
আগের পর্বে পড়ুন— ভাষা আন্দোলনের পর্যায় বিশ্লেষণ
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয় সাতচল্লিশে উপমহাদেশের তদানীন্তন রাজনৈতিক পটভূমিতে নানা প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে। প্রতিষ্ঠার পনের দিনের মধ্যেই (২৬/২৭ আগস্ট) সিদ্দিক বাজারস্থ লিলি কটেজে প্রথম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন গবেষক ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জিন্নাহ্’র রবক্তব্যের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ থেকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত দেখিয়েছেন। কার্যত আন্দোলনের সূচনা ৪৭-এর অক্টোবরে নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে যেসব পোস্টকার্ড, এনভেলাপ, মানি অর্ডার ফর্ম, রেল টিকেট, টাকা ইত্যাদি ছাপানো হয়েছিলো, তা কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই শুধু উর্দু ও ইংরেজিতে ছাপা হয়। পাকিস্তানি শাসকদের এই অর্বাচীন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় সচিবালয়ের বাঙালি কর্মচারীরা জীবিকার শঙ্কায় বাংলা ভাষার তত্ত্বগত দাবির বাস্তব রূপায়নে আন্দোলনে নামেন। শুধু সচিবালয়ের কর্মচারীরাই নন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত অধিবাসীদের একটি বিশাল অংশ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করেন। ১২ নভেম্বর ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সভায় কাজী মোতাহার হোসেন, কবি জসিমউদ্দিন, আবুল কাশেম প্রমুখ বাংলার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন । ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়ের সিলেবাসে বাংলা না থাকার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি এবং ঢাকা সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ফরিদ আহমদ ৮ জানুয়ারি ১৯৪৮ চাকরি হতে ইস্তাফা দেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানের নৌ-বাহিনীর নিয়োগেও উর্দু ও ইংরেজিতে পরীক্ষা নেওয়ার সীদ্ধান্ত হয়। ২৭ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের প্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে সভাস্থলের বাইরে ছাত্র-জনতা বাংলাকে অবিলম্বে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। উক্ত সম্মেলনের প্রতিক্রিয়ায় ৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভা শেষে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, উর্দুর জুলুম চলবে না ইত্যাদি স্লোগানে মিছিল বের হয়। ৭ ডিসেম্বর মাওলানা আকরাম খাঁর সভাপতিত্বে এস এম হলে বাংলা ভাষার ওপর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। একই দিন দুপুরে রেলওয়ে শ্রমিকদের সভায় এ কে ফজলুল হকের সভাপতিত্ব করার প্রশ্নে বাঙালি অবাঙালি কর্মচারীদের মাঝে বিরোধ দেখা দেয়। বিরোধের সুযোগে স্থানীয় লোকদের মাঝে এই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, সিরাজ-উদ-দৌলা পার্কের এই সভাটি হিন্দুদের সহযোগিতায় ফজলুল হকের পাকিস্তান বিরোধী একটি ষড়যন্ত্র। তাছাড়া বাংলার মতো একটি হিন্দু ভাষাকে উর্দুর পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তও ঐ সভার উদ্দেশ্য। ফলে মুসলিম লীগের অনুসারি স্থানীয় কট্টর অধিবাসীরা সভায় হামলা করে। ধারণা করা হয় উক্ত ঘটনার পিছনে খাজাদের ইন্ধন ছিল। ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে একটি প্রেস সাক্ষাৎকারে সরকারের ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ডক্টর কুদরত-ই-খুদা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার তৎপরতার বিরোধিতা করেন। সিরাজ-উদ-দৌলা পার্কের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১২ ডিসেম্বর একদল লোক বাস ও ট্রাকে চড়ে উর্দুর পক্ষে ধ্বনি দিতে দিতে পলাশী ব্যারাক, পাশ্ববর্তী মেডিকেল কলেজ এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সাধারণ জনতা সচিবালয় অভিমুখে মিছিল করে যান এবং বাধা ভেঙে সচিবালয়ে প্রবেশ করে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ, কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ আফজাল ও তদানীন্তন চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের নিকট থেকে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার সমর্থন দানের লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। অবশ্য আজিজ আহমদ প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি বাংলার বিপক্ষে তার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তৎপর থাকেন। বাংলা ভাষার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা পূর্ণ হরতাল পালন করেন এবং ঐ দিন থেকে ১৫ দিনের জন্য ঢাকায় ১৪৪ ধারা বলবৎ করা হয়। অবশ্য ১৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাবৃন্দ উক্ত আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন। ১৭ ডিসেম্বর করাচীতে পাকিস্তান সংবিধান নিয়মকানুন নির্ধারণ কমিটির সভায় সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজিকে সমমর্যাদা দানের সুপারিশ করা হয়।
