Author Picture

বীরত্ব নিয়ে বিতর্ক

সুদীপ্ত সালাম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪৫) রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জাপানের ইও জিমা দ্বীপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় মার্কিন সেনারা। দ্বীপ জয়ের পর দ্বীপের ৫৫৪ ফুট উচ্চতার পাহাড়চূড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ছয় মার্কিন মেরিন সদস্য। পতাকা উত্তোলনের প্রাণপণ চেষ্টার মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দি করেন ফটোসাংবাদিক জো রোজেনথাল। সেই ছবি সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ছবিটি রাতারাতি মার্কিন বাহিনীর বীরত্ব ও সফলতার প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

অনেকে বলেন, ছবিটি দেখে নাকি সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) নড়েচড়ে বসে। তাদের সৈনিকেরাও তো যুদ্ধে শহীদ হচ্ছে, বীরত্বের স্বাক্ষর রাখছে—কিন্তু কই, তাদের তো এমন একটি ছবি হলো না! রাশিয়াও এমন একটি নাকি ছবি চাইছিল এবং সেই চাহিদা পূরণেই সামনে আসে ‘রেইজিং এ ফ্ল্যাগ ওভার দ্য রাইকস্টাগ’ ছবিটি।
ছবিতে দেখা যায়, জার্মানির পতনের পর বার্লিনের রাইকস্টাগ ভবনের মাথায় দাঁড়িয়ে এক রুশ সেনা সদস্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা নাড়াচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে শহরের ছবি, দূরে আকাশছোঁয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলি। যে পতাকাটি উড়াচ্ছে সে যেন পড়ে না যায় সেজন্য নিচ থেকে তাকে ধরে রেখেছে আরেক রুশ সেনা সদস্য। এই ছবিটিও অনেক সাড়া ফেলে। ছবিটি তুলেছিলেন রুশ বিমানবাহিনীর সদস্য ও আলোকচিত্রী ইয়েভজেনি খালদেই। কিন্তু কিছুদিন পরই উন্মোচিত হতে থাকে ছবিটির তথাকথিত অন্ধাকার দিক। সমাদৃত ছবিটির অন্য একটি কপি সামনে আসে। নতুন ছবিটিকেই ‘আসল’ ছবি দাবি করা হলো। এই ছবিটির সঙ্গে আগের ছবিটির কিছু পার্থক্য রয়েছে। আগের ছবিটিতে দিগন্তরেখায় কোনো ধোঁয়া নেই। নাটকীয়তা বাড়াতে আগের ছবিটির কন্ট্রাস্ট অনেক বাড়ানো হয়েছিল। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, দেখা গেলো যে পতাকাধারীকে সাহায্য করছিল তার দুই হাতে দুটি ঘড়ি! প্রথমবার প্রকাশিত ছবিতে একই ব্যক্তির হাতে কোনো ঘড়িই নেই। তারমানে, হাত থেকে ঘড়িও মুছে ফেলা হয়। সমালোচকেরা দাবি করলেন, লাল বাহিনী জার্মানিতে লুটতরাজ চালিয়েছিল, একাধিক ঘড়ি তারই প্রমাণ। যদিও এই বক্তব্যকে খারিজ করে সোভিয়েত রাশিয়া দাবি করে, ওই ব্যক্তির একহাতে ঘড়ি আর অন্যহাতে কম্পাস ছিল।

ঘড়ি আছে, ঘড়ি নেই!

ছবিটি নিয়ে সেই যে বিতর্ক শুরু হয়—আজো চলছে। ঘটনা সত্য কি মিথ্যা তা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিন্তু মার্কিন প্রচারমাধ্যমগুলো রাশিয়াকে জালিয়াত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছে। ২০১৫ সালে ‘চাইল্ড ফোর্টি ফোর’ নামে একটি সিনেমা হয়। সেখানেও এবিষয়টি তুলে ধরা হয়। একথাও উড়িয়ে দেয়া যায় না যে—ছবিটি সত্যিই ঘষামাজা করা হয়েছিল।
ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের অধ্যাপক এবং ‘ভিজুয়াল গ্লোবাল পলিটিক্স’ গ্রন্থের সম্পাদক রোনাল্ড ব্লিকার বলেছেন, ‘ইমেজ ও দৃশ্যশিল্পকর্ম শুধুমাত্র বিশ্বরূপকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে না, রাজনীতির গতিপথকেও প্রভাবিত করে।’ যুদ্ধক্ষেত্রেও ছবি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ইতিহাস বলে, যুদ্ধের সময় প্রচার ও অপপ্রচারে ইমেজের রাজনীতি বিশেষ ভূমিকা রাখে। মিথ্যাকে ছবির মোড়কে পেশ করার অপকৌশল দীর্ঘদিনের। আবার যুদ্ধের ভয়াবহতাকে বুঝতে সাহায্য করেছে এই ইমেজ।

আরো পড়তে পারেন

মৃত্যুতেও থামেনি সমালোচনা

জাতিসংঘের একটি ফুড ক্যাম্পের পাশে একটি অসুস্থ শিশু পড়েছিল। শিশুটির ঠিক পেছনেই একটি শকুন অপেক্ষা করছে, কখন শিশুটি মরবে, কখন সে পাবে মাংসের স্বাদ! কি নিদারুণ দৃশ্য! এই ছবির সমমানের কোনো ছবি পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। ১৯৯৩ সনে ছবিটি তুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ফটোসাংবাদিক কেভিন কার্টার। একই বছরের ২৬ মার্চ ছবিটি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়।….

আজও শরণার্থী ‘আফগান গার্ল’

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের আলোকচিত্রী স্টিভ ম্যাককারি ১৯৮৪ সনে পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছাকাছি এক শরণার্থী শিবির থেকে কিশোরী শরবত গুলার ছবি তোলেন। পরের বছর ছবিটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ হওয়ার পরপরই আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে এই কিশোরী। আর ছবিটি ওয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত পোরট্রেটগুলোর একটি। গুলার পাথরের মতো চোখ দুটি ছিল বিস্ময়কর। সবুজ চোখে একই সঙ্গে ভয় ও….

টেসলার অপছন্দের ছবি

তার নামে যুক্তরাষ্ট্রে ১১২টি এবং অন্য ২৬টি দেশে আরো ১৯৬টি প্যাটেন্ট নিবন্ধিত আছে, এর মধ্যে ৩০টি শুধু ফ্রান্সেই নিবন্ধিত—এ থেকে অনুমান করা যায় নিকোলা টেসলা কত বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে এই সার্বীয়-মার্কিন ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার দিয়ে মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করা শুরু করেন। বিদ্যুৎ ছাড়াও মোটর,….

error: Content is protected !!