
কিছুদিন আগে একটি খবর পড়লাম, খবরটা নদী দখল নিয়ে। আবার পড়া যাক;
অমুক জেলার বা অমুক উপজেলার অমুক নদীসহ এর শাখা নদীতে চলছে দখলের মহোৎসব। নদীর চরে দরগা শরীফের বা কোন মসজিদ বা মাদ্রাসা বা এতিম খানার নামে বিশাল এলাকা জুড়ে সাইনবোর্ড। নদী দখল করে ১৬টি দোকানের জায়গা তৈরি করেছেন স্বয়ং পৌর মেয়র ও কয়েকজন কাউন্সিলর। এছাড়া নামবিহীন একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ ছাড়াও নদীর চরের ৭০ ভাগ দখল করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগে বা বিএনপি অমুক সম্পাদক তমুক। প্রতিবাদ করতে এলে দখলদারদের পেটে যাচ্ছে তাদের বসত ভিটেও। আর প্রাণের ঝুঁকি তো থাকছেই। এছাড়া, একের পর এক মামলা দিয়ে করা হচ্ছে হয়রানি। নাটের গুরুরা থেকে যাচ্ছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়দের অভিযোগ, দখলদারদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
উপরোক্ত খবরটা খেয়াল করলে দেখবেন এই খবরে অনেকগুলো ফিল্টার মিলে একটা সমন্বয়ের দিকে ছুটেছে। মানে নদী দখল কোন একজন মানুষের কাজ নয়। এটা হচ্ছে অর্গানাইজড ক্রাইম। এবং এটার সাথে সরাসরি ক্ষমতা ও ক্যাপিটালিজম জড়িত। অর্গানাইজড ক্রাইম হয় ফ্যাসিস্ট স্টাইলে এখানে ধর্ম রাজনীতি আর অর্থনীতি একাকার হয়ে যায়। সোভিয়েতকে ঠেকানোর জন্য আফগানিস্তানে পুঁজিবাদীরা তালেবান নামের ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে যেমন আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আবার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার জন্য যেমন রামমন্দির। আমাদের দেশে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দখল করার জন্যও প্রয়োজন হয়েছিল ধর্ম। শাহজালাল। কেন শাহজালাল? কারণ গণমানুষের রোষ থেকে বাঁচতে হলে চাই ধর্ম। ধর্মের নামে অনেক অধর্মকেও হজম করে ফেলা যায়। ধর্ম মোটামুটি এইভাবে ক্যাপিটালিজমের সহায়তায় বলা যায় ক্যাপিটালিজম নিজের প্রয়োজনে ধর্মকে তার সাথে নিয়ে চলছে। এটাতো উপরি হিসাব। ভিতরে আছে এলাকার ছিচকে মাস্তান থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনির সদস্য পর্যন্ত। অর্থ সংস্থান থাকলে পুঁজিবাদে সব কিছু জায়েজ।
রাষ্ট্র একদিকে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ সচল রাখার তাগিদ দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে নদী-খাল-বিল জলাশয় সংরক্ষণ, দখলমুক্ত করা, পুনঃখনন করার কথা বলছে অপরদিকে সেই রাষ্ট্র ও তার সরকারেরই ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের লেজুড়বাহিনি স্থানীয় পর্যায়ে দখল, দূষণ অব্যাহত রেখেছে। প্রশাসন আছে, দেখছে, মামলা হচ্ছে, রায় বেরুচ্ছে দখলদারদের বিরুদ্ধে কিন্তু এই খাদকদের শেষ নেই, বিনাশ নেই। সারাদেশেই নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় এগুলো ভরাট হয়ে এখন নদীর রূপ পাল্টে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি প্রতিদিন আরও ভয়াবহ হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত আছে হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই আমরা তেমন কোন নদীর অস্তিত্ব আর খুঁজে পাব না। এখন বদলে যাচ্ছে বরেন্দ্র এলাকার প্রাণ বৈচিত্র। শুকিয়ে যাচ্ছে চলনবিল অঞ্চলের ১৬টি নদ-নদী। মরে যাচ্ছে নীলফামারীর ১০টি। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে চিত্রানদীসহ আরও অসংখ্য নদীও মৃতপ্রায়। বিগত কয়েক দশকে অবৈধ দখলে-দূষণে নদীগুলো এখন শুধুই বর্জ্য অপসারণের ড্রেন।
সোভিয়েতকে ঠেকানোর জন্য আফগানিস্তানে পুঁজিবাদীরা তালেবান নামের ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে যেমন আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আবার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার জন্য যেমন রামমন্দির। আমাদের দেশে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দখল করার জন্যও প্রয়োজন হয়েছিল ধর্ম। শাহজালাল। কেন শাহজালাল? কারণ গণমানুষের রোষ থেকে বাঁচতে হলে চাই ধর্ম। ধর্মের নামে অনেক অধর্মকেও হজম করে ফেলা যায়।
