
আবদুল্লাহ ওমর সাইফ
মানুষের বুদ্ধি প্রয়োগ করবার ক্ষমতা অতি বিস্ময়কর। সেই আদিম যুগে যখন মানুষের সহায় সম্বল বলতে কিছুই ছিল না, তখন অন্তত বুদ্ধিটা সঙ্গে ছিল। আর সেই বুদ্ধির জোরেই মানুষ একদিন সভ্য হলো। যার বলতে গেলে কিছুই ছিল না, সে মহাকাশ পাড়ি দিল, সমুদ্রের তলায় ডুব দিয়ে গোপন সব খবরাখবর বয়ে নিয়ে এল। শুধু বিজ্ঞান নয়। শিল্পকলা, সাহিত্য, ইতিহাস, ভাষা -বেঁচে থাকবার জন্যে যা যা লাগে তার সবটার জোগাড় হল। কিন্তু বেঁচে থাকতে গিয়ে বুদ্ধিকে ভালো কাজে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে অনেকে একে খারাপ কাজেও ব্যবহার করা শুরু করে দিল। আর বিপত্তিটাও বাঁধলো গিয়ে সেখানে। বুদ্ধি হচ্ছে একটা অস্ত্রের মত। একে ভালো বা মন্দ দু কাজেই ব্যবহার করা যায়। যারা সুবুদ্ধি দেয় তাদেরও যেমন শক্ত যুক্তি আছে, তেমনি যারা কুবুদ্ধি দেয় তাদেরও কর্মকান্ডের পেছনে যুক্তি এঁটে দেয়া থাকে।
স্বৈরাচার হিটলার কী যুক্তি দিয়ে জার্মানির মানুষকে বোঝান নি, কেন তার যুদ্ধ শুরু করা প্রয়োজন? অনেক মানুষ তো মেনেছিল তার কথা। নইলে এত বড় যুদ্ধ হয় কী করে? মানছি, আজকে আমরা বলছি যে হিটলারের এই সমস্ত ব্যাপার আসলে ছিল মানুষকে মগজ ধোলাই করার জন্যে কুবুদ্ধি কিংবা কুযুক্তির প্রয়োগ। অথচ যারা হিটলারের দলের লোক ছিল, তারা কিন্তু একে সুবুদ্ধি হিসেবেই দেখেছে। তারা নিজেরাও তো শিক্ষিত লোক ছিল। তারা কেন বুঝল না ব্যাপারটা। তার মানে কী বুদ্ধির ভালোমন্দ বোঝা সহজ কাজ নয়? এই প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করা যেত। কিন্তু আমার মনে হয় এই প্রশ্নের চেয়েও দরকারি হচ্ছে ভেবে দেখা কীভাবে মানুষের অভিজ্ঞতা তার বুদ্ধির বিকাশকে প্রভাবিত করে। কেন একদল মানুষের কাছে যা কুযুক্তি আরেকদলের কাছে সেটা সুযুক্তি বলে মনে হয়। এটা ঠিক যে মানুষ কীভাবে চিন্তা করতে শেখে এর সঙ্গে বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণের একটা সম্মন্ধ আছে।
জঁ প্যাজে নামের একজন বড় মনস্তত্ববিদ শিশুদের ওপর অনেক গবেষণা করে একখানা তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষের মনে কিছু ছাঁচেঢালা ধারণা থাকে যেসবের ওপর ভিত্তি করে মানুষ চিন্তার ডালপালা মেলে। এই ধারণার তিনি নাম দিয়েছেন স্কিমা। ধরা যাক একটা ছোট্ট বাচ্চা চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘ দেখে এসেছে। তার বাবা তাকে বাঘ দেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দেখো বাবু এটা হচ্ছে বাঘ। হালুম। এখন বাবু বাসায় এসে চার পা ওয়ালা যাই দেখছে বলছে হালুম। ছেলের মা পরে ছেলেকে অনেক কষ্টে বোঝালেন বাবা ওটা বাঘ নয়। চার পা হলেই বাঘ হয় না। ওটা