(একটি কাল্পনিক বিতর্ক ৷ যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :

প্লেটো (Plato, খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮-৩৪৮): গ্রিক দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী, পশ্চিমা দর্শনশাস্ত্রের জন্মদাতা, সক্রেটিসের প্রিয় ছাত্র, এবং এরিস্টটলের গুরু ৷ বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত, চিকিৎসা-শাস্ত্র; জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় ছিল তাঁর অবাধ অসংশয় বিচরণ ৷ প্লেটোর মৃত্যুর পরে দর্শনশাস্ত্রে যা কিছু ঘটেছে সবই নাকি তাঁর লেখা বইয়ের একটি ফুট-নোটের চেয়েও তুচ্ছ! তবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর প্রায় সব ধারণাই ভুল ছিল ৷

ডেমোক্রিটাস (Democritus, খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০): গ্রিক দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী ৷ জীবনের সব প্রতিকূলতার মাঝে তিনি আনন্দ খুঁজেছেন, তাই তিনি হাসি-দার্শনিক বলেও পরিচিত ৷ ডেমোক্রিটাস পদার্থের পরমাণু তত্ত্বের জন্মদাতা৷ তাঁর মতে মহাবিশ্ব পরমাণু এবং শূন্যতা দিয়ে তৈরী ৷ পরমাণু গোলাকার, কঠিন, নিশ্ছিদ্র ৷ পরমাণু চিরন্তন, ওদের গড়া যায় না, ভাঙাও যায় না ৷ পরমাণু এবং শূন্যতা বাস্তব (real), বাঁকি সবকিছু শুধুই মানুষের মতবাদ (opinion) ৷)


প্লেটো : এই মহাবিশ্বের সবকিছু কি দিয়ে তৈরী? আগুন, পানি, বায়ু, এবং মাটি দিয়ে ৷ পদার্থকে বারেবারে যতবার ইচ্ছে ভাঙা যায় ৷ মহাপন্ডিত সক্রেটিস থেকে শুরু করে আমার ছাত্র এরিস্টোটলের একই ধারণা ৷ কিন্তু এই ব্যাটা বুড়ো ডেমোক্রিটাস এবং ওর গুরু লুসিপ্পাস (Leucippus) যত সব ফালতু ধারণা প্রচার করে বেড়াচ্ছে ৷ ওদের কথা শুনলে হাসি পায় ৷ সাধে কি সবাই ডেমোক্রিটাসকে হাসি-দার্শনিক (laughing philosopher) বলে ডাকে! হা হা! পদার্থ নাকি পরমাণু এবং শূন্যতা দিয়ে তৈরী ৷ পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে সবশেষে নাকি পাওয়া যাবে পরমাণু যাকে আর ভাঙা যায় না! কেন? এমন বেকুব, বুড়ো বয়েসে চোখের মাথা খেয়ে বসে আছে ৷ এক টুকরা লোহার কথা ধরা যাক৷ ওর মাঝে ফাঁকা জায়গা কোথায়?

ডেমোক্রিটাস : আমার ধারণা এই পরমাণু হবে গোলাকার, কঠিন, নিশ্ছিদ্র, এবং অভেদ্য ৷ শুনেছি এরিস্টোটল এবং তুমি আমার লেখা বইগুলো পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলে ৷ ভালোই করেছিলে ৷ একেই বলে শাপে বর! তোমাদের অভিশাপে এথেন্সের বাজারে আমার বইয়ের কাটতি গেলো বেড়ে ৷ সবাই আমাকে এখন চেনে হাসি-দার্শনিক বলে ৷ “পারস্যের রাজত্বের চেয়ে সত্য উৎঘাটনের আনন্দ আমার কাছে বড় ৷” তাই জ্ঞানের অন্বেষণে ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রীস, রোম, আলেকজান্দ্রিয়া, এবং মিশরের পথে পথে ৷ মানুষের দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র, অপমান যা দেখেছি তা ভেবে কাঁদতে ইচ্ছে করে ৷ কিন্তু কেঁদে কি লাভ? তাই আমি সব সময় হাসি ৷ হা হা! এবারে পরমাণুর কথায় আসা যাক ৷ একটি চাকু দিয়ে আপেল কাটছো ৷ চাকুর ফলাটা আপেলের ভিতরে ঢোকে কি করে যদি না সেখানে ফাঁকা জায়গা থাকে? এক গ্লাসভর্তি পানির সাথে এক চামচ চিনি মেশালে চিনি গলে যায় কিন্তু পানির আয়তন একটুও বাড়ে না ৷ চিনি কোথায় হারিয়ে গেলো যদি না পানির ভিতরে ফাঁকা স্থান থাকে? এক টুকরা লোহাকে উত্তপ্ত করলে ওর আয়তন যায় বেড়ে ৷ কেমন করে? লোহার ভিতরে আরো ফাঁকা জায়গা জন্মালো, না কি আরো নতুন লোহা তৈরী হলো?

একেই বলে শাপে বর! তোমাদের অভিশাপে এথেন্সের বাজারে আমার বইয়ের কাটতি গেলো বেড়ে ৷ সবাই আমাকে এখন চেনে হাসি-দার্শনিক বলে ৷ “পারস্যের রাজত্বের চেয়ে সত্য উৎঘাটনের আনন্দ আমার কাছে বড় ৷” তাই জ্ঞানের অন্বেষণে ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রীস, রোম, আলেকজান্দ্রিয়া, এবং মিশরের পথে পথে ৷ মানুষের দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র, অপমান যা দেখেছি তা ভেবে কাঁদতে ইচ্ছে করে ৷ কিন্তু কেঁদে কি লাভ? তাই আমি সব সময় হাসি ৷ হা হা!

