জীবনানন্দ দাস :

আলো – অন্ধকারে যাই – মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
উপেক্ষা করিতে চাই তারে:
মড়ার খুলির মতো ধরে
আছাড় মারিতে চাই।
তবু সে মাথার চারিপাশে!
তবু সে চোখের চারিপাশে!
তবু সে বুকের চারিপাশে!

রবীন্দ্রনাথ:
আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।

লেখক : হে প্রভু, কবিদের একটু বিজ্ঞান শেখাও! বোধ, চেতনা, বেদনা, সব-ই বিদ্যুতের সংকেত! আর বিদ্যুৎ হলো ইলেক্ট্রনের নাচ। তবে উল্টোটা ঠিক নয়। সব চেতনা বিদ্যুতের খেলা, কিন্তু বিদ্যুতের সব খেলা চেতনা নয়। বৈদ্যুতিক সংকেতের চেতনাতে রূপান্তরিত হওয়া একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। মানবজীবনের রহস্য জড়িয়ে আছে এর সাথে। এই রহস্য জানাজানি হয়ে গেলে হয়তো জড়পদার্থ থেকে প্রাণ সৃষ্টি করা যেত! চেতনা থেকে তৈরি করা যেত চেতনা, বোধ থেকে বোধ!
গাছের স্নায়ুতন্ত্র নেই, তাই ওদের বেদনার বালাই নেই। আর সব প্রাণীর কপালে সুখদুঃখ থাকবেই, কিন্তু চেতনা আছে কি? চেতনা কি শুধুই বেঁচে থাকার অনুভূতি? বেদনার জন্যে বুদ্ধির প্রয়োজন নেই; মূর্খ, চালাক, অজ্ঞ, জ্ঞানী সবাই বেদনা পায়। কিন্তু চেতনা? জীবনানন্দের ‘বোধ,’ রবি ঠাকুরের ‘চেতনা’ কি সবার ভাবনায় আসা-যাওয়া করে? ‘কেন? আমি কে? কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাব? কেন এই অকারণ আনন্দ বা বিষন্নতা?’ এই প্রশ্নগুলো কি চেতনার চিহ্ন? মানুষ-ই কি একমাত্র প্রাণী যে এসব নিয়ে ভাবে, কষ্ট পায়? ইলেক্ট্রনের কোন নাচটি চেতনার জন্ম দেয়? কোয়ান্টাম তত্ত্বের ছন্দে ইলেক্ট্রনরা নাচানাচি করে। তাই ইদানিং ‘কোয়ান্টাম চেতনার’ (Quantum consciousness) কথা খুব শোনা যাচ্ছে।

মেরিয়ান (Marian Diamond, ১৯২৬-২০১৭): আমি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মগজ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছি। আইনস্টাইন মারা যাবার পর তাঁর মগজের সামান্য একটু অংশ নিয়েও গবেষণা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের মগজে আছে প্রায় এক শ বিলিয়ন (১ বিলিয়= ১০০ কোটি) নিউরোন (neuron), যারা বৈদ্যুতিক সংকেত দিয়ে একে অপরের সাথে কথা বলে। এরা এক ধরণের বিশেষ জীবকোষ। আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথে আছে প্রায় চার শ বিলিয়ন নক্ষত্র, একটি নিউরনে আছে এর চেয়ে হাজার গুন বেশি পরমাণু। প্রতিটি পরমাণুতে থাকতে পারে কয়েকটি ইলেক্ট্রন। ওদের নাচানাচি থেকেই বৈদ্যুতিক সংকেতের সৃষ্টি হয়। একটি ঘরে এক শ জন লোক পরস্পরের সাথে কথা বলা শুরু করলে কেমন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে? মস্তিষ্কের এক অন্ধকার বন্ধ গুহায় বসে কোটি কোটি নিউরোন প্রতি মুহূর্তে একে অপরের সাথে কথা বলছে। মস্তিষ্ক-রাজ্যে নিউরোনরা সবাই রাজা। সবার কথাই শুনতে হবে। খুব বেশি রাঁধুনি একসঙ্গে জুটলে নাকি রান্না ভালো হয় না! কিন্তু এই কোটি কোটি নিউরোনের পরামর্শ নিয়ে প্রতিমুহূর্ত আমাদের চলতে হয়। চেতনা, বোধ, মন, বিবেক, অনুভূতি সব-ই নিউরোনের সংকেত আদানপ্রদানের খেলা। আসলে ওরাই তো ‘আমি’। এই সংকেতগুলো পরস্পর বিরোধী হলে আমরা আর ‘আমি’ থাকি না, জীবনান্দের ‘বোধ’ আমাদের পেয়ে বসে, ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ একাকী কথা বলি, নিঃসঙ্গে নীরবে জীবনের জট ছড়াতে থাকি।