গরু। প্যাজেট বলছেন, বাচ্চা এই যে একটা নতুন তথ্য শিখল, এটা কিন্তু সে শিখল তার আগের সেই বাঘ ধারনা বা স্কিমার সঙ্গে মায়ের বলা কথার একটা মিল ঘটানোর মাধ্যমে। বাচ্চারা প্রথমে মিলানো শেখে। এরপর নতুন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তার যত স্কিমা আছে সবগুলির প্রয়োগ ঘটাতে থাকে। অভিজ্ঞতা না মিললে তার পূর্বের স্কিমার সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে একটা নতুন জ্ঞানের জন্ম দেয়। আমাদের উদাহরণের সেই বাবু সব চার পেয়ে যে বাঘ নয় এই জ্ঞান তার বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে করতে শিখেছে। এখন তার বয়স যত বাড়বে সে আরো মিলিয়ে দেখতে শিখবে সব চার পেয়ে যে শুধু বাঘ আর গরু তাই নয়। এখন চার পেয়ে ছাগল আছে, ঘোড়া আছে, ভেড়া আছে।
ধরা যাক একটা ছোট্ট বাচ্চা চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘ দেখে এসেছে। তার বাবা তাকে বাঘ দেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দেখো বাবু এটা হচ্ছে বাঘ। হালুম। এখন বাবু বাসায় এসে চার পা ওয়ালা যাই দেখছে বলছে হালুম। ছেলের মা পরে ছেলেকে অনেক কষ্টে বোঝালেন বাবা ওটা বাঘ নয়। চার পা হলেই বাঘ হয় না। ওটা গরু। প্যাজেট বলছেন, বাচ্চা এই যে একটা নতুন তথ্য শিখল, এটা কিন্তু সে শিখল তার আগের সেই বাঘ ধারনা বা স্কিমার সঙ্গে মায়ের বলা কথার একটা মিল ঘটানোর মাধ্যমে।
এভাবেই বয়স বাড়তে বাড়তে একের পর এক ধারণার সঙ্গে ধারণা মিলিয়ে মিলিয়ে সে বুদ্ধি ধারণ করা শেখে। এই বুদ্ধি ধারণের প্রক্রিয়া আবার পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। শৈশবের পরিস্থিতি তাঁকে স্কিমা তৈরি করতে শেখায়। স্কিমার কোনো ভালো মন্দ বাছ বিচার নেই। কোনো বাচ্চা যদি শৈশবে দেখে পুরুষেরা গাড়ি চালায় আর মেয়েরা ঘরে কাজ করে, তাহলে তার সেইরকম স্কিমাই মনে তৈরি হবে। কারণ, মানুষের জিন এবং পরিবেশ দুটোই স্কিমা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এর থেকে মানুষ সহজে বেরুতে পারে না। মানুষ মনে করে তার নিজস্ব ধারণা থেকে বের হলেই একটা অজানা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই অজানাকে মানুষ ভয় পায়। ফিয়ার অফ আননোন মানবজাতির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। অনেক সময় শুধু এই অজানার ভয় না, মানুষের মনে জমে থাকা রাগ কিংবা ঘৃণার অনুভুতি নানান ধরণের ধারণা তৈরি করে। বড় হয়েও এই মূল ধারণা থেকে মানুষ বের হতে দ্বিধাগ্রস্থ হয়। সে তখন তার বুদ্ধিও সেভাবে খাটাতে থাকে। আমাদের বর্তমান সমাজ কাঠামো তৈরির সময় আমাদের পূর্বপুরুষদের আজন্ম লালিত ধারণা যে কাজ করে নি সেটা জোর দিয়ে বলি কী করে?
