Author Picture

নেপলস এখন আনন্দনগরী!

মেজবাহ উদদীন

দিয়েগো চলে গেছেন অনেক দিন। তাঁর রেখে যাওয়া দুটি দল তিন যুগ পরে পেল শিরোপার স্বাদ। অনেকটা, দিয়েগোর মৃত্যু যেন দল দু’টির জন্য শাপে বর হয়েছে। বলছি আর্জেন্টিনা আর নাপোলির কথা। আর্জেন্টিনা পেল ২০২২-এর বিশ্বকাপ আর নাপোলি জিতল এই সিজনের লিগ শিরোপা। সেই নাপোলিকে নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন—

কথিত আছে, নাপোলির মেয়েদের প্রেমিক থাকে দুইজন। একজন হলো দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা। বিয়ের পরেও মেয়েরা যার ছবি বুকে নিয়ে ঘুমায়! একসময় ইতালির দক্ষিণের এই শহরের পরিচয় ছিল মাদক, মাফিয়া ও অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসেবে। কিন্তু এখন থেকে ৩৯ বছর আগে এই শহরের পরিচিতি বদলে দিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার দিয়েগো। নেপলস শহরটা ইতালির শহর হলেও ঠিক ইতালিয় নয়, এখানে দারিদ্রতা, বেকারত্ব আর সন্ত্রাস ছিল তুঙ্গে।

১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ম্যারাডোনার নৈপুণ্যে ইতালিয়ান সিরি আতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল নাপোলি। সেই অর্জনের পুনরাবৃত্তি এরপর আর করতে পারছিল না ক্লাবটি। অবশেষে তাদের ৩৩ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষ হলো। পরম আরাধ্য ‘স্কুদেত্তো’ জয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা হলো নেপলসবাসী। উদিনেসের মাঠে ১-১ গোলে ড্র করে ৫ ম্যাচ বাকি থাকতেই নাপোলি নিশ্চিত করল শিরোপা। নেপলস এখন আনন্দনগরী!
দেয়ালে দেয়ালে, রাস্তার মোড়ে ফুটবল নায়কের ছবি, ব্যানার, ফেস্টুন তো আছেই। এই উৎসবে অবধারিতভাবেই উপস্থিতি ম্যারাডোনার। পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি আড়াই বছর আগে। তবে নেপলসে তিনি প্রবলভাবে জীবন্ত প্রতিটি দিনই। এবারের এই উল্লাসের জোয়ারে তো তিনি থাকবেনই! সমর্থকদের হাতে হাতে ম্যারাডোনার ছবি, পোস্টার, ব্যানার। এই শহরে তিনি অমর।

ম্যারাডোনা ১৯৮৪ সালে যখন ইতালির নাপোলি ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন বিশ্ব ফুটবলের শীর্ষ তারকাদের একজন। ম্যারাডোনাকে বার্সেলোনা থেকে নিজেদের ক্লাবে সই করাতে স্পেনে গিয়েছিলেন নাপোলির স্পোর্টিং ডিরেক্টর অ্যান্তোনিও জুলিয়ানো, ম্যারাডোনাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই বলে, “নেপলসে এলে তুমি হবে জীবন্ত এক ঈশ্বর। লোকে তোমার জন্য মরতেও রাজি”। স্পেনের বার্সেলোনা ছেড়ে তিনি ইতালির নাপোলিতে যোগ দেন। বার্সেলোনার তুলনায় নাপোলি তখন ছিল অনেক অপরিচিত একটি দল।

ম্যারাডোনাকে তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি দিয়ে কিনেছিল নাপোলি, তবে বার্সেলোনা প্রেসিডেন্ট শেষ মুহূর্তে এসে আরও ৫ লাখ পাউন্ড দাবি করে বসেন। এই অর্থ জোগাড় করার জন্য নেপলসের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। ফুটবল বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘গোল ডটকম’ এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে সে কথা তুলে ধরেছেন কার্লো গার্গানিজে। তিনি ইতালির একজন শীর্ষ ফুটবল বিষয়ক সাংবাদিক। তিনি লিখেছেন, নেপলসের লোকেরা পথে নেমে পড়েন, সবার কাছ থেকে অর্থ তোলা শুরু করেন, কুখ্যাত জনাকীর্ণ বস্তি থেকে ওঠে ম্যারাডোনার ট্রান্সফারের জন্য বাড়তি চাওয়া অর্থ।

ম্যারাডোনাকে অনেকটা পোপের মতো দেখা হতো নেপলসে। তাদের বিশ্বাস ম্যারাডোনা এই শহরে বিরাজ করেন এখনও। বাস্তবে না হলেও, ম্যারাডোনার অস্বিত্ব আছে নেপলসের দেয়ালে, ১০ নম্বর জার্সিতে এবং মানুষের মনে।

৫ই জুলাই, ১৯৮৪, ম্যারাডোনা আনুষ্ঠানিকভাবে নাপোলির ফুটবলার হিসেবে জনসম্মুখে এসেছিলেন, এইদিন নেপলসের মানুষের আনন্দকে পত্র পত্রিকায় ‘হিস্টেরিয়া’ লেখা হয়েছিল। ৭০ হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে বসে চিল্লাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, “আমি ম্যারাডোনাকে দেখেছি, আমি ম্যারাডোনাকে দেখেছি”।