প্লেটো : “একটি বস্তুর অংশ যতই ছোট হোক, তা থেকে আরো ছোট অংশ বের করা যাবে ৷ কারণ, যত ছোটই হোক, যা আছে তা আর থাকবে না, এটা অসম্ভব ব্যাপার! তেমনি যাকে বড় বলছে, তারচেয়ে বড় থাকতেই হবে!” পরমাণু বলে কিছু থাকার কোনো সম্ভবনা নেই! তোমার কাল্পনিক পরমাণুর মতো আমার যুক্তিও নিশ্ছিদ্র, অভেদ্য ৷

ডেমোক্রিটাস : তোমাদের মতো দার্শনিকদের এই সব পেঁচানো যুক্তি সাধারণ মানুষ যত কম বোঝে, ভক্তি যায় ততই বেড়ে!

প্লেটো : আপেলের ভিতরে চাকুর ফলা সহজেই ঢুকে যায়, কিন্তু লোহার বেলা? একটি লোহার টুকরাকে চাকু দিয়ে কেটেছো কখনো?

ডেমোক্রিটাস : হ্যা, কেটেছি ৷ এক টুকরা লোহা বা স্বর্ণ উত্তপ্ত করলে এক সময় ওরা নরম হয়ে যাবে, তখন চাকু দিয়ে সহজেই ওদেরকে কাটা যাবে৷ তোমার কি ধারণা উত্তপ্ত লোহা আর লোহা নেই?

প্লেটো : আমি তো আগেই বলেছি সব কিছু তৈরী আগুন, বায়ু, পানি, এবং মাটি দিয়ে ৷ উত্তপ্ত লোহার মধ্যে আগুন এবং পানি ঢুকে পড়েছে তাই ওর গুণাবলী বদলে গেছে ৷ এবার তোমার পরমাণু তত্ত্ব দিয়ে লোহার গরম এবং নরম হয়ে যাওয়ার কারণটি বোঝাও দেখি ৷

ডেমোক্রিটাস : আমি জানি না ৷ নিজের অজ্ঞতা মেনে নিতে আমার কোনো সংকোচ নেই ৷ এ ব্যাপারে আমি তোমার গুরু সক্রেটিসের সাথে একমত, “একজন জ্ঞানী লোক জানে যে সে জানে না ৷ একজন মূর্খ লোক মনে করে সে সব কিছু জানে ৷” তবে আমার ধারণা পরমাণুগুলো একে ওপরের সাথে এক অদৃশ্য শিকল দিয়ে গাঁথা আছে ৷ লোহার বেলায় এই শিকলের টান আপেলের চেয়ে বেশি ৷ পরমাণুগুলো বস্তুর ফাঁকা স্থানে নড়াচড়া করতে পারে! উত্তপ্ত হলে শিকলের বাঁধন ঢিলা হয়ে শক্ত লোহা নরম হয়ে যায়, তখন চাকুর ফলা সহজেই ঢুকে পড়তে পারে ৷

প্লেটো : বস্তুর বিভিন্ন গুন আছে, যেমন স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ ৷ সব বস্তুই যদি পরমাণু দিয়ে তৈরী তবে পদার্থের এতো বৈচিত্র এলো কি ভাবে? আমার তত্ত্ব মতে সোনা চকচক করে কারণ ওর ভিতরে আগুনের পরিমান বেশি, তুলা হালকা কারণ ওর ভিতরে বায়ু বেশি, তেঁতুল টক কারণ ওর ভিতরে পানি আছে যার জ্যামিতি ত্রিকোণাকার ৷

ডেমোক্রিটাস : এর মাঝে আবার জ্যামিতি এলো কেমন করে? আমার মতে পদার্থের বৈচিত্র সৃষ্টি হয় পরমাণুদের বিন্যাস থেকে ৷ আমি আগেই বলেছি পরমাণু এবং শূন্যতাই বাস্তবতা, বাকি সব শুধুই মতামত (opinion), মানুষের সৃষ্টি৷ পদার্থের পরমাণু মানুষের চোখ, মুখ, ত্বক, কান, বা নাকের পরমাণুর সংস্পর্শে আসলে এই সব মতামতের সৃষ্টি হয় ৷ এই পৃথিবীতে মানুষ না থাকলে টক, মিষ্টি, ঝাল, কালো, সাদা, লাল বলে কিছু থাকতো না ৷ কিন্তু পরমাণু এবং শূন্যতা ঠিকই রাজত্ব করত৷ ওরা আদি, চিরন্তন, এবং খাঁটি ৷ স্বাদ, গন্ধ, বর্ণের অস্তিত্ব মানুষের অস্তিত্বের উপরে নির্ভর করে, মানুষের অস্তিত্ব নির্ভর করে পরমাণু এবং তাদের মাঝের ফাঁকা জায়গাটার উপরে ৷

প্লেটো : আর তোমার মতে এই সব পরমাণু একে অপরের সাথে অদৃশ্য শিকল দিয়ে গাঁথা, এদেরকে আর ভাঙা যায় না, এরা সেই না দেখা ফাঁকা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে বেড়ায় ৷ হা হা, হো হো, হে হাসি-দার্শনিক, হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যাথা হয়ে গেলো ৷

ডেমোক্রিটাস : যত খুশি হেসে নাও ৷ ভবিষ্যৎই বলে দিবে কে শেষ হাসি হাসবে, তুমি না আমি!

 

লেখক: পদার্থবিদ ও ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরিটাস প্রফেসর

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!