Author Picture

নেরুদার সঙ্গে নির্বাসিত জীবন

আন্দালিব রাশদী

মূল: মাতিলদে উরুটিয়া । অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী

[বিশ শতকের সর্বাধিক পঠিত কবি চিলির পাবলো নেরুদা (জন্ম ১২ জুলাই ১৯০৪—মৃত্যু ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩)। মাতিলদে উরুটিয়া (জন্ম ৩০ এপ্রিল ১৯১২—মৃত্যু ৫ জানুয়ারি ১৯৮৫)। পাবলো নেরুদার তৃতীয় স্ত্রী, দাপ্তরিকভাবে তাঁদের দাম্পত্যকাল ১৯৬৬ থেকে নেরুদার মৃত্যু পর্যন্ত। চিলির ডানপন্থী সরকারের হাতে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত পাবলো নেরুদা তখন দেশান্তরে। সেবিকা-গায়িকা মাতিলদের সঙ্গে নেরুদার প্রেম হয়ে ওঠে সেকালের অন্যতম গোপন কাহিনী। নেরুদাকে নিয়ে মাতিলদে উরুটিয়ার ‘মাই লাইফ উইথ পাবলো নেরুদা’র একাংশ অনূদিত হলো।]

 

আমি তৃতীয়বারের জন্য প্যারিস এসে পৌঁছলাম। আমার জন্য যে কেউ প্রতীক্ষা করবে না তা তো আমার জানাই আছে। আমি এসবের আর পরোয়া করি না। আমি অমূল্য সম্পদ বহন করে এনেছি, আমার পার্সবোঝাই সম্পদ, আমাকে নিয়ে লেখা পাবলোর আবেগময় কবিতা। আমি অগাধ ভালোবাসাকে আমার সঙ্গী করে এনেছি আর আছে নিয়নের স্মৃতি। সেই জাদুকরী শব্দ নিয়ন সম্পদের সিন্দুক খুলে দেয়। তাতে আছে হাসি, আবেগ, লেইক জেনেভা আর এর রাজহাঁস ও গাংচিল।

প্যারিসে আমি আর একবার আমার ছোট অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাই। এটা অনেকটা আমার নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মতো। যেখানে কেউ দু-এক রাত কাটিয়েছে, ঘুমিয়েছে, কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছে, সেখানে নিজের বাড়ির অনুভূতি পাওয়াটা কি অদ্ভুত ব্যাপার নয়? এক পাত্র কফি বানাবার জন্য আমি তখনই রান্নাঘরে ঢুকি। আমার তখন উৎফুল্ল মেজাজ, কফির কাপ নিয়ে আমি চিলেকোঠার জানালার সামনে বসি। কেন এমন হলো জানি না, আমার মেক্সিকোর অ্যাপার্টমেন্টের কথা মনে পড়ল। মেক্সিকোর একসময়ের শক্তিশালী স্মৃতি মিলিয়ে যেতে শুরু করল এবং এর গুরুত্ব কমে এলো। আমার হৃদয় চাইল এ স্মৃতি চিরদিনের মতো মুছে যাক, কারণ তা আমার বর্তমানের সুখময় জীবনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মনে হয় এখন একটি শক্তিশালী হাত আমার নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেদিন থেকে আগামীর দিনগুলোয় আমি কেবল পাবলো এবং আমার ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কিত যা কিছু আছে কেবল তা-ই গণ্য করব।

আমার বেলায় মেক্সিকো হবে বিস্মৃত সময়ের স্মৃতি। পাবলোর সঙ্গে যে শিগগির আমার আবার দেখা হবে এবং আমরা আবার একসঙ্গে বসবাস করতে পারব এই ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে আমি বেশ আয়েশের সঙ্গে প্যারিসে কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিলাম।

পাবলো আমাকে কয়েকজন বন্ধুর ঠিকানা দিয়েছে। আমি একমাত্র পল এলুয়ারের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি তার কবিতা পড়েছি, মেক্সিকোয় আমাদের দেখা হয়েছে। আমি তার কিছু মধুর স্মৃতি লালন করছি এবং তাকে আবারও দেখার জন্য আমার কৌতূহল রয়েছে। এক অপরাহ্ণে পল এলুয়ার এবং তার স্ত্রী ডোমেনিক আমাকে যেভাবে সাদরে গ্রহণ করলেন তা কখনো ভোলার নয়। তাদের ঘরের আরামদায়ক যে কোণটিতে আমরা বসি সেখানে ছিল ডিমলাইট, মনে হয় সুসংগঠিত একটি নৈরাজ্য, চারদিকে পেইন্টিং ঝোলানো। আমি যখন প্রথম এলাম, লক্ষ্য করলাম তারা গভীর কৌতূহল নিয়ে আমাকে দেখছেন। ডোমেনিক আমার বাকি জীবনের বন্ধু হয়ে ওঠে, তার সৌন্দর্যে চমক আছে; লম্বা, শানিত মুখাবয়বের পল এলুয়ার মুগ্ধ করার মতো হ্যান্ডসাম পুরুষ, তার নীল চোখের মধ্য দিয়ে পল প্রকাশিত। সেই নীল আমি তারপর আর কোথাও দেখিনি। তার শারীরিক সৌন্দর্যের বাইরে পল একজন মার্জিত, উষ্ণ হাসির স্বাগত জানানো মানুষ। তার সদয় চোখ যা কিছু দেখছে তার জন্যই দয়ার্দ্র হয়ে পড়ছে।