পাকিস্তানি শাসকদের এই অর্বাচীন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় সচিবালয়ের বাঙালি কর্মচারীরা জীবিকার শঙ্কায় বাংলা ভাষার তত্ত্বগত দাবির বাস্তব রূপায়নে আন্দোলনে নামেন। শুধু সচিবালয়ের কর্মচারীরাই নন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত অধিবাসীদের একটি বিশাল অংশ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করেন
১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর থেকেই বাংলা ভাষার সমর্থক আন্দোলকারীদের ওপর হামলা নির্যাতন অব্যাহত থাকে। বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল হক ভূইয়াকে আহ্বায়ক করে ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কমিটিতে ডান-বাম ও মধ্যপন্থীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও মজলিশের প্রভাবই ছিল মূখ্য। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলন বিরোধীরা রশীদ বিল্ডিংস্থ তমদ্দুন মজলিসের অফিস আক্রমণ করে ভাঙচুর চালায়। ২ ফেব্রুয়ারি ’৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অবাঙালি উপাচার্য ডক্টর মাহমুদ হাসান সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতায় বাংলা ভাষাকে সমর্থন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হয়। উক্ত অধিবেশনের পূর্বেই আবুল কাশেম, তমদ্দুন মজলিশের রাষ্ট্রভাষা সাবকমিটি ও মুসলিম ছাত্র লীগের একটি প্রতিনিধি দল পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক কমিটির সদস্য নূরুল আমীন, হাবীবুল্লাহ বাহার, গিয়াসুদ্দীন পাঠান প্রমুখের সাথে সাক্ষাৎ করে সরকারি দলিলে বাংলা না থাকা বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা এর প্রতিকারের আশ্বাস দেন। এই অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি ছিল খুবই সাধারণ, কিন্তু রাজনৈতিক বিচারে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেসের অপরাপর সদস্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। অধিবেশনে মুসলিম লীগের সকল সদস্য তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে একযোগে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের প্রতিক্রিয়া ও বক্তব্য ছিল রীতিমতো আপত্তিকর এবং সংসদীয় রাজনীতির রীতিনীতি বিরোধী। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন সবৈব মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে উর্দুর পক্ষে অবস্থান নেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ছাত্র-ধর্মঘট পালিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সভায় শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে দ্বিতীয় বার ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে সর্বদলীয় সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ঐ সভায় ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয় এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। ধর্মঘট সফল করার জন্য ৪ ও ৫ মার্চ ফজলুল হক হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অপরপক্ষে ধর্মঘট বানচাল করার জন্য দলিউর রহমান, মুখলেসুর রহমান ও ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ নানামুখী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ৭ মার্চ উক্ত কলেজ প্রাঙ্গনে সভা করেন। ৮ মার্চ সিলেটের গোবিন্দ পার্কে তমদ্দুন মজলিশ ও সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত সভা উর্দুর সমর্থক দুষ্কৃতিকারীরা পণ্ড করে দেয়। এর প্রতিবাদে সিলেট জেলা মুসলিম মহিলা লীগ ১০ মার্চ প্রতিবাদ সভা আহ্বান করেলে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দুই মাসের জন্য উর্দু-বাংলার পক্ষে সভা ও শোভাযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ১১ মার্চের ধর্মঘটকে সফল করার জন্য ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে প্রস্তুতি সভা করা হয়। ১১ মার্চ খুব ভোর থেকে আন্দোলনকারী ছাত্র, সেক্রেটারিয়েট ও রেলকর্মচারীদের একাংশ পিকেটিং শুরু করে। ফলে সেদিন আংশিক রেল ধর্মঘটও পালিত হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের প্রতিবাদে আইনজীবীরা আদালত বর্জন করেন। এদিন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমূখকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এই দিন বাংলা ভাষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিষদের অভ্যন্তরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে। স্পিকার নির্বাচনের পর কংগ্রেস দলীয় সাংসদ ড. প্রতাপচন্দ্র গুহ ভাষার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের নিন্দা করে একটি মূলতবি প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য স্পীকারের অনুমতি প্রার্থনা করলে নাজিমউদ্দিন এর বিরোধিতা করেন