শুধু কী দেশিয় দখলদার? দেশের ভেতরে সৃষ্ট সংকটের পাশাপাশি উজানে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ, পানিবিদ্যুৎ ও ক্যানাল প্রকল্প তৈরির ফলে বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়সহ পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ মনে করে উজানের এসব প্রকল্প এবং দেশের অভ্যন্তরে নদী ভরাট, দখলের ফলে দেশের সার্বিক পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। শুষ্ক মওসুমে সার্বিক সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, এমনকি অনেক স্থানে গভীর নলকূপ বসিয়েও কাঙ্খিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। উল্লেখ্য বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৪ টি নদীর পানির উৎস ভারতে। তারা প্রত্যেকটি অভিন্ন নদীতে বাঁধ, জলবিদ্যুৎ, ক্যানাল প্রকল্প, রিজার্ভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে পানির প্রবাহ আটকে রেখেছে। সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারতকে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না গেলে হয়ত একটা সমাধান মিলত। কোন সরকারইতো আদতে মানুষের উন্নয়ন চায় না। মানুষের উন্নয়নের ছদ্মবেশে তারা আত্মীয় স্বজনকে চুরি চামারি করে বড় লোক বানিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে দেশটাকে ফতুর করে দিতে চায়। বাংলাদেশে নদী নির্যাতন মূলত দুই প্রকার এক. নদীর পানি দূষিত করে, নদীতে বর্জ্য ফেলে সেটাকে হত্যা করা। দুই. হত্যা শেষে সেটাকে ভরাট কওে সেটাকে অবৈধভাবে দখল করে সেটার পরিচয় মুছে ফেলা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে নদী বাঁচাতে হবে কেন? সে ক্ষেত্রে নদীর জীবনচক্র ভেবে দেখতে বলবো। ভাবুন কেন আমাদের নলকূপগুলোতে আগের মত পানি পাওয়া যায় না? সামান্য খরা হলেই কেন আমাদের মাঠগুলো ফেটে চৌচির হয়ে যায়? কেন আমাদের পানিতে অতিমাত্রায় বিষাক্ত আর্সেনিক দেখা দিয়েছে? কেন আমাদের মাছ, পাখি, অনেক চেনা বৃক্ষ হারিয়ে যাচ্ছে? কেন আমাদের গাছগুলোতে আগের মত ফল ধরে না বা ধরলেও ফল ছোট হয়ে যায়? এসবের সাথেই জড়িয়ে আছে পানি প্রবাহের গভীর সম্পর্ক।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার হিউম্যান রাউটস ওয়াচ তাদের এক প্রকাশিত রিপোর্টে বলছে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ এখনও আর্সেনিক দূষিত পানি পান করছে। সংস্থাটির দাবি অনুযায়ী প্রতিবছর বাংলাদেশে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে মৃত্যু ঘটছে ৪৩ হাজার মানুষের। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সচিবের দেয়া তথ্য মতে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষকে আর্সনিকের ঝুঁকিতে আছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে ঝুঁকির মাত্রা কমে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকারি সূত্র যতই আশার বাণী শোনাক কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জরিপে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ আর্সেনিকের চিত্র গত বিশ বছরে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। (বিবিসি ডটকম, ৬ এপ্রিল ২০১৬)। দেশের কূপগুলোর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের পানিতে ৫০ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন-দেশে আর্সেনিকের নির্ধারিত সহনীয় মাত্রা) মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ আর্সেনিকের উপস্থিতি দেখা গেছে। আর্সেনিকের দীর্ঘ সংশ্রবে ক্যান্সার ও ত্বকের ক্ষতে সংক্রামণের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। একই সাথে শিশুর মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