পাবলো কেমন আছে তাদের জানাই এবং বলি ফ্রান্স সরকারের বহিষ্কারাদেশের কারণে তার পক্ষে প্যারিস আসা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতি তদের জানা, পল বলল, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। পল পাবলো সম্পর্কে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে, অসংখ্য বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে চাইছে যেন পল বড় ভাই হিসেবে ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করছেন। আমি একান্তভাবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি, মিথ্যা না বলে এবং কোনো ধরনের লুকোচুরি না করে কেবল আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পেরেছি।

পাবলোর ট্রেন স্টেশনে এলো, এত মানুষ যে ভিতরে ঢোকাই কষ্টকর। একদম বোঝাই। আমি কখনো ভাবিনি পাবলোকে অভিবাদন জানাতে এত মানুষ স্টেশনে আসবে, কিন্তু তা-ই হয়েছে।
আমি ভিড় ঠেলে পথ করে লাগেজ কার্ট ঠেলতে থাকা এক তরুণকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে এত মানুষ কেন?’
উত্তেজিতভাবে সে বলল, ‘একজন কবি আসবেন, একজন কবি আসবেন।’

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা পুরনো বন্ধুর মতো স্বচ্ছন্দে কথা বলতে শুরু করি। আমি তাদের বার্লিন ফেস্টিভাল এবং মেক্সিকোর কথা বলি। ডোমেনিক জানতে চায় আমি শিগগির সেখানে ফিরে যাচ্ছি কিনা। আমি বলিে— আমি আগে রোম যাচ্ছি, সেখানে আমার প্রিয় মেক্সিকান বন্ধুরা আছে, সেখানে সম্ভবত পাবলোর সঙ্গেও আমার দেখা হয়ে যাবে; কটা দিন কাটাতে পাবলো এখন ইতালিতে। আমার কথায় তারা পরস্পর চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন, আমি ভাবলাম তারা কি আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটি জেনে ফেলেছেন? শেষে মনে হয়েছে তারা কি জেনেছেন বা জানেননি তা আমার না জানাই ভালো।

প্যারিসে বসবাসকারী চিলির ক’জন বন্ধুর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে যাই। নেমেসিও আন্তনেজ এবং তার স্ত্রী ইনেস ফিগারোয়া এক বিকালে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি নেমেসিওর স্টুডিওর ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখলাম তার কাজের টেবিলে কিছু পচা মাছ।
‘মাছ?’ আমি ইনেসকে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘নেমেসিও এগুলোকে রং করছে।’ যেন এগুলোই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাকৃতিক বস্তু।
আমি একটু একটু করে এগোচ্ছি, এ এক পৃথিবী— কত কিছু যে দেখার আছে আর কত বিস্ময়!

অধৈর্য আমার ভালো দিকটাকে হরণ করতে শুরু করেছে—  কয়েকদিন পর কোনো কিছুই আর আমি উপভোগ করতে পারছিলাম না। আমি সবকিছুই দ্রুত গতিতে করতে থাকি। আমি একটু হাঁটাহাঁটি করব, কিন্তু আমি এত দ্রুত হাঁটি যে সামান্য পথ গিয়েই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। গিয়েই বলছি আমি আসি, বিদায়, যেন আমাকে জরুরি কাজে ছুটতে হবে। আমি রাতে ঘুমাতে পারছি না।
আমি রোমের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, যেখানে পাবলোর জন্য প্রতীক্ষায় থাকব। আমি আমার মেক্সিকান বন্ধুদের ডেকে আমার পরিবর্তিত পরিকল্পনার কথা জানালাম। তাদের কোনো পান্থশালায় আমার জন্য বন্দোবস্ত করতে পারবে কিনা জানতে চাইলাম। আমি সেই প্রিয় বন্ধুদের সান্নিধ্য লাভের আশায় আছি।

স্টেশনে গেলাম, আসার সময় স্যুটকেস যত না ভারী ছিল এখন তার চেয়ে অনেক বেশি ভারী। আমাদের ঘর সাজানোর জন্য প্যারিস থেকে অনেক কিছু কিনেছি— কিন্তু কখন কোথায় যে আমরা একত্রে বসবাস করতে পারব আমার কোনো ধারণাই নেই। আমি কতগুলো সুন্দর কাপ কিনেছি, গোলাপি টি-পট, পাখি আঁকা কটা ডিশ। আমি জানি পাবলো এগুলোতে খুশি হবে।