ম্যারাডোনা বলেছিলেন, নেপলস একটা পাগলা শহর, অনেকটা তার মতোই। সেখানে ফুটবলই জীবন। এই শহরের মানুষের ভালোবাসা তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছেন। ম্যরাডোনার জীবন নিয়ে বই ‘টাচ্ড বাই গডে’-এ এসব কথা উঠে এসেছে। ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত জীবনের মতোই নেপলস শহর ছিল অগোছালো। এই শহরের মানুষ দরিদ্র হলেও তারা ছিলেন প্রচন্ড আবেগি। এখানেই ম্যারাডোনা নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন।

ন্যাপলিটনরা পেয়েছিলেন গৌরবের উপলক্ষ্য এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। শুধু তাই নয়, নেপলসের সাথে পুরোপুরি মিশে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সেই ম্যারাডোনাকে এখনও নেপলসে আরাধনা করা হয়। ম্যারাডোনা তখন শুধু একজন ফুটবলার হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার থেকে অনেক বেশি। তিনি শোষকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিস্কো ক্যারিন্যানি মরে করেন, “একারণেই নেপলসের মানুষ ভেবে নিয়েছিল তখন, হয়তো সাধারণ মানুষের জন্য ম্যারাডোনা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন”। নাপোলির এক ফুটবল সমর্থক বলেন, “হয়তো তিনি ঈশ্বর, হয়তো সাধু, হয়তো প্রেসিডেন্ট, হয়তো তিনিই সবকিছু”।

ম্যারাডোনাকে অনেকটা পোপের মতো দেখা হতো নেপলসে। তাদের বিশ্বাস ম্যারাডোনা এই শহরে বিরাজ করেন এখনও। বাস্তবে না হলেও, ম্যারাডোনার অস্বিত্ব আছে নেপলসের দেয়ালে, ১০ নম্বর জার্সিতে এবং মানুষের মনে। ম্যারাডোনা এই শহরের মানুষের অধিকার নিয়ে এতোটাই সোচ্চার ছিলেন যে, এই শহরের লোক আর্জেন্টিনা বনাম ইতালি ম্যাচে আর্জেন্টিনার সমর্থনে ছিলেন। ম্যারাডোনা শেষ পর্যন্ত নাপোলি আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে ইতালি ছাড়েন। যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, “উত্তরের দলগুলোকে আমরা হারিয়ে দিচ্ছিলাম এবং প্রচলিত সমাজ আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল”।

ম্যারাডোনা ফুটবল ইতিহাসের এমন এক চরিত্র যাকে অনেক মানুষই ভালোবেসেছেন, অনেকেই করেছেন সমীহ আর কেউ কেউ মনে করেন তিনি ঠিক আদর্শ হওয়ার মতো নন, অনেক সমালোচনা তার বিরুদ্ধে, কোনও কোনওটি আবার আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল, কোনও কোনওটি তাকে দাঁড় করিয়েছিল নীতির কাঠগড়ায়।

ম্যারাডোনা এই নেপলসের সব রূপ দেখেছেন এবং নাপোলি যখন উৎসবে ভাসছে তখন তিনি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন ন্যাপোলিটনদের উদযাপনে, একারণেই ম্যারাডোনা নাপোলির নামের সাথেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন এবং উঠবেন।

আরো পড়তে পারেন

বৈভব সূর্যবংশীর উত্থানের রূপকথা

ভারতীয় ক্রিকেটে আইপিএল-এর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেখানে আইপিএল-এর অবদান নিয়ে নিশ্চিয়ই আলাদা একখানা অধ্যায় লেখা হবে। তাতে ক্ষতি আর সমৃদ্ধি দুই দিকের আলোচনাই হবে নিক্তি মেপে। তবে এই পাদটীকা একদিকে সরিয়ে রেখে একটা কথা বলাই যায় যে, ভারতবর্ষে আইপিএল আর শুধুমাত্র একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নয়, এটি একটি সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির অংশ। এর সামগ্রিক….

বিদায় রূপকথার দেবদূত

যে পরিবেশে জলছবি আর রংমশালের গল্প ছিল না। না ছিল রূপকথার পরীদের গল্পও। কেবল ছিল অভাবের গল্প, আর একটা বল ছিল। যতবার সেই বলকে দূরে ছুড়ে দিত রোগা পা, ততবার, একবেলা খেতে না পাওয়ার কথা ভুলে যেতেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ভুলে যেতেন, তাঁদের জীবনটা অভাব অন্ধকার আর না-পাওয়ার সবটুকু রংহীনতা মেখে নিচ্ছে রোজ। ফুটবলের সঙ্গে….

বিশ্বকাপের মার্কশিট

‘পরের জন্মে আমি এর প্রতিশোধ নেব। নেবই। মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে জন্ম নিয়ে…।’ অনেক বছর আগে এক ভারতিয় পত্রিকায় পড়া এক চিঠি। যে চিঠি হয়তো লেখা হয়েছিল কোনও এক অনির্বাণ দহনের রাতে। লিখে আর ভাবেনি, লেখক চলে গিয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে। প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। প্রায় পাঁচ দশক আগে পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলের অনলে দগ্ধ এক মোহনবাগান….

error: Content is protected !!