
কবি তার দেশের যন্ত্রণা সম্ভাবনা এবং স্বপ্নের নাম। একটা দেশের প্রকৃত চিত্র দেখতে হলে সে দেশের একজন প্রকৃত কবিকে দেখতে হয়। গত ১৪-১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট অবৈধ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ কেমন ছিল তা ভালো জানেন একজন কবি। দেশ ভালো না থাকলে কবি ভালো থাকেন না। দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হলে কবির লেখায় নানাভাবে উঠে আসে তার যন্ত্রণা। তিনি তখন ভালোবাসতে ভয় পান, আতঙ্কিত থাকেন, প্রতিবাদ করেন, সহযোদ্ধাদের নতুন করে স্বপ্নও দেখান দুঃশাসন থেকে মুক্তির। সেই কবির জীবন-যাপন দেখলে এবং তার লেখা পড়লেই আমরা বুঝতে পারি বাংলাদেশ কেমন ছিল। বিগত স্বৈরশাসনের প্রকৃত চিত্র দেখতে আমি রহমান হেনরীর কবিতা পড়ি। রহমান হেনরীর ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখালেখির কারণে তিনি তার চাকরি জীবনের নিয়মিত পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সরকারদলীয়দের কাছ থেকে নানা ধরনের অপমানের শিকার হয়েছেন। চাকরি জীবনের অনেকটা সময় ওএসডি থেকেছেন। বারবার বদলিজনিত নির্যাতন সহ্য করেছেন। শেষমেশ ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকার তাঁকে চাকরিচ্যূত করেছে। এতো কিছুর পরেও রহমান হেনরী কোনো আপোষ করেননি, আত্মমর্যাদার পক্ষে থেকেছেন, নিজের কবিসত্তার প্রতি দায়বদ্ধতা রক্ষা করেছেন এবং দেশ ও দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন। এতো দীর্ঘ সময় একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বেঁচে থাকা এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া; বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো কবির জন্য সত্যিই বিরল ঘটনা। গত ১৪-১৫ বছর ধরে নানা বিরোধী মতের মানুষের নির্যাতিত হওয়ার ফসল এই ২০২৪ সালের ‘স্বাধীনতা’। হাজার হাজার গুম খুনের ফসল এই স্বাধীনতা।
…কিন্তু এই ফ্যাসিস্ট পতনের এতোদিন পরেও কবি রহমান হেনরী তার চাকরি ফিরে পাননি! আমি ফোনে রহমান হেনরীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করার এক পর্যায়ে চাকরি পুনর্বহালের বিষয়টি জানতে চাইলে উনি বললেন, ‘হবে ভাই, এখন তো আর ফ্যাসিস্ট সরকার নাই। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
… এই হবে হবেটা উনি বলছেন অনেকদিন ধরেই। যখনি জিজ্ঞেস করি তখনি মন খারাপ করে এই কথা বলেন। আচ্ছা, যে কর্মকর্তারা চাকরি পুনর্বহালজনিত কাজগুলো করেন তারা কাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত? কী কাজ নিয়ে ব্যস্ত? নিপীড়িত, বঞ্চিত এবং ফ্যাসিস্ট বিরোধী বীরযোদ্ধা রহমান হেনরীর চাকরি পুনর্বহালে এতো দেরি করা হচ্ছে কেন? ওনার চাকরি পুনর্বহালের কাজটা তো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলব, ফ্যাসিস্টের বিরোধিতা করে চাকরি হারানোদের পুনর্বহালের বিষয়ে আপনাদের কালক্ষেপণ করা মানে ফ্যাসিস্ট বিরোধী এই বীর যোদ্ধাদের অবহেলা করা।
রহমান হেনরীর কয়েকটি কবিতা
বাক-স্বাধীনতা
শান্তির কানের ভিতর
অনর্গল বেজে চলেছে— আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর পারস্পারিক
আলাপ-আলোচনা; এবং তারই নেপথ্য সংগীত…
‘ঠাণ্ডা লড়াই’-এর দিনগুলোর কথা বলছি না; দুনিয়াব্যাপী
চিত্তবিনোদনের স্বাদহীন সালুনে, নুনের যোগান দিতেই,
হয়তোবা SALT নামে খ্যাতি পেয়েছিল:
কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণের আলোচনা!
শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য গলদঘর্ম নেতারা, দুনিয়ার
দেশে দেশে তৎপর রয়েছেন; বাক্-স্বাধীনতার পক্ষে
তাদের দৃঢ় অবস্থান— মুগ্ধ করছে আমাকে: অগ্নেয়াস্ত্রের মুখে
কুলুপ এঁটে দেয়াটা, একদমই, পছন্দ করেন না ওঁরা
মেশিন বলেই কি তার বাক্-স্বাধীনতা থাকবে না?