রোমে পৌঁছলাম, দেখলাম বন্ধুরা সত্যিই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা খুব আমোদে আছে। হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়ে তারা আমাকে এই পান্থশালার মালিকের পরিচয় দিল। ভদ্রমহিলার নাম ব্যামবোলা। বিশালদেহী, গোলাকার মিষ্টি স্বভাবের এই মহিলা আমাকে সস্নেহে গ্রহণ করলেন। তিনি বললন, তোমার সম্মানে আজ রাতে আমাদের স্পেশাল ডিনার হবে। আমরা মোৎজারেলা সালাদ এবং রিসোতো আলা মিলানিজ খাব।

পান্থশালার অতিথিদের নিয়ে আমরা বড় টেবিলে খেতে বসি। ব্যামবোলা বসেন হেড টেবিলে এবং সবার মায়ের ভূমিকা পালন করতে থাকেন, সবার প্লেটে প্রচুর খাবার বেড়ে দেন। সবাই কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। প্যারিসে অনেক নিঃসঙ্গ দিনের ভোগান্তি সইবার পর শেষ পর্যন্ত আমি আনন্দসঙ্গী পাচ্ছি। মেক্সিকান বন্ধুদের সান্নিধ্য আমাকে সরল আনন্দের সেই বেপরোয়া জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তাদের একজন ডোরা বলে, ‘আমরা একটি পার্টি দিই না কেন, মাতিলদে রাঁধবে তার বিশেষ খাবার সে ছাড়া অন্য কেউ রাঁধতে জানে না, আমরা রাঁধব মেক্সিকান খাবার। আমরা টার্কি কিনে আনতে পারি, আর তারপর বানাব মোল সস।’ ডোরা যে খাবারের কথা বলছে সে সম্পর্কে ইতালিয়ানদের কোনো ধারণাই নেই। তাদের কাছে সবই অভিনব মনে হচ্ছে। আমরা সুস্বাদু রিসোতো খেলাম, চিজ ও ওয়াইন, সঙ্গে মুরগি দিয়ে রান্না করা ভাত এই রিসোতো।

আমার বন্ধুরা সবকিছু নিয়ে পরিহাস করতে পছন্দ করে। বলল, আগের রাতে চিকেন রোস্ট খাওয়ার পর আজ খাচ্ছি রিসোতো আলা মিলনিজ— সবই আমার ভাগ্যের কারণে— আমি লাকি। খুব আনন্দের খাবার। পরে আমি যখন রুমে ফিরে এলাম পাবলোকে মিস করতে শুরু করলাম। কখন সে এসে পৌঁছবে? আমি জানি এখনই তার ফোন বেজে উঠবে, আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাব; তারপর আমরা এ রকম স্বাগত জানানো প্রাণবন্ত মানুষে ভরপুর শহরে অভিযানে নামব।

রোমে আমি অনেক স্বস্তিবোধ করছি। পান্থনিবাসটি পিয়াৎজা দেল পপোলোতে; সেখানে প্রাণবন্ত কর্মচাঞ্চল্য, অনেক কাফে, অনেক ব্যবসা। বিশাল মনে হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিন কফি খেতে যাই, আমাদের অনেক কিছু ধরার আছে, স্মরণ করার আছে— আমরা মেক্সিকোর অনেক কথা বলি। আমার বন্ধুদের চেয়ে আমি বেশি মেক্সিকান। আমি মেক্সিকোর সবই জানতে চেষ্টা করেছি— এর রীতিনীতির, আমার মেক্সিকোর বিশাল জাঁকজমক— অন্য কোনো দেশে এমন নেই। বহু বিচিত্র মানুষ, সবাই জাতীয় অহংকার ভাগ করছে, প্রায় সবাই দেশজ অতীতের সঙ্গে নিজেদের একটি যোগসূত্র দাবি করে চলেছে। আমি এর প্রশংসা করি, কারণ আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি যেখানে আদিবাসীদের প্রতি ঘৃণা লালন করা হয়।

my life with PABLO NERUDA – matilde urrutia

শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত দিনটি এলো। টেলিফোন বাজল, পাবলোর কণ্ঠ। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সবকিছুই হঠাৎ আগের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক প্রাণবন্ত, অনেক আনন্দময় হয়ে উঠল। বিকালে সে আমার জন্য আসবে। সারা দিন আমি খুব নার্ভাস ছিলাম। আমার গোপন এই রোমাঞ্চের কথা যে বন্ধুটি জানত, আমাকে টিটকারী দিতে শুরু করল। আমি একটার পর একটা পোশাক বদলে যাচ্ছি, সঙ্গে যোগ করছি নেকলেস, তারপর বো-টাই। কিন্তু এসবের কোনোটাই আমার পছন্দ হচ্ছে না। সময় হয়ে গেছে, তখনো আমার সাজগোজ শেষ হয়নি। যখন দরজায় বেল বাজল, হাতে যা ছিল ছুড়ে ফেলে, এমনকি চুলও না আঁচড়ে আমি তাকে অভিবাদন জানাতে গেলাম। আমাকে দেখাচ্ছে বিভ্রান্ত হৃদয়, আওলা লাগা মস্তিষ্কের টিনএজারের মতো।