দুনিয়ার আদি সভ্যতা ও মনুষ্য বসতি গড়ে উঠেছিল এই নদীকে কেন্দ্র করেই। নদীর পাশে সভ্যতা গড়ে উঠার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে যাতায়াতের সুবিধা, নদীর পানি চাষাবাদের সহায়ক। ইরাকের ইউফ্রেটিস-তাইগ্রিস নদের সুমেরীয় সভ্যতা, চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসি নদী সভ্যতা, মিশরীয়দের নীল নদের সভ্যতা অনেক সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা নদীকে বাঁচিয়ে রেখেছে, নদীকে সাজিয়েছে, নদীকে আরও বেশি খনন করে জনজীবন যাতায়াত সহজ ও পরিবেশবান্ধব করেছে। প্রতিটি নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলেছে একাধিক পর্যটনকেন্দ্র। আমাদের দেশ যেহেতু নদীমাতৃক তাই অজস্র বাজার হাট মোকাম গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। যার কোনো হিসাব নাই। আর ক্যাপিটালিজমের বিশৃঙ্খল বিকাশের শিকার হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের নদীগুলো। যেন লুটেরারা দেশের সমস্ত নদী নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলেই তাদেও জীবন ধন্য হবে।
রাষ্ট্র একদিকে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ সচল রাখার তাগিদ দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে নদী-খাল-বিল জলাশয় সংরক্ষণ, দখলমুক্ত করা, পুনঃখনন করার কথা বলছে অপরদিকে সেই রাষ্ট্র ও তার সরকারেরই ক্ষমতা ব্যবহার করে তাদের লেজুড়বাহিনি স্থানীয় পর্যায়ে দখল, দূষণ অব্যাহত রেখেছে। প্রশাসন আছে, দেখছে, মামলা হচ্ছে, রায় বেরুচ্ছে দখলদারদের বিরুদ্ধে কিন্তু এই খাদকদের শেষ নেই, বিনাশ নেই। সারাদেশেই নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে।
‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বরাতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার একটি শিরোনাম ছিলো ‘বাংলাদেশে নদীর পানি সবচেয়ে দূষিত’। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-র তৈরি করা সে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে- এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা অববাহিকার পানি। গৃহস্থালি পানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক পানি নিরাপত্তা, নগরের পানি নিরাপত্তা, পরিবেশগত পানি নিরাপত্তা ও পানি সংক্রান্ত দুর্যোগ সহিষ্ণুতা এই পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে জাতীয় পানি নিরাপত্তা ইনডেক্স তৈরি করা হয়েছে। এই মানদন্ডে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান (৪৬তম), ভারত (৪৫তম), বাংলাদেশ (৪৪তম), আফগানিস্তান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ কিরিবাতি।
এখন দেখা যাক আমাদের শহরগুলো কীভাবে নদীর পানিকে বিষাক্ত করে ফেলছে। বিশেষ করে কৃষি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার ও কলকারখানার রাসায়নিক দ্রব্য প্রবাহিত হয়ে পানিতে মিশে দূষিত হয়। বাংলাদেশের মাটির ওপরের ও নিচের-দুই ধরনের পানির অবস্থা খুবই খারাপ। মাটির নিচের পানি উত্তোলনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতাও বাংলাদেশে অনেক বেশি। শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলোর ৮০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদীগুলোতে রাসায়নিক পদার্থের দূষণ বাড়ছে।
এই প্রতিবেদন আরও বলছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর ভূগর্ভ থেকে ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার (কিউবিক কিলোমিটার) পানি উত্তোলন করে। এর ৮৬ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষির সেচ কাজে। বাকি ১৩ শতাংশ গ্রহস্থালি কাজে ও ১ শতাংশ পানি শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। ভূগর্ভস্থ থেকে এত ব্যাপক হারে উত্তোলনের ফলে পরিবেশগত ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষকদের ধারণানুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা এক হাজার কোটি হলে সমস্যা প্রকট আকারে ধারণ করবে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোতে খাবার ও পানির চাহিদা বাড়বে।