মানুষ চিন্তা করার সময় তার স্কিমার বাইরে কতটুকু যায় সেটা বলা মুশকিল। বার্লেটের পরীক্ষা নামে একটা মজার ব্যাপার আছে। ব্রিটিশ সাইকোলজিস্ট বার্লেট সাহেব একদল লোককে একবার আদি আমেরিকানদের একটা গল্প বললেন। তারপর অল্প কিছুদিন পর তাদের মুখ থেকে গল্পটা শুনতে চাইলেন। এর পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আবার সেই গল্প ঐ একই লোকদের বলতে বলা হলে দেখা গেল গল্পের নানারকম অদলবদল ঘটে গেছে। শ্রোতারা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গল্পের কোনো অংশ হয় বাদ দিয়েছে, নইলে নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী যুক্তি দাঁড় করিয়েছে। কেউ কেউ আবার নিজের কৃষ্টি কালচার অনুযায়ী গল্পের কাহিনীর ধারা বদলে দিয়েছে। বার্লেট সাহেব এই পরীক্ষা দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের স্কিমা অনুযায়ী ঘটনার বর্ণনা, ব্যাখা বা বিশ্লেষণ করে বসে। মানুষের অবচেতন মন তার মনের তৈরি সেই পূর্ববর্তী ধারণা অনুযায়ী ঘটনাচিত্র সাজায়। ঘুরে ফিরে তার চিন্তায় ব্যক্তিজীবন, শৈশবের অভিজ্ঞতা সবকিছু প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মানুষ যেখানেই সমাজ গঠন করতে গেছে সেখানেই নিজেদের মনের পূর্ববর্তী ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এমন কী মিথও তৈরি হয়েছে এইসব ধারণার আদলে। একটা উদাহরণ দিই। অনেক পন্ডিতই এখন একমত যে মেয়েরাই প্রথম কৃষিকাজের সূচনা করেছে, পুরুষেরা নয়। পুরুষ ব্যস্ত ছিল বাইরে, শিকারে। মেয়েরা ঘরেই থাকত, গৃহস্থালির কাজকর্ম করত। মেয়েরা ফল খেয়ে ফলের বীচি বাইরে ফেলে একসময় লক্ষ্য করল সেখান থেকে দিব্যি গাছ হয়। এভাবে শস্য উৎপাদন করার আইডিয়া মানুষের মনে এল। আর প্রথমদিকে কৃষিকাজ মেয়েরাই মোটামুটি করত। কিন্তু পরে মানুষ হিসেব করে দেখল বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে ফলমূল আর শিকার করার চেয়ে কৃষিকাজ করলে বেশি খাবার ফলানো যায়। তখন ধীরে ধীরে বড় আকারে কৃষিকাজ আরম্ভ হল। হাল আবিষ্কার হল, চাকা আবিষ্কার হল। কৃষিকাজ যখন অর্থনীতির মানদণ্ড হয়ে গেলো তখন পুরুষেরা নিজেদের কতৃত্ব ফলাতে কৃষিকাজ থেকে ধীরে ধীরে মেয়েদের সরিয়ে দিল। কিন্তু এত কিছু করলেও মেয়েরাই যে কৃষিকাজের জন্মদাত্রী এর ধারণা তাদের অবচেতন মন ঠিক মুছতে দেয় নি। এ কারণেই যখন মিথ তৈরি হলো তখন দেখা গেল ফসলের উৎপাদন কিংবা জমির উর্বরতার দেবতা কেউ পুরুষ নন। সবাই মেয়ে মানুষ। প্রাচীন পৃথিবীতে উর্বরতার কোনো দেবতার খোঁজ আজ পর্যন্ত মেলে নি। সব দেবী। মেয়েদের অর্থনীতিক স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইলেও অবচেতন মন ঠিকই তাদের অবদান মনে রেখেছে। আর সেটার প্রতিফলন ঘটেছে মিথে, গল্পে, ধর্মে। এটাই প্রমাণ করে মানুষের অবচেতন মন কিছু পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে বুদ্ধি চালনা করে। এরকম একটা পূর্ববর্তী ধারণা হতে পারে চিন্তার দ্বৈততা। শব্দটা কঠিন শোনালেও আসলে একটু ভেবে দেখলে জিনিসটা সহজ মনে হবে।
মানুষের অবচেতন মন তার মনের তৈরি সেই পূর্ববর্তী ধারণা অনুযায়ী ঘটনাচিত্র সাজায়। ঘুরে ফিরে তার চিন্তায় ব্যক্তিজীবন, শৈশবের অভিজ্ঞতা সবকিছু প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মানুষ যেখানেই সমাজ গঠন করতে গেছে সেখানেই নিজেদের মনের পূর্ববর্তী ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এমন কী মিথও তৈরি হয়েছে এইসব ধারণার আদলে।