একটি ছোট পুষ্পস্তবক নিয়ে পাবলো সেখানে দাঁড়িয়ে। পাবলো আমার দিকে তাকায়, মুখে হাসি, আমার হাতে ফুল তুলে দেয়। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বন্ধুদের চোখ তার ওপর। পাবলো এবং আমি হাত আঁকড়ে ধরি, শহরের দিকে বেরিয়ে যাই। আবারও পৃথিবী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কেবল আমরা দুজন আমাদের মহাবিশ্বে।

অনেক রাত করে ফিরে আসি। বন্ধুরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, জিজ্ঞাসা করল, ‘পরিচয় করিয়ে দিলে না কেন?’
আমি সততার সঙ্গে বললাম, ‘সম্পূর্ণ ভুলে গেছি, তখন এটা মাথায় আসবে এটাই মনে করছ কেন?’
তারা বালিশ দিয়ে আমাকে আঘাত করে যার যার রুমে ফিরে গেল। সে রাতে রুমে আমি একাই ছিলাম, কিন্তু পাবলোর উপস্থিতি অনুভব করেছি। প্রতিটি দিন সে আমার জন্য এসেছে, আমরা রোমের রাস্তায়, জাদুঘরে, ক্যাথিড্রালে আর কাফেতেও ঘুরে বেড়িয়েছি। তৃতীয় দিন পাবলো বলল, ‘একজন মানুষ আমাদের সব জায়গায় অনুসরণ করছে। চল তাকে নিয়ে একটু মজা করি, চল তাকে এড়ানোর পথ খুঁজি।’

কেউ আমাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করছে, এ রকম একটি ধারণা আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন— একজন মানুষ কেন এত সময় নষ্ট করবে, কী কারণে? আমাদের অনুসরণ করে আবিষ্কার করার মতো বিশেষ গোপনীয় কিছু নেই : আমি এবং পাবলো, প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে একবার চুমো খাচ্ছি। কিন্তু বুঝতে পারছি আমিও পাবলোর মতো তাড়া করে বেড়ানো মানুষ হয়ে উঠছি— আর বাকি জীবন এটা থেকেই যাবে।

শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আমাদের তেমন খাটাতে পারেনি। রোমে আমরা আউটডোর কাফেতে খোলামেলাভাবে বসেছি, আমাদের প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলেছি, লাখ লাখ বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, নিঃশব্দে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থেকেছি, কোনো শব্দ বিনিময় না করে কত কিছু যে বলে গেছি!

সবকিছুতেই পাবলোকে হাসানোর ক্ষমতা আমার ছিল। এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই আমি অবাক হই আমরা কী নিয়ে এত হাসাহাসি করতাম? কে জানে।
নতুনভাবে অনুপ্রবেশ করে সুখ আমাকে ছেয়ে ফেলেছে, আমি তা আমার মাংসপেশিতে, আমার ত্বকে অনুভব করছি। বেঁচে থাকার জন্য আমি কেবল তার ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছুই চাইনি, কিন্তু আমি কোনো কিছুই প্রত্যাখ্যান করিনি। সামনে যা-ই থাকুক আমার জীবন এখন যে পথে এগোচ্ছে— এ পথে আমার আর সন্দিহান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমার ভবিষ্যৎ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে : আমাদের আর কখনো বিচ্ছেদ ঘটবে না।

এমন স্বাগত স্থান রোমে বেশ কদিন কাটানোর পরও, নিজেদের অনেক সুখ প্রত্যক্ষ করার পরও কোত্থেকে আমরা আশ্রয়ের সূচনা করব সে সম্পর্কে আমাদের কখনো কোনো ধারণা নেই। আমরা কাছাকাছি একটি দ্বীপের কথা ভাবলাম। তারপর পাবলো তার ন্যাপলসবাসী বন্ধুদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল, আমরা কোথায় থাকতে পারি সে আলোচনাও করবে তাদের সঙ্গে।

যেদিন পাবলো রোম ছেড়ে গেল সব সংবাদপত্রে খবর বেরোল : পাবলো নেরুদাকে ইতালি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সেই সন্ধ্যায়ই পাবলোর রোমে ফিরে আসার কথা। আমি পাবলোর ইতালিয়ান বন্ধু রেনাতো গুত্তোসোকে ফোন করে জানতে চাইলাম ন্যাপলস থেকে আসা ট্রেন কখন রোম পৌঁছবে। রেনাতো সেসব হাতে গোনা বন্ধু কজনের একজন, আমাদের সম্পর্কটি যার জানা।