২০১২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস ও সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক সহকারী অধ্যাপক কর্ণফুলীর দুই পাড়ের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ১০০ পরিবারের ওপর প্রাথমিক গবেষণা চালান। তাতে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। সেখানের মাটি ও পানি পরীক্ষা করে ক্ষতিকর জীবাণুর সন্ধান পান তিনি। কেবল শিল্পবর্জ্যর রাসায়নিকই নয়, কর্ণফুলী নদীর পানি ও মাটি দূষিত হচ্ছে নানা প্রজাতির প্রাণঘাতী জীবাণু দ্বারা। গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কর্ণফুলীর পানি ও মাটিতে ক্ষতিকর সালমোনেলা, স্ট্রেপটোকক্কাস ও স্টেফাইলোকক্কাস এবং ভিব্রিও ব্যাকটেরিয়া উপস্থিতি পাওয়া গেছে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। কর্ণফুলীর তীরের বাসিন্দারা এর পানি ও মাটি ব্যবহার করার ফলে ডায়রিয়া, টায়ফয়েড, কলেরা ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে ভুগছেন। (প্রথম আলো, ৯ মার্চ, ২০১৪)
চট্টগ্রামের টিএসপি সার কারখানা থেকে সালফিউরিক ও ফসফরিক এসিড এবং চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলি কাগজ মিল, সিলেট কাগজ মিল, দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি, খুলনার শিপইয়ার্ড ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ করাখানা, ঢাকার অলিম্পিক ও কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস লক্ষ লক্ষ গ্যালন তরল বর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদী ও জলাশয়ে নিক্ষেপ করে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে। এভাবে চট্টগ্রামের ১৪০টির অধিক শিল্পকারখানার বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে মিশছে। এছাড়া ১৯টি চামড়া শিল্প, ২৬টি বস্ত্রকল, ১টি তেলশোধানাগার, সিমেন্ট কারখানা, সাবান কারখানা, কীটনাশক কারখানার বর্জ্য নদীগুলোকে ধংস করে দিচ্ছে। কেবল ঢাকা আর চট্টগ্রাম নয় সারা দেশের সকল শিল্প ও কলকারখানার বর্জ্য কোথায় কিভাবে ফেলা হয় তার কোন পরিকল্পনা নাই সরকারের। অথবা সেটা সরকার বুঝে কিনা সন্দেহ।
মানুষের শরীরের ৬৫% পানি। পৃথিবীর ৭১% পানি। যে পানি জীবন বাঁচায় সে পানিকেও তারা দূষিত করে চলেছে ব্যবসার স্বার্থে, মুনাফার স্বার্থে। প্রাথমিকভাবে নদী দূষণের ১২টি উৎস নির্ধারণ করলেও এটি চূড়ান্ত নয়। কলকারখানার বর্জ্য, অভ্যন্তরীণ আবর্জনা, ওয়াসার পানির লাইনের ওপর অবৈধ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নলকূপের পানিতে আর্সেনিক, ফসলের ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত হয়। এছাড়াও মলমূত্র নদী-নালায় পড়ে পানীয় জলকে দূষিত করছে। দেশের নদ-নদীগুলোর চারপাশে দেখা যায় আবর্জনার স্তুপের পাশাপাশি অসংখ্য শৌচাগার। ইউএনডিপির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতে শিল্প কলকারখানা থেকে দূষণের মাত্রা হচ্ছে ৬০ শতাংশ আর বাকি ৪০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ বর্জ্য থেকে।
বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ নদী রয়েছে যার বেশিরভাগই এখন মৃত। সরকারি জরিপ অনুযায়ী দেশের ৩০টি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বাকিগুলোতে শুকনো মওসুমে কোন পানি থাকে না। এক-তৃতীয়াংশ বা তারও কম অংশে থাকে হাঁটু পানি। নদী দখল ও দূষণকারীদের কোন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু নদীদখলের পেছনে সিংহভাগই রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে।
‘পরিবেশ বাঁচাও’ আন্দোলনের সর্বশেষ (৭ মার্চ) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রীষ্মকালে রাজধানীর চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর প্রায় অধিকাংশ স্থানের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যে নেমে যায়। ফলে মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তিসহ নদীগুলো আজ মৃত প্রায়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা না গেলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে পানির অভাবে সম্পূর্ণভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। নদীগুলোর পানিতে দূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা ব্যবহার কোন উপায় নাই। বর্ষা মৌসুমে কিছুটা পানি বাড়লেও অন্যসময়ে গোটা নদী ড্রেনে পরিণত হয়। ঢাকার ৪টি নদীর পানি প্রাণিকুলের জন্য এক মরণফাঁদ। টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এলাকার পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্য, টেক্সটাইল ডায়িং কারখানা, নৌযান নির্মাণ, মেরামত ও রংকরণ, নৌযান থেকে নির্গত তেল এবং নৌযানের বর্জ্যসহ হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারিসমূহের বর্জ্যে ঢাকা পরিত্যক্ত শহরের রূপ ধারণ করছে। ট্যানারির বর্জ্য কতটা অসহনীয় তা কেউ নিজ চোখে না দেখলে তাকে বর্ণনা দিয়ে বোঝানে অসম্ভব। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ট্যানারিসমূহ থেকে ২২ হাজার কিউবিক মিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড ইত্যাদি। ট্যানারি থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য শুধু বুড়িগঙ্গার পানিকেই দূষিত করছে না, নদীর তলদেশ ও উভয় পাড়ের মাটি এমনকি বাতাসকেও ভয়াবহভাবে দূষিত করছে। ৬২ রকমের রাসয়নিক বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা যেন আসল বুড়ির রূপ ধারণ করছে। নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে ৮ ফুট পলিথিনের স্তর। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার দূষিত ও বিষাক্ত পানি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া অতিক্রম করে মেঘনা নদীতে প্রবেশ করছে। এর ফলে মেঘনার দু’কূলের জীববৈচিত্র, ফসল, কৃষি পণ্য, মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও ইলিশের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।
বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার এক সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়াসা। তবে অধিকাংশ এলাকায় ওয়াসা যেন এক যন্ত্রণার নাম। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষের অসন্তোষ বরাবরই ছিল এবং আছে। দায়সারা ভাবেই তারা জনসেবা দিচ্ছে বলে গণমাধ্যমে অনেক সংবাদ বেরিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া নদী থেকে সরবরাহ করা পানি সঠিক উপায় বিশুদ্ধ না করা, পানির জলাধারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করা, শোধানাগারে পানি শোধনের সময় সঠিক পরিমাণে শোধন কেমিক্যাল না দেয়া, ওভারহেড ট্যাঙ্ক নিয়মিত পরিষ্কার না করা, পুরনো লাইনগুলো সংস্কার বা মেরামত না করাই যেন তাদের কাজের অংশবিশেষ। মানুষ না জেনে ওয়াসাকে বিশ্বাস করে ওয়াসার পানি পান বা ব্যবহার করে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফায়েড, জন্ডিস, চর্মরোগ ইত্যাদি অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগ। এটা জনগণের সাথে মারাত্মক প্রতারণা।
বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ নদী রয়েছে যার বেশিরভাগই এখন মৃত। সরকারি জরিপ অনুযায়ী দেশের ৩০টি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বাকিগুলোতে শুকনো মওসুমে কোন পানি থাকে না। এক-তৃতীয়াংশ বা তারও কম অংশে থাকে হাঁটু পানি। নদী দখল ও দূষণকারীদের কোন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু নদীদখলের পেছনে সিংহভাগই রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। নদীর পাড় দখল করে ভবন বা অবকাঠামো নির্মাণ অথবা নদীর মধ্যে বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরি, মাছ চাষের নামে নদীকে পুকুর বানিয়ে ফেলা, নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি কর্মকান্ডের মাধ্যমে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে।
এখানে আমাদের সক্রাতেসকে হাজির করতে হবে আবার। তিনি কেন শিক্ষিত দার্শনিক শাসকদের কথা বলেছিলেন। কারণ একটা রাষ্ট্রের সমস্ত পালস বুঝতে না পারলে সেই রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব না। বছরের পর বছর পিতা বা স্বামীর সূত্রে ক্ষমতা ধরে রাখার যে খেলা রাজনৈতিক দলগুলো খেলছে তা নদী দখল ও দূষণের চেয়েও মারাত্মক। এক নোংরা স্থবির আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্বাধীনতার নামে কোটি কোটি মানুষের কাধে জোয়ালের মত চেপে বসে তাদের জীবন নানা বিষক্রিয়ায় বিষাক্ত করে দেওয়ার যে রাজনীতি নদীদূষণ ও নদীদখলও তার বাইরে নয়।