চিন্তার দ্বৈততা হলো আমরা যখন চিন্তা করি তখন সেই চিন্তার একটা বিপরীত রুপও কল্পনা করি। আলো-অন্ধকার, সাদা-কালো, অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব, ভালো-মন্দ, দোষ-গুন ইত্যাদি। এই চিন্তার বাইরে যাবার কথা আমরা চট করে ভাবতে পারি না। এটা প্রতিটা মানুষের মনের গভীরে বাস করে মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। এ কারণে পৃথিবীতে যখনই কোনো মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অনেকটা অবশ্যম্ভাবী হিসেবেই তার বিপরীত মতবাদের জন্ম হয়। আস্তিক-নাস্তিকের দ্বন্দ্ব, কমিউনিজম-ক্যাপিটালিজমের দ্বন্দ্ব- এ সবকিছুর পেছনেই এসব মতবাদ প্রবক্তাদের স্কিমার প্রভাব জড়িত আছে। আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাতেও এই রকম পূর্ববর্তী ধারণার চিহ্ন রয়েছে। চিন্তার এই দ্বৈততার কারণেই অপরাধীর শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা অপরাধ ও শাস্তি ধারণার বাইরে সহজে যেতে পারি না। খুন করেছে, ফাঁসি দাও। চুরি করেছে, জেলে ভরো। অথচ আধুনিক পৃথিবীতে আমরা দেখি সবসময় অপরাধ ও শাস্তি সরলভাবে চলে না। অনেক সময় অপরাধ ও শাস্তির মাঝখানেও অনেক কিছু রয়ে যায়। যেমন, একই অপরাধ একজন প্রাপ্তবয়স্ক আর একজন অপ্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে সমান ওজন বহন করে না। এই ধরনের সমস্যায় সরাসরি অপরাধ ও শাস্তি ধারণা প্রয়োগ করা যায় না। যদিও আমাদের অবচেতন মন কিন্তু জিনিসটাকে দ্বৈততার আলোকেই দেখতে চাইবে। বিচার ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ করার জন্যে বিচারকগণ তাই পূর্ববর্তী ধারণার বাইরে থাকার জন্যে সবসময় চেষ্টা করেন। তারা অপরাধের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে জড়িত সামাজিক, মানসিক, শারীরিক -সব ফ্যাক্টর বিবেচনায় আনার চেষ্টা করেন। বিচার ব্যবস্থার এই দিকটা অনেক আধুনিক।
প্রাচীনকালে অনেক সমাজেই বিচার ব্যবস্থা এ রকম ছিল না। সেখানে অপরাধ আর শাস্তিকে একে অপরের বিপরীত করে দেখা হতো। যারা বিচার করত তাঁরা এর বাইরে চোখ দিয়ে দেখতে পারতেন না। আসলে কোনো কিছুই সরলরেখায় চলে না। কিন্তু আমাদের মন সবকিছুকে একটা নির্দিষ্ট ছকে দেখতে পছন্দ করে। অবচেতন মনে আমরা কোনো রহস্য বা জটিলতাকে পছন্দ করি না। চিন্তার দ্বৈততা মানুষকে দীর্ঘকাল প্রভাবিত করেছে। এখনো করছে। তবে আধুনিক মানুষ এর বাইরে যেতেও চাচ্ছে। ইসলামে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) যখন একবার খাদ্য চুরির অপরাধে এক ব্যক্তির শাস্তি বাতিল করলেন তখন অনেকেই চোখ টেরিয়েছিল। কিন্তু ওমর (রা) সম্ভবত দেখাতে চেয়েছিলেন সবসময় অপরাধ আর শাস্তি এভাবে দ্বৈতরুপে ভাবলে চলে না। ঐ ব্যক্তি খাবার চুরি করে ছিল কারণ ঐ সময়ে ঐ এলাকায় ছিল দুর্ভিক্ষ। অপরাধকে এখানে অপরাধ হিসেবে আর ধরা যাচ্ছে না। অপরাধ হলেও এক্ষেত্রে শাস্তি নেই। এখানে চিন্তার দ্বৈততাকে পাশ কাটিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কাজটা সহজ না। আমাদের মন এ ধরণের চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত নয়। সে চাইবে আমরা আমাদের ছাঁচে ঢালা ধারণার বাইরে না যাই। মহামানব যারা তাঁরা নিজেদের চিন্তার ছাঁচের বাইরে যেতে পারেন।