পাবলোর ট্রেন স্টেশনে এলো, এত মানুষ যে ভিতরে ঢোকাই কষ্টকর। একদম বোঝাই। আমি কখনো ভাবিনি পাবলোকে অভিবাদন জানাতে এত মানুষ স্টেশনে আসবে, কিন্তু তা-ই হয়েছে।
আমি ভিড় ঠেলে পথ করে লাগেজ কার্ট ঠেলতে থাকা এক তরুণকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে এত মানুষ কেন?’
উত্তেজিতভাবে সে বলল, ‘একজন কবি আসবেন, একজন কবি আসবেন।’
আমি হতবাক হই, আমি ভাবতে পারছি না এত অল্প সময়ের মধ্যে এত মানুষ কেমন করে একত্রিত হলো। অনেক চেষ্টা করে আমি প্ল্যাটফরম পর্যন্ত পৌঁছি। রেনাতো গুত্তোসো আমাকে দেখতে পেয়ে সতর্ক করে দিল—  ‘একটু দূরে থেকো, যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। পাবলো ট্রেন থেকে না নামা পর্যন্ত কাছে যাবে না।’

শিগগির ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। মানুষের মিছিল চিৎকার করছে, গান গাইছে— আমি থ হয়ে আছি। আমি কোচের জানালায় পাবলোর বাহু দেখতে পাই; পাবলো ট্রেন থেকে নেমে আসে। তাকে ঘিরে ধরে সাদা পোশাকের পুলিশ। আমি তার দিকে এগোতে থাকি। আমাকে দেখে পাবলোর মুখে হাসি— যেন আমাকে বলছে, ‘এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠো। এটাই আমার জীবন।’
তার হাতে ছিল পুষ্পস্তবক। তারপর জনতা যেভাবে তার দিকে ছুটে তাকে রক্ষা করার জন্য মানবপ্রাচীর তৈরি করে ঘিরে রাখে আন্ডারকাভার পুলিশ— আমি তাকে আর দেখতে পাচ্ছি না। পাবলো হয়তো বন্ধুদের ঘেরের ভিতর, সাদা পোশাকের পুলিশের সমর্থনে আরও পুলিশ আসে, এরা পূর্ণ ইউনিফর্মে। এরপর যা দেখি— দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে, নারী ও পুরুষ পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তাদের হোঁচট খাওয়াচ্ছে নাক ভাঙছে— এ এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। এর মধ্যে লেখিকা এলসা মোরানতে আছেন, উৎসাহের সঙ্গে তিনি তার সুন্দর ছাতা উঁচিয়ে ধরে রেখেছেন।

আমি শেষ পর্যন্ত আবার পাবলোর কাছে পৌঁছি। দুজন সিনেটর, কিছু বন্ধু, কজন পুলিশ অফিসার পাবলোর গ্রেফতার নিয়ে দরকষাকষি করতে রেল স্টেশনে একটি অফিসে ঢুকেছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাতভর্তি ফুল। মানুষ পাবলোর জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ গান গাইছে, কেউ হাসছে, কেউ পুলিশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে, গালাগাল দিচ্ছে। আর আমি সদ্য খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসা আতঙ্কিত মুরগির বাচ্চার মতো বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি— যাকে অভিজ্ঞতা নিতে হবে প্রাণে পরিপূর্ণ পৃথিবীর আঘাত ও সংগ্রামের এবং সেসব মানুষের যারা তাদের জীবনের বাইরে আরও বড় এবং আরও ভালো কিছুর কথা ভাবেন।

আমি শেষ পর্যন্ত আবার পাবলোর কাছে পৌঁছি। দুজন সিনেটর, কিছু বন্ধু, কজন পুলিশ অফিসার পাবলোর গ্রেফতার নিয়ে দরকষাকষি করতে রেল স্টেশনে একটি অফিসে ঢুকেছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাতভর্তি ফুল। মানুষ পাবলোর জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ গান গাইছে, কেউ হাসছে, কেউ পুলিশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে, গালাগাল দিচ্ছে। আর আমি সদ্য খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসা আতঙ্কিত মুরগির বাচ্চার মতো বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি— যাকে অভিজ্ঞতা নিতে হবে প্রাণে পরিপূর্ণ পৃথিবীর আঘাত ও সংগ্রামের এবং সেসব মানুষের যারা তাদের জীবনের বাইরে আরও বড় এবং আরও ভালো কিছুর কথা ভাবেন। পুলিশের সঙ্গে এই খণ্ডযুদ্ধে তারা বিভিন্ন বিষয়ে ঝুঁকি নিচ্ছেন যা আগে হলে আমার বিবেচনাতেই আসত না। আমি বুঝতে পারি কেবল পাবলোর ইতালিতে থাকার অধিকার নিয়েই তারা লড়ছেন না, ইতালিতে কোনো অপরাধ করেননি এমন লেখককে সরকার বহিষ্কার করতে পারে— এমন ধারণার বিরুদ্ধে লড়ছেন, যে লেখক নিজ দেশে স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে এসেছেন তার বহিষ্কারের বিরুদ্ধে লড়বেন। এটা ছিল অবিচার ও সারা পৃথিবীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই।

বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ সময় পার করে সিনেটর আবির্ভূত হয়ে ঘোষণা করলেন পাবলোকে নির্বাসিত করা হবে না। স্টেশনে আবেগের বন্যা বয়ে গেল, প্রত্যেকেই গান গাইছে, কোলাকুলি করছে। আমিও খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আমি সবকিছুর দিকে এমন বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছি যেন গতকাল আমার জন্ম হয়েছে। তারা ভিন্ন একটি দরজা দিয়ে পাবলোকে বের করে নিয়ে যায় যাতে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কণ্ঠে আনন্দের ধ্বনি নিয়ে সিনেটর জনতার সঙ্গে কথা বলে যদিও তার ভাঙা নাক ক্রমেই ফুলে উঠছিল।

গুত্তোসো আমার কাছে এসে বলল, পাবলো ইঙ্গহিলটেরা হোটেলে যাচ্ছে, সেখান থেকে আমাকে ফোন করবে। আমি আমার পান্থনিবাসে ফিরে আসি। আমি যা কিছু দেখে এসেছি সব আমার মাথায় গিজগিজ করছে। কী হয়েছে সে কথা যখন আমার বন্ধুদের বলছিলাম, ডোরা রেগে গিয়ে বলল, ‘আমাকে নিলে না কেন, তাহলে আমার জুতো দিয়ে পুলিশকে আঘাত করতাম’।

সে রাতে পাবলো ফোন করল। বলল, হোটেল ছেড়ে দিয়েছে কারণ তার বন্ধুরা জানিয়েছে সেখানে একা থাকা তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তারা তাকে সতর্ক করেছে, তারা তোমাকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে সীমান্তে ছেড়ে আসবে, তারপর তোমার কী হবে তা জানার মতো কেউ তোমার আশপাশে থাকবে না। কাজেই সে কোনো একজন সিনেটরের বাড়ি চলে গেছে, সেখানে বরং নিরাপদে থাকবে। কাতর হয়ে বলল, পরদিন আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। ‘সকাল সকাল আসবে, আমি তোমাকে দেখতে চাই।’

আমি বলি, এটা কোনো উত্তম পরিকল্পনা নয়, তবে যেভাবেই হোক আমি তার কথামতো কাজ করব। তাকে মনে হলো দুশ্চিন্তামুক্ত; হেসে উঠে বলল, ‘এখন সব ঝামেলা শেষ, আমরা ইতালিতে থাকতে পারব।’
সংবাদপত্র চিলির কবি সম্পর্কে খবরটি ছেপেই চলেছে, চিলির কবিকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ইতালি ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি ১৯৫১-তে প্রকাশিত সেই খবরের ক্লিপিংস এখনো আমার কাছে আছে। পরদিনই সংবাদপত্র লিখছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে পাবলো নেরুদাকে বহিষ্কার করার কোনো যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পায়নি, তিনি ইতালিতে থাকতে পারেন। আমরা খুশি হলাম, আমরা এখন রোম ঘুরে দেখার জন্য মুক্ত।

আমাদের বিজয় উদযাপনের জন্য পরদিন আমরা মিলিত হলাম। আমরা যখন হাঁটছি পাবলো হঠাৎ একটি পোষা প্রাণীর দোআনের জানালার সামনে থমকে দাঁড়াল। একটি মূল্যবান কুকুরছানা গভীর নিদ্রায়। ছোট, বাদামি দাগের সাদা কুকুরছানা। পাবলো যখন জানালায় টোকা দিল, জেগে উঠল, ঘুম ঘুম চোখে আমাদের দিকে তাকাল, চেষ্টা করে দাঁড়াল এবং হাঁটল। আমরা দোকানের ভিতর গেলাম এবং আমাদের কুকুর নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমরা তার নাম রাখলাম ‘নিয়ন’, তাকে নিয়ে আমার পান্থশালায় উঠলাম। অল্প সময়েই সে আমার বন্ধুদের মন জয় করে নিল।

আরভিন সেরিও নামের একজন লেখকের কথা শুনেছি, ক্যাপ্রিতে থাকেন। ইতালির সরকার নেরুদার সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাতে এই লেখক অসন্তুষ্ট বলে মনে হয়েছে। তিনি ক্যাপ্রিতে তার বাড়িতে নেরুদা ও তার স্ত্রীকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। চিলির প্রাদেশিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা ভাবছিলাম কবি যাকে নিয়ে সেখানে হাজির হবেন সে তার স্ত্রী নয়, মাতিলদে নামের একজন নারী, তখন তিনি কী ভাববেন? আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আগে সত্যটা আমরা তাকে খুলে বলব, তারপর আশা করতে থাকব যে ভাগ্য আমাদের প্রতি প্রসন্ন হবে।

