
আয়নাওয়ালা
অদ্ভুত সেই আয়নাওয়ালা যেদিন শহর ছেড়ে চলে গেল, সেদিন সাতশত পাখির পালক
রাস্তায় ঝরে পড়তে দেখেছিল লোক। বিদ্ঘুটে এক বিকট গোলাকার আয়না হাতে নিয়ে
যে অবলীলায় ঘুরে বেড়াত পথে পথে আর অকস্মাৎ সেটি মেলে ধরতো মানুষের মুখে।
আতঙ্কিত মানুষ আয়নায় তার বীভৎস মুখমন্ডল দেখে চিৎকার করে জ্ঞান হারাত।
সেই আয়নাওয়ালা বিদায় নিলে যারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল, তারা অবাক হয়ে দেখলো
জগতের সমস্ত আয়না থেকে তাদের প্রতিবিম্ব মুছে গেছে!
পদচিহ্ন
যেদিকে পদচিহ্ন, পাঁচটি আঙুল অথবা গোড়ালির
ছাপ জেগে আছে, সেদিকেই হেঁটে যাই দৃপ্ত পায়ে
মাঝে মাঝে শূন্যতার পায়ের আঙুল ফুটে ওঠে দৃশ্যজুড়ে
কিছুদূর পেরোলে মহীরূহ, কিছুটা দূরে ছায়ার মরু
ছোট ছোট পা বড় হয় ধীরে ধীরে
বিপরীত পথেও চোখ বুলোই এক নিমেষ
একই ঢঙের পদ কিংবা পাদুকার চিহ্ন বয়ে গেছে
দিগন্তের দিকে, পাতার জমজ শিশুরাও চুপচাপ
শুয়ে আছে পদচিহ্নের পা ধরে
বলেছিলে, পদচিহ্নে পা রেখে হেঁটে এসো
সাবলীল শরীরী ভাষায়, অগণন পদ আর পাদুকার
ভিড়ে তোমার নির্ভুল পদচিহ্ন কেবলই হারিয়ে ফেলি।
রাম ও রাবণ
শুভ’র মন ভালো নেই
অশুভ তার জামা পরে হাঁটছে দিগ্বিদিক
রাম নির্বাসনে
রাবণ চষে নাগরিক জমিন
আলো ঘুমিয়ে পড়েছে অবেলায়
অন্ধকার হাতে তুলে নেয় প্রগতির হারিকেন
স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখার অপরাধে গুম
দুঃস্বপ্ন পরেছে তার হারানো মুখোশ
সুসময় পলাতক বাছুরের খোঁজে নিরুদ্দেশ
দুঃসময় পায়ে পা তুলে সেজেছে রাজন…
সৃষ্টিগৃহ
লীন হয়ে থাকে সপ্তাকাশ আরশির ভাঁজে
প্রাচীন হরফে তাতে খুদিত অনাগত জন্মলিপি
প্রতিদিন ঈশ্বরের লিপিকর দক্ষ হাতে জুড়ে দেন আয়ুরেখা
কতটা প্রলম্বিত হলে নড়ে উঠবে জন্ম-পাথর
সৌরবিশ্বের অতিক্ষুদ্র এক ঘূর্ণমান গ্রহে
মাতৃজরায় যে পেয়ে যাবে ভ্রুণজন্ম!
ধ্যানী ঈশ্বর জপমন্ত্রে ভরে তোলেন সৃষ্টিগৃহ
অনাদি মৃত্তিকা খেলা করে তার ছান্দসিক করতলে
বাতাসের জৈবনিক ইতিবৃত্ত লেখা হতে থাকে জীবনের
দীঘল পৃষ্ঠাজুড়ে, কোনো এক কারুময় শিল্পীর অভিজ্ঞতা
রূপ পেতে থাকে জীবনার্থী পাথরের রূপান্তরশীল অস্তিত্বজুড়ে।
ধুলোর দুর্বোধ্য অক্ষরে
কিছুদুর গিয়ে পেছনে ফিরি আবার-
ফেলে আসা জন্মদাগ ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজি
কী লেখা তাতে ধুলোর দুর্বোধ্য অক্ষরে।
মনে হয় বুঝি পেয়ে গেছি হারিয়ে ফেলা সেই বিরল চাবি
জাগতিক সমস্ত তালা খুলে যাবে যার হিরণ্ময় স্পর্শে
হয়তো এখানেই লুকানো সৃষ্টির সেই অনিবার রহস্য
যার ইঙ্গিত পেয়ে ভাষা-ভোলা কাক কেবল কা কা
ডেকে যায় বিস্ময়বোধক সমূহ বৃক্ষের ডালে!