কিছুদিন পরে দেখা গেল সোফিস্টরা এসে বলছে তোমাদের সব বাজে কথা। জ্ঞান দেব, পয়সা নেব না কেন ভাই? এরকম করে দেখা গেল একদল ঈশ্বরের ধারণা দিল তো আরেকদল আরেকদিন এসে বলবে ঈশ্বর নেই। সবই কিন্তু ঘটছে নিজেদের ব্যক্তিগত ধ্যান ধারণার একটা প্রতিফলন হিসেবে। নিজেদের অভিজ্ঞতার বাইরে যেয়ে কিংবা চিন্তার দ্বৈততার বাইরে যেয়ে কিছু ভাবতে পারা কী সম্ভব? কোনটা নিরপেক্ষ মত, এটা মানুষের পক্ষে বুদ্ধি চালনা করে বলা সম্ভব বলে তো মনে হয় না।
চিন্তার দ্বৈততা দার্শনিক মতবাদ তৈরিতেও মানুষ ব্যবহার করেছে। হয়ত কাজটা সে সজ্ঞানে করে নি। কিন্তু এর প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। প্রাচীন ভারতে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর দিকে চার্বাকদের উদ্ভব হল। সময়টা বৈদিক যুগের শেষ। উপনিষদের দর্শনের প্রভাব সবখানে। চারিদিকে সব শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত। পন্ডিতরা সমাজের শাসন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। এই সময় চার্বাকরা এসে হুট করে বলল, ঐ সব বেদজ্ঞান টান আসলে কিছু না। মানুষ যা দেখে শেখে সেটাই আসল। বেদের জ্ঞান যেহেতু চোখে দেখা যায় না, কাজেই সে জ্ঞানের কোনো ভিত্তি নেই। বলাই বাহুল্য চার্বাকদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা মেনে নেয় নি। কিন্তু কেন তারা মূল ধারার বিরোধে গেল এটা বড় প্রশ্ন। কোন সামাজিক পরিস্থিতি তাদের চিন্তার বিকাশে ভিন্ন ধারার স্কিমার জন্ম দিল। স্কিমা শিশুর বুদ্ধির বিকাশ ব্যাখ্যায় ব্যবহার করা হয় মানি। কিন্তু মানুষের মনে আমৃত্যু স্কিমার সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। চার্বাকদের আগমণ কী বৈদিক কালচারের একটা অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া নয়? শুধু প্রাচীন ভারতে কেন, প্রাচীন গ্রীসেও ঐ একই অবস্থা। একেকটা মতবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একেকটা মতের জন্ম হয়েছে। সক্রেটিস, প্লেটো খুব প্রভাবশালী ছিলেন। এরা বিশ্বাস করতেন একজন দার্শনিকের আর যাই হোক জ্ঞান বিতরণ করে পয়সা নেয়া উচিত না।
কিছুদিন পরে দেখা গেল সোফিস্টরা এসে বলছে তোমাদের সব বাজে কথা। জ্ঞান দেব, পয়সা নেব না কেন ভাই? এরকম করে দেখা গেল একদল ঈশ্বরের ধারণা দিল তো আরেকদল আরেকদিন এসে বলবে ঈশ্বর নেই। সবই কিন্তু ঘটছে নিজেদের ব্যক্তিগত ধ্যান ধারণার একটা প্রতিফলন হিসেবে। নিজেদের অভিজ্ঞতার বাইরে যেয়ে কিংবা চিন্তার দ্বৈততার বাইরে যেয়ে কিছু ভাবতে পারা কী সম্ভব? কোনটা নিরপেক্ষ মত, এটা মানুষের পক্ষে বুদ্ধি চালনা করে বলা সম্ভব বলে তো মনে হয় না। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে যেটা সকলের পক্ষে মঙ্গলকর সেটা বিবেচনায় আনাটা অত সহজ কাজ নয়। ভিন্ন মত এলেই যে সেটা সকলের জন্যে ভালো হবে, এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আমার নিজের পূর্ববর্তী ধারণা সব ক্ষেত্রে সত্য না, এটা মেনে নেয়া মানুষের পক্ষে কঠিন। চিন্তার দ্বৈততার প্রভাবেই আমরা ভিন্ন মতের সূচনা করি। কারণ, ন্যায় অন্যায় আমাদের কাছে আপেক্ষিক। কাজেই কোনো ভিন্নমত যখন আমাদের মাথায় আসে একে আমরা ভাবতে চাই যে এক আমরা ন্যায় অন্যায়ের ভিত্তিতে চিন্তা করছি। কিন্তু আসলেই কী তাই? আমাদের ন্যায় অন্যায় বোধ কী আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধ্যান ধারণা, কিংবা প্যাজে সাহেব যাকে বলেন স্কিমা, সেটার বাইরে?
বুদ্ধির ভালো মন্দ বোঝা তাই অত সহজ কাজ নয়।