আমরা সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম— আমরা রোম থেকে পৃথকভাবে রওনা হব, তারপর ন্যাপলসে আমাদের দেখা হবে। সেখান থেকে পাবলো সেরিওকে ফোন করবে এবং বলবে এখানে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেছে, তাই আমাকে নিয়েই আসছে।

সে রাতে পাবলো ফোন করল। বলল, হোটেল ছেড়ে দিয়েছে কারণ তার বন্ধুরা জানিয়েছে সেখানে একা থাকা তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তারা তাকে সতর্ক করেছে, তারা তোমাকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে সীমান্তে ছেড়ে আসবে, তারপর তোমার কী হবে তা জানার মতো কেউ তোমার আশপাশে থাকবে না।

পাবলো ন্যাপলস রওনা হয়ে গেল। আমি রোমে আমার শেষ উদ্বিগ্ন সময় কাটালাম। আমি এক অজানা ভূখণ্ডে যাত্রা করতে যাচ্ছি। আমার অনেক কিছু শেখার আছে। আমার বেলায় পুরো ব্যাপারটাই এতটা নতুন যে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। নিয়নে আমরা যেমন একত্রে থেকেছি, এখানেও তাই করব— কিন্তু তা হবে বেশ ক’মাসের অবস্থান। সবকিছুর ওপরে এখন পাবলোকে তার নিজের কাজে নিবেদিত হতে হবে। আমার নিজের অহংকার এক পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। তা করার সামর্থ্য কি আমার আছে? পাবলোর সঙ্গে আমার এই সম্পর্কের জন্য আমাকে যে সবকিছু বিসর্জন দিতে হবে। আতঙ্কিত অনুভূতি নিয়ে বুঝতে পারছি আমার একটি অংশ এখনো দেয়ালের পেছনে আমার স্বাধীনতা ও আমার স্বতন্ত্র পরিস্থিতির জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আমি নিজের ভিতর আবিষ্কার করছি মহান আবেগময় ভালোবাসা যা আমাকে অবিরাম পাবলোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু পাবলো আমার জন্য যে তীব্র ও শক্তিশালী ভালোবাসা দেখিয়ে যাচ্ছে আমার কি তার জবাব দেওয়ার সামর্থ্য আছে? সুন্দর ও সংবেদনশীল সম্পর্কে আমাদের আবদ্ধ থাকতে হবে।
আমার স্যুটকেস গোছানোর সময় আমার ছোট কুকুরটিকে পাশে নিয়ে কেবল ভেবেছি আর ভেবেছি, নিয়ন ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি নিয়নকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেরিও যদি আমাদের তার বাড়িতে থাকতে না দেয় তাহলে? তখন আমরা কী করব?’ নিয়ন ঘরঘর শব্দের একটা কিছু বলল, আমি হেসে উঠলাম। ভাবলাম, সবচেয়ে ভালো ঘুমিয়ে পড়া।

ন্যাপলসে পাবলো সম্ভবত আমার কথা ভাবছে। আমি ভাবছি তার মনও কি আমার মতো চিন্তায় বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে?
ভোর হলো। সুন্দর রৌদ্রস্নাত সকাল। রাতেই মিলিয়ে গেছে আমার উদ্বেগ। আমি পান্থশালার কোলাহলে যোগ দিই। আমার বন্ধুরা আবার আমাকে নিয়ে ঠাট্টা শুরু করেছে। তাদের কজন আমাকে স্টেশনে নিয়ে এলো। চেঁচিয়ে স্কার্ফ উড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাল যেন তারা আমার বর্ধিত পরিবারেরই অংশ। আমি গৌরবের সাগরে সাঁতার কাটছি। আমার জীবনে আমি এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারি? আমার ছোট্ট কুকুর কুণ্ডলি পাকিয়ে আমার বুকের ওপর শুয়ে আছে।

রোম থেকে ন্যাপলসের ট্রিপটা মনে হয় অনেক দীর্ঘ। আমি শিগগির পৌঁছার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছি। আমাদের বন্ধু সারাহ অ্যালিসাটা স্টেশনে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। বুদ্ধিমতী, সুন্দরী, আনন্দময়ী এই মেয়েটি সময় গড়ালে যতটা না বন্ধু তার চেয়ে বেশি বোন হয়ে উঠল। সারাহ আমাকে আলিঙ্গন করে বলল, ‘তুমি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। পাবলো অসহ্য হয়ে উঠেছে। গতরাতে আমাকে বলেছে, মাতিলদে যদি না আসে তাহলে কী হবে? পাবলো এ দুশ্চিন্তার মধ্যেই আটকে আছে, সে যে আমাকে কতটা ভোগাচ্ছে তুমি ভাবতেই পারবে না। আমিও ভাবছিলাম মাতিলদে যদি না আসে তাহলে পাবলোকে নিয়ে কী করব? সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু একই সঙ্গে খুব ঈর্ষাপরায়ণ ও আতঙ্কগ্রস্ত যে তুমি তার জীবন থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যেতে পারো যেমন তুমি অনেকবার আগেও করেছ।’
আমি সারাহর দিকে তাকিয়ে হাসি, বলি, ‘জীবন আমাদের এক জায়গায় নিয়ে এসেছে, এবার মনে হচ্ছে তা চিরদিনের জন্য। অন্তত আমি তা-ই মনে করি— আমি পাবলোকে যেভাবে চিনি এখন মনে হচ্ছে আগে যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তির কথা ভাবতেও পারছি না।’ আমি এখন ভিন্ন এক নারী।