দূরত্ব
ভেবেছিলাম, ভাসমান পাখির মতো দূরে সরে
যেতে যেতে জ্যামিতিক বিন্দুতে স্থির হবে
আমাদের প্রণয়
আজ দেখি, তুমি সেই অক্ষয় আকাশ
যত দূরে যাই ততটাই জুড়ে আছো কেবল
দূরত্ব কিছু নয়।
চেয়েছিলাম, জ্বলন্ত মোমের মতো গলে গলে
শেষ হোক এই পরিণয়
চেয়ে দেখি, তুমি সেই অনড় ধ্রুবতারা
যতটা পোড়াই ততটাই জ্বলে ওঠো শুধু
বিন্দু থেকে বিশ্বময়…
পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামে
দিগন্তের দুয়ার খুলে গেলে দেখতে পাবো
তারাপোড়া ছাই উড়ছে হাওয়ায়
সূর্যের দারুণ দহনে নিদারুণ আকাশ বেদনায় নীল
অপমৃত্যুর অপমানে বিদেহী আত্মাদের মিছিল
আর জন্মের তুমুল আশঙ্কায় আতঙ্কিত সদ্যসৃষ্ট প্রাণ
কিছু দূরে প্রাচীন পৃথিবীর আভিজাত্যমুগ্ধ
মৃতদের কোলাহল, সভ্যতার বারুদে পোড়া মানবাত্মার
ক্রন্দনে ভারী আধুনিক দিগন্তসীমা
রক্তের হরফে ভালোবাসা লেখা নগ্ন চিরকুট
পড়ে আছে কবন্ধ চাঁদের সমতল বুকে
দ্বন্দ্বমুখর নক্ষত্ররা ধেয়ে আসছে মুখোমুখি
দেখবো, ধ্বংসের উৎসবে মেতে উঠছে সৌরবিশ্ব
জন্মান্ধ সূর্য নির্বাক তাকিয়ে পৃথিবীর পানে
তার বিস্ময়ের বিভায় পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামে।
বৃষ্টি অথবা তোমার চোখ
আজ বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা তোমার চোখের মতো
আমার দিকে তাকিয়ে ছিল
চোখ ফেরাতে গিয়েও বহুবার লেগে গেছে চোখ
দেখেছি কতটা অম্ল আর কতটা মধু মেশানো
সেই চাহনির রসায়নে
কিছুটা তির্যক আর কিছুটা সরল বিন্দু বিন্দু জল
কখনো গরল কখনোবা হয়ে ওঠে খল
দমকা হাওয়ায় ভর করে কতদূর থেকে
উড়ে আসে জলাতুর ভাষার স্ফটিক
অভিমানী পাতাদের নুয়ে পড়া দেখে দেখে
বুকের ভেতর জ্বলে ওঠা অনুভূতি ওমে
মোমের মতো গলছিল সব কথার শরীর …
মানুষ, তোমার দিকে
মানুষ, তোমার দিকে বাড়িয়েছি হাত
গোলাপ হত্যার পাপে কলুষিত নয়
এ হাতের একটি আঙুল
নিহত কোনো ভ্রুণের জন্মে
এ হাতের কারসাজি ছিল না কস্মিনকালে
ঘৃণার মন্ত্রসিদ্ধ ছোরায় ধার দিতে দিতে
ধেয়ে যায়নি এ হাত
অপাপবিদ্ধ বৃক্ষের দিকে
ভালোবাসার লবঙ্গ ছুঁয়ে
মানুষ তোমার দিকে বাড়িয়েছি হাত
এ হাতে রাখলে হাত
সমূহ রক্তের দাগ মুছে যাবে নিমিষেই
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা সহসা থেমে যাবে
একটিবার এ হাতে রাখো যদি মায়াময় হাত…