক রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দুপুরে। যাত্রীবোঝাই পাবলিক বাসে চেপে যাত্রা করলাম সেন্ট মার্কোসের উদ্দেশে। সেন্ট মার্কোসে অবস্থিত বিখ্যাত স্থাপত্য ক্যাথেড্রাল। ক্যাথেড্রালের চারদিকের দেয়াল সুসজ্জিত কারুকার্যে খচিত। চিত্রকর্ম ও অক্ষরে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন কাহিনি মুগ্ধতা তৈরি করে। এখানেই ভেনিসের প্রাণভোমরা, সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানেল যা যুক্ত করেছে শতাধিক জলরাশিকে। বিশাল খাল ভেনিসকে….

error: Content is protected !!