আমরা একটি ছোট উপসাগরের দিকে এগোই। এখান থেকে পাবলো ও আমি ক্যাপ্রিতে পারাপারের জন্য নৌকা ধরব। পাবলো সেখানে অপেক্ষা করছিল, তাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। আমি শিগগিরই তার বাহুতে আলিঙ্গনে বাঁধা হয়ে যাই, তার প্রেমে মত্ত। সেরিওকে নিয়ে আমার প্রথম প্রশ্ন : ‘সে কী বলেছে? আমাকে গ্রহণ করবে?’
পাবলো হেসে উঠে বলল, ‘আমরা এতটা প্রাদেশিক ভাবনার মধ্যে আছি। আমি যখন তাকে বললাম, আমার স্ত্রী নয় এমন একজন নারীকে নিয়ে আমি আসছি, সে বরং আরো উদ্দীপিত হলো, বলল, দারুণ শোনাচ্ছে, বিয়ে মানুষকে কেবল ঝগড়ার দিকে ঠেলে দেয়। সে আমাকে আরও বলেছে তার বাড়িতে তোমার জন্য পুষ্পস্তবক অপেক্ষা করছে।’

সারাহ আমাদের নৌযাত্রার বন্দোবস্ত করল। আমাদের নৌকা ছেড়ে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরও দেখি সারাহ তার রুমাল উড়িয়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছে। আমরা পরস্পর চাপাচাপি করে বসি, নিঃশব্দে হাত ধরে রাখি, আমাদের অন্তরঙ্গ সুখ উপভোগ করতে থাকি। বিকালের আকাশ রং বদলাচ্ছে সংবেদনশীল নীলের সমারোহ গোলাপির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে— আমরা এতই আচ্ছন্ন হয়ে দেখছি ঠান্ডা টের পাচ্ছি না। আমি চাই, এই মুহূর্তটি যদি চিরদিন থাকত।

আমরা দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে থাকি, আমরা যে জাদুতে আচ্ছন্ন তার ঘোর কাটাতে চাচ্ছি না। এভাবেই আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের একটি অধ্যায় শুরু হয়।

আরো পড়তে পারেন

নিজেকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ হয়ে ওঠার সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না: হারুকি মুরাকামি

তখনো শহরের ষড়যন্ত্রে পা দেয়নি গ্রাম, মানুষের মনের দখল মানবতার কাছেই ছিল। সেই বিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধি হারুকি মুরাকামি আধুনিক জাপানি সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় লেখক। তার রচনাগুলো শুধু জাপান নয়, বরং সারা বিশ্বের পাঠকদের মন জয় করেছে। তার লেখার অনন্য শৈলী, গভীর চরিত্র বিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার সঙ্গে অলৌকিকতার মিশ্রণে গড়ে ওঠা গল্পগুলো তাকে বিশ্ব….

ক্যালিডোনিয়া বুকস নামে একটি দোকানে আমার সমস্ত টাকা খরচ করতাম: স্টুয়ার্ট মারডক

স্টুয়ার্ট মারডকের লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় ঠিক যেন পাশে বসে কেউ কথাগুলো বলছেন। বিদ্যায়তনিক গাম্ভীর্য সরিয়ে রেখে পাঠকের সঙ্গে এই লেখক যেন একেবারে ব্যক্তিগত আলাপন রচনা করেছেন। স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি, মন্তব্য সব মিলিয়ে লেখা মারডকের বইগুলো বহু সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে তাকে। তাঁর শৈলীর জাদুতেই তিনি কথার স্থাপত্যের ভার কমিয়ে দিয়েছেন। অসম্ভবের….

আমার লেখালেখি এবং আমার প্রশ্নগুলো একে অপরের সাথে জড়িত: হান ক্যাং

স্বার্থপরতার গল্পে মোড়ানো জীবনের পাতায় পাতায় অসুখ। তবু জীবনের কাছে বাড়তে থাকা দায় শোধে মনোযোগী যারা, হান ক্যাং তাদেরই দলে। দক্ষিণ কোরিয়ান এই ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক, কবি জিতে নিয়েছেন ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। মানব জীবনের দুঃখ-কষ্ট কাব্যিকভাবে রূপায়ন করার স্বীকৃতি হিসেবে হান ক্যাংকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম সাহিত্যিক হিসেবে হান ক্যাং….

error: Content is protected !!