এক বিশ্বে আমি পেয়েছি আমার ভালোবাসার জন, আরেক বিশ্বে হারিয়েছি তাকে! এই সমান্তরাল বিশ্বগুলো কোথায় থাকে? হয়তো আমাদেরই সাথে, আমাদেরই ঘরে

মগজের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন অনুভূতির জন্ম হয়। এছাড়াও আছে মগজের ‘প্রাচীন’ এবং ‘আধুনিক’ অংশ। প্রাচীন অংশগুলো রক্ষণশীল, আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ওরা নিষ্ঠুর পরামর্শ দিতে পারে, আমাকে নরখাদক বানিয়ে ফেলতে পারে। কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনের পরেও ওদের ‘পশু’ স্বভাব বদলায় নি। এই আদিম অংশের চারপাশে গড়ে উঠেছে মগজের ‘আধুনিক’ অংশ। এখানকার নিউরোনরা নতুন করে ভাবতে চায়, খুনোখুনি না করে বাঁচার বিকল্প পথ খুঁজতে চায়। প্রাচীন এবং নবীন অংশের মধ্যে ঝগড়া লেগেই আছে। খুব বিপদের সময় আমাদের আদি কালের নিউরনগুলো সাধারণত জয়ী হয়। খাদ্য, বাসস্থান, যৌনতা, বংশ বিস্তার, সব প্রাণীর চিরন্তন দায়। লক্ষ বছর আগে যে মানুষ রেগে গিয়ে বেশি চেঁচাতো, মারামারি কাটাকাটি করতো, তাদের কপালেই এসব ‘জীবন-সামগ্রী’ বেশি জুটতো। সেদিন আর নেই। তবুও ভয়ানক সংকট দেখা দিলে আমরা সাধারণত সেই আদিম নিউরোনদের পরামর্শ অনুসারে চলি; ঘৃণা-ক্রোধ-স্বার্থপরতা আমাদের গ্রাস করে, আমরা পশু হয়ে যাই। পশু থেকে মানুষে উত্তরণের জন্যে জীবনভর ‘নবীন’ নিউরোনদের পরিচর্যা খুব প্রয়োজন। শিশুরা যতই মানবিক পরিবেশে বেড়ে উঠবে, তাদের মগজের নবীন অংশ ততই সবল হবে, ঘোর সংকটকালেও ওরা পশুতে পরিণত হবে না। ওদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যেও এই গুনটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে।
লেখক : কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্ভবনার ঢেউ নিয়ে কারবার করে, কোনো কিছুই এখানে অসম্ভব নয়! যা না চাইবার, তাকে কি আজ চাইবো? যা না পাইবার তাকে কি আজ পাওয়া যাবে? মগজের এক অংশ যুক্তিবাদী, রক্ষণশীল; আরেক অংশ কল্পনাপ্রবণ, আশাবাদী। মগজের এই দুই অংশের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। সেই পুরাতন অংশ বলে পাবে না, খামোখা অসম্ভবের দেয়ালে মাথা খুঁড়ে মরো না। আরেক অংশ ভরসা দেয়, শোনায় কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গের গল্প, যে অদৃশ্য সুড়ঙ্গ দিয়ে ইলেক্ট্রন দেয়ালের এপার থেকে ওপারে চলে যেতে পারে! মহাবিশ্বের অগুনতি ডালপালা আছে, প্রতিটি একটি সমান্তরাল মহাবিশ্ব। এক বিশ্বে আমি রাজা, আরেক বিশ্বে আমি চাকর। এক বিশ্বে আমি পেয়েছি আমার ভালোবাসার জন, আরেক বিশ্বে হারিয়েছি তাকে! এই সমান্তরাল বিশ্বগুলো কোথায় থাকে? হয়তো আমাদেরই সাথে, আমাদেরই ঘরে। আমাদের চেতনার অংশ ওরা। মগজের মধ্যে ওদের ধারণ করে আমরা ঘুরে বেড়াই। মাথার ভিতরে এক বোধ জন্ম লয়!

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!