Author Picture

বৈভব সূর্যবংশীর উত্থানের রূপকথা

মেজবাহ উদদীন

ভারতীয় ক্রিকেটে আইপিএল-এর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেখানে আইপিএল-এর অবদান নিয়ে নিশ্চিয়ই আলাদা একখানা অধ্যায় লেখা হবে। তাতে ক্ষতি আর সমৃদ্ধি দুই দিকের আলোচনাই হবে নিক্তি মেপে। তবে এই পাদটীকা একদিকে সরিয়ে রেখে একটা কথা বলাই যায় যে, ভারতবর্ষে আইপিএল আর শুধুমাত্র একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নয়, এটি একটি সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির অংশ। এর সামগ্রিক প্রভাব নিঃসন্দেহে ভারতীয় ক্রিকেটকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। ক্রিকেটপ্রেমীদের গভীর আবেগ, বিসিসিআই-এর সুশৃঙ্খল পরিচালনা এবং খেলোয়াড়দের অসামান্য প্রতিভার মিশ্রণে আইপিএল ভারতীয় ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। ১৩ বছরের বৈভব সূর্যবংশী তার নতুন ল্যান্ডমার্ক।

ভারতের বিহার রাজ্যের সমস্তিপুরের একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মেছিলেন বৈভব সূর্যবংশী। খুব সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা এই কিশোরের জীবন আজ অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পিতার পেশা কৃষি এবং ছোট্ট একটি দোকানের আয়ে চলা পরিবারে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা সহজ ছিল না। তবুও কঠোর পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং পরিবারের ত্যাগের মিশেলে বৈভব লিখে চলেছেন তাঁর জীবনের সাফল্যের গল্প।

বৈভবের বাবা সঞ্জীব সূর্যবংশী ছিলেন একজন কৃষক। পাশাপাশি একটি ছোট দোকান চালিয়ে ছেলের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করতেন। কিন্তু বৈভবের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অনুশীলনের পরিবেশ। তার গ্রামের আশপাশে কোনো ক্রিকেট একাডেমি ছিল না। তাই ভোর ৪টায় উঠে বাবা-ছেলে যেতেন ১০০ কিলোমিটার দূরের একাডেমিতে। রাস্তার ধুলোমাখা গন্ধ, গ্রামের মেঠোপথ, আর বাবার ক্লান্ত মুখ—এসবই বৈভবের প্রথম পাঠশালা। সেখানেই শিখেছিলেন কীভাবে স্বপ্নের জন্য লড়াই করতে হয়, কীভাবে প্রেরণার পুঁজি বানাতে হয় চ্যালেঞ্জকে।

নিজের চেয়ে বয়সে বড় সেই আইপিএলের নতুন তারকা বৈভব সূর্যবংশীর গল্প কেবল একটি কিশোরের ক্রিকেটার হওয়ার গল্প নয়; এটি সংগ্রাম, ত্যাগ, অধ্যবসায় এবং ইচ্ছাশক্তির মেলবন্ধনের এক অসাধারণ উদাহরণ

বৈভবের মা-ও ছেলের স্বপ্নে ছিলেন সমান অংশীদার। প্রতিদিন ভোরে উঠে ছেলের জন্য খাবার তৈরি করতেন। এমনকি অনুশীলনের খরচ চালাতে পরিবারকে জমি বিক্রি করতেও দ্বিধা করেননি। তাদের এই ত্যাগের মূল্য দিতে কখনোই পিছপা হননি বৈভব।

মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সেঞ্চুরিম্যান খ্যাতি অর্জন করেন বৈভব। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে সবাইকে চমকে দেন তিনি। এ ছাড়া বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে তাঁর নামের পাশে আছে একটি ট্রিপল সেঞ্চুরির রেকর্ডও।

এমন অভাবনীয় পারফরম্যান্সের কারণে বৈভবের প্রতি নজর পড়ে আইপিএলের দলগুলোর। ২০২৪ সালের আইপিএল নিলামে বৈভব ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড়। তাঁর ভিত্তিমূল্য ছিল ৩০ লাখ রুপি। কিন্তু নিলামে দিল্লি ক্যাপিটালস ও রাজস্থান রয়্যালসের লড়াইয়ে এই দাম পৌঁছে যায় ১ কোটি ১০ লাখ রুপিতে। রাজস্থান রয়্যালস তাঁকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ পেয়ে খুশি।

আইপিএল নিলামের আগে রাজস্থান রয়্যালস বৈভবের জন্য একটি ট্রায়ালের ব্যবস্থা করে। সেখানেই তিনি নিজেকে প্রমাণ করেন। কোচ তাঁকে এক ওভারে ১৭ রান তোলার লক্ষ্য দিয়েছিলেন। বৈভব সেই চ্যালেঞ্জ জয় করেন তিনটি ছক্কা হাঁকিয়ে। পুরো ট্রায়ালে তিনি আটটি ছক্কা এবং চারটি চার মেরে দলকে মুগ্ধ করেন।

বৈভবের ক্রিকেট জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল কোচ সৌরভ কুমার এবং মণীষ ওঝার কাছে। কোচ সৌরভ জানান, বৈভবের খেলার প্রতি নিবেদন ছিল অসাধারণ। অন্য ক্রিকেটাররা যেখানে দিনে ১০০-২০০ বল খেলতেন, সেখানে বৈভব খেলতেন ৫০০ বল। তার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তাঁর কোচরা সব সময়ই পাশে ছিলেন।