কবি
গোপন দীর্ঘশ্বাসও মহোত্তম কবিতা হতে পারে,
অস্বীকার করছি না; কিন্তু—
কবিকে দাঁড়াতে হবে বুক টান করে
রাজপথে
হত্যার নির্দেশের মুখোমুখি
যুদ্ধের ময়দানে
উৎপীড়ন, নৃশংসতা, নির্যাতন,
স্বপক্ষীয় হলেও
তার কোনও নিরপেক্ষতা নেই
আমতা আমতা নেই
প্রয়োজনে, নিজেরই বিপক্ষে
কবিকে দাঁড়াতে হবে, সরব—
তাকে, দাঁড়াতেই হবে— দলিত মানুষের পক্ষে
মেহগনি ফুল
হালকা বাতাসে ঝরছে মেহগনি ফুল
এ বসন্তে, তোমার মৃদুল
বাহু মনে পড়ে—
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের অম্বরে
আচমকা হাওয়ার ধুম—
ঘুমঘুম;
হাওয়া— মানে: বয়ে যাওয়া শুধু?
নাকি সেই গন্ধ-ইশারা
কিছু বলে যেতে চায়!
বসন্তে, বোশেখে যারা যারা
বিরহের পুষ্পক্ষেতে, মূর্ছিতপ্রায়,
শুয়ে থাকে, ধু ধু—
তাদের যন্ত্রণা পিয়ে, মশগুল
হয়ে থাকতে চাই—
শোনো, যত শত রাধা:
জুলেখা বা শিরি কিংবা রাই—
এ বসন্তে, ঝরে-পড়া মেহগনি ফুল
সংক্রামক, বিচ্ছেদীয়— ধাঁধা—
মহাজাগতিক
তারাগুলো পাখি; এবং
পাখির মতো স্থির।
বহুদূরের কম্পিত রং
আলোর শাদা ক্ষির
ঝরছে: দিনান্ধে ও রাতে;
গতি যদি মৌমাছি, তার
স্থিতি: মধুর চাকও;
দেহ এবং পরমাত্মার
দীর্ঘতর সাঁকো
গড়ছে: সন্দেহ-সংঘাতে;
মহাকাশের মহাজ্যোতি,
তারা: কল্পপাখি;
নম্রগ্রহের সকল ক্ষতি
সেই অসীমে ঢাকি—
অভিন্নতা
শহরের মধ্যে, এখানে ওখানে, তুমি দেখতে পেয়েছিলে:
নিজেরই ছেঁড়া চুল, ছিন্নবাহু, বিকৃত গ্রীবা,
থেঁতলে যাওয়া হৃৎপিণ্ডের খণ্ডিতাংশ— ছড়িয়ে আছে।
বলেছিলে, ‘অন্য কোনও সমুদ্র, বেলাভূমি, শহর
খুঁজে নেবে’; এবং নিয়েছিলেও—
এখানে, প্রতিমুহূর্তে, আমি আমার মৃত্যুকে দেখতে পাই:
কখনও নিজেরই ছায়া, কখনও প্রিয় শার্ট, মায়া লাগা
এক জোড়া পুরাতন জুতা, নিবিড় শয়নকক্ষ কিংবা
বিশ্রামের মাতৃ-আহ্বান হয়ে, সে আমাতে লেপ্টে থাকে—
তোমার বসবাসের নতুন শহরে, প্রতিটি ভোরবেলায়
মিশে যায় ত্যায্য সেই শহরের নারকীয় বাতাস—
প্রতিটি বিকেলের মধ্যে, হুড়মুড় ঢুকে পড়ে: পুরনোসব গল্প;
অভিনব কিছুই জোটে না আমাদের—
যেখানেই থাকো, যে দেশেই থাকি, তিলেতিলে অপচয় হচ্ছে:
আমাদেরই জীবনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। এখন তো,
তোমার ছেঁড়া চুলের পাশে, আমিও আমার
বিচ্ছিন্ন বাহু, কাঁধ ও কোমর দেখতে পাই—
বৃত্তবন্দি এই পৃথিবীর বাইরে, এখন আর কোথায় পালাবো আমরা?
আধোপূর্ণিমাতে
আজকে রাতের আধোপূর্ণিমাতে—
পুরনো হাত ছায়ার মত বেজে উঠলো হাতে,
ঘরের ভেতর লুকিয়ে পড়লো হাওয়া;
বলছি ওকে, ‘‘বেরিয়ে এসো মাঠে!’’
ঘরের আগুন বিপুল মেঘে ছাওয়া
বৃষ্টি এবং সমুদ্রঢেউ লাফাচ্ছে ওই— খাটে;
এবং আমার হাতের ছায়াহাত
খলখলিয়ে হাসছে, যেন মরুভূমির মেয়ে!
বালুঘঁষা ঝা-চিকচিক রূপার বাসন পেয়ে,
জ্যোৎস্না-পয়ার গাইছে সারারাত!
রাত্রিবেলায় গাছের হালকা ছায়া
পড়লো হঠাৎ সেই নটিনীর মুখে,
অম্নি, গাঢ় নীলের প্রাচীন কায়া,
ফুটলো আলোয়— এ মরু মুল্লকে;
ঘরের ভেতর লুকিয়ে কাঁদছে হাওয়া
বলছি ওকে, ‘‘বেরিয়ে এসো মাঠে!’’
ছিটিয়ে দাও হৃদয় এবং তোমার-আমার চাওয়া
অর্ধচাঁদের ঝিলিক মারা এ বালু তল্লাটে!