সরকারি জুলুম ও অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ১২ মার্চ সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন। ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় এবং ১৪ মার্চেও তা অব্যাহত থাকে। এ দিন বর্ধমান হাউসে মসুলিম লীগ সংসদীয় দলের সভায় ধর্মঘটের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। যেহেতু ১৫ মার্চ পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশনের দিন ধার্য ছিল তাই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৫ তারিখেও ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯ মার্চ কায়েদে আজম মোহাম্ম আলী জিন্নাহর ঢাকায় আগমণের প্রেক্ষিতে খাজা নাজিমউদ্দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৪ মার্চ রাতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বিষয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে পত্রসহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। অধিকাংশ নেতা জেলে উল্লেখপূর্বক জনাব কমরুদ্দীন আহমদ আলোচনায় অনাগ্রহ দেখান। ১৫ মার্চ দিনটি ছিল ঘটনাবহুল ও বিক্ষোভপূর্ণ। পূর্বদিনের অনাগ্রহের প্রেক্ষিতে এ দিন সকাল আটটার দিকে নাজিমউদ্দিনের পক্ষ হতে জনাব মোহাম্মদ আলী ও জনাব খাজা নসরুল্লাহ পুনরায় কমরুদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করে জানান যে, খাজা নাজিমউদ্দিন কর্মপরিষদের সাথে আলোচনা করতে ও তাদের শর্ত মানতে সম্মত আছেন। এর প্রেক্ষিতে সকাল আটটায় ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের কর্মীদের অনুষ্ঠিত সভায় আলোচনার জন্য বর্ধমান হাউসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘ তর্ক বিতর্ক সত্ত্বেও সংগ্রাম পরিষদ তাদের দাবিতে অনঢ় অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত নাজিমুিদ্দন সকল দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। বিষয়টি অবগত করতে জনাব আবুল কাশেম ও কমরুদ্দীন আহমদ জেলখানায় যান এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, গোলাম মাহবুব প্রমুখের সাথে আলোচনা করেন। সবাই সম্মত হলে বেলা তিনটায় বর্ধমান হাউসে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেদিন জনাব আবুল কাশেম নাজিমউদ্দিনের সাথে চুক্তি সম্পাদনের কথা ঘোষণা করলে বিক্ষুব্ধ জনতার অব্যাহত চাপে সংগ্রাম কমিটি ১৬ মার্চ পুনরায় ধর্মঘট আহ্বানে বাধ্য হন।
এই দিন বাংলা ভাষার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিষদের অভ্যন্তরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে। স্পিকার নির্বাচনের পর কংগ্রেস দলীয় সাংসদ ড. প্রতাপচন্দ্র গুহ ভাষার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের নিন্দা করে একটি মূলতবি প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য স্পীকারের অনুমতি প্রার্থনা করলে নাজিমউদ্দিন এর বিরোধিতা করেন। ১৬ মার্চ সকাল নয়টায় ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের সভায় পূর্বদিনের সম্পাদিত চুক্তির কিছু সংশোধন করে অলি আহাদের মাধ্যমে সেটি প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনের নিকট প্রেরণ করা হয়। এই দিন সকাল দশটায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় একটি প্রতিবাদ সভা শেষে বাংলা ভাষার সমর্থনে ও সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান ও মিছিল সহযোগে পরিষদ ভবন ঘেরাও করে। পুলিশের বেপরোয়া লাঠি চার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ও ফাঁকা গুলি ছোড়ার ফলে শওকত আলীসহ ১৯ জন আহত হয়। এর প্রতিবাদে ১৭ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় এবং বেলা সাড়ে বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ১৮ মার্চ সকাল ৯ টায় ফজলুল হক হলের হাউস টিউটর মাজহারুল হকের কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় সভায় ভাষা আন্দোলনের সম্পর্কে কমিটির বক্তব্যের আলোকে একটি খসড়া বিবৃতি প্রস্তুত এবং জিন্নাহকে সংবর্ধনা দানের জন্য একটি ছাত্র কমিটি গঠন করা হয়। ১১ মার্চের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ঢাকা শহর এবং এর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের অবাঙালি মোহাজেররা সংগঠিত হতে থকে এবং ১৮ মার্চ তারা ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সন্ধ্যায় রেলওয়ে স্টেশনে নিরীহ লোকজনের ওপর হামলা চালায়।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন ‘একথা আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়।’ জিন্নাহর এই ঘোষণায় সভার কোথাও কোথাও নো নো ধ্বনি উচ্চারিত হয়
পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ১৯ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে দেওয়া সংবর্ধনায় প্রায় ঘন্টাকালব্যাপী বক্তবে তিনি আন্দোলনকারীদের কঠোর সমালোচনা করে বিদেশি চর ও কমিউনিস্ট বলে অভিহিত করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন ‘একথা আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়।’ জিন্নাহর এই ঘোষণায় সভার কোথাও কোথাও নো নো ধ্বনি উচ্চারিত হয়। তাঁর বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে ২২ মার্চ জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণের প্রস্তাব পাশ করেন। ২৩ মার্চ বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক জিন্নাহর বক্তব্যের সমালোচনা করে এক বিবৃতি প্রদান করেন যা ২৫ মার্চ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়। ২৪ মার্চ কার্জন হলে আয়োজিত সমাবর্তনেও জিন্নাহ্ রেসকোর্স ময়দানের বক্তব্যের পুনরাবিত্তি করেন। এই ঘোষণার সাথে সাথেই উপস্থিত ছাত্রদের একাংশ নো নো বলে চিৎকার করেন। প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে জিন্নাহ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে পুনরায় তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। এই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের বাসভবনে জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচানার শুরুতেই নাজিমউদ্দিনের সাথে সম্পাদিত চুক্তি একতরফা, অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য অভিহিত করে তা মানতে অস্বীকার করেন। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তিনি ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে উর্দুর পক্ষে অটল থাকেন। প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডার মাঝে এই সভা সন্ধ্যা সোয়া সাতটা পর্যন্ত চলে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁর নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুসলিম ছাত্র সভা’ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে জিন্নাহকে সমর্থন করেন। এই সভায় শাসুল হুদা, মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
৯ দিনের সফর শেষে জিন্নাহ ২৮ মার্চ করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। এই দিন সন্ধ্যায় পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র থেকে তাঁর একটি দীর্ঘ বক্তৃতা প্রচারিত হয়। সেখানে তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তার পূর্বের অবস্থানের পুনউল্লেখ করেন। ৩১ মার্চ পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেন্দ্রের নিকট সুপারিশের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। যদিও সংগ্রাম পরিষদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির তৃতীয় দফায় উক্ত সুপারিশ করার জন্য নাজিমউদ্দিন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। মূলত জিন্নাহর ঢাকা সফরে ভাষা বিষয়ক তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই নাজিমউদ্দিন গংদের উল্লিখিত সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে। ৬ এপ্রিল ১৯৪৮ পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বাংলা ভাষা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেশ করেন। যদিও এই প্রস্তাবের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা। তথাপিও প্রস্তাবটি পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক গণপরিষদে গৃহীত হয়।
জিন্নাহ্’র ঢাকা সফরে নাজিমউদ্দিনের সকল উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ভাষা আন্দোলনের সাফল্যকে নস্যাৎ করে দেয়। যদিও ভাষা বিষয়ে অপরিণামদর্শী অবস্থানের কারণে তাঁর জনপ্রিয়তায় চিড় ধরে, তথাপিও তাঁকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তিতে আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র যত প্রকাশ পেতে থাকে মজলিশের প্রভাব তত হ্রাস পেতে থাকে। এ পর্যায়ে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ এবং সাধারণ ছাত্র সমাজেই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
পরের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর প্রস্তুতি পর্ব (১৯৪৯-১৯৫১)