বৈভবের এই পথচলা অনুপ্রেরণা দেবে অসংখ্য তরুণকে, যারা সীমিত সুযোগের মধ্যেও বড় স্বপ্ন দেখে। তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে আজ গোটা ক্রিকেট বিশ্ব আশাবাদী

বৈভবের পিতা-মাতার ত্যাগের গল্পও কম মর্মস্পর্শী নয়। সঞ্জীব সূর্যবংশী জমি বিক্রি করে ছেলের ক্রিকেট প্রশিক্ষণের খরচ জুগিয়েছেন। মা প্রতিদিন তাঁর দিনের শুরু করতেন ছেলের অনুশীলনের জন্য খাবার প্রস্তুত করে। বৈভব নিজেও জানেন, এই ত্যাগ এবং সহায়তার কারণেই তিনি আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছেন।

বৈভবের বর্তমান কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের মতো একজন কিংবদন্তির প্রশিক্ষণে কাজ করার সুযোগ পাওয়া এক বিরাট সম্মান। দ্রাবিড় বলেন, “বৈভব প্রতিভাবান এবং তাঁর শেখার মানসিকতা অসাধারণ। রাজস্থানে সে দারুণ পরিবেশ পাবে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো খেলোয়াড় হয়ে উঠবে।”

বৈভবের মতো তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য আইপিএল একটি বড় প্ল্যাটফর্ম। যদিও তাঁর ম্যাচ খেলার সুযোগ সীমিত হতে পারে, তবে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনুশীলন, শেখা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ তাঁকে আরও দক্ষ করে তুলবে। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি ভবিষ্যতে ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন দিগন্ত খুলতে পারবেন বলে বিশ্বাস কোচ ও পরিবারের।

ক্রিকেট তখনও পুরোপুরি পরিবর্তনের পথ ধরেনি। ২০০৮ সালে হটাৎ আগমন আইপিএলের। নিজের চেয়ে বয়সে বড় সেই আইপিএলের নতুন তারকা বৈভব সূর্যবংশীর গল্প কেবল একটি কিশোরের ক্রিকেটার হওয়ার গল্প নয়; এটি সংগ্রাম, ত্যাগ, অধ্যবসায় এবং ইচ্ছাশক্তির মেলবন্ধনের এক অসাধারণ উদাহরণ। তাঁর জীবন দেখিয়ে দেয়, সীমাবদ্ধতা কেবল মানসিক; কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে যে কেউ নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। বৈভবের এই পথচলা অনুপ্রেরণা দেবে অসংখ্য তরুণকে, যারা সীমিত সুযোগের মধ্যেও বড় স্বপ্ন দেখে। তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে আজ গোটা ক্রিকেট বিশ্ব আশাবাদী। ১৩ বছর বয়সেই মিলিয়নেয়ার হওয়া বৈভব সূর্যবংশী হয়তো একদিন ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে নিজের নাম লিখবেন সোনার হরফে।

আরো পড়তে পারেন

বিদায় রূপকথার দেবদূত

যে পরিবেশে জলছবি আর রংমশালের গল্প ছিল না। না ছিল রূপকথার পরীদের গল্পও। কেবল ছিল অভাবের গল্প, আর একটা বল ছিল। যতবার সেই বলকে দূরে ছুড়ে দিত রোগা পা, ততবার, একবেলা খেতে না পাওয়ার কথা ভুলে যেতেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ভুলে যেতেন, তাঁদের জীবনটা অভাব অন্ধকার আর না-পাওয়ার সবটুকু রংহীনতা মেখে নিচ্ছে রোজ। ফুটবলের সঙ্গে….

বিশ্বকাপের মার্কশিট

‘পরের জন্মে আমি এর প্রতিশোধ নেব। নেবই। মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে জন্ম নিয়ে…।’ অনেক বছর আগে এক ভারতিয় পত্রিকায় পড়া এক চিঠি। যে চিঠি হয়তো লেখা হয়েছিল কোনও এক অনির্বাণ দহনের রাতে। লিখে আর ভাবেনি, লেখক চলে গিয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে। প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। প্রায় পাঁচ দশক আগে পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলের অনলে দগ্ধ এক মোহনবাগান….

বাংলাদেশে আবারো শুরু হচ্ছে বার্সা একাডেমির ট্রেনিং ক্যাম্প

বাঙালির স্বপ্নিল বাসনা আর স্বপ্নের সীমাবদ্ধতা যেখানে ধাক্কা খায়, যে-দারিদ্র্য নায়কনির্ভর চিত্রনাট্য, স্পেক্টাকলের বিনোদন বহু কষ্টে পাঁজরে গোপন করে রাখে। ফুটবল সেখানে যেনো এক মুক্ত বাতাস হয়ে জড়িয়ে থাকে পুরোটা পথ। তবু বাঙালির ফুটবলার হওয়ার রাস্তায় জেগে থাকে অগণিত লাল বাতি। এবার ফুটবলার হওয়ার সেই বাধা দূর করতে ঢাকায় আয়োজিত হতে যাচ্ছে বার্সা একাডেমির নির্ধারিত….

error: Content is protected !!